সূর্য মিশ্র
১০৭ বছর আগে ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর থেকে দুনিয়া কাঁপানো দশদিনে রাশিয়ায় লেনিনের নেতৃত্বে নভেম্বর বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছিল এবং বিশ্বে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর প্রায় ৭৩ বছর পরে গর্বাচভের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে ফেলা হয়। মার্কস এঙ্গেলসের মতো লেনিনও অনুমান করেছিলেন পুঁজিবাদের বিকাশের দিক থেকে অপেক্ষাকৃত অনুন্নত রুশ দেশের বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পোন্নত জার্মানিতে বিপ্লব সফল হবে। কিন্তু তা হয়নি। এখন সারা বিশ্ব জানে কেমন করে রোজা লুক্সেমবার্গ ও লিবখনেখটকে নৃশংসভাবে হত্যা করে প্রতিবিপ্লব সফল হয়েছিল। লেনিনের মৃত্যুর পর স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ফ্যাসিস্ট জার্মানির আক্রমণের প্রতিরোধ করে বার্লিনে লাল ফৌজ লাল পতাকা উড়িয়েছে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতেও সমাজতন্ত্র জয়ী হয়েছিল। পাশাপাশি চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, উত্তর কোরিয়ায় বিপ্লবের সাফল্য ও সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম এখনও অব্যাহত আছে। সোভিয়েত ইউনিয়নেই মানবসভ্যতার ইতিহাসে প্রথম শ্রমজীবী মানুষ শ্রেণী শোষণ মুক্ত সমাজ গড়া হয়েছিল, সেই সঙ্গে সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে দ্রুত শিল্পায়ন এবং অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের সার্বিক অগ্রগতি ঘটেছিল। দারিদ্র, নিরক্ষরতা ও বেকারীর অবসান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আবাসনের ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তার বিপুল বিস্তার ঘটেছিল। একথাও মনে রাখতে হবে, দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া পুঁজিবাদী বিকাশের বিচারে অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর দেশগুলিতে এই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের অগ্রগতি পুঁজিবাদী দেশগুলির ওপরেও প্রভাব ফেলেছিল এবং সেখানকার শাসকশ্রেণীগুলি বাধ্য হয়েছিল জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের ধারণায় নিজেদের নাগরিকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করতে। (পার্টি কর্মসূচী- প্যারা ২.২)
কিন্তু সমাজতন্ত্র নির্মাণের অনির্ধারিত পথের যাত্রায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি গুরুতর ভুলও করেছিল। এই ভুলের উৎস সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের দীর্ঘস্থায়ী চরিত্র সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাব; পার্টি ও রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক কী হবে তা নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা; অর্থনীতি ও তার পরিচালনার ক্ষেত্রে সময়পোযোগী পরিবর্তনে ব্যর্থতা; আমলাতান্ত্রিকতা বৃদ্ধি এবং মতাদর্শগত চেতনার অবক্ষয়। এই সব কারণ সমাজতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্য সাম্রাজ্যবাদের নিরন্তর প্রচেষ্টাকে সাহায্য করেছিল। কিন্তু এই সব বিকৃতি মার্কসবাদ লেনিনবাদের যথার্থতাকে নস্যাৎ করতে পারে না, বরং এগুলি বৈপ্লবিক তত্ত্বের থেকে ও তার প্রয়োগ থেকে বিচ্যুতির প্রতিফলন। বিংশ শতাব্দীর শেষে সমাজতন্ত্রের শক্তিকে আবার পুনরুৎসাহিত সাম্রাজ্যবাদের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি পড়তে হচ্ছে। সিপিআই(এম) দৃঢ়বিশ্বাসী যে বিপর্যয় সত্ত্বেও কমিউনিস্ট আন্দোলন ও বিপ্লবী শক্তিগুলির ভুল থেকে শিক্ষা নেবে, পুণরায় সংগঠিত হবে এবং সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির আক্রমণ মোকাবিলা চালিয়ে যাবে। (পার্টি কর্মসূচী –প্যারা ২.৩)
২০০০ সালের ২০-২৩ অক্টোবর তিরুবনন্তপুরমে অনুষ্ঠিত সিপিআই(এম)’র বিশেষ সম্মেলনে গৃহীত সময়পোযোগী কর্মসূচীতে উপরোক্ত কথাগুলি বলা হয়েছে। অবশ্যই ঐ সম্মেলনের মূল কাজ ছিল পার্টি কর্মসূচীর সময়পযোগীকরণ, কিন্তু ১৯৯২ সালে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত চতুর্দশ পার্টি কংগ্রেসে ‘কয়েকটি মতাদর্শগত বিষয় প্রসঙ্গে’প্রস্তাব ও তার পরবর্তী আট বছরে বিশ্ব পরিস্থিতির মূল্যায়নের সংক্ষিপ্তসারের ভিত্তিতে। ঐ প্রস্তাবের প্রেক্ষাপট ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে অনুসৃত কয়েকটি ভ্রান্ত মতাদর্শগত অবস্থানজনিত বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নেওয়া ও আমাদের মতাদর্শগত অবস্থান স্থির করা। অবশ্য নভেম্বর বিপ্লবের ৭০তম বার্ষিকী উপলক্ষে গর্বাচভের প্রদত্ত ভাষণের সময় থেকেই আমাদের পার্টি ভিন্নমত পোষণ করেছিল। এতে কোন সন্দেহ নেই যে গর্বাচভের নেতৃত্বেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়। কিন্তু এটা একজন বিশেষ ব্যক্তির বিষয় নয়, বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের অংশীদার হিসাবে সিপিআই(এম)’র কেন্দ্রীয় কমিটি ১৯৯০ সালের মে মাসের সভায় গৃহীত প্রস্তাবে ১৯৫৭ সাল ও ১৯৬০ সালে বিশ্বের কমিউনিস্ট পার্টিগুলির বিবৃতির ভুল মূল্যায়নগুলি চিহ্নিত করেছিল। জন্মলগ্ন থেকেই সিপিআই(এম) আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সংশোধনবাদ ও সংকীর্ণতাবাদী বিচ্যুতির বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রামে মার্কসবাদ লেনিনবাদের মৌলিক নীতিগুলির ভিত্তিতে স্বাধীন বিবেচনা ও নিজস্ব অভিজ্ঞতার দ্বারা পরিচালিত হয়ছে। ১৯৬৮ সালে মতাদর্শগত প্রশ্নে বর্ধমান প্লেনামে সিপিআই(এম)’কে ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে সিপিএসইউ’র আধুনিক সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়েছে। ঐ সময়ে চীনের কমিউনিস্টি পার্টি অর্থাৎ সিপিসি’র বামপন্থী হঠকারী বিচ্যুতির বিরুদ্ধেও পার্টিকে লড়াই করতে হয়েছে। ১৯৯০ সালের কেন্দ্রীয় কমিটির দলিলের আত্মসমালোচনার ভিত্তি হলো ১৯৬০ সালের ৮১টি কমিউনিস্ট পার্টির বিবৃতি। ৮১ পার্টির ঐ বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ‘আমাদের সময়ের মুখ্য বৈশিষ্ট্য হলো যে সমাজবিকাশের নির্ণায়ক শক্তি হয়ে উঠছে বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা।’আরও বলা হয়েছে, ‘ভাঙন ও অবক্ষয়ের এক তীব্র প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলেছে বিশ্বের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা।’ এবং ‘সামাজিক প্রগতির স্বার্থে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাফল্যকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ক্রমশ বেশি বেশি করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে পুঁজিবাদ।’আরও বলা হয়েছিল, ‘সেদিন আর বেশি দূরে নয় যখন বিশ্ব উৎপাদনে সমাজতন্ত্রের অংশের পরিমান পুঁজিবাদের থেকে বেশি হবে।’ ‘মানব প্রয়াসের নিয়ামকের ক্ষেত্র, অর্থাৎ বৈষয়িক উৎপাদনের ক্ষেত্রে পুঁজিবাদ পরাস্ত হবে।’ বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছিল, ‘পুঁজিবাদের সাধারণ সঙ্কটের বিকাশের এক নতুন পর্ব শুরু হয়েছে।’ ‘পুঁজিবাদের সমগ্র বিশ্বব্যবস্থায় ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা’র কথাও বলা হয়েছিল। এইরকম মূল্যায়নের ভিত্তিতে বিবৃতিতে উপসংহার টানা হয়েছিল, ‘কেবল সোভিয়েত ইউনিয়নেই নয়, অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশেও পুঁজিবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা অসম্ভব হয়ে উঠেছে।’আত্মসমালোচনার দৃষ্টিতে এটা উল্লেখ করা উচিত যে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের শরিক হিসাবে সিপিআই(এম)’ও এই ভুল মূল্যায়ন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। (প্যারা ২.১০ ও ২.১১- কয়েকটি মতাদর্শগত বিষয় সম্পর্কে প্রস্তাব-১৯৯২)
আমাদের পার্টির সর্বশেষ ‘কয়েকটি মতাদর্শ বিষয় সম্পর্কে প্রস্তাব’গৃহীত হয় পার্টির ২০ তম কংগ্রেসে, কোঝিকোড়ে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন, এই দুটি কংগ্রেসে মতাদর্শগত প্রস্তাব পেশ করেছিলেন ও জবাবী ভাষণ দিয়েছিলেন সদ্য প্রয়াত সীতারাম ইয়েচুরি। এই প্রস্তাবে বলা হয়, সাম্রাজ্যবাদের স্তরের (stage) মধ্যে বিশ্বায়নের বর্তমান পর্যায় (Phase) পুঁজির বিকেন্দ্রীকরণ ও কেন্দ্রীভবনকে বিপুল আকার দিয়েছে। এর ফলে গত দু’দশকে আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির নেতৃত্বে বিপুল ঘনীভবন ও কেন্দ্রীভবন ঘটেছে। এই নিয়ে বিশদ তথ্যাদি দেওয়া হয়েছে যা এই লেখার সময়ে বহু গুণ বেড়েছে। এর পরিণতিতেই ঘটেছে বিশ্বের পুনর্বিন্যাস যেখানে উচ্চতম মুনাফার সন্ধানে বিশ্বজুড়ে সর্বত্র পুঁজি অবাধ অধিকার চায়। পুঁজি এই স্রোতের পথে সব বাধা অপসারণের শর্ত আরোপ করে, এটাই হলো আর্থিক উদারীকরণের মূল কথা। এর সঙ্গী হয়েছে নয়া উদারবাদী আক্রমণ যা বিভিন্ন জাতি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক তথা রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন ও অবদমিত করছে। এই ঘটনা ঘটছে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে। (মতাদর্শগত দলিল- প্যারা ২.৩)
অতীতেও দেখা গেছে ইতিহাসের একটা নতুন স্তর (stage) শুরু হওয়ার মানে এই নয় যে, যতদিন ঐ স্তরের অস্তিত্ব থাকবে তা অনড় ও অপরিবর্তিত থাকবে। প্রত্যেক স্তরেই পরিমানগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তনের ফলে এক নতুন পর্যায় (phase)সৃষ্টি হয়। ...ইতিহাসের একটি স্তর তাই একটি সরলরৈখিক প্রক্রিয়াও নয়, বা একমুখী অগ্রগতিও নয়। সাম্রাজ্যবাদের বর্তমান পর্যায়ও তাই লগ্নিপুঁজির চরিত্র ও আধিপত্যবাদী ভূমিকা সম্পর্কে লেনিনীয় পূর্বাভাষকে খন্ডন করে না।’ (প্যারা- ২.৪)
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি হয় কেবল উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। কোন পদ্ধতিতে এই উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ ও বিনিয়োগ করা হয় তার ওপরে নির্ভর করে বাড়তি নগদ সরবরাহ। এই আত্মসাৎ করা উদ্বৃত্ত বিনিয়োগ করা হয় বিভিন্নভাবে। ফাটকা ব্যবসার মাধ্যমে কর্পোরেট সংস্থাগুলি বাজারী পুঁজি বাড়ানোর ফলে নগদ সরবরাহের পথও ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছে। এইভাবে তৈরি হয় ‘বুদবুদ’যা সাময়িকভাবে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করলেও অবশ্যম্ভাবীভাবে ফেটে যায় এবং অর্থনীতি সঙ্কটের মধ্যে নিমজ্জিত হয়। (প্যারা-২.১)
উপরোক্ত নতুন নতুন আর্থিক পদ্ধতির একটা সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো আদানিদের সম্পর্কে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট। এছাড়াও তথাকথিত ডেরিভেটিভ বা উপজাত পুঁজির ফাটকা বাজার তো আছেই। মূলত এই পুঁজি নির্ভর বিপুল মুনাফা উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাতের (Appropriation) থেকে আলাদা। তাই একে বলা হয় লুটেরা পুঁজি যা সরাসরি লুটের (Expropriation) মাধ্যমে সঞ্চিত হয়, যাকে মার্কস পুঁজির আদিম সঞ্চয়ন বলে চিহ্নিত করেছেন। উপনিবেশগুলি দখল ও লুট করার মধ্য দিয়ে মার্কসের সমকালীন আদিম সঞ্চয়ন বর্তমান নয়া উপনিবেশবাদী ব্যবস্থার থেকে কোনোক্রমেই আলাদা নয়। প্রসঙ্গত লক্ষ্যনীয়, পুঁজির ঘনীভবন (Concentration), কেন্দ্রীভবন এমনকি একচেটিয়া রুপ (‘This is monopoly’-Marx, Capital)।
আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির বিশ্বায়নের অর্থ এই নয় যে, আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব একেবারে লুপ্ত হয়ে যাবে। সে দ্বন্দ্ব আছে তো বটেই, ভবিষ্যতে আরও তীব্র হতে বাধ্য, কারণ পুঁজিবাদের মূল নিয়ম হলো অসম বিকাশ। তার ফলে পুঁজিবাদী কেন্দ্রগুলির মধ্যে ঘটে স্বার্থের সংঘাত, যার প্রেক্ষিত হলো তাদের তুলনামূলক ভবিষ্যৎ ক্ষমতা। এখন প্রায়ই এর প্রতিফলন ঘটছে বিশ্বের সম্পদের ওপরে নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখতে গিয়ে স্বার্থের সংঘাতে অথবা নির্দিষ্ট প্রভাবাধীন এলাকা তৈরির লক্ষ্যে নতুন পুনর্গঠনের জন্য বিশ্বের পুনর্বিন্যাস চাওয়ার মধ্যে। (প্যারা -২.১০)
লেনিনের অবদান হলো, উনবিংশ শতাব্দীর ও বিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষনে ‘পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর সাম্রাজ্যবাদ’এর বিশ্লেষণ ও সেই যুগের রণকৌশল নির্ধারণ। তিনি দেখিয়েছিলেন কেন সাম্রাজ্যবাদী শিবিরে অন্তর্দ্বন্দ্ব থেকে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী এবং তার দুর্বলতম গ্রন্থি রুশ দেশে প্রথমে গণতান্ত্রিক বিপ্লব (১৯১৭ সালেএবং তারপর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে (ঐ বছরেই নভেম্বর মাসে, পুরনো ক্যালেন্ডার অনুসারে অক্টোবর মাসে) নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, রুশ দেশে নভেম্বর বিপ্লবের এই প্রেক্ষাপট সাম্রাজ্যবাদের যুগে বিপ্লবের দিশা দেখিয়েছিল, কিন্তু চীন ভিয়েতনাম কিউবা কোরিয়া কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে বিপ্লবকে নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য নিয়েই বিচার করতে হবে।
বর্তমান সময়ের লগ্নিপুঁজির বিশ্বায়নের কালপর্বেও সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের নেতৃত্ব দিচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। এর প্রধান তিনটি লক্ষ্য হলো, (১) অবশিষ্ট সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোকে ভেঙে ফেলা। (২) তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে আধিপত্য সুনিশ্চিত করা এবং (৩) একমেরু বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করা। এর জন্য কেবল সামরিক শক্তি নয়, মতাদর্শগত আক্রমণও তীব্রতর করা হচ্ছে। মুক্ত বাজার, সার্বজনীন মূল্যবোধ, মানবাধিকার, ফিরে দেখা, পুনর্মূল্যায়ন, মার্কসবাদের পুনর্নির্মান ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার করা হচ্ছে ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী মহল থেকে, উত্তরাধুনিকতাবাদের বর্তমান অবতার, সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ, সাংস্কৃতিক পণ্য মারফৎ সংস্কৃতির বাণিজ্যিকীকরণ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ওপরে আধিপত্য কায়েম, গণসংগ্রামগুলির ওপরে নজরদারি, তাকে প্রভাবিত করা ও পিছন থেকে ছুরিকাঘাত সহ সবরকম নজরদারির জন্য নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদি এগুলির দৃষ্টান্ত মাত্র। এসবের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, ক্রমবর্ধমান দারিদ্র, বেকারী, মূল্যবৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি ইত্যাদি বাস্তব সত্য ও জনজীবনের মৌলিক সমস্যাবলী থেকে নজর ঘোরানো। অক্সফোর্ড ডিকসনারি ২০১৬ সালে ‘উত্তর-সত্য’(Post-truth) শব্দবন্ধটিকে বছরের নতুন শব্দ বলে ঘোষণা করে ব্যাখ্যা দিয়েছিল- ‘এমন একটা পরিস্থিতি বা পারিপার্শ্বিকতা ও আবেগ যেখানে জনমত গঠনে ব্যাক্তি বিশ্বাসের চেয়ে বাস্তব তথ্য কম শক্তিশালী।’ ‘উত্তর-সত্য’র লক্ষ্য হলো একটি কল্প জগৎ তৈরি করে জনগণের জীবনজীবিকার দৈনন্দিন সমস্যা আড়াল করা, চলমান শ্রেণী সংগ্রামের বাস্তবতাগুলিকে আন্দোলন সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করেই উত্তর-সত্যের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হবে।
আমাদের দেশ ও রাজ্যের পরিস্থিতিতে উপরোক্ত আক্রমণগুলোর মধ্যে সবকটিকেই খুঁজে পাওয়া যাবে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হিন্দুত্ব-কর্পোরেট জোটের আধিপত্য। ধর্মীয় উন্মাদনায় মানুষের মধ্যে বিভাজনের জন্য মনুবাদী চতুর্বর্ণের দর্শনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হচ্ছে। এসব কিছু সত্ত্বেও আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব অনন্তকাল স্তিমিত থাকলেও লেনিনের শিক্ষায় অগ্রসর হয়ে এই সময়কালেও দুর্বলতম গ্রন্থিটি ছিন্ন করা সম্ভব।