Logo

স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিস্টদের ভূমিকা



“এমন দিনে স্বভাবতঃই দেশবাসী আশা করেন যে তাহাদের দুঃখ দারিদ্রের অবসান হইবে, অগ্রগামী যুব জগতের সঙ্গে তারা একতালে পা ফেলিয়া চলিবেন, শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, সমৃদ্ধিতে তারা সার্থকভাবে মানুষের অধিকারে প্রতিষ্ঠিত হইবেন, স্বাধীনতা দুরগত একটা আদর্শের গন্ডী কাটাইয়া আজ প্রত্যক্ষ ও বাস্তব রূপে তাহাদের নিকট প্রতিভাত হইবে। দুঃখের বিষয়, এ আশা এখনই তাহাদের কাছে দূরে আছে অন্নবস্ত্রের অভাব, জীবিকা ও বাসস্থানের অভাব, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও শান্তির অভাব তাহাদের জীবনে আজ দুঃসহ দুর্বিপাকের সৃষ্টি করিয়াছে। দুর্নীতি, চোরাবাজার, পুলিশি স্বৈরাচার ইহারই উপর তাহাদের দুর্দশা আরো শতগুণ বাড়িয়ে দিয়াছে। এ অবস্থায় যে স্বাধীনতার জন্য দেশবাসী অর্ধশতাব্দীর অধিকার সংগ্রাম করিয়াছেন, জেল-জরিমানা, অনশন, নির্যাতন হাসিমুখে বরণ করিয়াছেন সেই স্বাধীনতা জনগণের মনে আজ স্বাভাবিকভাবেই কোন উল্লাস, কোন উৎসাহ যোগাতে পারিতেছে না। হয়তো সুদীর্ঘ অধীনতা, ঔপনিবেশিক শাসন হইতে মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এত বড় দেশের সর্বোত্তম কি আর্থিক ও সামাজিক উন্নতি প্রত্যাশিত নয় - কিন্তু সেই উন্নতি বিধানের পথে একদিকে যেমন তৎপরতা চাই, অন্যদিকে তেমনি আন্তরিক গরজ চাই, আগ্রহ চাই, ব্যাথিত পতিত বিড়ম্বিত জনগণের জন্য অকৃত্রিম প্রীতি ও সহানুভূতি চাই। সেদিকে লক্ষণীয় কোনো পরিবর্তন দেখা গেলে তবু জনগণ কিছুটা আশ্বস্ত  হইতেন। তাহারও সমূহ অভাব রহিয়াছে। তাই জনগণ আজ নৈরাশ্য ও বেদনায় একেবারেই যেন ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছেন। বড় বড় নেতারা আজ লাট বেলাট, মন্ত্রী, রাষ্ট্রদূত ইত্যাদি হইয়াছেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও বিশ্বপ্রেমের পটভূমিতে স্থাপিত করিয়া তাদের বিবৃতি ও বক্তৃতার  বান ডাকাইতেছেন - দরিদ্র মানুষ, সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের দুঃখ বেদনা এইসব বড় বড় চিন্তার মধ্যে কোথায় স্থান পাইবে? যাহাদের ত্যাগ ও দুঃখ বরণের দ্বারা স্বাধীনতা অর্জিত হইয়াছে, স্বাধীন  ভারতে আজ শাসনতান্ত্রিক জাঁক জমকের আড়ালে কোথায় যেন তাঁহারা চাপা পড়িয়া গিয়াছেন।”

মনে হবে এটা হাল আমলের কোন উক্তি কিংবা কোন সংবাদপত্রের সম্পাদকের বিশ্লেষণ।  স্বাধীনতার ৭৪ বছর পর প্রকৃত চিত্র এর চেয়ে অনেক বেশি নিষ্ঠুর, অনেক বেশি বীভৎস।  প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন ৬ দশকে কংগ্রেস দল সরকার পরিচালনায় যা করতে পারেনি ৬ বছরে তাঁর সরকার তার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করে দেখিয়ে দিয়েছে। বিপরিত ও প্রকৃত চিত্র উপরোল্লিখিত এই মন্তব্যে পরিস্ফুট। এই বিশ্লেষণ খ্যাতনামা কংগ্রেস নেতার পরিবারের পরিচালিত সংবাদপত্র যুগান্তর পরিবারের।  প্রকাশিত হয়েছে স্বাধীনতার পর কংগ্রেস শাসনের ১০ মাসের মাথায় ১৯৪৮ সালের ২৩ শে জুন।  তারপর থেকে ৭২ বছর পার হয়েছে। আজ ২০২০ সালে ভারতীয় জনগণ আর্থিক-সামাজিক সমস্ত দিক থেকে ১৯৪৮  সালের চেয়ে বহু বহু গুণ বেশি বিপদে জর্জরিত।

New Delhi: Migrant workers along with their family members walk to their native village during a nationwide lockdown, imposed in the wake of coronavirus pandemic , at NH 24 near Akshardham in East Delhi, Sunday, March 29, 2020. (PTI Photo/Manvender Vashist)(PTI29-03-2020_000144B)

দানবীয় শাসনে আজ ভারতীয় সাধারণতন্ত্র ধ্বংসের মুখে। ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, জাত, শিক্ষা - সংস্কৃতিতে বৈষম্য বিভাজনকে পরিকল্পিত রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বলপ্রয়োগে তীব্র থেকে তীব্রতর, প্রশস্ত থেকে আরও প্রশস্ত করার যজ্ঞ চলছে।

১০০ বছর আগে ভারতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটানোর সংকল্প ও লক্ষ্য নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন সম্পূর্ণ নতুন এক আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ধারা তৈরি করে।  প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত কয়েক হাজার বছরে সমাজ ও ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন। কিন্তু প্রাচীনকাল থেকে নিপীড়ন ও অত্যাচারে যাদের জীবন ভারাক্রান্ত, সেই ব্যবস্থাই আজ পর্যন্ত বজায় রয়েছে। শোষণ ও অত্যাচারের মধ্যেও সেই সব প্রতিবাদ ও প্রতিবাদী মতাদর্শের ধারা বয়ে চলেছে।

দিশাহীন নেতৃত্বে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি  এই অচলায়তন ভাঙার জন্য। রবীন্দ্রনাথ  ‘লোকহিত’-এ “আমরা ভৃত্যকে অনায়াসে মারিতে পারি, প্রজাকে অনায়াসে অতিষ্ঠ করিতে পারি,  গরিব-মূর্খ কে অনায়াসে ঠকাতে পারি- নিম্নতনদের সহিত ন্যায় ব্যবহার করা,  মানহীনদের সহিত শিষ্টাচার করা, নিতান্তই আমাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। অপর পক্ষের শক্তির পরে নহে - এই জন্য আমাদের দরকার হইয়াছে নিম্নশ্রেণিয়দের শক্তিশালী করা। সেই শক্তি দিতে গেলেই তাহাদের হাতে এমন একটা উপায় দিতে হইবে যাহাতে ক্রমে তাহারা পরস্পর সম্মিলিত হইতে পারে”।  তিনি প্রয়োজনের কথা বলেছেন, সমৃদ্ধ করার উপায় হিসাবে বিশেষ রাজনৈতিক সামাজিক শক্তির অপরিহার্যতার কথা বলতে পারেননি। এই শোষণমূলক নিষ্ঠুরতা, সমাজব্যবস্থার নগ্নতার রক্ষার জন্য ধর্ম, আইন-শৃঙ্খলা, শক্তির প্রতি অসীম আস্থা ও প্রশ্নহীন আনুগত্যের দোহাই বিরামহীন চলছে তো চলছেই। তার জন্য শাসকদের নামে কতই না সুশোভন পদবীর আস্তরণের প্রলেপ দেওয়া হয়। নিপীড়িত জনগণের সুদীর্ঘ লড়াইয়ের ঐতিহ্য  ও ধারাবাহিকতায় এই অচলায়তন ভেঙে শ্রমজীবী জনগণের নিজেদের এক সমাজ ব্যবস্থা করতে সম্মিলিত সংগ্রাম এর শক্তি হিসেবে জন্ম নেয় কমিউনিস্ট পার্টি। এই পার্টি কখনোই গোপন করে না যে তারা পূঁজির মালিক ও জমিদারের বিরুদ্ধে আপোষহীন লড়াইয়ের সাথেই শ্রমিক-কৃষক নিম্নশ্রেণির স্বার্থপরক্ষার প্রশ্নেও অবিচল ।  এই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যেই তার সংগঠন, তার রাজনীতি, তার মতাদর্শ, তার নিঃস্বার্থ অবদান, তার অকুন্ঠ দেশপ্রেম ও আন্তর্জাতিকতাবাদ। ১০০ বছর ধরে অধ্যবসায় ও আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে একবিংশ শতাব্দীতে ভারতীয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের অভিমুখে তারা বর্তমান সংগ্রাম পরিচালিত করে চলেছে।

স্বাধীনতা সংগ্রামে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতায় সব রকমের আপোষকামিতা, সুবিধাবাদ, সংস্কারবাদ ও সংকীর্ণতাবাদ - এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লড়াইয়ের শিক্ষা থেকে বিভিন্ন স্রোতের সেরা ও সবচেয়ে যোগ্য স্বাধীনতাযোদ্ধারা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়।  কৃষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াই পরিচালনা করে একমাত্র কমিউনিস্টরাই। তার জন্য হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের পরাজয়ের পর দেশজুড়ে শ্রমিক, কৃষ্‌ক, নাবিক ও অন্যান্য জঙ্গী আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল কমিউনিস্টরা, এই সময় ব্রিটিশদের নৃশংসতা তাদের ওপর আরো বৃদ্ধি পায়। সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করার জন্য হিটলারের শক্তি যখন রাশিয়ায় ঢুকে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ করছে তখনই কংগ্রেস আহূত ১৯৪২- এর আন্দোলন লড়াইয়ের নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তারের পর নিস্তেজ হয়ে যায়। ১৯৪৭ সালের আপোষমূলক স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগের পাঁচ বছর ধরে কংগ্রেস আর কোন আন্দোলন করেনি। কংগ্রেস  নেতৃবৃন্দের মুক্তি এবং আজাদ হিন্দ ফৌজ-এর মুক্তির জন্য কমিউনিস্টরাই সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে লড়াইয়ের ঐতিহ্যের অধিকারী। কমিউনিস্ট পার্টি নিজের প্রতিষ্ঠার এক বছরের মধ্যে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রথমবার দাবি তুলে গোটা দেশে সাড়া জাগায়। এর চাপে কংগ্রেস পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানায় প্রায় দশ বছর পর ১৯৩০ সালে।

স্বাধীনতার দীর্ঘ সাত দশক ধরে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই থেকে কখনও এক মুহূর্তের জন্যেও কমিউনিস্টরা বিরত হয়নি। দেশে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অবস্থান নিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিশ্রুতি পালনের জন্যও সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসে। ১৯৩১ সালে কংগ্রেসের করাচি অধিবেশনে স্বাধীনতার পর সামাজিক বৈষম্য দূর, মৌলিক অধিকার, শ্রমিক কৃষকদের দাবি পূরণের ঘোষণা গৃহীত হয়েছিল। এই প্রতিশ্রুতি সাধারণতন্ত্রী সংবিধানে লিপিবদ্ধ হলেও কার্যকর হয়নি যার জন্য কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা আজও লড়াই করে চলেছে।

Jyoti Basu while movement

সবকটি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রশ্নে বিকল্প নীতির ভিত্তিতে ১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হওয়ার পরেও সিপিআই(এম) একটানা লড়াই চালিয়ে আসছে, ঐসব প্রশ্নে সিপিআই(এম)’র অবস্থান বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলির দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত। সার্বিক ভূমি সংস্কার না হলে এবং শ্রমিক কৃষকদের মৌলিক দাবি পূরণ না হলে দেশের সমৃদ্ধি মুখ থূবড়ে পড়বে এবং সাম্প্রদায়িকতা ও বৈষম্যের বিপদ দূর করা যাবে না - স্বাধীনতা আন্দোলনে ও পরবর্তী সময়ে এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে কমিউনিস্টরা লড়াই চালিয়ে গেছে। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে সব ধর্মের সমান অধিকারের ভ্রান্ত ধারণার পরিবর্তে রাজনীতি থেকে ধর্মকে সম্পূর্ণ পৃথক করে তা আইনসিদ্ধ করার দাবি কমিউনিস্টদেরই।

রাজনৈতিক স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য এবং স্বৈরাচারী আইন ও কার্যকলাপের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কমিউনিস্টরা সবসময় অবিচলিত এবং অগ্রণী। ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠন, নারীর অধিকার সুরক্ষিত করে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশকে সমৃদ্ধির পথে শক্তিশালী করার জন্য কমিউনিস্টদের আন্দোলন - সংগ্রামের অবদান উল্লেখযোগ্য। মহিলাদের সমান অধিকার, আর্থিকভাবে স্বাবলম্বীকরণ,  শিশু ও মহিলাদের ওপর নির্যাতন বন্ধে সরকার, প্রশাসন ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলির দায়-দায়িত্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি নারীশক্তি উত্থানের আন্দোলনেও অগ্রণী শক্তি কমিউনিস্টরা। জাতি বৈষম্য,  লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে অর্জিত অধিকারগুলিকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করতে বর্তমান স্বৈরাচারী সরকার উঠে পড়ে লেগেছে।

স্বাধীনতার পরে রাষ্ট্রের চরিত্র এবং বুর্জোয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় নিয়েই কমিউনিস্ট পার্টিতে এক দশক ধরে মূল বিতর্ক এবং পরিণামে পার্টি ভাগ হয়। পুঁজিবাদী বিকাশে বুর্জোয়া জমিদারদের স্বার্থরক্ষার পাশাপাশি শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষের দাবী আদায়ে বিভিন্ন আন্দোলনের ফলে সময়ে সময়ে কিছু পূরণ হয়। কিন্তু এই সময়ে শাসকগোষ্ঠী সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সহযোগিতার পথ ধরেও চলে। তিন দশক আগে শুরু হওয়া নয়া উদারীকরণের রাজত্ব বিশ্বব্যাপী সংকটের সমাধান হিসেবে একনায়কতন্ত্রী স্বৈরাচারী শাসনের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। তারই ফসল মোদি সরকারের লাগামহীন ফ্যাসিস্ট সুলভ অভিযান। একমাত্র কমিউনিস্টরাই এই সর্বনাশা নয়া উদার নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই চালিয়ে আসছে।  গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সাধারণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষার জন্য আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে কমিউনিস্টরাই ছিল - আজও রয়েছে।

এত কুৎসা-বিদ্বেষ এবং আক্রমনেও কমিউনিস্টের নিজেদের নীতি-আদর্শ থেকে একচুলও টলাতে পারেনি। তাদের মতাদর্শ ও নীতির রাজনৈতিক প্রভাবকে সংগঠনে সংহত করার কাজ দুর্বল ভাবে হলেও সমাজের আমূল পরিবর্তনে কমিউনিস্ট পার্টির পথ অনন্য, অদ্বিতীয় ও বিকল্পহীন - এই  অভ্রান্ত  রূপ নিচ্ছে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন