‘ভুলি নাই’ – ঐতিহাসিক নৌ-বিদ্রোহ স্মরণে : অর্কপ্রভ সেনগুপ্ত...

১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২২ , শুক্রবার

দ্বিতীয় পর্ব


১৯ তারিখ ধর্মঘট ছড়িয়ে পড়ল ক্যাসেল ব্যারাক সহ বোম্বের তীরবর্তী ১১টি নৌ-প্রতিষ্ঠান এবং ২০ টি জাহাজে। গঠিত হল প্রায় ২০ হাজার রেটিং-এর প্রতিনিধিত্বকারী ছত্রিশ জনের কেন্দ্রীয় ধর্মঘট কমিটি। সভাপতি পদে নির্বাচিত হলেন এম.এস খান ও সহ-সভাপতি মদন সিং। সমস্ত জাহাজ ও প্রতিষ্ঠান থেকে ইউনিয়ন জ্যাক টেনে নামিয়ে দেওয়া হল। তীরের লরিগুলিতে একত্রে বেঁধে দেওয়া হল জাতীয় কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পতাকা। Royal Indian Navy-এর নাম পাল্টে রাখা হল Indian National Navy। বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ল করাচি, মাদ্রাজ, বিশাখাপত্তনম ও কলকাতার নৌবাহিনী জাহাজেও, যদিও আংশিক ভাবে করাচিতে ছাড়া তা বোম্বের আকার ধারণ করেনি। বোম্বেতে সত্যিই সামগ্রিক ঘটনাবলি এক অভূতপূর্ব বৈপ্লবিক সম্ভবনা তৈরি করেছিল। ১৯ তারিখ সন্ধ্যে যখন অস্তমিত হচ্ছে, জনৈক ব্রিটিশ অফিসার, পার্সি গর্জে লিখেছেন বোম্বে নিদ্রায় গেল বাতাসে বিপ্লব নিয়ে। অধ্যাপক গৌতম চট্টোপাধ্যায় বলেছেন ‘Almost Revolution’, ‘প্রায় বিপ্লব’।
ঠিক এই সময়ে যদি নাবিকরা অস্ত্র হাতে প্রায় অরক্ষিত বোম্বে শহরের দখল নিতেন, যদি তাঁদের প্রতি তীব্র সহানুভূতি সম্পন্ন শ্রমিক শ্রেণীর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতেন শহর জুড়ে, হয়তো ভারতের ইতিহাসই পাল্টে যেত। দুর্ভাগ্য আমাদের, তা হয় নি।

১৯৪৬ ধর্মঘটের আহ্বানে , ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পোস্টার

রেটিং-রা তাঁদের ধর্মঘট কুড়ি তারিখে জাহাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে, অন্যদিকে তাঁদের নেতারা সহায়তার আশায় কংগ্রেস ও লীগের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকে। তাঁদের আশা ছিল খুব সহজেই জাতীয় নেতাদের সমর্থন তাঁরা পাবেন, কিন্তু কোনো দলই এই সমর্থন দিতে রাজি ছিল না, এক কংগ্রেস-সোশ্যালিস্ট নেত্রী অরুণা আসফ আলি ব্যতীত কেউই তাঁদের পাশে দাঁড়াতে রাজি ছিল না।

কংগ্রেস-সোশ্যালিস্ট নেত্রী অরুণা আসফ আলি


ব্রিটিশরা এই সময়ের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে প্রস্তুত হয় প্রত্যাঘাত করার। তাও ২১ তারিখ যখন ধর্মঘটিদের ঘেরাও করতে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাঠানো হয়, তারা গুলি তো চালায়ই নি, বরং অনেকে ধর্মঘটিদের সঙ্গে যোগদান করে। এর পর আরও বড় বাহিনী প্রেরণ করলে দুই পক্ষের মধ্যে গুলি বর্ষণ শুরু হয়। এরই মধ্যে ঐ গুলি বৃষ্টির মধ্যেও নাবিকদের সহায়তা করতে এগিয়ে আসে সাধারণ ভারতীয়রা। সন্ধ্যের পর অ্যাপলো বন্দরে দেখা গেল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। নাবিকদের দেওয়ার জন্য খাবার নিয়ে এসেছেন বোম্বেবাসী, কেউ নিয়ে এসেছেন ফলভর্তি টুকরি, কেউ বা মিষ্টি। ঐ গুলি বিনিময়ের মধ্যেই তা লঞ্চে করে জাহাজে প্রেরণ করা হল। এক প্যাকেট ছোলা দিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হল বছর আঠেরোর এক শ্রমিক সন্তান। এই সময়েই বোম্বের শ্রমিক শ্রেণীর সঙ্গে ব্রিটিশ বাহিনীর বারংবার সংঘাত লাগতে থাকে।


পরের দিন ২২ তারিখ যখন ধর্মঘটী নৌ-সেনারা কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির কাছে সাহায্যের আবেদন জানায় তখন এই তিন সংগঠনের মধ্যে একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টিই সেই ডাকে সাড়া দেয়। বোম্বের রাস্তায় রাস্তায় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ব্যারিকেড। শ্রমিকরা হামলা চালায় মিলিটারি লরির উপর। পুলিস ও মিলিটারির রাইফেল অবিরাম অগ্ন্যুদগার করতে থাকে। বোম্বের রাস্তা পিচ্ছিল হয় শ্রমিকদের রক্তে। পারেলে প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা কৃষ্ণ দেশাই (পরবর্তী কালে তিনি এখান থেকেই সিপিআই-এম এর বিধায়ক হয়েছিলেন, কংগ্রেস মদতপুষ্ট শিবসেনা দুষ্কৃতির হাতে নিহত হন) মেশিন-গান কেড়ে নিয়ে তার নল ঘুরিয়ে দেন ব্রিটিশ বাহিনীর দিকেই। বুলেশ্বর ও গিরগাঁও-এ শ্রমিকরা গড়ে তোলে সুতীব্র প্রতিরোধ, বারংবার গুলি বর্ষণ করেও তাঁদের ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি এই পরিস্থিতিতে এই দিনও যদি নাবিকরা জাহাজ থেকে নেমে শ্রমিকদের সঙ্গে বিদ্রোহে যোগদান করতেন অস্ত্র হাতে পরিস্থতি অন্যরকম হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। মেশিনগানের সামনে শেষ পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেণীকে পিছিয়ে আসতে হয়। শুধু সরকারি হিসেবেই এইদিন মৃত্যু হয়েছিল প্রায় আড়াইশো জনের। অসংখ্য কমিউনিস্ট কর্মী সমর্থক আহত ও নিহত হন। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পারেল মহিলা সঙ্ঘের কোষাধ্যক্ষ কমল ধোন্ধে। বুলেটবিদ্ধ হয়ে তাঁর মৃত্যুর সময় সঙ্গেই ছিলেন কুসুম রণদিভে ও অহল্যা রঙ্গনেকর। কুসুম রণদিভেও বুলেট বিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন।


এদিকে একদিকে কংগ্রেস অন্যদিকে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে তাঁদের রাজনীতির সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যানের ফলে মন ভেঙে গেছে। প্যাটেল তাঁদের ক্রমাগত বুঝিয়ে চলেছেন আত্মসমর্পণই শ্রেয় এবং তাঁদের যাতে শাস্তির ব্যবস্থা না হয় তা তিনি দেখবেন। একধাপ এগিয়ে প্যাটেল এও বলেন যে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে যোগদান না করার কলঙ্ক মুছে ফেলতে কমিউনিস্ট পার্টিই নাকি ইচ্ছাকৃত ভাবে এই ঝামেলা লাগিয়েছে। তাঁর মাপের নেতার নিকট থেকে এইপ্রকার ভিত্তিহীন অভিযোগ সকলের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল। নাবিকরা কোনো রাজনৈতিক দলের অনুগামী ছিলেন না। এই আন্দোলন তাঁরা স্বতঃস্ফুর্ত ভাবেই শুরু করেছিলেন, তাঁদের সহায়তার আহ্বানে কমিউনিস্ট পার্টি সাড়া দিয়েছিল মাত্র। সর্দার বল্লভভাই-এর পাশাপাশি পন্ডিত নেহেরুও ধর্মঘট উঠিয়ে নেওয়ার পক্ষে জোরালো সওয়াল করেন। মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে মহম্মদ আলি জিন্নাহও একই বক্তব্য রাখেন। মহাত্মা গান্ধী বলেন হিংসাত্মক উদ্দেশ্যে ব্যারিকেডে হিন্দু-মুসলমানের মিলনকে তিনি অশুভ মনে করেন। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় স্ট্রাইক কমিটি ২৩-শে ফেব্রুয়ারি নিঃশর্ত আত্ম-সমর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে তারা একথা বলে দেয় এই আত্ম-সমর্পণ দেশের জনতার কাছে, তাঁদের নেতৃত্বের কথা মান্য করে, ব্রিটিশ শাসকদের কাছে নয়। শেষ বার্তায় সেন্ট্রাল স্ট্রাইক কমিটি বলে – ‘Our strike has been a historic event in the life of our nation. For the first time the blood of men in services and men in streets flowed together in a common cause.’


নৌ-বিদ্রোহ ভারতের ইতিহাসে এক মোড় ঘোরানো ঘটনা ছিল। মহাত্মা গান্ধী হিংসাত্মক কাজে ব্যারিকেডে হিন্দু-মুসলিমের মিলন অপবিত্র মনে করেছিলেন, একথা জানা নেই ভবিষ্যতে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের ফলে কোন গরল পান করতে দেশবাসী বাধ্য হবে তা জানলে তিনি একই কথা বলতেন কিনা। কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট ও কমিউনিস্টদের তরফ থেকে সমর্থন ছাড়া নৌ-বিদ্রোহ-এর সময় শ্রমিক ও নাবিকরা প্রধান জাতীয় নেতৃত্বের থেকে কোনো প্রকার সহায়তা বা সমর্থন তো লাভ করেইনি বরং জাতীয় নেতৃত্ব সবরকম ভাবে সম্ভব তাঁদের তিরস্কার করেছিল। শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলেও এই বিদ্রোহ ছিল ঐক্যবদ্ধ অ-সাম্প্রদায়িক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী শেষ স্ফুলিঙ্গ গুলির অন্যতম। রজনী পাম দত্ত লিখেছেন – “The naval rising in February, 1946, the mass movement of support within India and the heroic stand of the Bombay working people constituted the signal of the new era opening in India and one of the great landmarks of Indian history.” সোমনাথ লাহিড়ী ‘স্বাধীনতা’-য় ২৪-শে ফেব্রুয়ারি ‘ভুলিব না’ শীর্ষক শিরোনামে যা লিখেছেন, তার একাংশও স্মরণ করা যেতে পারে –
“বোম্বাই শহরে প্রথমদিন এক লক্ষ, দ্বিতীয় দিন তিন লক্ষ মজুর ধর্মঘট করিয়া লাল ঝান্ডা লইয়া বাহির হইয়াছে। মৃত্যুপথযাত্রী নাবিক ভাইদের ম্লান হতাশার সম্মুখে তাহারা আশার গর্জন তুলিয়াছে – আমরা তোমাদের ভুলি নাই, ভুলিতে পারিনা, তোমাদের সংগ্রাম যে আমাদেরই সংগ্রাম।…সাম্রাজ্যবাদের প্রতিটি আঘাত প্রতিঘাত করিবার জন্য আমরা আছি, ভারতবাসীর মেরুদন্ডকে আমরা বাঁকিতে দেব না।“


এই ১৮-ই ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক নৌ বিদ্রোহ যখন তার ৭৫ বছর সম্পূর্ণ করবে তখনও প্রত্যেক কমিউনিস্ট কর্মী গৌরবময় সংগ্রামের ঐতিহ্য স্মরণ করবে একই ভাবে – ‘তোমাদের ভুলি নাই, ভুলিতে পারিনা, তোমাদের সংগ্রাম যে আমাদেরই সংগ্রাম।‘


শেয়ার করুন

উত্তর দিন