Site icon CPI(M)

May Day: A Look Back

মে দিবস ও শ্রমজীবি নবযুগের জন্ম

মানবসভ্যতা প্রতিদিন একটু একটু করে এগিয়ে যায় শ্রমিকের রক্ত জল করা ঘামে।এই সভ্যতা তৈরিই হয়েছে শ্রমের বিনিময়ে। তাই এই সভ্যতার ইতিহাসে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে আছে শ্রমিক শ্রেণি। শিল্প বিপ্লবের পর বিশ্বের নানান প্রান্তে শ্রমঘন এলাকা তৈরি হয়েছে, যেখানে বিপুল পরিমাণ শ্রমিক একটি কারখানা বা শিল্পকে কেন্দ্র করে একত্র হয়েছে। শ্রমিক শ্রেণির নিজেদের অধিকার আদায়ের প্রয়োজনে সংঘবদ্ধ হয়েছে, শ্রমিক ইউনিয়ন হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে দীর্ঘদিন ধরে পৃথিবীজুড়ে শ্রমিকের কর্মঘন্টার ব্যাপারটি সুরাহা হয়নি, বৃহৎ পুঁজির অধিকারি মালিকপক্ষ ঠিক করে দিয়েছে শ্রমিকেরা কত ঘন্টা কাজ করবে।

১৮০৬ সাল। ষড়যন্ত্রের অভিযোগ মামলা চলছে ফিলাডেলফিয়ার ধর্মঘটী জুতা শ্রমিক নেতাদের বিরুদ্ধে। এই মামলায় ফাঁস হয়ে গেলো যে, কারখানা মালিকরা শ্রমিকদের ঊনিশ থেকে বিশ ঘণ্টা পর্যন্ত খাটিয়ে মারে। তখনকার প্রচলিত অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী দিনের কাজের ঘণ্টা ছিল সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। এর প্রতিবাদে ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকেই প্রতিবাদ জানায় যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকরা। ১৮২০ সাল। আমেরিকায় বিভিন্ন শহরে ছোট-ছোট স্থানীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো একত্র করে একটা ফেডারেশন গঠনের চেষ্টা করা হয়। ১৮৪০ সাল পর্যন্ত ২০ বছর ধরে কাজের ঘণ্টা কমাবার দাবিতে ধর্মঘটের পর ধর্মঘট চলতে থাকে। অনেক শিল্পকেন্দ্রে দৈনিক দশ ঘণ্টা কাজের নিয়ম চালু করার সুনির্দিষ্ট দাবি তোলা হয়। ১৮২৭ সালে বিশ্বের প্রথম ট্রেড ইউনিয়নের জন্ম হয় ফিলাডেলফিয়ার গৃহনির্মাণ শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের উদ্যোগে। ওই শ্রমিকরা তখন দৈনিক দশ ঘণ্টা কাজের দাবিতে ধর্মঘট করেছিলেন। ১৮৩৪ সালে নিউইয়র্কে রুটি শ্রমিকরা ধর্মঘট করেন। এ ব্যাপারে ‘ওয়ার্কিং মেনস অ্যাডভোকেট’ এ লেখা হয়, “মিশরে যে ক্রীতদাস ব্যবস্থা চালু আছে তার চাইতেও দুঃসহ অবস্থার মধ্যে রুটি কারখানার কারিগররা বছরের পর বছর কাটিয়ে থাকেন। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে গড়ে আঠারো থেকে বিশ ঘণ্টা ওদের খাটতে হয়।”

এইসব অঞ্চলে ১০ ঘন্টা কাজের দিনের দাবি দ্রুতগতিতে একটা আন্দোলনের আকার ধারণ করল। ১৮৩৭ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময়ে এই আন্দোলন গতি হারায়। তবুও রাষ্ট্রপতি ভ্যান ব্যুরেনের আমলে আমেরিকার সরকারি কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের জন্য ১০ ঘন্টা কাজের দিন বেঁধে দিতে সরকার বাধ্য হয়। এই আইন সমস্ত ক্ষেত্রে প্রসারিত করার সংগ্রাম পরবর্তী যুগে একটানা গতিতে চলতে থাকে। কয়েকটা শিল্পে এই দাবি স্বীকৃত হবার সাথে সাথে শ্রমিকরা দৈনিক আট ঘন্টা কাজের নিয়ম চালুর দাবি তোলেন। ১৮৫০ সাল থেকে ট্রেড ইউনিয়ান গঠন নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ দেখা দেয় এবং ৮ ঘন্টা কাজের দাবি আরো জোরালো হয়। ১৮৫৭ সালের মার্কিন আর্থিক মন্দা(Panic of 1857) এই আন্দোলনের গতিকে স্তিমিত করে। তবে সঙ্কটের আগেই বেশ কিছু সংগঠিত ক্ষেত্রে এই দাবি আদায় বাস্তবায়িত হয়েছিল। কাজের ঘন্টা কমানোর এই লড়াই শুধু মার্কিন মুলুকেই আটকে ছিল না, উদীয়মান পুঁজিবাদী  ব্যবস্থায় যেখানেই শ্রমিকেরা শোষিত হচ্ছিল সেখানেই তারা সঙ্ঘবদ্ধ হতে শুরু করে। দেখা যায় সুদূর অস্ট্রেলিয়াতেও গৃহ-নির্মাণ শ্রমিকরা আওয়াজ তোলেন “আট ঘন্টা কাজ,আট ঘন্টা বিশ্রাম,আট ঘন্টা আমোদ-প্রমোদ”, এবং এই দাবি আদায়েও তারা সক্ষম হয়েছিলেন।

আমেরিকায় আট ঘন্টা কাজের আন্দোলনের উত্তুঙ্গ পর্যায়

১৮৬১ সাল। আমেরিকার গৃহযুদ্ধে প্রায় সকল সক্ষম পুরুষই যুদ্ধক্ষেত্রে। কল-কারখানায় শ্রমিকের অভাব। অর্থ কষ্টের কবলে শ্রমজীবী পরিবারগুলো। যুদ্ধের চাহিদা মেটাতে কল-কারখানা চালু রাখা চাই। মেয়েরা, শিশুরা জীবিকার তাগিদে দলে-দলে কল-কারখানায় কাজ নিতে থাকল। এই সুযোগে মালিকেরা তাদের শোষণ ও অত্যাচার বাড়িয়ে যেতে থাকল। যুদ্ধের অজুহাতে শ্রমিকদের অনভিজ্ঞতা ও অদক্ষতার অজুহাতে এই নারী ও শিশু শ্রমিকদের অত্যন্ত কম মজুরি দিয়ে যথাসম্ভব বেশি খাটিয়ে নিয়ে মালিকেরা লাভবান হতে থাকে। ফলে ১৮৬২ সালের শেষের দিকে বিভিন্ন কল-কারখানায় শুরু হয় ধর্মঘট এবং উৎপাদনে অসহযোগ। এই বিছিন্ন ধর্মঘটগুলোর মাধ্যমেই আমেরিকার শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত প্রতিরোধের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ১৮৬৬ সাল। ১ মে দিনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ বছর। এ বছরের ২০ আগস্ট আমেরিকায় ৬০টি ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা বাল্টিমোরে মিলিত হলেন। প্রতিষ্ঠিত হলো ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন। তখন থেকেই লন্ডনে ‘প্রথম আন্তর্জাতিক’ এর সাধারণ পরিষদের সাথে ইউনিয়নের গভীর সখ্যতা ও নৈকট্য গড়ে ওঠে। এই সময়েই সর্বপ্রথম আট ঘণ্টা শ্রম দিবসের দাবি ওঠে। ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে বাল্টিমোর সম্মেলনে এই সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়; ‘এই দেশের শ্রমিক শ্রেণিকে পুঁজিবাদীদের দাসত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য এই মুহূর্তের প্রথম ও প্রধান কাজ হলো এমন একটি আইন পাস করা যার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত রাজ্যের সাধারণ কাজের দিন হবে আট ঘণ্টা। এই মহান লক্ষ্য পূর্ণ করার পথে আমরা সমস্ত শক্তি নিয়োগ করার সংকল্প গ্রহণ করছি।’

ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন-এর আন্দোলনের ফলে অনেক  ‘আট-ঘন্টা-শ্রম সমিতি’ স্থাপিত হয়। এই সংগঠনের পরিচালনায় যে রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা তৈরি হল তার চাপে অনেকগুলো রাজ্য সরকার, সরকারি কর্মক্ষেত্রে আট ঘন্টা কাজের দিনের দাবি মেনে নেয়। ১৮৬৮ সালে মার্কিন আিন সভা এই মর্মে একটি আইনও পাস করে। আট-ঘন্টা শ্রম আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন বোস্টনের মেশিন-কর্মী ইরা স্টুয়ার্ড।

বাল্টিমোর সম্মেলন পরবর্তী বছরগুলোতে ‘ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। ১৮৬৯ সালে ইউনিয়ন ‘প্রথম আন্তর্জাতিক’ এর বেল কংগ্রেসে প্রতিনিধি পাঠায়। প্রতিনিধি হিসেবে ‘ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন’ এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি উইলিয়াম এইচ সিলভিস-এর যোগদানের কথা ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সম্মেলনের আগেই তার মৃত্যু ঘটে এবং প্রতিনিধি হিসেবে ‘ওয়ার্কিং মেনস অ্যাডভোকেট’ পত্রিকায় সম্পাদক এ সি. ক্যামেরন কংগ্রেসে যোগদান করেন। সিলভিসের মৃত্যু ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন-এর চরম বিপর্যয় ডেকে আনে এবং অচিরেই-এর বিলুপ্তি ঘটে।

১৮৬৭ সালে প্রকাশিত ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থের প্রথম খন্ডে ‘কাজের দিন’ নামক অধ্যায়ে মার্কস ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন এর উদ্যোগে পরিচালিত আট ঘণ্টা কাজের দিন কায়েম করার এই আন্দোলনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। কৃষ্ণাঙ্গ এবং শ্বেতাঙ্গ শ্রমিকদের শ্রেণিস্বার্থের অভিন্নতা সম্পর্কে যেখানে দৃঢ় ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে সেই বিখ্যাত অনুচ্ছেদেই মার্কস লিখেছেন:ক্রীতদাসের দরুন মার্কিন প্রজাতন্ত্রের একটি অংশ বিকলাঙ্গ হয়ে থাকায় এতদিন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বতন্ত্র শ্রমিক আন্দোলন একেবারে পঙ্গু হয়েছিল: কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিক যেখানে ক্রীতদাস সেখানে শ্বেতাঙ্গ শ্রমিক নিজেকে মুক্ত করতে পারেনা। ক্রীতদাসত্বের সমাধির উপরেই নবজীবনের অভ্যুদয় ঘটে। গৃহযুদ্ধের প্রথম অবদান হল দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের আন্দোলন – অবাধ গতিতে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে অতলান্তিক মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত, নিউ ইংল্যান্ড থেকে ক্যালিফোর্নিয়া অবধি।”

১৮৭০-এর দিকে সারা আমেরিকা জুড়ে শুরু হয় তীব্র অর্থনৈতিক সংকট, বাণিজ্যিক মন্দা। মন্দার অজুহাতে মালিকরা মজুরি কমানো, শ্রমিক ছাঁটাই, শ্রম ঘণ্টা বাড়ানো প্রভৃতি নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে থাকল। শ্রমিকরাও এইসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সাথে আন্দোলন শুরু করে। কাজের ঘণ্টা কমাবার আন্দোলন এই সময়কার বেকারত্ব ও দুঃসহ-দুরবস্থার কারণে আরও জোরদার হয়ে ওঠে। ওদিকে মিল মালিক, শিল্পপতিরা শ্রমিক সংগঠনগুলো ধ্বংস করার অপচেষ্টায় মেতে ওঠে প্রচণ্ডভাবে। লেন্সের জানিয়ায় কয়লাখনি মালিকরা ১৮৭৫ সালে খনি অঞ্চল থেকে শ্রমিকদের সংগঠন উচ্ছেদ করার ইচ্ছায় দশজন সংগ্রামী খনি শ্রমিককে ফাঁসিতে ঝোলায়। এর পরিণতিতে ১৮৭৭ সালের রেল ও ইস্পাত ধর্মঘট বিপুল সাফল্য লাভ করে। ১৮৮০ সাল থেকে ১৮৯০। এই দশ বছরে মার্কিন শিল্প ও অভ্যন্তরীণ বাজারের অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটে। তবে এরই মধ্যে ১৮৮৪-৮৫ সালে আবারও মন্দার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ইতোমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন সংক্ষেপে ‘আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার’ এর জন্ম হয়। ১৮৮৪ সালের ৭ অক্টোবর এই সংগঠনের চতুর্থ সম্মেলনের একটি প্রস্তাবে বলা হয়, ‘১৮৮৬ সালের ১-মে থেকে দৈনিক আট ঘণ্টাকেই কাজের দিন বলে আইনত গণ্য করা হবে। এই সঙ্গে আমরা সমস্ত শ্রমিক সংগঠনের কাছে সুপারিশ করছি যে, তারা যেন উপরোক্ত তারিখের মধ্যে এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজ নিজ এলাকায় আইন-কানুন পরিচালনা করেন। একই সাথে ফেডারেশন নাইটস অব লেবার(১৮৬৯ সালে এই শ্রমিক সংগঠনটি তৈরি হয়) এর কাছে আবেদন করলেন যাতে করে তারা আট ঘণ্টা দাবির আন্দোলনের পেছনে সমর্থন জানান। নাইটস অব লেবার, ফেডারেশন এর তুলনায় পুরনো এবং তখনো একটি বিস্তৃত প্রতিষ্ঠান।

১৮৮৫ সাল। ফেডারেশন-এর সম্মেলন থেকে সিদ্ধান্ত ঘোষিত হলো, পরবর্তী বছর প্রথম ধর্মঘট করে বেরিয়ে আসা হবে। কয়েকটি জাতীয় ইউনিয়ন আসন্ন সংগ্রামের জন্য আনুসঙ্গিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এই ইউনিয়নগুলোর মধ্যে কার সেন্টার ও সিগার মেকারদের ইউনিয়ন দুটো বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মে দিবসের আন্দোলন শুরু হবার সাথে সাথে ফল ফলতে শুরু করে। ইউনিয়নগুলোর সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। নাইটস অব লেবার কথাটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফেডারেশন-এর তুলনায় নাইটস অব লেবার অধিক পরিচিত ছিল। তখন এটাকে একটি সংগ্রামী সংগঠন বলে মনে করা হতো। এর সদস্য সংখ্য সংখ্য দুই লাখ থেকে বেড়ে হয় সাত লাখ। আট ঘণ্টা কাজের জন্য আন্দোলনের সূচনা করেছিল ফেডারেশন। ধর্মঘটের তারিখও ঠিক করেছিল এই সংগঠন। ফলে এর সদস্য সংখ্যাও দ্রুত বাড়তে থাকে। ধর্মঘটের দিনটি দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। এলাকায় এলাকায় গড়ে উঠছে আট ঘণ্টা শ্রম সমিতি। অসংগঠিত শ্রমিকরাও দ্রুত সংগঠনভুক্ত হচ্ছে। কিন্তু অচিরেই একটি গোপন ব্যাপার ধরা পড়ল-নাইটস অব লেবার গোপনে আসন্ন ধর্মঘটের বিরোধিতা করছে। তারা ধর্মঘট না করার জন্যও গোপন পরামর্শ দিচ্ছে। এই অবস্থায় বিশ্বাসঘাতক নেতাদের সমুচিত জবাব দেয়ার জন্য ফেডারেশন ধর্মঘটকে আরো জোরদার করার প্রস্তুতি নেয়।

সমগ্র শ্রমিক আন্দোলনে একটা নবজাগরণের সাড়া পড়ে গেল ; অসংগঠিত শ্রমিকদের মধ্যেও এর ছোঁয়াচ লাগল : আমেরিকার শ্রমিকশ্রেণীর ইতিহাসে নতুন ভোরের আলো দেখা দিল।

শ্রমিকদের তখনকার মনোভাব বোঝবার জন্য সব চাইতে ভালো উপায় হলো তাদের বিভিন্ন সংগ্রামের গুরুত্ব এবং ব্যাপকতা লক্ষ্য করা। শ্রমিকদের সংগ্রামী মনোভাবের সুন্দর একটি মাপকাঠি হলো তাঁদের ধর্মঘটের সংখ্যা। ১৮৮৫-৮৬ সালে যতগুলো ধর্মঘট হয়েছে তার সঙ্গে পূর্ববর্তী বছরের ধর্মঘটের সংখ্যা তুলনা করলেই বোঝা যায় কী এক অপূর্ব সংগ্রামী চেতনা তখন শ্রমিকদের উদ্বুদ্ধ করছিল। ১৮৮১ থেকে ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে মাত্র ৫০০ ধর্মঘট ও তালাবন্ধ হয়, আর এগুলোতে অংশ গ্রহণ করেন গড়ে ১ লক্ষ ৫০ হাজার শ্রমিক। ১৮৮৫ সালে ধর্মঘট ও তালাবন্ধের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০০ এবং সেগলিতে যোগদানকারী শ্রমিকদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২ লক্ষ ৫০ হাজার ১৮৮৬ সালে ধর্মঘট ও তালাবন্ধের সংখ্যা ১৮৮৫ সালের দ্বিগুণের বেশি বেড়ে যায়, সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫৭২; যোগদানকারী শ্রমিকদের সংখ্যাও আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পায় ; তাঁদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ লক্ষ। ধর্মঘটের ফলে ১৮৮৫ সালে যেখানে জড়িয়ে পড়ে মাত্র ২৪৬৭টি প্রতিষ্ঠান, ১৮৮৬ সালে সেখানে জড়িয়ে পড়ে ১১৫৬২ টি ; এ থেকে আঁচ করা যায় ১৮৮৬ সালে ধর্মঘট আন্দোলন কী দারুণ ব্যাপকতা লাভ করেছিল। ‘নাইটস’ অব লেবর’-এর নেতাদের খোলাখুলি বিশ্বাসঘাতকতা সত্ত্বেও, হিসেব করে দেখা যায় যে ৫ লক্ষ শ্রমিক আট ঘণ্টা শ্রম-আন্দোলনের ধর্মঘটগুলোতে সরাসরিভাবে অংশ গ্রহণ করেন ।

ধর্মঘটের কেন্দ্র ছিল শিকাগো। ধর্মঘটের আন্দোলন সেখানে সবচাইতে ব্যাপকতা লাভ করে; কিন্তু অন্যান্য অনেক শহরও ১লা মে তারিখের সংগ্রামে সামিল হয়। নিউইয়র্ক’, বালটিমোর, ওয়াশিংটন, মিলওয়াকী, সিনসিন্নাটি, সেন্টলুই, পিটসবার্গ’, ডেট্রয়েট এবং আরও অনেক শহর ধর্মঘট করে বেরিয়ে আসার ব্যাপারে প্রশংসনীয় ভূমিকা গ্রহণ করে। ধর্মঘট আন্দোলনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে অকুশলী এবং অসংগঠিত শ্রমিকেরা এই সংগ্রামের আবর্তে এসে গিয়েছিলেন।

রক্তাক্ত সেই দিন

১-মে ১৮৮৬। শনিবার। সমগ্র শিকাগো শহর নিস্তব্ধ। চালু নেই কোনো কল-কারখানা। মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে ধর্মঘটী শ্রমিকরা। মিছিল যাবে মিশিগান এভিনিউ দিয়ে লেক ফ্রন্টের দিকে। ছয় লাখ শ্রমিক জড়ো হয়েছে।সরকার ও মিল মালিকরা আপ্রাণ চেষ্টা করল মিছিল বন্ধ করবার জন্য। কাগজগুলোর মাধ্যমে আগেই গুজব ছড়ানো হয়েছে যে, শ্রমিকরা ধর্মঘট ও মিছিলের নামে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও লুটতরাজের প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সশস্ত্র পুলিশ ও গুণ্ডা বাহিনী নিয়োগ করা হয়েছে শ্রমিক ও জনসাধারণের মিছিলে অংশগ্রহণ রোধ করার জন্য। কিন্তু সরকার, মালিকপক্ষ এবং কাগজওয়ালাদের সব রকম প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে শান্তিপূর্ণ মিছিল এগিয়ে চলেছে মিশিগান এভিনিউর দিকে। শ্রমিক নেতা পারসনস ও স্পাইজের নেতৃত্বে। লেক ফ্রন্টে প্রায় এক লাখ শ্রমিকের সমাবেশে সাফল্যের জন্য শ্রমিকদের অভিনন্দন জানালেন। মিল মালিক ও কাগজওয়ালাদের গুজব সত্ত্বেও কোথাও কোনো অশান্তি ঘটল না। শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হলো শ্রমিকদের মিছিল ও সমাবেশ। পরের দিন রবিবার। ছুটির দিন। কোনো ঘটনা ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে কেটে গেল দিনটি। কিন্তু ৩-মে সোমবার আবার কারখানায়-কারখানায় শুরু হলো ধর্মঘট। উসকানি ও সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপ দ্বারা শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে সরকার ও মালিক পক্ষ। ম্যাক কর্মিক হারভেস্টার নামক কারখানার সামনে সমবেত শ্রমিকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ গুণ্ডারা। ঘটনাস্থলেই নিহত হয় ছয়জন শ্রমিক। পুলিশ ও গুণ্ডাবাহিনীর আক্রমণে আহত হলো অগণিত শ্রমিক।

এই নির্মম হত্যাকাণ্ড ও সন্ত্রাসের প্রতিবাদে শিকাগোর হে মার্কেটে প্রতিবাদ সভা ডাকা হলো ৪ মে। গত দিনের শ্রমিক হত্যার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অভূতপূর্ব জনসমাবেশ ঘটল। ঘাবড়ে গেল মালিক পক্ষ। যে-কোনো মূল্যে প্রতিবাদ সভা বানচাল এবং ক্রমবর্ধমান শ্রমিক সংহতি ও সংগ্রামী চেতনাকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে নিয়োজিত করল প্রশাসন যন্ত্রকে, ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনীকে। শান্তিপূর্ণভাবে প্রায় শেষ হয়ে এসেছে প্রতিবাদ সভা। শেষ বক্তা ফিল্ডেন উঠেছেন বক্ততা করতে। তখন রাত প্রায় ১০টা। শান্তি ও শৃঙ্খলার নামে জনসভা তখনই ভেঙে দেয়ার নির্দেশ নিয়ে উপস্থিত হলেন শিকাগো পুলিশের বড় কর্তা। প্রতিবাদ করলেন শ্রমিক নেতারা। পুলিশের সাথে শ্রমিক নেতাদের কথা কাটাকাটির সুযোগ গুণ্ডারা সভার বিভিন্ন অংশে বোমা ফাটাতে শুরু করে। শুরু হয় পুলিশের লাঠিচার্জ ও গুলি। ভিড়ের মধ্যে একটি বোমা এসে পড়ে এবং তার আঘাতে নিহত হন একজন সার্জেন্ট। সাথে সাথেই বেধে যায় লড়াই। রক্তের বন্যা বয়ে যায় হে মার্কেটে। এই দিনে নিহত হয় সাতজন পুলিশ, চার জন শ্রমিক। স্পাইচ এবং ফিল্ডেনকে সভাস্থলেই গ্রেফতার করা হয়, দাঙ্গা-হাঙ্গামার দায়ে। আরো গ্রেফতার হলেন মাইকেল মোয়া, জর্জ এঞ্জল, এডলফ ফিশার, লই কিং ও অস্কার নীবে।

রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া

এই ঘটনার পরে শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যায় আমেরিকার সরকার। আট নৈরাজ্যবাদীকে গ্রেফতার করা হয়, যাদেরকে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়।তবে পুলিশের উপর কে ডায়নামাইটের বোমাটি ছুড়েছিল তা আজও রহস্য। তবে শ্রমিকদেরকে উসকে দেওয়া, নৈরাজ্য সৃষ্টির সহ বেশ কয়েকটি অভিযোগে নৈরাজ্যবাদী আটজনকে এই বিচারকাজ নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বেশ সাড়া ফেলে, বিশেষ করে ইউরোপের দেশে দেশে সংঘটিত শ্রমিক, সমাজতান্ত্রিক তাত্ত্বিকরা এর সমালোচনা করেন।এই ঘটনার সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগ দিয়ে যাদের গ্রেফতার করা হয় তাদের মধ্যে সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং বাকি একজনকে পনের বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এরমধ্যে চারজনের মৃতুদণ্ড কার্যকর হয়, একজন আত্মহত্যা করেন এবং বাকি দুইজনের সাজা কমিয়ে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এই বিচারের বিচারকদেরকে রাষ্ট্রপক্ষের নিযুক্ত এটর্নির পক্ষ থেকে বলে দেওয়া হয়,

“Law is on trial. Anarchy is on trial. These men have been selected, picked out by the Grand Jury, and indicted because they were leaders. There are no more guilty than the thousands who follow them. Gentlemen of the jury; convict these men, make examples of them, hang them and you save our institutions, our society.”

মূলত এই বিচারের মাধ্যমে আমেরিকার সরকার এবং প্রশাসন মালিকপক্ষের পক্ষে তাদের অবস্থান নেয়, এবং শ্রমিকদের দীর্ঘ আন্দোলনের ইতিহাসকে আইনিভাবে অস্বীকার করার চেষ্টা করে। সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণি, নৈরাজ্যবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সাথে যুক্ত ব্যক্তিদেরকে দমন পীড়নের চেষ্টা করে। আইন বিচার ব্যবস্থা মূল দাবি ‘আট ঘন্টা প্রমাণ কর্মঘন্টা’ এই দাবিকে এড়িয়ে যায়।

১৮৮৯ সালে মে মাসের এক তারিখকে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ বলে ঘোষণা করে দেয় ‘ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর ওয়ার্কার্স এন্ড সোসালিস্টস’। হেমার্কেট ম্যাসাকারকে শ্রমিক আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যদিও আমেরিকার সরকার এই ঘটনার কোনো স্বীকৃতি দেয়নি, এবং শ্রমিকদের আট ঘন্টা কাজের দাবিকেও গুরুত্ব দেয়নি।

দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ১৯১৬ সালে আমেরিকা আট ঘন্টা কাজের দাবিকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার পথে এগিয়ে যায়। ১৯১৭ সালে রাশিয়ার জার দ্বিতীয় নিকোলাসের পতনের চারদিন পরে আমেরিকা অফিসিয়াল ডিক্রির মাধ্যমে ‘দিনে আট কর্মঘন্টা’র স্বীকৃতি দেয়।

ওয়েবডেস্কের পক্ষেঃ সরিৎ মজুমদার

শেয়ার করুন