ওয়েব ডেস্ক প্রতিবেদন
১১,১৯,৪১২ জন মোট আক্রান্ত, ৩,৯০,৮৪৯ সক্রিয় বা এ্যাক্টিভ কেস, সুস্থ হয়েছেন ৭,০০,৬৪৭জন ও মৃত২৭,৫১৪। ২০ জুলাই বিকেল অবধি ভারতের কোভিড চিত্র এইরকম। বিহারে আবার বাকি জুলাই মাস জুড়ে লকডাউন চলছে।ইতিমধ্যেই অমিতাভ থেকে আরাধ্যার করোনা সংক্রমণ নিয়ে মিডিয়াতে খবরের অন্ত নেই। তবে একটা জিনিস মোটামুটি সবাই বুঝে গেছে - অন্তত আশা করা যায়- থালা, ঘন্টা বাজিয়ে , প্রদীপ জ্বালিয়ে, আকাশে টিপ করে টর্চ জ্বালিয়ে করোনা ঠেকানো যায়না। অতএব উপায় হয় ভ্যাকসিন নয় ওষুধ।ভ্যাকসিন নিয়ে দুমদাড়াক্কা মন্তব্যের পরে আপাতত আইসিএমআর ও সরকার চুপচাপ রয়েছে। শেষ যা খবর ভারত বায়োটেক তাদের প্রথম পর্যায়ের মানব দেহে প্রয়োগের কাজ সবে শুরু করতে পেরেছে। অগতির গতি ওষুধ। কিন্তু এখনও অবধি বিশ্বের কোন দেশে এমন কোন একটা ওষুধের সন্ধান পাওয়া যায়নি যা করোনা থেকে ১০০ শতাংশ না পারুক অন্তত ৪০ শতাংশ রোগীকে সুস্থ করতে পেরেছে এটা বলা যাচ্ছে।
বিভিন্ন ধরণের ওষুধ নিয়ে বিভিন্ন রকমের প্রয়োগ চলছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত বিজ্ঞানের ১৮০ ডিগ্রী উল্টো দিকে থাকা লোক হঠাৎ দাবি করে বসল হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনে সুফল মিলছে, ব্যাস আমাদের দেশেও শুরু হল তৎপরতা - বিশ্বের সর্বোচ্চ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন উৎপাদক আমরাই। ট্রাম্প হুমকি দিল হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন না দিলে ভারতকে দেখে নেবে, আমাদের ৫৬ ইঞ্চি ছাতিও ক্ষীণ কন্ঠে সায় দিল হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন দিতে। WHO ট্রায়াল শুরু করল, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এই ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে একাধিক রিপোর্ট প্রকাশের পরে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের হাইপ এখন অনেকটাই কমে গেছে। তবে ভারতে আইসিএমআর এখনও দাবি করছে সামান্য থেকে মাঝারি উপসর্গ যুক্ত রোগিদের ক্ষেত্রে এই ওষুধ নাকি কাজে দিচ্ছে। ভারতের মত দেশে স্বল্প মূল্যের হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন বাস্তবে কার্যকর হলে সেটা নিঃসন্দেহে ভালো। কিন্তু সংক্রমণ যে হারে বাড়ছে ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার ও ইন্টেনসিভ কেয়ার রোগীর সংখ্যা ও মৃতের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে তা ভারতের জনসংখ্যা বা জনঘনত্বের তুলনায় খুব নগন্য হলেও সংখ্যার হিসাবে ও হাসপাতালের পরিকাঠামোর বাস্তবতায় দুশ্চিন্তার বিষয়।
জটিল,অতি জটিল কোভিড রোগিদের ক্ষেত্রে বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর অনুকরণে রেমডেসিভির ও টসিলিজুম্যাব নামের দুটো ওষুধের প্রয়োগ করা হচ্ছে ভারতে। তবে সার্বিকভাবে সবাই যে এই ওষুধ ব্যবহার করতে পারবেন এমন নয়।শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় এই ওষুধদুটো কিভাবে কাজ করে তার বিস্তারিত ব্যাক্ষাতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
রেমডেসিভির একটি এ্যান্টি ভাইরাল (এ্যান্টি বায়োটিক নয়) বা ভাইরাস নাশক ওষুধ যেটা তৈরি করা হয়েছিল মূলতঃ হেপাটাইটিস সি এর জন্য, পরবর্তীতে ইবোলা বা মারবার্গ ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে এটা প্রয়োগ করা হয়, কিন্তু কোনটির ক্ষেত্রেই এই ওষুধ কার্যকর ফলাফল দেয়নি। তবে সার্স ও মার্স করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে এর কিছুটা কার্যকর ভূমিকা লক্ষ্য করতে পারায় মার্কিন ওষুধ সংক্রান্ত নির্ধারক সংস্থা এফডিএ (ফেডেরাল ড্রাগ এ্যাডমিনিস্ট্রেশান)শুধুমাত্র মহামরি বা সমতুল্য বিশেষ পরিস্থিতিতে এই ওষুধের ব্যবহারের অনুমতি দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক ওষুধ ও বায়োটেকনোলজি সংস্থা জিলিয়াড সায়েন্সেস এর হাতে রয়েছে এই ওষুধের পেটেন্ট। আমেরিকা ও ইউরোপের কিছু দেশে এই ওষুধে কোভিডের ক্ষেত্রে কিছু সুফল মেলায় ভারতে কোভিড পরিস্থিতিতে এই ওষুধ ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সিপলা ও হেটেরো নামক দুটো ভারতীয় ওষুধ সংস্থা ভারতে এই ওষুধ বিক্রি করছে। এখনও অবধি পাওয়া তথ্য অনুসারে জটিল ও অতি জটিল কেসের ক্ষেত্রে রোগী ৪টে ভায়াল ইঞ্জেকশন প্রয়োজন পরে। প্রতি ভায়ালের ভারতে অনুমোদিত দাম ৪,০০০ থেকে ৫,৪০০ টাকা মানে রোগী পিছু স্রেফ ইঞ্জেকশনের খরচা ১৬,০০০ থেকে ২১,৬০০ টাকা ! আর ইতিমধ্যেই খবর যে ভায়াল পিছু ৬০,০০০ টাকাও নেওয়া হচ্ছে মুম্বাই, দিল্লির মত শহরে।
টিসিলিজুম্যাব ওষুধটি হল ইমিউনোসাপ্রেস্যান্ট বা অনাক্রম্যতা রোধক গোষ্ঠীর।কোভিড রোগীদের ক্ষেত্রে অনেকসময় সংক্রমণ এমন পর্যায়ে পৌছায় যে দেহের অনাক্রম্যতার ক্ষমতা বা ইমিউনিটি দেহ কোষের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করে।এই ওষুধটা সেই সময়ে ব্যবহার করলে কিছু ক্ষেত্রে সুফল মিলেছে। যদিও সেই হার শতাংশের হিসাবে খুবই কম। বহুজাতিক উষুধ সংস্থার রশে (Roche)এর এই ওষুধটার যে মাত্রা বলা হচ্ছে সঙ্কটগ্রস্ত ও অতিসঙ্কট গ্রস্ত রোগীদের ক্ষেত্রে তার দাম প্রায় ৮০,০০০টাকা। বহুক্ষেত্রে ওষুধ ব্যবসায়ীরা মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ৯০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ টাকাও দাম হাঁকাচ্ছে। গ্লেনমার্ক ফার্মাসিউটিক্যালস এর ফ্যাবিরাভিপিরও একটি এ্যান্টি ভাইরাল ওষুধ- ১৪ দিনের জন্য এই ওষুধটি খরচা পড়ছে ১২,৫০০টাকা। এই ওষুধটির প্রয়োগ ও দাম নিয়ে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে ভারতের ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনেরালের দফতর।
এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনেরালের দফতর থেকে আরেকটি ওষুধকে কোভিড-১৯ মোকাবিলার জন্য ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে- ইটোলিজুম্যাব । বায়োকন সংস্থার এই ওষুধটিও ইমিউনোসাপ্রেস্যান্ট গোষ্ঠীর যা দেহে অতিরিক্ত সাইটোকাইন ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে ফুসফুস,কিডনিতে রক্ত জমাট বাধা ও মাল্টি অর্গ্যান ফেলিওর নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, অন্তত সংস্থার তরফে এমনটাই দাবি। সব মিলিয়ে মাত্র ৮০জন(অন্য একটা সূত্র মতে ১৫০ জন) কোভিড আক্রান্তের ওপরে প্রয়োগের ভিত্তিতে এই ওষুধটিকে ছাড়পত্র দেওয়া হল। ২৫মি.গ্রা/৫মি.লি এক একটা ভায়ালের দাম ৮,০০০ টাকা। রোগীর পরিস্থিতি বুঝে ৪ থেকে ৬ ভায়াল ইঞ্জেকশান লাগতে পারে।মানে ৩২হাজার থেকে ৪৮হাজার টাকা খরচ এক এক জন রোগী পিছু।
কাঁসর,ঘন্টা,টর্চের পরে মানুষ এখন ওষুধের জন্য হন্যে হয়ে পড়ছেন কিন্তু বহুজাতিক মুনাফাবাজ ওষুধ সংস্থাগুলো এবং ওষুধ ব্যবসায়ীদের আঁতাতের ফলে সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে দাম চলে যাচ্ছে ওষুধগুলোর। অথচ ব্রিটেনের সাম্প্রতিক একটা বিস্তারিত রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ডেক্সামিথাসোন কোভিড রোগীদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি কার্যকর হয়েছে। একেক জন কোভিড রোগীর ক্ষেত্রে যে মাত্রার ডেক্সামিথাসোন প্রয়োগ করতে হবে তার দাম পড়বে মাত্র ১০টাকা ! আশ্চর্যের বিষয় হল ভারতের মত দেশে এই ওষুধটি নিয়ে ততটা চর্চা নেই যতটা এর থেকে অন্তত হাজার গুণ বেশি দামি ওষুধগুলো নিয়ে চর্চা আছে। আরো আশ্চর্যের বিষয় যে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে ঘোষণা করতে হয় ৮০ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে নভেম্বর মাস অবধি রেশান দেওয়ার কথা সে দেশে এই মহামারির সময়ে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের কোন সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন তৈরি করা হয় না ।