৪ ডিসেম্বর, ২০২০ ভারতের নির্বাচন কমিশনের কাছে সিপিআই(এম) সাধারন সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির লেখা চিঠি
শ্রী সুনীল অরোরা
মুখ্য নির্বাচন কমিশনার
ভারতের নির্বাচন কমিশন
নির্বাচন সদন,
নয়া দিল্লী
শ্রী সুনীল অরোরা মহাশয়,
গনমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে আমরা অত্যন্ত বিস্মিত যে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা এবং পন্ডিচেরিতে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে দেশের বাইরে বসবাসকারী ভারতীয়দের (এন আর আই) ভোটাধিকার প্রয়োগের সুবিধার্থে ভারতের নির্বাচন কমিশন একটি আইনানুগ ব্যাবস্থাপনা গড়ে তুলতে চলেছে।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, সিপিআই(এম) প্রথম থেকেই দেশের বাইরে বসবাসকারী ভারতীয়দের (এন আর আই) জন্য দেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহনে এক কার্যকরী ব্যাবস্থাপনার পক্ষে থেকেছে। বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী ভারতীয়রা যাতে দেশের নির্বাচনে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন সেই উদ্দেশ্যেই সিপিআই(এম)-এর পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বিদেশে ভারতীয় দূতাবাস কিংবা মিশন দপ্তরগুলিতে পোলিং বুথ স্থাপন করা হোক, এবং সেইসব দেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের ভোটদানের অধিকার সহ সংশ্লিষ্ট কাজে অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুযোগসুবিধার ব্যাবস্থা করা হোক। ইতিমধ্যেই এধরণের ব্যাবস্থা পৃথিবীর বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষ থেকেই নাগরিকদের জন্য রয়েছে। এতে নির্বাচনী প্রক্রিয়া চলাকালীন প্রকৃত ভোটারদের যাচাই করার সুযোগ থাকে।
নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এধরণের কোন বড় সিদ্ধান্ত নেবার আগে রাজনৈতিক দলগুলির সাথে আলোচনা করাই দীর্ঘদিনের প্রথা, অথচ এক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এবং আমাদের বিস্মিত হবার কারন সেটাই। ২০১৪ সালে নির্বাচন কমিশন এনআরআই’দের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে দেবার অনুমতি সম্পর্কে প্রস্তাব দেয়। সেইসময়ে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে থেকে একটি সর্বদলীয় সভা ডাকা হয়েছিল যাতে আলোচনার প্রধান বিষয় ছিল বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয় নাগরিকদের ভোটদানের কিভাবে পক্ষপাতমুক্ত এবং ন্যায্য প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করা যায়। ভারতীয় নাগিরিকত্বের পাসপোর্ট রয়েছে, বিদেশে বসবাসকারী এমন সকল ভারতীয়দের জন্য দেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আরও কার্যকরী অংশগ্রহনের অধিকার সুনিশ্চিতকরণ সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশও ছিল।
১৬তম লোকসভার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় সেসময় বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের বদলী (Proxy) ভোটদানের বিষয় সম্পর্কিত বিল কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই খারিজ হয়ে যায়। এখন নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে আইনমন্ত্রকের সমীপে যে চিঠি লেখা হয়েছে তাতে এনআরআই’দের জন্য বদলী (Proxy) ভোটের পরিবর্তে পোস্টাল ব্যালট ব্যাবহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর অর্থ হবে সরকারের পক্ষ থেকে ১৯৬১ সালের নির্বাচনী নিয়মকানুন সংশোধন করে নিলেই সেই ব্যাবস্থা আইনানুগ হয়ে যাবে, গোটা প্রক্রিয়ায় সংসদের অনুমোদনের কোন প্রয়োজন হবে না।
দীর্ঘদিনের অভ্যাস এবং প্রথাসম্মত পদ্ধতিতে নির্বাচন কমিশনের উপরিল্লিখিত প্রস্তাব সম্পর্কে কোন সর্বদলীয় সভা হয় নি। এটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের দল গঠন করে ২০১৫ সালে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সম্ভাব্য বিকল্পের যেসকল প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল সেগুলির একটিতেও কার্যকরী ব্যাবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব হয় নি।
গনমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২৫শে নভেম্বর আইনমন্ত্রকের সমীপে নির্বাচনের কমিশনের পক্ষ থেকে চিঠির আকারে যে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে তাতে কোন এনআরআই যদি দেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় পোস্টাল ব্যালট ব্যাবহার করতে চান তবে নির্বাচনী নির্ঘণ্ট প্রকাশিত হবার অন্তত পাঁচদিন পরে সেই ব্যাক্তিকে (এনআরআই ভোটার) সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারকে তা জানাতে হবে। রিটার্নিং অফিসার এধরণের কোন আর্জির প্রত্যুত্তরে ইলেকট্রনিক ব্যালট পেপার পাঠাবেন। সংশ্লিষ্ট এনআরআই ভোটার সেই ইলেকট্রনিক ব্যালট প্রিন্ট করে তাতে নিজের মতামত চিহ্নিত করবেন এবং যে দেশে তিনি বসবাস করছেন সেই দেশে ভারতের ডিপ্লোম্যাট কিংবা কন্স্যুলার প্রতিনিধি দ্বারা নিযুক্ত আধিকারিকের সাক্ষরযুক্ত ঘোষণাপত্র সমেত সেটি ফেরত পাঠাবেন।
এই মুহূর্তে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে স্পষ্ট নয় ঐ এনআরআই ভোটার (যিনি ইলেকট্রনিক ব্যালট ব্যাবহার করলেন) সেই ব্যালট সাধারন ডাকে ফেরত পাঠাবেন নাকি ব্যালটটি সেই দেশের ভারতীয় দূতাবাসে জমা করতে হবে যেখানে নির্দিষ্ট নির্বাচনী ক্ষেত্র অনুযায়ী ব্যালটগুলিকে পৃথক করা হবে।
বর্তমানে এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বড় বাধা ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে পাঠানো ব্যালটের গোপনীয়তা রক্ষা। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় মতদানের বিষয়ে প্রকৃত ভোটারদের সরাসরি যাচাই করার নীতি বাস্তবিক অলঙ্ঘনীয়, অথচ ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে ব্যালট হস্তান্তরের বিষয়টি সেক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করে। নির্বাচনী কর্ত্রীপক্ষের তরফে ডেসপ্যাচড হওয়া ব্যালট ফেরত এলে নির্দিষ্ট নির্বাচনী ক্ষেত্রে সেটিকে চিহ্নিতকরণের কাজ সমস্যার পরের ধাপ। ভোটারের কাছে পৌঁছানো ব্যালটের গোপনীয়তা এবং সুরক্ষা রক্ষা করাই মূল কথা। এক্ষেত্রে সেইসব ভোটার যারা দেশের বাইরে বিভিন্ন বিদেশী সংস্থায় কর্মরত, ইলেকট্রনিক আদানপ্রদানের মাধ্যমে তাদের ভোটদানের গোপনীয়তা রক্ষা করার বিষয়টি নিশ্ছিদ্র নয় মনে করার যথেষ্টই কারন রয়েছে এবং সেটা উদ্বেগজনক।
এইসব কারনেই সিপিআই(এম) দাবী জানাচ্ছে অবিলম্বে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের ভোটদানের প্রক্রিয়ায় যেসব জটিলতা রয়েছে সেই নিয়ে একটি সর্বদলীয় সভার আয়োজন করা হোক, এই ব্যাপারে পরবর্তী কোনো সিদ্ধান্ত নেবার আগেই এই সভায় বিষয়গুলি সম্পর্কে দ্রুত আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।
ধন্যবাদ সহ,
আপনার জ্ঞাতার্থে,
সীতারাম ইয়েচুরি
সাধারন সম্পাদক
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)
শেয়ার করুন