দেশের অর্থনীতি ঝিমিয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং সংস্থা মুডি’সও তাদের রিপোর্টে শুনিয়েছে উদ্বেগের কথা। ক’দিন আগে আইএমএফ শুনিয়েছিল পাঁচে নয়, চলতি বছরে জিডিপি বৃদ্ধির হার নেমে যাবে ৪.৮ শতাংশে। প্রায় একই সুরে মুডি’স বলেছে, এই মার্চে শেষ হওয়া আর্থিক বছরে প্রকৃত জিডিপি বৃদ্ধির হার নেমে হবে ৪.৯ শতাংশ। আগামী আর্থিক বছরে হবে ৫.৫ শতাংশ, যেখানে পাঁচদিন আগে সরকারের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় পূর্বাভাস ছিল ৬ থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ। এই পরিস্থিতিতে সিপিআই(এম), সিপিআই, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, এআইএফবি, আরএসপি এদিন বলেছে, মোদী সরকার ভারতের অর্থনীতিকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে চলেছে বেনজির বোঝা। একইসঙ্গে, ধনী ও কর্পোরেটদের দিয়ে চলেছে ছাড়ের পর ছাড়। যা দেশের মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক অসাম্যকে আরও প্রশস্ত করেছে। আর তা এতটাই, যে এমনকি স্বাধীন ভারতের আগেও কখনও দেখা যায়নি। এই পরিস্থিতিতে, এবারের বাজেট আমাদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনজীবিকায় দুর্দশা আরও বাড়াবে।
যে চারদফা দাবিতে সপ্তাহভর প্রতিবাদ আন্দোলন হবে, সেগুলি হলো: এক, জীবনভর সঞ্চয় এবং নিরাপত্তার আধার জীবনবিমার শেয়ার বিক্রি সহ জাতীয় সম্পত্তির ব্যাপক আকারের বেসরকারিকরণ প্রত্যাহার। দুই, কারখানার ঝাঁপবন্ধ, কর্মীসঙ্কোচনের কারণে অভূতপূর্ব মাত্রায় বেকারত্বের বিরুদ্ধে এবং মাসিক ন্যূনতম মজুরি ২১,০০০ টাকা ও পর্যাপ্ত বেকার ভাতার দাবিতে। তিন, তীব্র কৃষি সঙ্কটের বিরুদ্ধে এবং কৃষকদের জন্য এককালীন ঋণ মকুবের দাবিতে। চার, খাদ্যে ভরতুকি, কৃষি ও মৎস্যচাষ সহ সংশ্লিষ্ট কার্যকলাপ, রেগা, সমাজকল্যাণ, নগর উন্নয়ন এবং স্বাস্থ্যের মতো জরুরি ক্ষেত্রে ব্যাপক আকারে সরকারি বরাদ্দ ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে। যেমন খাদ্যে ভরতুকি ছাঁটাই করা হয়েছে ৭৫,৫৩২ কোটি টাকা। কৃষি ও মৎস্যচাষ সহ সংশ্লিষ্ট কার্যকলাপে ৩০,৬৮৩ কোটি টাকা। রেগায় ৯,৫০০ কোটি টাকা। সমাজকল্যাণে ২,৬৪০ কোটি টাকা, নগর উন্নয়নে ৫,৭৬৫ কোটি টাকা এবং স্বাস্থ্যে ১,১৬৯ কোটি টাকা। এই বরাদ্দ ছাঁটাই আরও কোটি কোটি মানুষকে ঠেলে দেবে দারিদ্রে। এই অবস্থায় সরকারি বরাদ্দ বাড়ানো না গেলেও, অন্তত আগের জায়গায় নিয়ে যাওয়ার দাবি তুলতে হবে।
মানুষের জীবনজীবিকার উপর একদিকে যখন এ ধরনের নির্মম আক্রমণ চালানো হচ্ছে, তখন অন্যদিকে মোদী সরকার আঘাত নামিয়ে আনছে আমাদের সংবিধানের উপর। সিএএ-এনপিআর-এনআরসি’র মতো কট্টর হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডা প্রয়োগ করে ভাগ করা হচ্ছে আমাদের জনগণকে। দেশজুড়ে মানুষের মধ্যে তৈরি করা হচ্ছে ক্রমবর্ধমান বিদ্বেষ এবং হিংসার পরিবেশ।
সিপিআই(এম)’র সীতারাম ইয়েচুরি, সিপিআই’র ডি রাজা, সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, এআইএফবি’র দেবব্রত বিশ্বাস এবং আরএসপি’র মনোজ ভট্টাচার্য যৌথ বিবৃতিতে এই আহ্বান জানিয়েছেন। সঙ্কটে জর্জরিত দেশের অর্থনীতিকে কীভাবে মোকাবিলা সম্ভব, তার কোনও সুলুকসন্ধান দিতে পারেননি অর্থমন্ত্রী, তাঁর বাজেট ভাষণে। সমস্যার মুখে দাঁড়িয়ে কোনও সুসঙ্গত নীতি অভিমুখের দিশা দেখানোর পরিবর্তে, আড়াই ঘণ্টা ধরে নির্মলা সীতারামন যা বলেন, তা আসলে নাকানিচোবানি খাওয়া অর্থনীতিকে আড়াল করার লক্ষ্যে স্বগতোক্তি মাত্র। চাতুরির সঙ্গে তথ্যের কারচুপির চেষ্টা করলেও, বাজেট আড়াল করতে পারেনি অর্থনৈতিক সঙ্কটকে। যা আসলেই অধোগতির মূল কারণ, সেই ক্রমবর্ধমান ভয়াবহ বেকারি, শ্রমিক, কৃষক এবং যাঁদের জোর করে ঠেলে দেওয়া হয়েছে স্বনিযুক্ত কর্মসংস্থানে— সেইসব শ্রমজীবী মানুষের জীবনজীবিকার পরিস্থিতিকে মোকাবিলা না করে, মোদী সরকারের একমাত্র আগ্রহ দেখা গিয়েছে কেবলই কর্পোরেটের স্বার্থপূরণ, আর সম্পদশালীদের স্বস্তি দেওয়া, তা একেবারে বেআব্রু হয়ে গিয়েছে।
সেদিনই দেশের সম্পত্তি ব্যাপক আকারে বিক্রির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন তীব্র করার ডাক দিয়েছিল সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো। বাজেটের প্রতিক্রিয়ায় পলিট ব্যুরো বলেছিল, এই ঘোষণা তীব্র করবে অর্থনৈতিক দুর্দশাকে। বাজেটে একমাত্র অঙ্গীকার দেখিয়েছে কোষাগারীয় ঘাটতি কমানোয়। এবং এই ঘাটতি কমানো হবে সরকারি বরাদ্দে নতুন করে ছাঁটাই, বৃহৎ কর্পোরেটের হাতে দেশের সম্পত্তি বিক্রি এবং সমস্ত কিছুর বোঝা শ্রমজীবী মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে। এই পরিস্থিতিতে, দেশের সম্পত্তি ব্যাপক আকারে বিক্রি, জীবনবিমা ও বিমা ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ, বেকারি, কৃষি সঙ্কট এবং দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের উপর দুর্দশা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন তীব্র করার ডাক দেয় পলিট ব্যুরো।
শেয়ার করুন