'নন্দীগ্রামের ডায়েরি'র পাতা এখনও শেষ হয়নি।
নন্দীগ্রামকে ঘিরে চক্রান্তের জাল বোনা হয়েছিল। তার অনেক রহস্য উদঘাটন এখনও বাকি আছে।নন্দীগ্রামের আরো কথা বলার আছে। জানিয়ে দিলেন মমতা ব্যানার্জি। কী বলেছেন তিনি?
"আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, পুলিশের পোশাক পরে অনেকে গুলি চালিয়েছিল। হাওয়াই চটি পরে এসেছিল। এবারেও সেসব কেলেঙ্কারি করছে। এই বাপ-ব্যাটার পারমিশান ছাড়া সেদিন পুলিশ নন্দীগ্রামে ঢুকতে পারত না, আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি। ফেয়ার এনাফ, ভদ্রলোক বলে কিছু বলিনি। সহ্য করে গিয়েছি।"
এই ছটি বাক্য ১৪ বছর বাদে এক ভয়াবহ চক্রান্তের অনেকটা খোলসা করেছে। কিছু বাকি আছে। তা কিছুদিনের মধ্যেই স্পষ্ট হবে। আশা করা যাচ্ছে।
উপরের এই কথাগুলো মমতা ব্যানার্জি বলেছেন রবিবার। বলেছেন নন্দীগ্রামের রেয়াপাড়ার একটি সভায়।
২০০৭-র ১৪ই মার্চে নন্দীগ্রামের ঘটনাবলী সম্পর্কে তার এই বক্তব্য। ঘটনার প্রায় ১৪ বছর পর এই স্বীকারোক্তি তৃণমূল নেত্রীর।
২০০৭-এ রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার ছিল। ১৪ ই মার্চ নন্দীগ্রামে পুলিশ গেছিল। সেদিন কী ঘটেছিল তা প্রশাসনিক স্তরে যারা ভালো করে জানেন তাদের কয়েকজন হলেন, রাজীব কুমার, তন্ময় রায়চৌধুরী, সত্যজিৎ ব্যানার্জি, নীতিশ দাস প্রমুখ। রাজীব কুমার নন্দীগ্রামে মাওবাদী তৎপরতার দিকে নজর রাখছিলেন। বাকিরা ১৪ ই মার্চের পুলিশী অপারেশনে সরাসরি যুক্ত হয়েছিলেন। গুলি চালানোর আগে পুলিশের প্রশাসনিক নির্দেশ লাগে। সেদিন সেটা দেন নীতিশ দাস।
মমতা ব্যানার্জি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর এদের প্রত্যেকের প্রমোশন হয়েছে। সত্যজিৎ ব্যানার্জি গোকুলনগরের কাছে অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি অবসর নিয়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন।
খুব স্পষ্ট - - - নন্দীগ্রামে কোন পুলিশ আধিকারিককে শাস্তি দেয়নি তৃণমূলের সরকার। অর্থাৎ ২০০৭-র ১৪ ই মার্চ একটি চক্রান্ত হয়েছিল। মানুষ মেরে বামফ্রন্ট সরকারকে বিপাকে ফেলার চক্রান্ত - 'লাশের রাজনীতি।' তাতে তৃণমূলের প্রধান ভূমিকা ছিল। মমতা ব্যানার্জির রবিবারের মন্তব্য তা আরও স্পষ্ট করেছে।
একটি দিন এই প্রশ্নে ভুলে যাওয়ার নয়। ২০০৭-র ১১ই ফেব্রুয়ারি। খেজুরির হেঁড়িয়াতে সভা ছিল বামফ্রন্টের। সেই সভায় তৎকালীন
মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য স্পষ্ট বলেছিলেন, "মানুষ না চাইলে নন্দীগ্রামে এক ইঞ্চি জমি নেওয়া হবে না।"
সেই ঘোষনার পরেও অবরুদ্ধ এলাকা থেকে দখল তোলেনি মমতা ব্যানার্জি-শুভেন্দু অধিকারীরা। সেদিন নন্দীগ্রাম থেকে তথাকথিত 'আন্দোলন' তুলে নেওয়া হলে ১৪ই মার্চ পুলিশকে পাঠাতে হত না। ১১ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৭-র পরে নন্দীগ্রামে কোন জমির আন্দোলন ছিলোই না। তা পর্যবসিত হয়েছিল মানুষের লাশের বিনিময়ে তৃণমূলের ক্ষমতা দখলের হিংস্র নৈরাজ্যে।কেন পুলিশ গেছিল?
২০০৭-র ৩রা জানুয়ারি থেকে নন্দীগ্রাম-১ ব্লকের প্রায় ৫ টি পঞ্চায়েত এলাকা দখল করেছিল তৃণমূল - মাওবাদী-বিজেপি-জামাতের সম্মিলিত বাহিনী। রাস্তা কেটে দেওয়া হয়েছিল। কালভার্টগুলি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। প্রচুর অস্ত্র মজুত করা হয়েছিল। সুদীপ চোঙদারের মত মাওবাদী পান্ডারা সেই অবরুদ্ধ এলাকায় অস্ত্র প্রশিক্ষণ শিবির চালু করেছিল। পুলিশ, প্রশাসন যেতে পারতো না। পঞ্চায়েত অফিস বন্ধ করা হয়েছিল। উন্নয়নের সব কাজ বন্ধ করা হয়েছিল। কালিচরণপুর পঞ্চায়েত অফিস ভাঙচুর করা হয়েছিল। কয়েক হাজার মানুষকে এলাকা ছাড়া করা হয়েছিল। ১৪ ই মার্চের আগে প্রায় ১০ জন সিপিআই(এম) কর্মীকে খুন করা হয়েছিল। কোন স্বাধীন, গনতান্ত্রিক দেশে এমন অবরুদ্ধ এলাকা থাকতে পারে না। তাই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পুলিশ গেছিল।
এখানে একটি কথা মনে রাখা দরকার। নন্দীগ্রামে একটি পেট্রো রসায়ন শিল্প তালুক তৈরীর প্রস্তাব ছিল। দেশে দুটি জায়গায় এই ধরনের তালুক তৈরীর প্রস্তাব ছিল। একটি নন্দীগ্রামে। আর একটি কোথায়? গুজরাটের দাভোসে। নন্দীগ্রামেরটি করার কথা ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার। গুজরাটেরটি আমবানিদের। নন্দীগ্রামেরটি মাওবাদী - তৃণমূল মিলে ভেস্তে দিলেও গুজরাটেরটি হয়েছে। এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য। যা সেই সময়ে নৈরাজ্য, হাঙ্গামার মধ্যে খুব একটা খতিয়ে দেখা হয়নি।
তবে সময় সবকিছুকেই সামনে এনে দেয়। নন্দীগ্রামে ১৪ই মার্চ গুলি চালাতে বাধ্য হয় পুলিশ। সিবিআই তদন্তে স্পষ্ট জানানো হয়, পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়। কারন পুলিশকে আটকাতে দুটি জায়গায় জমায়েত করেছিল তৃণমূল - মাওবাদীরা। ভাঙাবেড়া সেতুর কাছে। এবং তেখালি ব্রিজের কাছে। গ্রামবাসীদের পিছন থেকে পুলিশকে আক্রমন করছিল দুষ্কৃতীরা। পুলিশ আহত হয়। তারপর টিয়ার গ্যাস চালায়। তারপর রবার বুলেট। তারপর গুলি।
ঘটনার পরে মমতা ব্যানার্জি দাবি করেন, চটি পরা পুলিশ ছিল। এক কথা শুভেন্দু অধিকারীও দাবি করেন। যদিও ঘটনার সময় দুজনের কেউ নন্দীগ্রামেই ছিলেন না। এই দুই জন 'চটি পরা' পুলিশের কথা লাগাতার বলে গেছেন। মমতা ব্যানার্জি রবিবার ও বললেন। সিবিআই তাদের তদন্তে এই 'চটি পরা' পুলিশের কোন চিহ্ন পায়নি। সিবিআই কিন্তু সেদিন পুলিশকে যারা আক্রমণ করেছিল তাদের জেরা করতে পারেনি তৃণমূলের বাধায়। এমনকি মমতা ব্যানার্জি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর 'অভিযুক্ত' পুলিশ কর্মীদেরও জেরা করার অনুমতি দেননি। তাহলে কী আসল পুলিশ জানতে পারেনি। কিন্তু নকল পুলিশরা আগে থেকেই তৈরী ছিল? আসল পুলিশরা গ্রামে না ঢুকে ব্রিজের অন্য পার থেকে গুলি চালিয়েছিল। নকল পুলিশরা ভিতরেই ছিল। লুকিয়ে ছিল। তারাই মানুষ খুন করেছিল? গ্রামবাসীরা তাদেরই আসল পুলিশ বলে ভেবেছিল? ওই নকল পুলিশদের এনেছিল তৃণমূল এবং মাওবাদীরা।
মমতা ব্যানার্জির স্বীকারোক্তির পর এটাই সত্যি মনে হওয়ার যথেষ্ট কারন আছে। এই ভয়ঙ্কর তথ্য তিনি জানতেন। শুভেন্দু তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ফলে ঘটনার পর থেকে তারা দুজনেই লাগাতার 'চটি পরা' পুলিশের কথা বলে গেছেন। কারন তারা জানতেন কী ঘটেছে। আজ শুভেন্দু অধিকারীকে প্যাঁচে ফেলতে এবং বামপন্থীসহ তৃণমূল এবং বিজেপি বিরোধী অবস্থান নেওয়া একাংশকে নিজের সমর্থনে আনতে মমতা ব্যানার্জি তথ্যটি ফাঁস করে দিয়েছেন। কারন তিনি জানেন গত দশ বছরে নন্দীগ্রাম তথা পূর্ব মেদিনীপুরে তৃণমূলের যাবতীয় দুর্নীতি, অত্যাচার, ভোট লুট, হামলার দায় পুরোটাই শুভেন্দুর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যায়। কারন নন্দীগ্রামসহ পূর্ব মেদিনীপুরে তৃণমূল চালিয়েছেন মূলত শুভেন্দু অধিকারীই।
নন্দীগ্রামে 'চটি পরা' পুলিশ সেজে তৃণমূল কর্মীরাই গ্রামবাসীদের খুন করেছিল--এর দায়ও মমতা ব্যানার্জি চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন শুভেন্দুর কাঁধে।
এই ক্ষেত্রে আর একটি তথ্য বারবার সিপিআই(এম) বলেছে। আর মিডিয়া এবং বুদ্ধিজীবীরা এড়িয়ে গেছেন। ১৪ই মার্চ মৃত্যু হয় ১৪ জনের। তারমধ্যে ৮ জনের দেহে গুলির আঘাত ছিল। পুলিশের গুলি অনায়াসেই মাওবাদীরা জোগাড় করতে পারে। তৃণমূলও সংগ্রহ করে থাকতে পারে। এখন বোঝা যাচ্ছে তাও মমতা ব্যানার্জিদের কাছে নেহাতই নস্যি। কিন্তু বাকি ৬ জনের মধ্যে ৫ জনের দেহে ছিল তীক্ষ্ণ অস্ত্রের আঘাত। পুলিশ কাটার, ছুরি, ভোজালির মত অস্ত্র ব্যবহারই করে না। আর একজনের দেহে ছিল বোমার আঘাত। তাও আসল পুলিশ ব্যবহার করে না। ওই ৬ জনকে পিছনে থাকা দুষ্কৃতীরাই মেরেছিল। অর্থাৎ ১৪ই মার্চ ১৪ জনকেই ক্ষমতা দখলের জন্য মমতা ব্যানার্জিরাই মেরেছিলেন। আজ তা অনেকটাই স্পষ্ট হলো।
মমতা ব্যানার্জি এবং শুভেন্দু অধিকারীরা সেদিন যা যা প্রচার করেছিলেন তার সব মিথ্যা। কোন শিশুর পা চিড়ে ফেলা হয়নি নদীতে। আজ পর্যন্ত এমন কোন নিখোঁজ শিশুর কথা জানা যায়নি। আর যদি তা আদৌ হয়ে থাকে তাহলে তাও তৃণমূল মাওবাদীরা মিলেই করেছিল। একইভাবে সেদিন কোন মহিলার স্তন কেটে নেওয়া হয়নি। কেউ ধর্ষিতাও হননি। সব ছিল মিথ্যা। নন্দীগ্রাম নিয়ে তৃণমূলের ভূমিকা কী ছিল? সি বি আই নন্দীগ্রামে তদন্ত শুরু করে ২০০৭-র ১৫ই মার্চ। ঐদিনই কলকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরিন্দর সিং নিজ্জর এবং বিচারপতি পিনাকীচন্দ্র ঘোষের ডিভিসন বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নন্দীগ্রামের ঘটনার সি বি আই তদন্তের নির্দেশ দেন। সেদিনই বিধানসভায় নন্দীগ্রামের ঘটনাবলী সম্পর্কে
তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য সবার সহযোগিতা চেয়ে সর্বদলীয় মিটিং ডাকা হয়েছে বারবার। বলা হয়েছে রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট মেরামত করা দরকার। পুনর্নির্মাণ করা দরকার। কিন্তু বারবার বলা সত্ত্বেও কোনও সহযোগিতা মেলেনি। ওখানকার ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি কোনও সাড়া দেয়নি।...মাধ্যমিক পরীক্ষাপর্ব মোটামুটি ঠিকঠাক মিটলেও ১১ই মার্চ যখন সর্বদলীয় মিটিং করা হয়, তাতে কংগ্রেস বা তৃণমূল আসেনি।’’
তৃণমূল এই বক্তব্যের বিরোধিতা করেনি। আবার সমস্যা সমাধানে সহযোগিতাও করেনি।পুলিস কি গোপনে গিয়েছিল ?
১৪ই মার্চ নন্দীগ্রামে পুলিসকে গোপনে পাঠায়নি তৎকালীন রাজ্য সরকার। আগে থেকে ঘোষণা করে এবং বিস্তীর্ণ অবরুদ্ধ এলাকায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে, ভাঙা রাস্তা, সেতু মেরামত করতে পুলিস গিয়েছিল। এই বিষয়ে ঘটনার দুদিন আগে, ১২ই মার্চ রীতিমত সাংবাদিক সম্মেলন করে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব সাংবাদিকদের পুলিস যাওয়ার পরিকল্পনা জানিয়েছিলেন।
ন্যাককারজনক ছিল তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের একাংশের ভূমিকা। অপর্ণা সেন সোনচূড়ায় শঙ্কর সামন্তর শহীদ বেদীতে লাথি মেরেছিলেন। নন্দনে বুদ্ধিজীবীদের আলোচনায় ডেকেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সেই সভায় কৌশিক সেনের মত কয়েকজন তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। ব্রাত্য বসুর মত বেশ কয়েকজন বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে তীব্র, জঘন্য প্রচার শুরু করেছিলেন। এরা সবাই কিছু নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করেছেন। তা আরও স্পষ্ট বোঝা যায় যখন দেখা যায় ব্রাত্য বসু, অর্পিতা ঘোষরা তৃণমূলের নেতা হয়ে যান। মন্ত্রী, সাংসদ হয়ে যান। সেদিন এরা সবাই মূলত বামপন্থীদের সরিয়ে রাজ্যে তৃণমূল এবং বিজেপিকে জায়গা করে দেওয়ার চক্রান্তের শরিক ছিলেন।
এখন বোঝাই যাচ্ছে কেন গত দশ বছরে রাজ্যে বিজেপি এত বেড়েছে। কেন তৃণমূলের নেতারা বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। রাজ্যকে সাম্প্রদায়িক বিজেপির হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত ছিল মমতা ব্যানার্জি - শুভেন্দু অধিকারীদের যৌথ চক্রান্ত। নন্দীগ্রামের মানুষকে ভুল বুঝিয়ে তাদের চক্রান্তের বোড়ে করা হয়েছে।
মমতা ব্যানার্জির স্বীকারোক্তিতে তা পরিস্কার।