বর্তমান বিশ্বের বিজ্ঞান চর্চায় একটি বহুল চর্চিত গবেষণার বিষয় স্ট্রিং-থিওরি। এ হল সেই গবেষণাক্ষেত্র যাতে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মধ্যে যোগ সাধনের প্রয়াস চলে। আজকের প্রজন্মের মনে রাখা উচিত স্ট্রিং থিওরি তত্ত্বে ব্যবহৃত গাণিতিক বিষয়বস্তু যা কিছু, তাতে ব্যাপক অবদান রয়েছে এক ভারতীয় গণিতজ্ঞের। তিনি শ্রীনিবাস রামানুজন।
আজ তারই জন্মদিবস।
ভারতের জাতীয় গণিত দিবসও আজই- তার প্রতি শ্রদ্ধায়, স্মরণে।
১৮২৭, ২২ ডিসেম্বর মাদ্রাজের এক হত দরিদ্র পরিবারে রামানুজনের জন্ম। পিতা শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার ছিলেন কাপড়ের দোকানে কর্মরত সামান্য কর্মচারী। ছেলেকে বড় করে তুলেছিলেন মূলত মা’ই- কমল্লোতাম্মাল। পারিবারিক সংস্কার তো বটেই, তবু বিশেষ করে মায়ের প্রভাবেই রামানুজন ধর্মাচরণের অভ্যাস শেখেন। অল্প বয়স থেকেই গণিতের প্রতি তার অসম্ভব আকর্ষণ ছিল। বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকার সময়েই, গাণিতিক সমস্যা চর্চায় বিখ্যাত গ্রন্থ ‘A synopsis of elementary results in pure and applied matleamatics’-এর অধিকাংশ প্রবলেম সলভ করে ফেলেন৷
২২ বছর বয়সে সংসারের আর্থিক সংকটের চাপে, স্বল্প বেতনের কাজে যোগ দেন। মন পড়ে থাকে অচেনাকে চেনার, অজানাকে জানার জগতে। তৎকালীন রীতি অনুযায়ী বিবাহ সম্পন্ন হল, স্ত্রী জানকির তখন বয়স ৯ বছর। গণিতের প্রতি তাঁর এই অদম্য ভালোবাসাই একদিন তাঁকে পৌঁছে দেয় কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গনিত বিভাগে। যেখানে হার্ডির সাথে কাজ করে বিখ্যাত বেশ কিছু অবদান রাখেন। রামানুজনই একমাত্র ভারতীয় যিনি ‘Royal Society of Mathematics’ এর সদস্য হয়েছিলেন। বিখ্যাত বিভিন্ন গাণিতিক সুত্র, সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে ক্রমাগত ডুবে যেতে থাকেন নিভৃত গবেষণায়, সেসবের অনেকটাই একান্ত মানসিক চর্চা। এখানেই তার অনন্যতা, যা ইউরোপীয় পন্ডিতদের চোখে বিস্ময় জাগিয়েছিল। বিস্ময়- ম্যাজিক না। পাঠক মনে রাখবেন বিজ্ঞান ম্যাজিক না। বিজ্ঞান হল না জানাকে উপলব্ধির এক সচেতন যাত্রা বিশেষ। প্রথম থেকে শেষ অবধি বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা ও সিদ্ধান্তের পর্যায়ক্রমিক উৎক্রমণ। এমনকি ইতিমধ্যে যা কিছু জানা তাকেও যাচাই’র কষ্টিপাথরে নিক্তি মেপে এগোনই জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রধান বৈশিষ্ট। ভারতে গণিত চর্চার ধারা সুপ্রাচীন একথা ঠিক। কিন্তু সেই ধারা ইতিহাস নির্দিষ্ট একটা পর্যায়ের পরে আর এগোতে পারেনি। কেন পারেনি তা ইতিহাস গবেষণার অন্তর্গত বিষয়। আগ্রহীরা আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের লেখা আ হিস্টরি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি পড়ে দেখতে পারেন। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের পাতা উল্টাতে গিয়ে চরক, শ্রুশ্রুত’দের কৃতিত্ব সম্পর্কে প্রফুল্লচন্দ্র যত বেশি জেনেছিলেন ততই নিশ্চিত হয়েছিলেন সমসাময়িক যুগে রসায়নের জ্ঞানে ন্যুনতম অগ্রগতি ছাড়া চিকিৎসাশাস্ত্রের ঐ উন্নতি ঘটত না।
সেই দুরন্ত অগ্রগতি থমকে গেল কিভাবে? প্রফুল্লচন্দ্রের জাতিয়তাবোধে কোনও ফাঁকি ছিল না। তাই বুঝেছিলেন ইতিহাসকে নির্মোহ চোখেই যাচাই করে নিতে হবে, এই যে নির্মোহের শিক্ষা সেটিই বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয়। তাই ঐ প্রশ্নের উত্তরটি তিনি শুধু খুঁজে পেয়েছিলেন বললে কম বলা হয়, হাজার বছরের ইতিহাসকে বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনায় পরখ করেছিলেন বলেই তিনি কার্যত ঐ উত্তরটি নির্মাণ করেছিলেন।
তিনি লিখছেন- ‘The very touch of corpse, according to Manu, is enough to bring contamination to the sacred person of Brahmin… Anatomy and Surgery fell into disuse and became to all intents and purposes lost science to the Hindus. It was considered equally undignified to sweat away at the forge line a Cyclops. …..The intellectual portion of the community being thus withdrawn from active participation in the arts, the how and why of phenomena- The condition of cause and effect-were lost light of- the spirit of enquiry died out…and India for once bade adieu to experimental and inductive sciences. Her soil was rendered morally unfit for birth of a Boyle, a Descartes or a Newton and her very name was all but expunged from the map of the scientific world.” Secondly, “the Vedanta philosophy as modified and expounded by Sankara, which teaches the unreality of the material world is also to a large extent responsible for bringing the study of physical science into disrepute.’
বিজ্ঞানমনস্কতার বদলে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাব, বস্তুকে প্রকৃত অর্থে জানার চেষ্টায় এগোনর বদলে রহস্যের প্রতি মনোযোগী হয়ে মুর্খের স্বর্গে বসবাসের কামনা এসবই আমাদের পেছিয়ে দিয়েছে। মনুস্মৃতি, শংকরাচার্যের মায়াবাদ এগুলিই আমাদের বিজ্ঞান চর্চার অগ্রগতিকে রুদ্ধ করেছে। বর্ণাশ্রম, জাতিভেদের ন্যায় বিধিনিষেধগুলি আমাদের সমাজে স্থায়ী বন্দোবস্ত হওয়ার পর থেকেই আমরা শ্রমসাধ্য কাজকে মেধার বিপরীত কর্তব্য বলে বুঝতে শিখলাম। যাবতীয় শ্রমসাধ্য বৃত্তিই বংশানুক্রমিক পেশার পরিচয়ে আচ্ছন্ন হল, ক্রমে সেই পরিচিতি সামাজিক মর্যাদাকে কুলীন ও কামীনে ভেঙ্গে দিল। ইন্দ্রিয়াতীত বিষয়সমুহের সুক্ষ জ্ঞানের আতিশয্যে আমরা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুজগতকে অপ্রয়োজনীয় বিবেচনা করলাম। কি হয় থেকে কেমন করে হয়- অবধি পৌঁছানই হল বিজ্ঞানের স্বাভাবিক পরিণতি। যে মুহূর্তে আমরা মস্তিস্ক প্রসুত বিশুদ্ধ জ্ঞানের অনুভবে মজে গেলাম, তখনই যাচাই করে নেওয়ার তাগিদটুকু চলে গেল। যাচাই করে নেওয়ার মধ্যেই থাকে ফলিত জ্ঞানের ভ্রূণ, তা অকালে নষ্ট হল। যে ভেদপন্থা শ্রমকে ঘৃণা করতে শেখাল, সেই উপলব্ধি পরবর্তীকালে মেহনতের কাজ যারা করে তাদের প্রতি অবহেলার শিক্ষাও দিল। এসবের মিলিত প্রভাবেই আমাদের দেশে বিজ্ঞান চর্চায় পরিশ্রমকে ক্রমাগত নিরুৎসাহিত করা শুরু হয়। বস্তু থেকে সরে আসার ফলেই অজ্ঞেয়, অবস্তু অস্তিত্বের প্রতি আমাদের ভয়ানক আকর্ষণ। তাই এদেশে বিজ্ঞান সাধনা ফলিত চর্চার পথে এগোতে পারেনি, রহস্যবাদ-অজ্ঞেয়বাদের প্রভাবে ক্রমশ বস্তুবাদী চেতনা থেকে সরে এসে মেধার নামে আধ্যাত্মবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। ভারতের ইতিহাসে অভিশাপ বলে যদি কিছু থাকে তা আসলে এই। আমাদের পূর্বজরা কিছুদূর অবশ্যই এগিয়েছিলেন- কিন্তু সব কাজ আদৌ শেষ হয়নি।
ভারতীয় বিজ্ঞান চর্চার ধারা-টারা এসব বলে আজ যে সমস্ত আজগুবি গপ্পো হাজির করা হচ্ছে তা হয় অপবিজ্ঞান নাহলে বড় জোর হাতুড়ে বিদ্যার অহমিকা। আজকের যুগে ঐ চর্চায় দেশ তো কোন ছাড় একজন মানুষও এগোতে পারে না, পারবে না।
হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আকুল নেতাগণও খুব ভালো করেই জানেন বিজ্ঞান অযৌক্তিক চিন্তাভাবনাকে ন্যুনতম স্বীকৃতি দেয় না। তবুও তারা এমনটা করেন তার কারণ এটা তাদের ব্যবসা। এই হিন্দুত্ব আসলে ধর্ম বিষয়ক কথাবার্তাই না, যেন তেন প্রকারেণ ক্ষমতাসীন থাকতে গৃহীত রাজনৈতিক কর্মসূচি যার মূলে রয়েছে অন্যের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ। এই ধারা শ্রীনিবাস রামানুজনের না। হিন্দুত্বের রাজনীতি ও বৈজ্ঞানিক চেতনা অনেকটা তেল-জলের মতো ব্যাপার।
১৯২০ সালের ১৬ই এপ্রিল মাত্র ৩৩ ব্ছর বয়সে রামানুজন মারা যান। মানুষের ইতিহাসে গণিত চর্চার ধারায় তার কাজ রয়ে গেছে, যাবে। গণিত সমাজ থেকে ঘৃণা-বিদ্বেষ দাঙ্গা ঘোচাতে পারে না ঠিকই, কিন্তু গনিত একটা কথা অন্তত সদর্পে ঘোষণা করে- যে কোনো সমস্যারই শেষ অবধি একটা সমাধান থাকে।
আর তাই সমস্যা যখন সামাজিক ব্যাধি বিশেষ (জাতি বিদ্বেষের মতো) তার সমাধানই বামপন্থা। তাই কমিউনিস্টদের, বামপন্থীদের ওরা এত ভয় পায়।
আজ আমাদের দেশে নয়া জাতীয় শিক্ষা নীতির নামে যা প্রণীত হয়েছে তার ধাক্কায় প্রথমে দরিদ্র পরিবারগুলি এবং পরে নিম্ন- মধ্যবিত্তরা শিক্ষার অধিকার থেকেই বঞ্চিত হবে। এমনটা চললে আর যাই ঘটুক না কেন ভবিষ্যতের ভারত আর কোনো রামানুজন পাবে না, এটুকু নিশ্চিত। আজকের ভারতে এক রাজ্যের বিদ্যালয়ে শিশুদের শেখানো হচ্ছে সংখ্যালঘুদের প্রতি চূড়ান্ত বিদ্বেষ। হঠাৎ এই প্রসঙ্গ কেন? শ্রীনিবাস রামানুজন নিজেও একান্ত ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু ধর্মের প্রতি তার বিশ্বাস, আস্থা ছিল অনেকটাই মহাত্মা গান্ধীর ন্যায়। শান্তির খোঁজে সহিষ্ণুতার চর্চা। তাই মনে রাখতে হয় গান্ধী হত্যাকারীদের জমানায় রামানুজনরাও নিরাপদ থাকেন না। নরেন্দ্র দাভোলকর, এম এম কালবুর্গী এবং গৌরী লংকেশ’দের খুন হয়ে যাওয়া ইতিমধ্যে সেই বিপদের স্পষ্ট সংকেত দিয়েছে।
চন্দ্রযান ৩ পাঠানো দেশে ক্রমশই কমছে গবেষণা খাতের বাজেট। গবেষণা, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অপ্রয়োজনীয়, কারণ বিজ্ঞান গবেষণার ফলে আদানীদের মুনাফা হয় না। সাবেক পুঁজিবাদে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নতি হলে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় তার প্রয়োগ ঘটত, উৎপাদনের হারে গতি বাড়ত, নতুন করে অনেকে কাজও পেত সেই কারনেই। এসবই বিংশ শতাব্দীতে শেষ হয়ে গেছে, এখন সবটাই ধান্দার বা বলা ভালো লুঠেরা পুঁজি (ক্রোনি ক্যাপিটাল)। এই পুঁজি বিনিয়োগ হয় মানি মার্কেটে, কল-কারখানায় না। এই পুঁজি রাতারাতি নিজের চারপাশে বুদবুদ ছড়ায়, সেসব ফাটলে জনসাধারণের অর্থ,সঞ্চয় সব হাওয়া হয়ে যায়। এরই পোশাকি নাম প্রফিট ডেরিভেটিভ। এমনটা চালিয়ে যেতেই বিনিয়োগ এখন পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট।
বিজ্ঞান, গণিত, প্রযুক্তি সবকিছুর শেষে একটা মূল কথা উঠে আসে। মুক্ত চিন্তা, মুক্ত জীবন।
এমনটা হলে সবচেয়ে বেশি অসুবিধা কার?
মুনাফা, মুনাফা আর মুনাফা।
তাই জীবনদায়ী টিকার উপরেও পেটেন্টের জিভ বুলানো চলে, রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করে দাম বাড়ার জন্য বসে থাকতে হয়।
মুক্ত চিন্তা, সচেতন ভাবনা এবং বিজ্ঞানমনস্কতা এসবের বিরুদ্ধে কথা বলে।
আর তাই ক্রোনি ক্যাপিটাল চায় না বিজ্ঞান চেতনার প্রসার হোক।
এই প্রেক্ষিতেই আমাদের রামানুজন’কে স্মরণ করতে হয়, হবে। ভারতীয় বিজ্ঞান কেন কোনও দেশেরই নিজস্ব, আলাদা বিজ্ঞান বলে কিছু হয় না। জ্ঞান, বিজ্ঞান, কিংবা গণিত মানুষের ধর্ম, বর্ণ, জাতি পরিচিতি কিংবা ভাষা কোনকিছুরই তোয়াক্কা করে না। তা প্রকাশ করে প্রকৃতির নিয়ম- যা পৃথিবীর সকলের জন্যই সত্য, একমাত্র শাশ্বত। শ্রীনিবাস রামানুজন যা করেছিলেন তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব এখানেই। একসময় নীল রক্তের অহমিকায় একদল নিজেদের প্রভু আর অন্যদের নেটিভ বলত, তাদের চোখে চোখ রেখেই রামানুজন ও তার গবেষণা।
আজও একদল নিজেদের অন্ধবিশ্বাসের জোরে প্রভু সাজতে চাইছে। তারাও ভুলে গেছে ইতিহাসে একমাত্র অজেয় বাহিনীর নাম জনগন- যাদের নির্দিষ্ট একটি ভাষা নেই, একরকম পরিধান নেই। গায়ের রং থেকে শুরু করে এক থালায় বেড়ে নেওয়া খাদ্য অবধি বৈচিত্রই তাদের জেতার গ্যারেন্টি।
বিজ্ঞান গবেষণার মূল স্তম্ভ যুক্তি এবং স্বাধীন চেতনা।
সেই অনুভবেই আমাদের জাতীয় গণিত দিবস স্বার্থক হোক।
সেই উপলব্ধিতেই চিরায়ত হন শ্রীনিবাস রামানুজন, তার কৃতিত্ব।
প্রতিবেদনটি কার্যত এক যৌথ রচনা
লিখেছেন-
সরসেন হাজরা, ফ্রান্সের Université de Bourgogne, Dijon-এ ম্যাথামেটিক্যাল ফিজিক্সের গবেষক
সৌভিক ঘোষ, CPI(M) WB ওয়েবডেস্ক
ছবিতে হার্ডির সাথে শ্রীনিবাস রামানুজন - সোশ্যাল মিডিয়া সুত্রে সংগৃহীত