শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
১৯১৭ সালের নভেম্বর বিপ্লব (পুরাতন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী অক্টোবর বিপ্লব) মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক দিকচিহ্নকারী ঘটনা। মানব সভ্যতা বিগত ১০৭ বছর ধরে বার বার এই ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লবকে স্মরণ করে চলেছে। নভেম্বর বিপ্লব মানব ইতিহাসের ধারার মৌলিক পরিবর্তন ঘটয়েছিল। শ্রেণি বঞ্চনা ও দমনের অবসান ঘটানো সম্ভব হয়েছিল নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। মানব ইতিহাসের ধারায় বহু বিপ্লবের প্রমাণ পাওয়া যায়। অন্য সমস্ত বিপ্লবের থেকে নভেম্বর বিপ্লবের মৌলিক পার্থক্য হলো, অন্য কোনও বিপ্লবের মাধ্যমে (ক্ষণকালের ‘প্যারি কমিউন’ব্যতিরেকে) শোষণ ব্যবস্থার সম্পূর্ণ অবসান সম্ভব হয়নি। বিপ্লবের ইতিহাসে নভেম্বর বিপ্লব এইজন্য অতুলনীয় কারণ এই বিপ্লবের মাধ্যমে শোষণ ব্যবস্থার অবসান প্রথমবারের জন্য ঘটানো সম্ভব হলো।
নভেম্বর বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল রুশ দেশে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে রুশ দেশ ছিল অনুন্নত পুঁজিবাদী দেশ। জারের শাসনকে অবলম্বন করে সামন্তবাদের শক্তিশালী অবস্থান ছিল রুশ দেশে। রুশ দেশকে বলা হতো ইউরোপীয় পুঁজিবাদের পশ্চাদভুমি। জারের শাসন ছিল চরম অত্যাচারের শাসন। রুশ জাতির মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও আরও বহু জাতির মানুষকে নিয়েই ছিল রুশ দেশ। রুশ দেশকে বলা হতো বিভিন্ন জাতির ‘কারাগার’। রুশদের ছিল একাধিপত্য।
নভেম্বর বিপ্লব যেমন রুশ দেশে জারের শাসন সহ সমস্ত ধরনের শোষকের আধিপত্যের অবসান ঘটালো, আবার শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পত্তন ঘটালো। নভেম্বর বিপ্লবের সময়কালের অর্থাৎ ১৯১৭ সাল অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের সময়ের বিভিন্ন দ্বন্দ্বগুলির আলোচনা নভেম্বর বিপ্লবের তাৎপর্য সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, রুশ দেশে ঐতিহাসিক নভেম্বর বিপ্লব সংঘটিত হলেও এর তাৎপর্য আন্তর্জাতিক। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সহ সমস্ত ধরনের শোষণের অবসান সর্বহারা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সম্ভব, একথা জোরের সাথে তুলে ধরলো নভেম্বর বিপ্লব। পুঁজিবাদের সৃষ্টি আধুনিক শ্রমিকশ্রেণি (প্রলেতারিয়েত)-র নেতৃত্বে সমাজ বিপ্লবের মাধ্যমে শোষণহীন সমাজের প্রথম রূপ অর্থাৎ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, একথা সোচ্চারে উপস্থিত করল নভেম্বর বিপ্লব।
সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদ
১৯১৭ সালের নভেম্বর বিপ্লব (যা মাত্র দশ দিনের মধ্যে অধিকাংশ বিজয় অর্জন করল) যখন সংঘটিত হচ্ছে তখন চলছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী, বীভৎস এই যুদ্ধ চলেছে। কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে রুশী কমিউনিস্টরা ও জার্মানির কমিউনিস্টরা সর্বপ্রথম এই বিশ্বযুদ্ধকে ‘সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করলেন। নতুন বাজার গড়ে তোলা ও বাজারের সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি এই যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এই যুদ্ধে যুক্ত দেশগুলির শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের কোনও স্বার্থ এই যুদ্ধে জড়িত নয়। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে এক দেশের শ্রমিক সহ গরিব মানুষ অপর দেশের শ্রমিক-গরিবদের মারছে অথবা নিজেরা মরছে। এই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে ‘জনযুদ্ধে’ পরিণত করতে হবে। নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ নয়, দেশে দেশে সর্বহারাদের নিজেদের দেশের পুঁজিপতি শাসকদের বিরুদ্ধে রাইফেলটা বাগিয়ে ধরতে হবে। সাম্রাজ্যবাদের প্রয়োজনে দেশ দখলের বোড়েতে রূপান্তরিত হওয়ার পরিবর্তে দেশে দেশে শোষণ ব্যবস্থার পরিবর্তনের লক্ষ্যে সর্বহারাদের নিজেদের সহযোগীদের নিয়ে তৎপর হতে হবে। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ প্রসঙ্গে মার্কসীয় বোঝাপড়াকে সমকালীন পরিস্থিতিতে আরও সমৃদ্ধ করে এই বিপ্লবী আহ্বান কমরেড লেনিন উপস্থিত করলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালেই ‘সাম্রাজ্যবাদ — পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৬ সালে এটি প্রকাশিত হয়। সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী স্তরকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করলেন কমরেড লেনিন। সাম্রাজ্যবাদের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনার সাথে সাথে সাম্রাজ্যবাদী স্তরকে মুমূর্ষু পুঁজিবাদ হিসাবে উপস্থিত করলেন কমরেড লেনিন। সাম্রাজ্যবাদের যুগে পুঁজিবাদী সঙ্কট ও দ্বন্দ্বগুলি তীব্রতর হয়। সমাধানের অতীত সঙ্কটে পুঁজিবাদ নিমজ্জিত হয়। ‘নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ’-এর (concrete study of the concrete situation) ভিত্তিতে দ্বন্দ্বগুলিকে চিহ্নিত করে ‘কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্ব’ও ‘মুখ্য দ্বন্দ্ব’কে বিবেচনার মধ্যে রেখে সর্বহারা শ্রেণি ও তাদের পার্টি (কমিউনিস্ট পার্টি) যদি সঠিকস্থানে আঘাত করতে সক্ষম হয়, সাম্রাজ্যবাদের দুর্বলতম গ্রন্থিতে (weakest link in the imperialist chain) আঘাত করতে সমর্থ হলে, সর্বহারা বিপ্লবী প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব। সেই দুর্বলতম গ্রন্থিটা যদি অনুন্নত পুঁজিবাদী দেশ হয়, তাহলেও সেখানে সর্বহারা বিপ্লবী প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। কেবলমাত্র উন্নত পুঁজিবাদী দেশে সর্বপ্রথম প্রলেতারীয় বিপ্লব সফল হবে, এই ধারণাকে লেনিন উন্নত করলেন, সমৃদ্ধ করলেন। সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ সম্পর্কে এই বিশ্লেষণকে কমরেড লেনিন ও রুশী কমিউনিস্ট পার্টি প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে রুশ দেশে প্রয়োগ করলেন। বিশ্বের প্রথম সফল সর্বহারা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্ম হলো নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯১৫ সালে সুইজারল্যান্ডের জিমেরওয়াল্ড (Zimmerwald)-এ বিশ্ব সমাজতন্ত্রী সম্মেলন থেকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত করার আহ্বান উপস্থিত হয়েছিল।
মার্চ বিপ্লব (পুরাতন ক্যালেন্ডার অনুসারে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব)-এর মাধ্যমে রুশ দেশে জার শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটলো। কেরেনস্কির নেতৃত্বের বুর্জোয়া সরকার স্থাপিত হলো। লেনিন এই সময়ে নির্বাসিত হয়ে দেশের বাইরে ছিলেন। তৎকালীন রুশ দেশের সফল বুর্জোয়া বিপ্লবকে প্রত্যক্ষ করার সাথে সাথে তিনি বিশ্লেষণও করলেন পরিস্থিতি। বিশ্লেষণ ও আগামী কর্তব্য সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য চিঠি আকারে রুশ দেশে বলশেভিক (রুশী কমিউনিস্ট)-দের কাছে পাঠালেন। মোট পাঁচটি চিঠি। এই চিঠিগুলির একত্র সংকলনকে ‘দূর থেকে চিঠি’(Letters from a far) হিসাবে বলা হয়। দূর বলতে জেনেভা থেকে লেখা চিঠি। এই পাঁচটি চিঠির মধ্য দিয়ে রুশ দেশের বিপ্লবী আন্দোলনের তৎকালীন রূপ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। সেই মুহূর্তের কর্তব্যকেও তুলে ধরলেন। এই পাঁচটি চিঠি বিপ্লবের সুফলকে নভেম্বর বিপ্লব পর্যন্ত প্রসারিত করার মূল্যবান দিকনির্দেশিকা।
প্রথম চিঠিতে লেনিন উল্লেখ করলেন, মার্চ বিপ্লব ও জারের শাসনের অবসান-এর প্রক্রিয়ার প্রধান নিয়ন্ত্রক হলো সাম্রাজ্যবাদ। ১৯১৬-তে ‘সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’বিশ্লেষণাত্মক রচনায় সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের অর্থ হলো একটা দেশের শ্রমজীবী মানুষের বিরুদ্ধে ‘অপর দেশের শ্রমজীবী মানুষের লড়াই, এটা লেনিন দেখিয়েছিলেন। জিমেরওয়াল্ডে বিশ্ব সমাজতন্ত্রী সম্মেলনে লেনিন জোর দিয়েছিলেন যে, সমাজতন্ত্রীদের সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে দেশে দেশে শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধে পরিণত করতে হবে।
আলোচ্য চিঠিগুলিতে লেনিন দেখালেন, মার্চ বিপ্লব সফল করার মধ্য দিয়ে রুশ বিপ্লব প্রথম স্তর অতিক্রম করেছে। এবারে দ্বিতীয় স্তরে প্রবেশের অপেক্ষা। বুর্জোয়া বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে, এবার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে অগ্রসর হতে হবে।
কেরেনস্কির পুঁজিপতি-জমিদার সরকার লুণ্ঠনমূলক সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বন্ধ করতে যে কোনও ভূমিকা গ্রহণ করবে না, এব্যাপারে লেনিনের কোনও মোহ ছিল না। বুর্জোয়া বিপ্লবের চরিত্র কখনও বিপ্লবী হতে পারে না — এটাই লেনিন বিশেষভাবে উল্লেখ করলেন। আলোচ্য চিঠিগুলিতে রুশ কমিউনিস্টদের কাছে লেনিন এই নির্দেশই দিলেন যে, সর্বহারা শ্রেণিকে যদি মার্চ বিপ্লবের সুফলকে রক্ষা করতে হয় এবং শান্তি, রুটি এবং মুক্তিকে অর্জন করতে হয়, তাহলে এই শোষণের রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করতে হবে এবং একটি নতুন রাষ্ট্রযন্ত্র স্থাপন করতে হবে।
বিরাজমান শোষণের রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভাঙার বার্তা লেনিন উপস্থিত করলেন। এই ভাবনাকে লেনিন আরও সমৃদ্ধ করলেন অব্যবহিত পরে ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’গ্রন্থে। কেরেনস্কির অস্থায়ী সরকারকে কোনও সমর্থনের অর্থ যুদ্ধের সমর্থনে দাঁড়ানো। আসল কর্তব্য হলো শ্রমিক-কৃষক এবং সৈন্যদের প্রস্তুত করা সর্বহারা ও কৃষকদের বিপ্লবী একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য। এটা একমাত্র সম্ভব হবে যদি বুর্জোয়া সংসদ (ডুমা)-র প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয় জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিষ্ঠান সোভিয়েতের স্থাপনার মধ্য দিয়ে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করতে হলে প্রলেতারিয়েতের সংগঠন প্রয়োজন— এই আহ্বানের মধ্য দিয়ে ‘দূর থেকে চিঠি’শেষ হয়েছে।
১৯১৭ সালের ৩ এপ্রিল লেনিন রুশ দেশে প্রবেশ করলেন। পরবর্তী দিন লেনিন তাঁর ‘এপ্রিল থিসিস’প্রকাশ করলেন। এই থিসিস রুশ বিপ্লবীদের মধ্যে বিশাল আলোড়ন সৃষ্টি করল। যুদ্ধের বিরোধিতা করতে হবে বিপ্লবীদের এবং বুর্জোয়া-জমিদার শাসন (যা মার্চ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে) তার অবসানের সংগ্রামে জোর দিতে হবে। সোভিয়েতগুলিকে ক্ষমতার প্রকৃত কেন্দ্রে পরিণত করার জন্য লেনিন শ্রমিক-কৃষক-সৈন্যদের ঐক্যবদ্ধ করার কথা বললেন এবং নিজে সেই লক্ষ্যে অগ্রসর হলেন। এটাই ছিল এপ্রিল থিসিসের মূল বক্তব্য। ‘‘বর্তমান বিপ্লবে প্রলেতারিয়েতের কর্তব্য’’ হিসাবেই বিপ্লবে ‘এপ্রিল থিসিস’প্রকাশিত হলো। ‘‘রুশ দেশের বর্তমান সময়ের বৈশিষ্ট্য হলো, দেশ প্রথম স্তরের বিপ্লব থেকে (যার মধ্য দিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণির হাতে ক্ষমতা অর্পিত হয়েছে) দ্বিতীয় স্তরের বিপ্লবে (যার মাধ্যমে প্রলেতারিয়েত ও কৃষক সমাজের দরিদ্রতম অংশের হাতে ক্ষমতা অর্পিত হবে) উন্নীত হচ্ছে।’’এটা এপ্রিল থিসিসে বলা হলো। এপ্রিল থিসিসে লেনিন দেখালেন, দ্বিতীয় স্তরে (সমাজতান্ত্রিক স্তর) বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক গড়ে উঠবে তার রূপ কি হবে। একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, ‘দূর থেকে চিঠি’ (Letters from Afar) এবং ‘এপ্রিল থিসিস’ রুশ দেশে মার্চ বিপ্লব অর্থাৎ বুর্জোয়া বিপ্লব থেকে নভেম্বর বিপ্লব (সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব)-এ উত্তরণের মূল অনুঘটক (catalyst)।
কমিউনিস্ট পার্টির ঐতিহাসিক ভূমিকা
নভেম্বর বিপ্লব সর্বহারার পার্টি অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টি সংগঠনের প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এল। সর্বহারার নিজস্ব পার্টি অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টি ব্যতিরেকে বিপ্লব সফল হতে পারে না। শোষণভিত্তিক রাষ্ট্রকে সর্বহারা বিপ্লবের মাধ্যমে অপসারিত করে শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
১৮৯৮ সাল থেকে রুশ দেশে কমিউনিস্ট পার্টি সংগঠনের প্রশ্নে লেনিনের কার্যধারা ও সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে। ১৯০২ সালে ‘কি করিতে হইবে’(What is to be done) ও ১৯০৪ সালে এক পা আগে, দু’পা পিছে’ (One step forward two steps back) গ্রন্থের মধ্য দিয়ে লেনিন কমিউনিস্ট পার্টির গঠন, মর্মবস্তু, কার্যধারা ও রূপ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে তুলতে সমর্থ হলেন। সংশোধনবাদী, দলত্যাগীদের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে প্রকৃত বিপ্লবী বলশেভিক পার্টি (রুশ দেশের কমিউনিস্ট পার্টি)-কে গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। একদিকে যে কোনও চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে সক্ষম এবং শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষের সাথে হাজার সম্পর্কে আবদ্ধ এভাবেই গড়ে উঠেছিল দেশের কমিউনিস্ট পার্টি। লেনিনের নেতৃত্বে এই পার্টি নভেম্বর বিপ্লবের পূর্বেই গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। এই পার্টির পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল বিপ্লব-পূর্ব রুশ দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক দ্বন্দ্বগুলি সঠিকভাবে চিহ্নিত করে উপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
বিপ্লবের মুহূর্তকে চিহ্নিত করা, শ্রমিক-কৃষক ও সৈন্যদের ব্যাপক অংশকে বিপ্লবের সপক্ষে শামিল করা, শাসক-প্রতিবিপ্লবীদের সমস্ত ষড়যন্ত্রকে পরাস্ত করে বিপ্লবকে সফল করার জন্য যে ধরনের পার্টি প্রয়োজন, এভাবেই প্রস্তুত হয়েছিল রুশ দেশের কমিউনিস্ট পার্টি। নভেম্বর বিপ্লবের সাফল্যের এটাই হলো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে, শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষ সহ সমস্ত পশ্চাৎপদ অংশের মানুষ, নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এক নতুন ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসাবে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন অভূতপূর্ব নজির স্থাপন করল।
নভেম্বর বিপ্লবের ১০৭তম বার্ষিকী যখন উদযাপিত হচ্ছে, তখন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্ব নেই। নভেম্বর বিপ্লবের ৭৪ বছর পর সে দেশের প্রতিবিপ্লবী শক্তির ষড়যন্ত্র ও তাতে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের সমস্ত মদত এই বিপর্যয় ঘটিয়েছে। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বিপ্লবী মর্মবস্তুকে নস্যাৎ করে সংশোধনবাদী মতবাদ গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে মতাদর্শগত-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক সমস্ত দিক দিয়ে সমাজতন্ত্র ভিতর থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে। এই মূল কারণের জন্যই প্রতিবিপ্লব সফল হয়।
বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন এই বিপর্যয় থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে বিশ্বজুড়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের সপক্ষে লড়াইকে তীব্রতর করার লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।
সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ে পুঁজিবাদ সঙ্কটমুক্ত হতে পারেনি। পক্ষান্তরে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্কট ক্রমান্বয়ে তীব্র হচ্ছে। সামাজিক উৎপাদন ও ব্যক্তিগত মালিকানার দ্বন্দ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মৌলিক দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের সমাধান একমাত্র সম্ভব সামাজিক উৎপাদনের সাথে সঙ্গতি রেখে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্রই একমাত্র বিকল্প, একথা আজ জোরের সাথে সামনে আসছে।
নভেম্বর বিপ্লবই আলোকবর্তিকা হিসাবে সামনে রয়েছে। উন্নত, সমৃদ্ধ ও শোষণহীন সমাজ গঠনের সংগ্রামকে আগামীদিনেও পথ দেখাবে নভেম্বর বিপ্লব ও তার শিক্ষা।