Site icon CPI(M)

‘গান্ধী বনাম লেনিন’: একশো বছর -চন্দন দাস…

৭ নভেম্বর ২০২১, রবিবার

ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ এবং অমলেশ ত্রিপাঠি — এক জায়গায় এসে দাঁড়ালেন। তবে পৃথক কোণ থেকে।
প্রসঙ্গ? গান্ধী, মার্কসবাদী দর্শন এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম।
ইএমএস প্রাজ্ঞ কমিউনিস্ট। অমলেশ ত্রিপাঠির ইতিহাস-দর্শনে কোথাও কমিউনিস্টদের প্রতি কোনও দুর্বলতার চিহ্ন নেই। তবু দুই প্রায় বিপরীত ধর্মী ব্যাখ্যা থেকে দুজনে একটি বিন্দুতে পৌঁছেছেন।
কিভাবে? সেই প্রসঙ্গে পৌঁছোনর আগে সময়কালের ব্যাাখ্যাটি চমকপ্রদ। গান্ধী দেশে পাকাপাকি থাকার জন্য পা রেখেছেন ১৯১৫-র জানুয়ারিতে। কংগ্রেস তখন গোষ্ঠীতে বিদীর্ণ, সংগ্রাম বিমুখ, বিতর্কে ব্যস্ত একটি মঞ্চ। অন্যদিকে ১৯১৭-তে রাশিয়ায় মার্চে গনতান্ত্রিক বিপ্লব। প্রমাদ গোণে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। তরিঘরি ভারত শাসনের দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্রিটিশ মন্ত্রী মন্টেগু ভারতকে দায়িত্বপূর্ণ শাসন ক্ষমতা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। তা নিয়ে কংগ্রেসে আর এক প্রস্থ বিতর্ক, বিবাদ শুরু হয়। ওই বছরের নভেম্বরেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব লেনিনের নেতৃত্বে। গান্ধীর ভারতের জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠার উদ্যোগ ঠিক ওই সময়ে — ১৯১৮-১৯-এ।

EMS Namboodiripad


১৯১৫-তে দেশে ফিরলেও তিনি কোনও সংগঠনে থাকবেন না — এই মনোভাব থেকে বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় আন্দোলনে গান্ধী অংশ নিয়েছেন। ‘ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল ফর ইনডিপেন্টেন্স, রিভাইজড অ্যান্ড আপডেট’-এ বিপান চন্দ্র, মৃদুলা মুখার্জি, আদিত্য মুখার্জি, সুচেতা মহাজন, কেএন পানিক্কররা দেখাচ্ছেন, ১৯১৭ এবং ১৯১৮-র গোড়ায় গান্ধী তিনটি স্থানীয় আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন — বিহারের চম্পারনে, গুজরাটের আহ্‌মেদাবাদে এবং খেড়ায়। গান্ধী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতীয় পর্যায়ের আন্দোলনের প্রথম উদ্যোগ নিচ্ছেন ১৯১৯-র ফেব্রুয়ারিতে, রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে। আন্দোলনের ফর্ম — সত্যাগ্রহ। রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে ১৯১৯-র ৬ই এপ্রিল ছিল আন্দোলন শুরুর ঘোষিত দিন। ১৩ই এপ্রিল জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকান্ড। ১৮ এপ্রিল গান্ধী আন্দোলন তুলে নেন। পাঞ্জাবে মার্শাল ল জারি হল। বিশ্ব মানবতার আত্মা রবীন্দ্রনাথ খোলা চিঠি লিখলেন গান্ধীকে। সত্যাগ্রহ নীতির তীব্র সমালোচনা করে তিনি লিখলেন,‘‘I know your teaching is to fight against evil by the help of the good. But such a fight is for the heroes and not for men led by impulses of the moment.’’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাইট উপাধী ত্যাগ করলেন। গান্ধী বললেন,‘এতো সত্যাগ্রহ নয় — দূরগ্রহ, এ আমার হিমালয় প্রধান ভুল।’
আশ্চর্য! আশ্চর্য হয়েছেন অনেকে। বিরক্ত, ক্ষুব্ধও।


গান্ধীর ‘সত্যাগ্রহ’, ‘অহিংসা’র রাজনীতির প্রভাব দেশে যখন ছড়াতে শুরু যখন করেছে, সেই সময়েই কমিউনিস্টরা দেশে কাজ শুরু করেছেন। কমিউনিস্টরা তখন ছোট, ছোট গোষ্ঠী। কিছুটা অসংগঠিত। দুটি মতাদর্শ প্রায় একইসঙ্গে কাজ শুরু করেছে, যা মূলগতভাবে পরস্পরের বিরোধী। গান্ধীর হাতে ছিল কংগ্রেস নামের প্রতিষ্ঠান। কমিউনিস্টদের কাছে ছিল মার্কসবাদী দর্শন এবং সোভিয়েত বিপ্লবের বার্তা।


ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতীয় কংগ্রেসের ভূমিকার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠি গান্ধী সম্পর্কে লিখছেন,‘‘সন্ত্রাসবাদীদের অভয়মন্ত্র ও অমরবীর্য তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। কিন্তু হিংসা ও অসত্যের পথে স্বরাজ সাধনায় ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলের মধ্যে সে-সাধনা আবদ্ধ রাখায় তাঁর ঘোর আপত্তি ছিল। কি নিজের কি দেশের জীবনে তিনি সর্বব্যাপী গণ-সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন। এখানে মার্কসবাদীদের সঙ্গে তাঁর একটা মিল ছিল। কিন্তু মার্সবাদীদের মত তিনি সহিংস শ্রেণীসংগ্রামের নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর যুদ্ধে ধনী-দরিদ্র, ব্রাহ্মণ-শূদ্র, জমিদার-কৃষক, ধনিক-শ্রমিক সমান ভাবে শরিক;’’( ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস’, পৃষ্ঠা-৯০।)


ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ কি ভাবে দেখছেন? ‘জাতির পিতা’ প্রবন্ধে সিপিআই (এম)-র প্রাক্তন সাধারন সম্পাদক লিখছেন,‘‘ভারতের শ্রমিক ও কৃষককে স্বাধীনতা আন্দোলনে শামিল করার ক্ষেত্রে তিনি নেতার ভূমিকা পালন করেছেন। পরাধীন ভারতে তাঁরই নেতৃত্বে তিন-তিনবার গণ রাজনৈতিক আন্দোলনের ঢেউ গোটা দেশে আছড়ে পড়েছিল।’’ অর্থাৎ, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে এক গণ আন্দোলনের চরিত্রে গড়ে তুলতে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর ভূমিকা অসামান্য। কিন্তু? ইএমএস-র কথায়,‘‘বিষয়গত দিক থেকে তাঁর উদ্দেশ্য মহৎ থাকলেও কার্যক্ষেত্রে তিনি এমন নীতি ও কৌশল নিয়েছেন, যা বুর্জোয়াদেরই শক্তিশালী করেছে। তিনি অনুসরণ করেছেন অহিংসার তত্ব। জমিদার ও বুর্জোয়ারা তাঁর কাছে ছিলেন দেশের সম্পত্তির ‘ট্রাস্টি’ বা রক্ষক। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গীর সাহায্য নিয়েই বুর্জোয়ারা স্বাধীনতার দাবির পিছনে ভারতীয় জনগনকে সমবেত করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু বিপ্লবী গণ কর্মসূচীর পথে যেতে তাঁদের বাধাও দিয়েছেন।’’

প্রমাণ অনেক। আসামের চা শ্রমিকদের আন্দোলনের কথাই ধরা যাক। চা শ্রমিকদের উপর চাঁদপুর ঘাটে পুলিশী হামলার প্রতিবাদে ধর্মঘট শুরু হয়। তার সঙ্গে ছিল মজুরদের মজুরির প্রশ্নও। সেই ধর্মঘটের বিরোধিতা করেন ‘মডারেট কংগ্রেসী’রা। ১৯২১-র ২৫ জুন ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় গান্ধী বললেন,‘‘আমরা ধন ও ধনিকদের ধ্বংস করতে চাই না। ধনিক ও শ্রমিকদের সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করতে চাই। সহানুভূতি দেখানোর জন্য ধর্মঘট চালানো মূর্খামি হবে।’’ অমলেশ ত্রিপাঠির ব্যাখ্যায়,‘‘অসহযোগ আন্দোলনে শ্রমিক ধর্মঘট প্রয়োগ করতে তিনি অরাজি। কলকাতার এক সভায়(১১ সেপ্টেম্বর ১৯২১) তিনি তা বলেনও।’’ কেন গান্ধী বিরোধিতা করেছিলেন? চা বাগানের মালিকরা এবং তাদের স্বার্থবাহীরা চাইছিলেন না। একই রকম দ্বন্দ্ব দেখা যাবে যখন বিলাতি দ্রব্য বিরোধী আন্দোলনে বড় বড় ব্যবসায়ীরা সমর্থন করেননি। আন্দোলন কোনও দিশা না দেখিয়ে ধসে গেছে।
ইতিহাসের শিক্ষা হোক বা প্রহসন — গান্ধীর জীবিত কালেই তাঁর ভাবনা থেকে তাঁর শিষ্যরা সরে গেছেন। গান্ধীর ধারনা ব্রাত্য হয়ে যায়। তিনিও ১৯৪৫-৪৬ থেকে আগের মত গুরুত্বপূর্ণ থাকেননি কংগ্রেসের মধ্যেই। আর ‘শ্রেণী সংগ্রাম’ ক্রমাগত এক প্রবল সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশে। শাসক আর শোষিত সংগ্রামে সোভিয়েত বিপ্লবের শিক্ষা হয়ে উঠেছে আলোকবর্তিকা — গান্ধীর দেশেই।


ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে গোড়া থেকেই কমিউনিস্টরা শ্রেণী সংগ্রামের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিচার করেছেন। কৃষক আন্দোলন, কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গড়ার মাধ্যমে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে ভূমিকা পালন করেছেন কমিউনিস্টরা। স্বাধীনতা সংগ্রামে সাম্রাজ্যবাদী দমন পীড়নের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের লড়তে হয়েছে। পাশাপাশি তথাকথিত ‘গান্ধীবাদ’র প্রবল প্রতিপত্তির মুখোমুখিও লড়তে হয়েছে কমিউনিস্টদের।
একটি উদাহরণ দেখা যাক। ১৯২১-র এপ্রিল-মে’তে প্রকাশিত হল ‘গান্ধী বনাম লেনিন।’ লেখক শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে। কেন ১৯২১?
ডাঙ্গে ১৯২০ নাগাদ কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন। মিশনারিদের পরিচালিত উইলসন কলেজে বাইবেল ক্লাস ছাত্রদের জন্য বাধ্যতামূলক হওয়ার প্রতিবাদে একদল ছাত্র আন্দোলন করে। ডাঙ্গে ছিলেন তাঁদের নেতা। তাই ‘রাস্টিকেটেড।’ এরপর ডাঙ্গে গান্ধী পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির মধ্যে আরও কয়েকজনের সঙ্গে ‘র‌্যাডিক্যাল গ্রুপ’ গড়েন। ডাঙ্গে ওই সময়ে একটি বই লেখেন — ‘গান্ধী বনাম লেনিন।’


কেন লিখলেন? কারন — গান্ধীর পথ নিয়ে একাংশের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সোভিয়েত বিপ্লবের বার্তা পৌঁছে গেছে দেশে। সমাজ কেমন হবে — তা নিয়ে গান্ধীর মত আর মার্কসবাদী দর্শনের প্রভেদ পৌঁছে যাচ্ছিল অনেকের কাছে। ওই ১৯২১-র নভেম্বরে কলকাতায় মুজফ্‌ফর আহ্‌মেদ সন্ধান পেলেন — (১) বলশেভিকরা কী ক্ষমতা দখলে রাখতে পারবেন? (২) বামপন্থী কমিউনিজ্‌ম — শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা, (৩) পিপ্‌লস মার্কস — প্রভৃতি বই।
সাম্রাজ্যবাদের সঙ্কট, মানুষের তীব্র মন্দা এবং তার বিপ্রতীপে এক নতুন সমাজ গড়ে তোলার বার্তা সোভিয়েত থেকে দেশে দেশে পৌঁছোতে শুরু করেছে ১৯১৭-১৮ থেকেই। গান্ধী ভারতের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ নেওয়া শুরু করছেন প্রায় এই সময়েই।
গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে পাকাপাকি ভাবে যে বছর চলে এসেছেন তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। সেই বছরই, ১৯১৫-র মার্চে দেশজোড়া সশস্ত্র অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন রাশবিহারী বসু। চলে গেলেন জাপানে। পাকাপাকিভাবে। ভারতে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের একটি পর্যায় ওই সময়ে শেষ হচ্ছে। ১৯১৫-তেই সশস্ত্র বিপ্লবী কার্যকলাপে বিশ্বাসী নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য দেশ ছাড়লেন আরও অস্ত্র, ভিন দেশের নানা অংশের সাহায্যের আশায়। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার পি মিত্রর গড়ে তোলা প্রথম অনুশীলন পার্টির সদস্য। আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সেখানকার বাসিন্দা ধনগোপাল মুখার্জি বদলে দিলেন নরেন্দ্রনাথের পরিচয়। ‘জন্ম নিলেন’ মানবেন্দ্রনাথ রায়।


১৯১৭-র মার্চে জার শাসিত রাশিয়ায় গনতান্ত্রিক বিপ্লব। ১৯১৭-র গ্রীষ্মকালে মানবেন্দ্রনাথ রায় মেক্সিকোতে পৌঁছোন। তারপরে ওই বছরের অক্টোবরে(পুরোন ক্যালেন্ডার অনুসারে) বলশেভিকদের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। মেক্সিকোতে বলশেভিক নেতা মাইকেল বরোদিনের প্রভাবে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মার্কসবাদী চিন্তায় আকৃষ্ট হওয়া। ১৯২০-র ১৯ জুলাই থেকে ৭ আগস্ট — কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেস হয়। রায় সেখানে প্রতিনিধি। সেই কংগ্রেস শেষ হওয়ার কিছুদিন পরে রায় তুর্কমেনিস্তান রওনা হন। তাঁর স্মৃতিকথায় দেখা যাচ্ছেন,‘‘I had no intention to leaving MOSCOW without provided with the sinews of war – material to make a revolution. I had failed a similar attempt in the Far East. Then the Germans duped us. This time I wanted to succeed. The Russina Bolshevics were realiable allies.”
এরপর ১৯২০-তে তাশখন্দে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের উপস্থিতিতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম, ১৯২০-র ১৭ অক্টোবর। প্রায় ওই সময়েই ভারতের অন্তত চারটি জায়গায় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার কাজ শুরু হয়। উদ্যোক্তাদের পরস্পরের সঙ্গে পরিচয় ছিল না তখন। চারটি জায়গা হল — কলকাতা, মুম্বাই(তৎকালীন বোম্বে), লাহোর এবং চেন্নাই(তৎকালীন মাদ্রাজ।) চারটি জায়গারই কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। চারটি জায়গার সংগঠকদের পরস্পরের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই পরিচয় হয়েছিল মস্কোতে থাকা কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সদর দপ্তর মারফত। যেমন শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গের সঙ্গে মুজফ্‌ফর আহ্‌মেদের পরিচয়।

প্রথম থেকেই শ্রমিক, কৃষকদের সংগঠিত করার উপর জোর দিয়েছে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন — এই ক্ষেত্রে নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাব অপরিসীম। প্রমাণ কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেসন। পার্ক সার্কাসে এই অধিবেসন হয় ১৯২৮-এ। সেখানে কমিউনিস্টরা ‘পূর্ণ স্বরাজ’র দাবি তোলেন। এই অধিবেসনে আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। প্রায় ২০-২৫ হাজার শ্রমিক শহীদ মিনার (তখন মনুমেন্ট) ময়দান থেকে মিছিল করে অধিবেসনে পৌঁছোন। প্রথমে তাঁদের বাধা দেয় কংগ্রেস নেতৃত্ব। তাঁদের মেজাজ দেখে অধিবেসনে আসতে দিতে বাধ্য হয়। চটকল, সুতাকলসহ নানা কারখানার শ্রমিকরা অধিবেসনে পূর্ণ স্বরাজকে লক্ষ্য হিসাবে ঘোষণার দাবি জানান। তাঁদের মুখে ছিল নানা স্লোগান, যেমন — ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’,‘পূর্ণ স্বাধীনতা চাই’,‘লাল ঝান্ডাকী জয়’ ইত্যাদি। এই বিরাট শ্রমিক মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন মুজফ্‌ফর আহ্‌মেদ, বঙ্কিম মুখার্জি, রাধারমণ মিত্র, আবদুল হালিম প্রমুখ।


ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারা বলছে, ১৯১৯-২১, ১৯৩০-৩৩ এবং ১৯৪২ —এই তিনটি পর্যায়ে দেশজুড়ে গণ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। তার আগে, গান্ধী যখন আসেননি, তখন ১৯০৫-র বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনও এক গণ আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। ১৯০৫-র আন্দোলন ছাড়া বাকিগুলির ক্ষেত্রে গান্ধী ছিলেন তার কেন্দ্রে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত সেই সংগ্রামে অংশ নিয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত ঔপনিবেশিক ভারতে বিরাজমান জমিদার এবং ক্রমশঃ মাথা তুলতে থাকা বুর্জোয়াদের একটি বড় অংশ কংগ্রেসকে সহায়তা করেছেন। পাশে থেকেছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই একটি বিন্দুতে গিয়ে তা প্রত্যাহৃত হয়েছে। ১৯২২-এর ১২ই ফেব্রুয়ারি চৌরিচৌরার ঘটনার পর গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন প্রাত্যাহার এক প্রবল হতাশা, ক্ষোভের জন্ম দেয়। এই ক্ষোভ, হতাশার সামনে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সৈনিকরা নানা ধরনের পথের সন্ধান করেছেন। ভারতে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের অনেক ধারা গড়ে উঠেছে এরই প্রেক্ষাপটে। যাঁদের একাংশ পরবর্তীকালে মার্কসবাদী হয়েছেন। জাতীয় কংগ্রেসের পথে বীতস্পৃহ, ব্যক্তিহত্যা-গুপ্ত সংগঠনের পথে আস্থা হারানো অনেকে গণ আন্দোলনের মাধ্যমে নতুন সমাজ গড়ে তোলার পথকে গ্রহণ করেছেন মার্কসবাদের অনুপ্রেরণায়।
উদাহরণ অনেকে। শুধু একটিই ঊদ্ধৃতি দেব।

Kalpana Dutta

‘কেমন করে কমিউনিস্ট হলাম’ জানাতে গিয়ে সূর্য সেনের সহযোগী, যাঁর সঙ্গে দেখা করতে মেদিনীপুরে হিজলি জেলে আসতে চেয়েছিলেন স্বয়ং গান্ধী, সেই তিনি প্রবন্ধের শেষে লিখলেন —‘‘একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টিই আজ সমস্ত অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে নির্ভিক চিত্তে প্রতিবাদ জানায়। কমিউনিস্ট পার্টি জানায় তার কাগজের মধ্য দিয়ে — আজ দেশের শত্রু কারা, লড়াই আমাদের কাদের সঙ্গে। একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টিই আমাদের শিখিয়েছে কেমন করে আমাদের দেশপ্রেমের ঐতিহ্য, মাষ্টারদার ঐতিহ্য বজায় রেখে আমরা চলতে পারি এবং জনসাধারনের প্রতি বিশ্বাস রেখে নিজের ওপর বিশ্বাসও কেমন করে অবিচলিত রাখতে পারি।’’
কার লেখা? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহের কল্পনা দত্ত’র।

                                           তথ্য সূত্রঃ

১) ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস’— অমলেশ ত্রিপাঠি
২) স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি — ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ
৩) India’s Struggle For Indendence: Revised and Updated
Bipan Chandra, Mridula Mukherjee, Aditya Mukherjee, Sucheta Mahajan, K.N.Panikkar
৪) বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলন দলিল ও প্রাসঙ্গিক তথ্য-প্রথম খণ্ড
৫) আমার জীবন ও কমিউনিস্ট পার্টি — মুজফ্‌ফর আহ্‌মেদ

শেয়ার করুন