আধুনিক সভ্যতার ইতিহাসে সারা দুনিয়ার মেহনতি মানুষের কাছে এযাবৎ সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা নিঃসন্দেহে রাশিয়ায় ১৯১৭ সালের মহান নভেম্বর বিপ্লব। দুটি পর্যায়ে, দু’স্তরে বিপ্লব। ফেব্রুয়ারি মাসে জারতন্ত্রের উচ্ছেদ, মানে সামন্তবাদের অবসান। এরপর নভেম্বরে কেরেনস্কির নেতৃত্বাধীন বুর্জোয়া সরকারের বিরুদ্ধে রুটি-জমি-শান্তি’র দাবিতে বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিক কৃষক বাহিনীর চূড়ান্ত লড়াই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রণক্লান্ত রাশিয়ার সেনাবাহিনীও শ্রমিক কৃষকের সেই লড়াইয়ে যোগ দিয়েছিলেন। লেনিনের নিখুঁত বৈপ্লবিক কৌশলে ১০ দিনেই ভেঙ্গে পড়েছিল কেরেনস্কির সরকার। শ্রমিক, কৃষক ও সেনা’র মিলিত সোভিয়েতের হাতে এলো সমস্ত রাষ্ট্র ক্ষমতা। গোটা বিশ্বে সেই প্রথম বিপ্লবের মধ্য দিয়ে শ্রেণিহীন সমাজের সূত্রপাত হলো। বিপ্লবের নেতৃত্বে সর্বহারা শ্রেণি। দেশ চালানোর আসনে রাজা-মহারাজা বা বড় বড় শিল্পমালিকদের দল নয়। বিপুল ধনরাশির গরিমার বিপরীতে যাঁরা যুগ যুগ অবহেলিত, তাঁরাই এলেন নীতি প্রণয়নের দায়িত্বে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “ধনগরিমার ইতরতার সম্পূর্ণ তিরোভাব”, (রাশিয়ার চিঠি, দ্বিতীয় পত্র)।
নভেম্বর বিপ্লব পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষের জীবনে নিয়ে এলো মুক্তির নতুন বার্তা। পরনের কাপড়, মাথার ওপর ছাদ, সবার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যের অধিকার, বেঁচে থাকার জন্য এসব মৌলিক অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের শিক্ষাও সেই ঐতিহাসিক বিপ্লবের হাত ধরেই।
গোটা বিশ্ব দেখলো, সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া মানে, ক্ষুধার্তের পেটে দুবেলা খাবার। সম্পদের ওপর নারী ও পুরুষের সমান অধিকার। সম কাজে সম মজুরি। কল-কারখানায়, অফিসে শ্রমিকের আট ঘন্টা কাজ। অতিরিক্ত সময় কাজের জন্য বর্ধিত মজুরি। ঘাম ঝরানো ফসল কৃষকের ঘরে তোলার নিশ্চয়তা। কৃষি সমবায়, ফসল উৎপাদনে কয়েক দশকের মধ্যেই ইউরোপে সেরা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গায়ে গায়ে। বেকারত্বর অবসান। বুনিয়াদি শিক্ষা, উচ্চ শিক্ষা, বিজ্ঞান গবেষণা, সাহিত্য সংস্কৃতি, ক্রীড়া ক্ষেত্র সবেতেই সোভিয়েত ইউনিয়ন দুনিয়ার সেরা।
কিন্তু কাজটা মোটেই সহজ ছিল না। রুশ বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল ১০ দিনে। কিন্তু সেই বিপ্লবকে কার্যকরি করতে সাত বছর সময় লেগেছিল। সীমান্তের বাইরে থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ক্রমাগত আক্রমণ, দেশের অভ্যন্তরে প্রতিবিপ্লবী শক্তির গৃহযুদ্ধের মোকাবিলা। একইসঙ্গে নতুন রাশিয়া গড়ে তোলার কাজ। পুঁজিবাদীদের সাময়িক সহায়তা নিয়ে অর্থনীতিতে, “নয়া অর্থনৈতিক নীতির” প্রয়োগ। তবে তার মেয়াদ ক্ষণকাল। অচিরেই পুরানো উৎপাদন সম্পর্ক ভেঙ্গে উৎপাদনের উপকরণের সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হলো। উদ্বৃত্ত মূল্যেরও সামাজিক মালকানা। ক্রমান্বয়ে পুরানো রাষ্ট্রযন্ত্রটি ভেঙ্গে শ্রমিক শ্রেণির চাহিদাকে মর্যাদা দিয়ে গড়ে উঠলো নতুন আইন, আদালত, সেনা, পুলিশ, প্রশাসন। সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তত্ত্বের সফল বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিলেন লেনিন। শুধু পুরানো ব্যবস্থাটির ব্যাক্ষা বিশ্লেষনই নয়, সুচারু বিপ্লবের মাধ্যমে ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে গোটা দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষের সামনে একটি উন্নত সমাজব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যে ব্যবস্থায় শ্রেণি শোষনের উৎখাত হয়েছিল। যুগের পর যুগ ধরে যারা ছিল উপেক্ষিত, উপরতলার উচ্ছিষ্টে পালিত, সবচেয়ে কম খেয়ে, কম পরে, কম শিখে, সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করে, অসম্মানের বোঝা নিয়ে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় “তারা সভ্যতার পিলসুজ”- সেই শ্রেণির মানুষকেই আলোকিত করেছিল।
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার নির্মাণে গুরুতর চ্যালেঞ্জ ছিল সর্বহারা শ্রেণিকে দ্রুত বুনিয়াদি শিক্ষা এবং উন্নত সাংস্কৃতিক চেতনায় উন্নীত করা। কেননা, জারের রাশিয়ায় শিক্ষা, সংস্কৃতি, থিয়েটার সবই ছিল সমাজের এলিট শ্রেণির জন্য। লেনিন, ট্রটস্কি, আলেক্সান্দার ভরনস্কি, অ্যান্টনি লুনাচারেস্কি প্রমুখ বলশেভিক পার্টির নেতৃবৃন্দের অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে শুরু হলো প্রোলেতারিয়েত মানুষের নিরক্ষরতা, কুসংস্কার, মাদকাশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম। তখন রাশিয়ায় শতকরা ৫০ ভাগেরও কম মানুষ লিখতে পড়তে পারতেন। মহিলাদের মধ্যে নিরক্ষরতার হার ছিল আরও বেশি। নভেম্বর বিপ্লবের একমাসের মধ্যেই ১৯১৭ -এর ডিসেম্বরে নিরক্ষরতার অন্ধকার থেকে আপামর জনসাধারনকে গণতান্ত্রিক পথে বাধ্যতামূলক শিক্ষার আঙ্গিনায় নিয়ে আসার ডিক্রি জারি হলো। একইসঙ্গে শুরু হলো সময়ানুবর্তিতার প্রশিক্ষণ। এর ঠিক দুবছরের মাথায় ১৯১৯ –এর ডিসেম্বরে লেনিন ফের শিক্ষার প্রসারে নয় দফা ডিক্রি জারি করলেন। কর্মক্ষেত্রেই শ্রমিক কর্মচারিদের শিক্ষাদানের জন্য বলশেভিক পার্টির ১ লক্ষেরও বেশি স্বেচ্ছাসেবককে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হলো। ৩০ হাজার সাক্ষরতা স্কুল এবং ৩৩ হাজার পাঠকেন্দ্র বা লাইব্রেরি চালু করা হলো রাতারাতি। ৬০ লক্ষেরও বেশি পাঠ্য পুস্তক ছাপিয়ে তুলে দেওয়া হলো পড়ুয়াদের হাতে। মাত্র দু’দশকেই সোভিয়েত ইঊনিয়ন হয়ে উঠেছিল প্রায় একশো শতাংশ সাক্ষর একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা।
সাহিত্য, থিয়েটার, সংস্কৃতি, কৃষ্টিতে বরাবরই রাশিয়া ছিল একটি সমৃদ্ধশালী দেশ। অ্যালেকজান্ডার পুসকিন, মিখাইল লারমনটভ, নিকোলাই গোগল, ইভান তুর্গেনেভ, লিও টলস্টয়, অ্যান্টন চেকভ, ইভান বুনিন, ফিয়োদর দস্তয়োভস্কি- তালিকাটা দীর্ঘ। উনবিংশ শতকের শেষার্ধে অবিচার, ভন্ডামী, নৈরাজ্যবাদ এবং জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে এঁদের কলম বার বার ঝলসে উঠেছে। সন্ত্রাস, বিশৃংখলার বিরূদ্ধে এঁরা সবাই ছিলেন শান্তির পুজারি। কিন্তু তাঁদের শিল্প সাহিত্যের চর্চা সীমাবদ্ধ ছিল ওপরতলার শিক্ষিত মহলের মধ্যেই। একটু অন্য ধারার ছিলেন ম্যাক্সিম গোর্কি। তাঁর উপন্যাস গল্পে অন্যায় অবিচারের অবসান ঘটিয়ে মুক্তির পথ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা ছিল। সমাজের ঘাত প্রতিঘাত, দ্বন্দ্বগুলো খুব গভীরে গিয়ে একেবারে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি দেখার চেষ্টা করেছিলেন। জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ১৯০৫ -এর শ্রমিক অভ্যুত্থান থেকে অনুপ্রানিত হয়ে তাঁর কালজয়ী উপন্যাস, দ্য মাদার। শ্রেণি শোষনের বিরুদ্ধে একটা বৈপ্লবিক লড়াইয়ের বার্তা। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় ধীরে ধীরে কবিতা গানে উপন্যাসে নাটকে এটাই রেওয়াজ হয়ে উঠেছিল। মায়াকোভস্কির কবিতায়, নিকোলাই অস্ত্রোভস্কি, বরিস পলেভয়দের লেখায়, সের্গেই আইজেনস্টাইন, পুদভকিন, বার্নেট, ভার্তভ, অ্যালেকজান্ডার দভঝেঙ্কো’দের চলচ্চিত্রে ফুটে উঠেছিল যুগ যুগ ধরে সভ্যতার পিলসুজবাহি আঁধারে থাকা মানুষগুলোর বিজয়ের কথা। সার্বিক শিক্ষার বিস্তার ঘটায় প্রোলেতারিয়েত অংশের নাগালের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিল শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির অনবদ্য সৃষ্টিগুলি। চাষা-ভুসো, শ্রমিকরাও কূপমন্ডুকতার আঁধার থেকে বেরিয়ে সমস্ত হীনম্ন্যতাকে পদদলিত করে পা ফেলতে লাগলেন তথাকথিত এলিটদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। শিক্ষা প্রসারের সেই উদ্যম বিস্মিত করেছিল রবীন্দ্রনাথকেও। তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে চিঠিতে কবি লিখলেন, “শিক্ষার পরিমাণ শুধু সংখ্যায় নয়, তার সম্পূর্ণতায়, তার প্রবলতায়। কোনো মানুষই যাতে নিঃসহায় ও নিষ্কর্মা হয়ে না থাকে এজন্যে কী প্রচুর আয়োজন ও কী বিপুল উদ্যম! শুধু শ্বেত রাশিয়ার জন্যে নয়- মধ্য-এশিয়ার অর্ধ্যসভ্য জাতের মধ্যেও এরা বন্যার মতো বেগে শিক্ষার বিস্তার করে চলেছে; সায়েন্সের শেষ-ফসল পর্যন্ত যাতে তারা পায় এইজন্যে প্রয়াসের অন্ত নেই। এখানে থিয়েটারে ভালো ভালো অপেরা ও বড়ো নাটকের অভিনয়ে বিষম ভিড়, কিন্তু যারা দেখছে তারা কৃষি ও কর্মীদের দলের। কোথাও এদের অপমান নেই। ইতিমধ্যে এদের যে দুই-একটা প্রতিষ্ঠান দেখলুম সর্বত্রই লক্ষ্য করেছি এদের চিত্তের জাগরণ এবং আত্মমর্যাদার আনন্দ” (রাশিয়ার চিঠি, প্রথম পত্র)।
শেকসপিয়রের চর্চায়ও বাকি ইউরোপকে পিছনে ফেলে দিয়েছিল রাশিয়া। বিপ্লবোত্তর যুগে প্রথম তিন দশকে শেকসপিয়রের সাহিত্য নাটকের ৫০ লক্ষ কপি প্রকাশনা ছাপানো হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের মোট ২৮ টি সরকারি ভাষায়। ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সম্মিলিত ভাবে যতো না শেকসপিয়রের নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল তার চেয়ে ঢের বেশি হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমজীবী জনগণের এই উত্তোরন সারা পৃথিবীর চিন্তাবিদ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। যা অতীতে কোনও সামাজিক পরিবর্তনে লক্ষ্য করা যায়নি। বিপ্লবের চূড়ান্ত মুহুর্তে অরোরা জাহাজ থেকে জারের শ্বেত প্রাসাদে ছুঁড়ে দেওয়া গোলার প্রসঙ্গ উদ্ধৃত করে চীন বিপ্লবের মহান রূপকার মাও জে দং বলেছিলেন, “ঐ কামানের গোলার আওয়াজে আমাদের ঘুম ভাঙল।“ বাস্তবিকই গোটা দুনিয়ার মেহনতি মানুষকে জাগিয়ে তুলেছিলো ঐতিহাসিক নভেম্বর বিপ্লব। তিন দশকেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র সাময়িক ভাবে পিছু হটেছে। সাবেক সোভিয়েতও এখন অতীত। আমাদের পার্টি সবিস্তারে এর মূল্যয়ন করেছে। সেই মূল্যয়নের সারাংশ হলো, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন মানে বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক মতবাদের পতন নয়। এই পতন মতাদর্শের প্রয়োগে, পরিচালনায়, নির্মাণে বিচ্যুতির কারনে। গোটা বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলন সোভিয়েতের ভুলগুলি থেকে শিক্ষা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। কোনও কাল্পনিক ধারণা থেকে নয়, পুঁজিবাদের অবসানের মধ্য দিয়েই শ্রেণিহীন সমাজ ব্যবস্থার সূচনা ও সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা দ্বান্দ্বিক বিকাশের ঐতিহাসিক পরিণতি। মহান নভেম্বর বিপ্লব পৃথিবীর মুক্তিকামী মেহনতি মানুষ কে বরাবরের জন্য এই বৈজ্ঞানিক সত্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
শেয়ার করুন