- ৭ নভেম্বর ২০২০ ,শনিবার
নভেম্বর বিপ্লব হাতে কলমে দেখিয়েছে শ্রমিক কৃষক মৈত্রীর প্রায়োগিক অনুশীলন। যেসব দেশে দেরিতে পুঁজিবাদ বিস্তার করেছে সেই সব দেশে উদীয়মান বুর্জোয়ারা কখনো সামন্ত শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত করতে চাইবে না, যেমন বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব হয়েছিল ১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লবের সময়। পিছিয়ে থাকা পুঁজিবাদী দেশে উদীয়মান বুর্জোয়াদের মনে প্রবল ভয়, আজ যদি সামন্তদের সম্পদের উপর আক্রমন ঘটে কাল বুর্জোয়াদের সম্পদের উপরেও আক্রমন ঘটবে। তাই এই সব দেশে সর্বহারাদের দায়িত্ব হল বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত করে সামন্ত জাল থেকে কৃষকদের মুক্ত করা। লেনিন জোর দিয়েছিলেন শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে শ্রমিক কৃষক জোটের উপর, শুধু মাত্র বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত করে থেমে যাওয়া নয়, তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সমাজতন্ত্রের অভিমুখে বিরামহীন বিপ্লবী পদ্ধতিতে। বুর্জোয়া বিপ্লব থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের রূপান্তরের সময়ে পরিবর্তিত হতে থাকবে শ্রমিক কৃষক জোটের শ্রেণি উপাদান। ১৯০৫ সালে লেখা ‘টু ট্যাকটিক্স অফ সোশ্যাল ডেমোক্র্যসি ইন ডেমোক্র্যাটিক রিভোলিউশন’এ লেনিন লিখলেন, ‘প্রোলেতারিয়েতরা গণতান্ত্রিক বিপ্লব সমাধা করবে কৃষক জনগণের সঙ্গে জোট বেঁধে স্বৈরাচারের প্রতিরোধকে বলপূর্বক ধ্বংস করে এবং বুর্জোয়াদের অস্থিরতাকে পঙ্গু করে। প্রোলেতারিয়েতরা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সমাধা করবে আধা সর্বহারা জনগণের সঙ্গে জোট বেঁধে বুর্জোয়াদের প্রতিরোধকে বলপূর্বক ধ্বংস করে এবং কৃষকদের এবং ক্ষুদ্র উৎপাদকদের অস্থিরতাকে পঙ্গু করে’। নভেম্বর বিপ্লব দেখিয়েছিল শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা শ্রমিক কৃষক জোটের মধ্য দিয়ে কিভাবে কৃষকদের বিপ্লবী শক্তির মধ্যে শামিল করা যায়, প্রোলেতারিয়েত ক্যাম্পের মধ্যে কৃষকদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। নভেম্বর বিপ্লব দেখিয়েছিল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব কেবল উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে নয়, সংঘটিত হতে পারে অনুন্নত পুঁজিবাদী দেশেও। উন্নত পুঁজিবাদী দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হতে পারে সরাসরি, অনুন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতেও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত করা যায় দীর্ঘমেয়াদী ঐতিহাসিক বিপ্লবী রূপান্তরের প্রক্রিয়ায়। মার্কসবাদের সমালোচকরা যাঁরা মার্কসবাদকে কেবল ‘স্টেজ থিওরি’তে আটকে রাখতে চান, তাঁদের যোগ্য জবাব নভেম্বর বিপ্লব। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রে ফিরতে চাওয়ার আকাঙ্খা, সোভিয়েত নস্টালজিয়া কি শুধুই প্রতি বছরের সমীক্ষায় থেকে যাবে? নভেম্বর বিপ্লবের একশো বছর পার করে আজকের দুনিয়ায় আজকের সঙ্কটে কি পথ দেখাবে নভেম্বর? বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কি বাস্তবে সম্ভব আজকের সময়ে? সমকালের পৃথিবীর সঙ্কটে নভেম্বরের আলো ফেলা তাই জরুরি। করোনা পর্বে আরও তীব্র হয়েছে পুঁজিবাদের সঙ্কট। আরও তীব্র হয়েছে বৈষম্য। সুইস ব্যাঙ্ক ইউবিএস জানিয়েছে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুলাইয়ের মধ্যে বিলিওনারদের সম্পদ বৃদ্ধি ঘটেছে ২৭.৫ শতাংশ, টাকার হিসাবে ১০.২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৭ সালে পৃথিবীতে বিলিওনারদের সংখ্যা ছিল ২১৫৮, ২০২০ সালের মহামারি পর্বে সেই সংখ্যা বেড়ে ২১৮৯। ২০১৭ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বিলিওনারদের মাথা পিছু সম্পদ বেড়েছে ১৩ শতাংশ। অক্সফ্যামের রিপোর্টে দুনিয়ার ডাকসাইটে ৩২টি বৃহ্ৎ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলির শুধু লকডাউন পর্বে মুনাফা বেড়েছে ১০৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অক্সফ্যামের পূর্বাভাষ, গুগল-অ্যাপল-ফেসবুক-আমাজন-মাইক্রোসফট’র চলতি বছরে অতিরিক্তি মুনাফা হবে ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিপরীতে, ধনী ১০ শতাংশ মার্কিনীদের হাতে আমেরিকার মোট স্টক শেয়ারের ৮৯ শতাংশ। ব্রিটেনের ১০ শতাংশ ধনীর হাতে দেশের ৪৬ শতাংশ জনগনের পেনশন। আইএলও জানান দিয়েছে, কোভিড বিশ্বের ৮১ শতাংশ শ্রমজীবী মানুষের আয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলেছে। লকডাউন পর্বে কাজের ঘন্টা কমেছে ১০.৭ শতাংশ, টাকার হিসেবে ৩.৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। আইএলও জানিয়েছে চলতি বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক জুন থেকে সেপ্টেম্বরে কাজ হারিয়েছেন গোটা দুনিয়ায় ২৫ কোটি মানুষ। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্বে কাজ হারানো মানুষের সংখ্যা হবে ৪৫ কোটি, সামনের জানুয়ারি থেকে মার্চে এই সংখ্যা পৌঁছবে ৫১ কোটিতে। পুঁজিবাদ যখনই সঙ্কটে, ঠিক তখনই ঘটে পুঁজির কেন্দ্রীভবন। মার্কসের পুঁজির কেন্দ্রীভবনের ভাবনাকে যেমন দেখেছিলেন লেনিন সাম্রাজ্যবাদের পর্যায়ে। করোনা সঙ্কট কালে বেআব্রু হয়েছে পুঁজিবাদী দুনিয়া। আমেরিকা থেকে ইউরোপ ব্যর্থ মহামারি মোকাবিলায়। মৃত্যুমিছিল নিউইয়র্ক থেকে লোম্বার্ডি। উন্নত প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে হাহাকার। আর্তনাদ। হাসপাতালে বেড নেই। মাস্ক নেই। ওষুধ নেই। একথা বুঝতে রকেট সায়েন্স লাগে না, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো পুরোপুরি বেসরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকলে মহামারি কালে সুরক্ষা দেওয়া যায় না দেশের বিপুল সংখ্যক জনগনকে। করোনার ধাক্কায় বেসরকারিকরণের অ্যাজেন্ডাকে কুঁকড়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সামাজিকীকরণ। রাতারাতি স্পেনে সব বেসরকারি হাসপাতালের রাষ্ট্রীয়করণ। পুঁজিবাদী দেশগুলি যেখানে করোনা মোকাবিলায় বিপর্যস্ত, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির অভাবনীয় সাফল্য মহামারি মোকাবিলায়। চীন থেকে ভিয়েতনাম, কিউবা থেকে গণতান্ত্রিক কোরিয়া, এমনকি ছোট্ট লাওস পর্যন্ত। আমাদের দেশে দেখেছি আমরা মহামারি পর্বে পরিযায়ী শ্রমিকদের হাইওয়ে ধরে বাড়ি ফিরতে চাওয়া, ট্রেনোর ধাক্কায় ট্রাকের ধাক্কায় মারা যাওয়া। আমরা দেখেছি আমাদের দেশে ছাঁটাই, মজুরিত কোপ, ভুখ মিছিল। সঙ্কট মোকাবিলায় উদাসীন থেকেছে দেশের সরকার। সরাসরি অর্থ সাহায্য মাত্র ৯২হাজার কোটি টাকার, জিডিপি’র এক শতাংশেরও কম। যে সময়ে সড়কে নিরন্ন মানুষের মিছিল সেই সময়ে সরকারের গুদামে মজুত ৭৭লক্ষ মেট্রিক টন শস্য। সরাসরি হাতে টাকা দিয়ে সামগ্রিক চাহিদা বাড়ানো, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোতে প্রবল অনীহা উদারনীতির ফর্মুলা মেনে চলা সরকারের। আন্তর্জাতিক পুঁজি পছন্দ করে না সরকারের কোষাগার থেকে টাকা খরচ করে রাজস্ব ঘাটতির। দেশের সরকার ভয় পায় রাজস্ব ঘাটতি বেড়ে গেলে নিও লিবারেল রেটিং এজেন্সিগুলি রেটিং কমিয়ে দেবে দেশের, বিনিয়োগ হারাবে বেশ। তাই জনগণের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করে পুঁজি আগলে রাখে মুনাফাকে। লেনিন সঙ্কটগ্রস্ত পুঁজিবাদকে দেখেছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে, ‘সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’। মার্কসীয় ব্যাখ্যায় কোন উৎপাদন পদ্ধতিকে ফেলে দেওয়া যায় না যদি না তা ঐতিহাসিক ভাবে বাতিল হয়। লেনিন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের পুঁজিবাদকে বললেন ‘মরিবান্ড ক্যাপিটালিজম’, যে পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের স্তরে একের পর এক ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। পুঁজিবাদ কেবল মাত্র শ্রমিকশ্রেণির কাছে এই বিকল্পই রেখেছে নয় তারা যুদ্ধের ট্রেঞ্চে অন্য দেশের যোদ্ধার পোষাকে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে বন্দুকের নিশানা করবে নয় তো তারা পুঁজিবাদী কাঠামোর বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করবে। রোজা লুক্সেমবার্গের ভাষায় একটিই পথ বেছে নিতে হবে সমাজতন্ত্র আর বর্বরতার মধ্যে। করোনা সময় কালে দুনিয়া জুড়ে সঙ্কটগ্রস্ত পুঁজিবাদ মৃত্যুর কানাগলিতে। আজকের সঙ্কট থেকে সমাধানের কোন পথ নেই নয়া উদারবাদের কাছে। নেই ভ্যাকসিন। হাসপাতালে বেড। মৃত্যু মিছিল। কাজ হারিয়ে ভুখ মিছিল। বিপরীতে বিলিওনারদের সম্পদ বৃদ্ধি। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার লুট। পুঁজিবাদ আরও নগ্ন হয়েছে এই সময়ে। মুমুর্ষু পুঁজিবাদ ফের একবার শ্রমিকশ্রেণির কাছে একটিই পথ তুলে ধরেছে বর্বরতার বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রের পথ। আজকের সঙ্কট থেকে সমাধান পেতে হলে একটিই পথ। অর্থনীতিতে সামগ্রিক চাহিদা বাড়িয়ে বেকারি কমানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। একাজ করতে হলে দেশের সরকারগুলিকে নয়া উদারবাদের ফর্মুলাকে অস্বীকার করে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, রাজস্ব থেকে টাকা খরচ করতে হবে রাজস্ব ঘাটতি বাড়িয়ে নয়তো ধনীদের উপর কর চাপিয়ে। দেশের সরকারকে এই কাজ করাতে বাধ্য করতে প্রয়োজন শক্তিশালী শ্রমিক কৃষক মৈত্রী। শ্রমিক কৃষক জোটকে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলে দেশের সরকারকে নয়া উদারবাদের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে যে নীতিগুলি শ্রমিকদের কৃষকদের উপর শোষণ চালিয়েছে সেই নীতিগুলিকে প্রত্যাহার করে বিকল্প নীতি কার্যকর করে কেবল একাজ থেমে থাকলে হবে না। যেমনটি লেনিন শিখিয়েছিলেন, শ্রমিক কৃষক জোট শুধু মাত্র গণতান্ত্রিক আন্দোলন সমাধা করে থেমে যাবে না দীর্ঘমেয়াদী বিপ্লবী পদ্ধতিতে তাকে রূপ দেবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে। নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে শ্রেণি যুদ্ধে শামিল শ্রমিক কৃষক জোটকে বিকল্পের কর্মসূচী বাস্তবায়িত করে থেমে গেলে হবে না তাকে লড়তে হবে সমাজতন্ত্রের অভিমুখে। আমাদের দেশে ২৬ নভেম্বরের সাধারণ ধর্মঘটে মোদী সরকারের শ্রমিক বিরোধী কৃষক বিরোধী নীতিগুলিকে প্রত্যাঘাত হানবে শ্রমিক কৃষক জোট। কেন্দ্রের নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে অগ্নিগর্ভ গোটা দেশ। ট্রাক্টর নিয়ে সড়কে কৃষকরা। নয়া লেবার কোড শ্রমজীবী মানুষের উপর চাপিয়েছে শ্রম দাসত্বের শর্ত। কারখানা ঘিরে নয়া লেবার কোড মানতে অস্বীকার করছেন শ্রমিকরা। নভেম্বর বিপ্লবে তত্বকে সফল অনুশীলনে পরিণত করা রাশিয়ার শ্রমিক কৃষক জোটের মৈত্রীর শিক্ষা নিয়ে এদেশের শ্রমিক কৃষক মৈত্রী জোটের সামনে নয়া চ্যালেঞ্জ ২৬ নভেম্বরের ধর্মঘট। শুধু মাত্র সফল ধর্মঘটেই শ্রমিক কৃষক জোটের থেমে যাওয়া নয়, মানুষ মারা নীতিগুলিকে প্রত্যাহার করিয়ে বিকল্প নীতির বাস্তবায়ন করিয়ে থেমে যাওয়া নয়, খেত খামার থেকে কারখানায় জোট বাঁধা শ্রমিক কৃষক জোটকে এগিয়ে নিয়ে চলা সমাজতন্ত্রের অভিমুখে দীর্ঘমেয়াদী লড়াইয়ের ময়দানে প্রতিদিন জীবন্ত রেখে। এই নভেম্বরেও তাই নির্ভুল থেকে যান লেনিন। নির্ভুল থেকে যায় সমাজতন্ত্রের আদর্শ।
শেয়ার করুন