World Book Day Cover

বিশ্ব বই দিবস: পাঠ্য সংকট ও এর আর্থ সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাব

তনুশ্রী চক্রবর্তী

বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে উদযাপিত বিশ্ব বই দিবস কেবল প্রতীকী বই উৎসব নয়। এটি একটি আহ্বান- একটি সচেতনতার ডাক। এটি মনে করিয়ে দেয়, বই পড়া শুধু বিনোদন নয় -এটি শক্তি। এটি শিক্ষার ভিত্তি, সহমর্মিতার চালিকাশক্তি এবং গণতন্ত্রের স্তম্ভ। কিন্তু ডিজিটাল বিভ্রান্তি ও কমে যাওয়া মনোযোগের ফলে মানুষের পড়ার অভ্যাস দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। এর পরিণতি শুধু ব্যক্তিগত নয়-গোটা সমাজের ওপর প্রভাব ফেলছে।

ইউনেস্কো ১৯৯৫ সালে বই পড়া, প্রকাশনা ও কপিরাইটকে উৎসাহিত করতে বিশ্ব বই দিবস চালু করে। ২৩ এপ্রিল একটি প্রতীকী তারিখ - শেক্সপিয়ার ও সারভান্তেসের মৃত্যুবার্ষিকী। দিনটি মানুষকে, বিশেষ করে শিশুদের, বই পড়ার আনন্দ আবিষ্কারে উৎসাহ দেয়। লেখক ও পাঠকদের মধ্যে সংযোগ তৈরি হয়, প্রকাশকরা বইয়ের প্রসারে কাজ করেন।

তবে যতই উৎসব হোক, মূল উদ্দেশ্য একটাই—একটি এমন বিশ্ব, যেখানে বই পড়া হারিয়ে যাচ্ছে, সেখানে এই অভ্যাসটিকে বাঁচিয়ে রাখা।

বই পড়া শুধু শিক্ষাগত দক্ষতা নয় - এটি জীবনের দক্ষতা। বই পড়ার নানান গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে -

মানসিক বিকাশ:

বই পড়লে শব্দভাণ্ডার বাড়ে, স্মৃতি শক্তি ভালো হয়, আর যুক্তিশীল চিন্তা গড়ে ওঠে। শিশুকাল থেকেই পড়ার অভ্যাস মস্তিষ্কের গঠনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

সহানুভূতি ও আবেগ তাড়িত বুদ্ধিমত্তা:

বিশেষ করে উপন্যাস পাঠ অন্যের জীবনের অভিজ্ঞতা জানার সুযোগ দেয়। এতে সহানুভূতি গড়ে ওঠে, যা সমাজে সহনশীলতা ও মমতা বাড়ায়।

শিক্ষাগত ও পেশাগত সাফল্য:

যোগাযোগ দক্ষতা, বিশ্লেষণ ক্ষমতা, এবং সমস্যা সমাধানের সক্ষমতা—সবই বই পড়া থেকে আসে।

নাগরিক সচেতনতা ও গণতন্ত্র:

বই, পত্রিকা, নিবন্ধ মানুষকে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সচেতন করে। সচেতন নাগরিকদের প্রতারিত করা কঠিন। তারা দায়িত্ববান ভোটার হয়।

মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মপ্রকাশ:

বই পড়া মানসিক চাপ কমায়। গবেষণায় দেখা গেছে, গান শোনা বা হাঁটার চেয়েও বই পড়া বেশি মানসিক প্রশান্তি দেয়।

পৃথিবীব্যাপী বই পড়ার প্রবণতা ক্রমশ কমে যাচ্ছে, তার কারণ গুলিঃ

১. ডিজিটাল বিভ্রান্তি: স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়া, ভিডিও স্ট্রিমিং বইয়ের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।

২. সংক্ষিপ্ত মনোযোগ: রিলস, টিকটক, স্টোরিজ আমাদের সংক্ষিপ্ত কনটেন্টের প্রতি অভ্যস্ত করে তুলেছে।

৩. লাইব্রেরির ভূমিকা হ্রাস: বাজেট কমে যাওয়ায় ও ডিজিটাল শিফটের কারণে অনেক লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

৪. আর্থ-সামাজিক বাধা: দরিদ্র এলাকায় বই কেনার সামর্থ্য নেই অনেকের, ফলে বইয়ের সুযোগ সীমিত।

৫. শিক্ষাগত চাপ: পরীক্ষার জন্য পড়া—আসক্তির বদলে দায়িত্ব।

৬. সাংস্কৃতিক পরিবর্তন: এখন আর ‘পড়ুয়া’ হওয়া সামাজিক মর্যাদা নয়। বইয়ের বদলে পডকাস্ট ও নেটফ্লিক্সের আলোচনা বেশি জনপ্রিয়।

বই না পড়ার ক্ষতি শুধু ব্যক্তিগত নয়—সমাজকেও দুর্বল করে দেয়।

১. যুক্তি ও বিশ্লেষণ শক্তি কমে যায়:

বই না পড়লে মানুষ সরলীকৃত, চটকদার মিথ্যে গল্পে সহজে বিশ্বাস করে। এটি গণতন্ত্রের জন্য হুমকি।

২. বিভাজন ও গোষ্ঠীবাদ বাড়ে:

বই মানুষকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পরিচয় করায়। যখন মানুষ শুধু নিজের মতামতের প্রতিধ্বনি শোনে, তখন সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে।

৩. নাগরিক অংশগ্রহণ হ্রাস:

বই পড়া মানুষ ভোট দেয়, প্রশ্ন তোলে, বিতর্ক করে, সচেতন থাকে। অন্যদিকে, বই না পড়া মানুষ নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে।

৪. সাংস্কৃতিক স্মৃতিভ্রংশ:

পাঠ্যচর্চা ছাড়া মানুষ ইতিহাস ও সভ্যতার মূলধারা ভুলে যায়। এই শূন্যস্থান পূরণ হয় ভুয়া তথ্য ও বিকৃত ইতিহাস দিয়ে।

বই পড়া, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শোষণ বোঝার একটি শক্তিশালী মাধ্যম

তথ্যে ভরা কিন্তু বিশ্লেষণে অনাহারে থাকা এই পৃথিবীতে, বই পড়ার সাধারণ অভ্যাসটি বিপ্লবী সম্ভাবনা বহন করে। বই শুধু গল্প বা তথ্য নয়—এগুলি জাগরণের হাতিয়ার, প্রশ্ন তোলার মাধ্যম এবং সেই ক্ষমতার কাঠামো দেখার চাবিকাঠি, যা প্রায়শই ছায়ার আড়ালে কাজ করে। অরওয়েল থেকে আম্বেডকর, মার্ক্স থেকে মরিসন—লেখকদের বই বরাবরই পাঠকদের সামনে অন্যায়কে প্রকাশ করার মাধ্যম হয়েছে, শুধু ধারণা নয়, বরং বাস্তবতা যা মানুষের জীবন গড়ে।

বই পড়ার গুরুত্ব শুধু ব্যক্তিগত উন্নয়ন মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। পড়া নিজেই একটি রাজনৈতিক কাজ। এটি মানুষকে ভাষা, প্রেক্ষাপট এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতা দেয়, যার মাধ্যমে তারা বুঝতে পারে, সমাজে তাদের অবস্থান কোথায়। আর একবার মানুষ তা বুঝে ফেললে, তারা প্রতিরোধ করাও শুরু করে।

জাতপাত, বর্ণবাদ ও লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে লেখা বই পাঠককে দেখায় কীভাবে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীগুলোকে সম্মান ও সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়।

১) The Diary of Anne Frank (by Anne Frank)

২) The Souls of Black Folk (by W.E.B. Du Bois)

৩) Joothan: A Dalit's Life (by Omprakash Valmiki)

৪) Caliban and the Witch by Silvia Federici

এ বই গুলি কেবল ব্যক্তিগত কাহিনি নয়—তারা একেকটি ইতিহাস যা বর্জন ও নিপীড়নের কাঠামো তুলে ধরে।

অর্থনৈতিক শোষণ বুঝতে হলে আমাদের পুঁজিবাদ, শ্রম শোষণ, মজুরি কাঠামো, সম্পদের বন্টন বৈষম্যে এবং কর্পোরেট লোভ যা গরিব মানুষকে অর্থনৈতিক ভাবে প্রান্তিক করে তোলে, তা বুঝতে হবে। তার জন্য বই পড়ার দরকার। মার্ক্স, বা বারবারা এহরেনরেইচের মতো লেখকদের চোখ দিয়ে দেখা যায় - কীভাবে নীতিমালা, মজুরি কাঠামো এবং কর্পোরেট লোভ গরিবদের আরও গরিব করে তোলে।

৫) The Poverty of Philosophy by Karl Marx

৬) Why Marx Was Right by Terry Eagleton

৭) The Accumulation of Capital by Rosa Luxemburg

৮) Marx's Ecology by John Bellamy Foster

৯) Postmodernism, or, The Cultural Logic of Late Capitalism by Fredric Jameson

১০) The Origin of Capitalism by Ellen Meiksins Wood

১১) Capital in the Twenty-First Century by Thomas Piketty

এ-বই গুলো দেখায় এই ব্যবস্থাগুলো কিভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিরুদ্ধে কাজ করে।

রাজনৈতিক শোষণ বোঝার ক্ষেত্রেও বই অত্যন্ত কার্যকর। রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা, নজরদারি ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা দেয়। তারা শেখায় কীভাবে রাজনৈতিক ব্যবস্থা মানুষকে দমন করতে পারে—নিয়ন্ত্রণ, সেনা-নির্ভরতা, এবং বাকস্বাধীনতা খর্ব করে।

এই সংকট ঠেকানো সম্ভব, যদি সচেতনভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়:

১. বই পড়াকে অভ্যাস বানাতে হবে:

স্কুলে স্বাধীনভাবে বই পড়ার সুযোগ দিতে হবে, শুধু পরীক্ষার জন্য নয়।

২. প্রযুক্তিকে বন্ধু বানানো:

ই-বুক, অডিওবুক, অ্যাপ—সবই কাজে লাগানো যায়। লক্ষ্য হতে হবে গভীর পাঠ।

৩. লাইব্রেরিতে বিনিয়োগ:

সাম্প্রতিক ডিজাইন, ডিজিটাল সংগ্রহ আর সমাজিক কার্যক্রম—লাইব্রেরিকে আবার প্রাণ ফিরিয়ে দিতে হবে।

৪. সুযোগসীমা দূর করতে হবে:

সরকার ও এনজিও-দের দরিদ্র এলাকায় বিনামূল্যে বই পৌঁছে দিতে হবে।

৫. স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ:

সময় বেঁধে দেওয়া উচিত, যেন বই পড়ার জায়গা তৈরি হয়। শাস্তির জন্য নয়—উৎকর্ষের জন্য।

আমরা অনেক সময় অন্যায় বা বৈষম্য অনুভব করলেও তাকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না। বই আমাদের সেই ভাষা দেয়। তারা আমাদের শেখায় কীভাবে প্রতিদিনের জীবনে লুকিয়ে থাকা সামাজিক ও কাঠামোগত শোষণকে চিহ্নিত করতে হয়।

শোষণ যত বেশি পুরনো, ততই তা স্বাভাবিক বলে মনে হয়। বই এই স্বাভাবিকতার মুখোশ সরায়। ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ও রাজনৈতিক তত্ত্ব পড়ে মানুষ বুঝতে পারে—আজকের বাস্তবতা কিভাবে অতীতের সিদ্ধান্ত থেকে এসেছে।

কেন কিছু সম্প্রদায় অন্যদের তুলনায় দরিদ্র? কেন কিছু গোষ্ঠী রাজনীতি বা গণমাধ্যমে আধিপত্য রাখে? কেন শ্রমিকরা অনেক ক্ষেত্রে গরিবই থেকে যায়? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হলে, বইয়ের সাহায্য নিতে হয়।

উদাহরণস্বরূপ, ঔপনিবেশিক ইতিহাস পড়লে বোঝা যায়, কীভাবে ধনী দেশগুলো গরিব দেশগুলোকে লুট করেছে। দাসত্ব নিয়ে লেখা বই বোঝায়, সম্পদ কীভাবে মানুষের কষ্টের ওপর দাঁড়িয়ে তৈরি হয়েছে। নারীবাদী লেখাগুলো দেখায়, কীভাবে সামাজিক কাঠামো নারীর স্বাধীনতা সংকুচিত করেছে।

বই শুধুই তথ্য দেয় না - তা চিন্তার কাঠামো তৈরি করে। একজন পাঠক কেবল তথ্য তালাস করে না, সে প্রশ্ন তোলে, মতাদর্শ বিশ্লেষণ করে, এবং পক্ষপাত চিনে ফেলে।

এ কারণেই অত্যাচারী সরকার বই নিষিদ্ধ করে। কারণ বই পড়া মানুষকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শেখায়। এবং স্বাধীনচিন্তকরা অন্ধভাবে অনুসরণ করে না।

পড়া শুধু বুদ্ধিকে ধার দেয় না, হৃদয়কেও নরম করে। গল্প, আত্মজীবনী ও স্মৃতিচারণ পাঠককে অন্যের জীবন অনুভব করতে শেখায়। এই অনুভূতিমূলক সংযোগ থেকেই সংহতির জন্ম।

যখন আপনি The Color Purple by Alice Walker পড়েন, তখন কেবল বর্ণবাদ বা নারী নিপীড়নের কথা শোনেন না—তা অনুভবও করেন। যখন আপনি পার্সেপোলিস পড়েন, তখন কোনো স্বৈরাচারী শাসনের অধীনে বড় হওয়ার মানসিক চাপ বোঝেন।

এই অনুভবই মানুষের মধ্যে প্রতিরোধের বীজ বোনে।

বাঁচতে হলে, শিখতে হলে, এবং সমাজ গড়তে হলে—পড়তে হবে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন