০৫/০৮/২১ ( বৃহস্পতি বার)
কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা,ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের পথিকৃৎ, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীরযোদ্ধা কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ আজ আর আমাদের মধ্যে নেই।১৮ই ডিসেম্বর সূর্যোদয়ের প্রারম্ভেই তাঁর জীবন প্রদীপ নিভে গিয়েছে। কিন্তু যে মহান আদর্শের, কমিউনিজমের আদর্শের দীপ তিনি ভারতের মাটিতে জ্বেলেছিলেন সেই দীপ নেভেনি, নিভতে পারেনা। সেই আদর্শের দীপশিখা আমাদের জীবনে,ভারতের মেহনতী মানুষের জীবনে,শ্রমিক-কৃষকের জীবনে অনির্বান হয়ে রয়েছে,অনির্বান হয়েই থাকবে।
আজ কমরেড মুজফ্ফর আহমেদের স্মরণ সভায় বজ্রকণ্ঠে আমরা এই কথাই ঘোষণা করতে চাই যে, আমাদের জীবনে কমিউনিজমের আদর্শের দীপশিখা কোনোদিন নিভবে না,শ্রেণী সংগ্রামের বন্ধুর,দুর্গম পথে সেই দীপশিখাই স্ফুলিঙ্গ হয়ে উঠবে, সৃষ্টি করবে বিপ্লবেরই বহ্নিশিখা। কমরেড মুজফ্ফর আহমেদের জীবনাবসানে আমরা শোকাচ্ছন্ন,বিয়োগব্যথায় হৃদয় আমাদের ভারাক্রান্ত,আমরা ব্যথিত,ব্যাদনাহত কিন্তু শোকে আমরা মুহ্যমান নই। তাঁর আরোদ্ধ কাজকে সার্থকতার পথে, সফলতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার,তার শিক্ষাকে বাস্তবায়িত করার শপথ গ্ৰহণনের জন্যই আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি।
কমরেড মুজফ্ফর আহমদ তাঁর জীবন-সংগ্রামের দৃষ্টান্ত দিয়ে আমাদের এই শিক্ষাই দিয়েছেন যে ,কমিউনিস্টরা হচ্ছে এক বিশেষ ধাঁচে গড়া মানুষ এক বিশেষ উপাদানে তৈরি, আদর্শে যাঁরা অটল ,শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তি সংগ্রামের বীর সৈনিক তাঁরা, প্রলেতারিয়েতের সুমহান সংগ্রাম - বিজ্ঞান মার্কসবাদ-লেলিনবাদ আয়ত্ত করতে তাঁরা , দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং নিজ নিজ দেশের বাস্তব পরিস্থিতে সেই সংগ্রাম - বিজ্ঞান প্রয়োগে তারা শ্রেষ্ঠ রণকুশলী । কমরেড মুজফ্ফর আহমদ - এর সংগ্রামী জীবনের এই মহান শিক্ষাকে আমাদের জীবনে সমুজ্জ্বল করেই রাখবো- এই শপথই আজ আমরা গ্রহণ করেছি।
কমরেড মুজফ্ফর আহমদ সারা জীবন ধরে ভারতের বুকে রক্ত পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে রেখেছিলেন। সেই পতাকার শুচিতা ,শুভ্রতাকে চোখের মণির মতন রক্ষা করেছিলেন। শত ঝড়ঝঞ্জা , বাঁধা বিপত্তি দুঃখকষ্ট এবং শাসক ও শোষকের নিষ্ঠুর নিপীড়নের মধ্যেও সেই রক্ত পতাকার উপর তার ব্রজমুষ্ঠি একদিনের জন্যও শিথিল হয়নি। শ্রমজীবী মানুষের সেই
সুমহান পতাকার আদর্শ কে আমরা কোথাও ম্লান হতে দেব না, সেই পতাকার আদর্শ কে আমাদের দেশে আমরা গৌরবজ্জ্বল করে তুলবো: সেই রক্ত পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেই আমরা এগিয়ে যাবো শ্রমিক -কৃষকের , মেহনতি মানুষের মুক্তির পথে।
আমরা লক্ষভ্রষ্ট , পথভ্রষ্ট হব না। কমরেড মুজফ্ফর আহমদ -এর স্মৃতির উদ্দেশ্যে আমরা এই শপথই গ্রহণ করছি।
সারা জীবন ধরে কমরেড মুজফ্ফর আহমদ সংগ্রাম করেছেন প্রলেতারিয় আন্তর্জাতিকতাবাদের জন্য। প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শকেই তিনি সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছিলেন।
প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শকে বর্জন করতে এবং উগ্র জাতীয়তাবাদের কাছে নতি স্বীকার করতে অস্বীকার করার জন্য চীন- ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ এর দিনগুলিতে তিনি বুর্জোয়া শাসক আর তাদের রক্ষিত পত্রিকাগুলি কর্তৃক "দেশদ্রোহী" বলে চিহ্নিত হয়েছিলেন। এবং ভারত রক্ষা আইনে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। শ্রেণীশত্রুর তীব্র আক্রমণকে উপেক্ষা করে প্রলেতারিয় আন্তর্জাতিকতাবাদের মহান আদর্শই তিনি প্রচার করে গেছেন। বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের বর্তমান সমস্যার দিনে সেই প্রলেতারিয় আন্তর্জাতিকবাদের আদর্শকে দীপ্যমান করে তোলার অঙ্গীকারী আমরা করছি।
কমরেড মুজফ্ফর আহমদ তার জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে আমাদের এই শিক্ষাই দিয়েছেন যে, শ্রেণীসংগ্রাম কে সম্প্রসারিত করে নিয়ে যেতে হবে শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার দিকে। তিনি আমাদের এই শিক্ষাই দিয়েছেন যে, পার্লামেন্টারি নির্বাচনের গুরুত্ব আমরা অস্বীকার করি না। নির্বাচনের ভিতর দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির ভাবধারা প্রচারিত হবে, পার্টির প্রভাব হবে প্রসারিত। তিনি আমাদের আরও স্বরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, নির্বাচনে আমরা যদি কোন রাজ্যে সংখ্যাধিখ লাভ করি তবে আমরা সেই রাজ্যে সরকারও গঠন করব এবং সেই সরকার কে সংগ্রামের সহায়ক শক্তি হিসাবে ব্যবহার করবো। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য ও কমিউনিস্ট যদি ভাবেন যে , তিনি লক্ষ্যে পৌঁছেছেন তবে তিনি কমিউনিস্ট আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবেন।
কমরেড মুজফ্ফর আহমদ এর এই শিক্ষা আমাদের জীবনে ধ্রুবতারার মতই জ্বলতে থাকে - এই শপথই আমরা আজ গ্রহণ করছি।
কমরেড মুজফ্ফর আহমদ পার্টি গড়ার কাজে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অক্লান্তভাবে দিনের পর দিন আমাদের এই কথাই বুঝিয়েছেন যে ,পার্টিকে আরো সংহত করতে হবে। তিনি বলতেন - "আমাদের পার্টিকে আরো সংহত করতে হতে হবে; পার্টির কায়দা-কানুনের বাঁধন কে আরও মজবুত করতে হবে; পার্টির সভ্যদের জীবন সৈনিকের জীবন আজকের দিনে পার্টি সভ্যদের মনে এটা যদি একান্ত চিন্তা না হয় তাহলেস চারিদিকের আক্রমনের ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। " কমরেড মুজফ্ফর আহমদ তোমার কাছে আমাদের শপথ : তোমার ঐ নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো, পার্টি-সংগঠনকে আরো সংহত করে পার্টিকে আমরা ইস্পাতের মত দৃঢ় করবো।
ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও বুর্জোয়া -জমিদার শাসনকে ধ্বংস করার এবং আমাদের দেশে সমাজতন্ত্র ও কমিউনিস্ট সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে একটি জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার শক্তিশালী হাতিয়ার হিসাবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের প্রতি বিশ্বস্ত এক শক্তিশালী পার্টি গড়ে তোলার জন্য তিনি সংগ্রাম করে গেছেন। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটেছে সত্য কিন্তু স্বাধীন ভারতে বৃহৎ বুর্জুয়া নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বুর্জুয়া জমিদার রাষ্ট্র। অসমাপ্ত রয়ে গিয়েছে গণতান্ত্রিক বিপ্লব। দেশ স্বাধীন হবার পর সেই অসমাপ্ত গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সমাপ্ত করার কাজেই আত্মনিয়গ করেছিলেন কমরেড মুজাফফর আহমেদ। কিন্তু সেকাজের সমাপ্তি তিনি দেখে যেতে পারলেন না। কিন্তু মার্কসবাদ লেনিনবাদের প্রতি বিশ্বস্থ যে পার্টির পুরোভাগে তিনি ছিলেন সেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদীর পক্ষ থেকে আজ আমরা শপথ গ্রহণ করছি-কমরেড মুজাফফর আহমেদ তোমার আরোদ্ধ কাজ সমাপ্ত করার অভিযানেই আমরা এগিয়ে যাবো বলসেবিক দৃঢ় সংকল্প নিয়ে।
কমরেড মুজাফফর আহমেদ আজ আমাদের মধ্যে নেই। মৃত্যু তাকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে কিন্তু যে আদর্শের জন্য তিনি সারাজীবন সংগ্রাম করে গেছেন সেই কমিউনিজমের মৃত্যু নেই,আদর্শের মৃত্যু নেই। কমিউনিজমই আগামীদিনের মানব জাতির ভবিষ্যৎ।
সেই কমিউনিজমের আদর্শের মধ্যেই কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদ চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন।
তাই মরণেও কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদ অমর হয়ে রইলেন।
কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদ জিন্দাবাদ। কমিউনিজম জিন্দাবাদ।
[কমরেড মুজাফফর আহমেদ স্মরণে ২২ডিসেম্বর শহীদ মিনার ময়দানে অনুষ্ঠিত স্মরণ সভায় সভাপতির ভাষণে কমরেড প্রমোদ দাসগুপ্ত লিখিত এই ভাষণটি পাঠ করেন]