CPC100 (2)

২১ শতকের মার্কসবাদ এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টির একশো বছরের অভিজ্ঞতা

২১ শতকে মার্কসবাদ এবং বিশ্ব সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ শিরোনামে মূল নিবন্ধটি ইংরেজিতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-এর কেন্দ্রীয় মুখপত্র পিপলস ডেমোক্র্যাসির ১০ই জুন, ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। সেই নিবন্ধের সম্পূর্ণ বাংলার অনুবাদ রাজ্য পার্টির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হল।

সীতারাম ইয়েচুরি

চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সি পি সি) “২১ শতকে মার্কসবাদ এবং বিশ্ব সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ” শিরোনামে একটি কর্মসুচি পালন করছে।

২০১৭ সালের ৩০ শে নভেম্বর থেকে ৩রা ডিসেম্বর অবধি বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক দলসমূহের সাথে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সি পি সি) এক উচ্চপর্যায়ের আলোচনা সংগঠিত করে যার শেষে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি উপরোক্ত প্রসঙ্গে বিভিন্ন ধারাবাহিক কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।

সেই সিদ্ধান্তক্রমেই ২০১৮ সালের ২৮শে মে চীনের ওয়াংদং প্রদেশের শেনঝেন অঞ্চলে সি পি সি ( চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ) কার্ল মার্কসের ২০০ তম জন্ম দিবস পালন আয়োজন করে।

এই কর্মসূচিতে সি পি সি’র তরফে সারা পৃথিবীর ৭৫টি কমিউনিস্ট এবং ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতিনিধিবৃন্দকে আমন্ত্রন জানানো হয়, ৭০টি দেশ থেকে প্রতিনিধিরা আলোচনায় অংশ নেন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের পক্ষ থেকে ১৭ জন সংশ্লিষ্ট আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। আলোচনা সভার আরম্ভ এবং সমাপ্তির মাঝে মোট তিনটি বিষয়ে সমান্তরাল অধিবেশন চলে। সেই বিষয়গুলি হল ১) কার্ল মার্কসের ঐতিহাসিক অবদান এবং সমসাময়িক বিশ্বে মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতা, ২) আধুনিক পৃথিবীতে চীনের বৈশিস্ট অনুযায়ী সমাজতন্ত্র সম্পর্কে শি জিন পিং চিন্তাধারা এবং মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতা এবং ৩) চীনের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সমাজতন্ত্রের তত্ব ও প্রয়োগসমূহ এবং সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের ভবিষ্যৎ।

কর্মসূচির সমাপ্তি অধিবেশনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বক্তব্য রাখেন। নীচে সেই বক্তব্যটি দেওয়া হলঃ

প্রিয় কমরেডগণ ও বন্ধুরা,

চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সি পি সি) আয়োজিত এই গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনের সমাপ্তিসূচক পর্যায়ে আমরা উপনীত হয়েছি। এই সম্মেলন এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ, ভ্রাতৃপ্রতিম অন্যান্য পার্টির প্রতিনিধিরাও এখানে উপস্থিত রয়েছেন। আমি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)’র পক্ষ থেকে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সি পি সি) আয়োজিত এই গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচীর প্রতি সংহতি প্রকাশ করছি।

পূর্বনির্ধারিত সময়ের মধ্যেই উপস্থিত সকল পার্টির প্রতিনিধি নিজেদের বক্তব্য এই মঞ্চে তুলে ধরবেন বলে আমরা ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাই আমি কোন লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনাবো না। একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে পাঁচটি সংশ্লিষ্ট পয়েন্টসহ আমি আমার কথা বলবো।

আমার আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয়টি হল “২১ শতকে মানবসভ্যতার বিকাশের গতি ও পথ নির্ধারণে মার্কসবাদের ভূমিকা”।

এহেন বিষয় নির্বাচনে আমার যুক্তি হলঃ

পৃথিবীব্যাপি পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বর্তমানে যেরকম সংকটের কবলে পুনরায় রয়েছে তাতে সন্দেহাতীতভাবে মার্কসবাদের যথার্থতা প্রমানিত হয়েছে। এই ব্যবস্থায় মানুষের উপলব্ধি সম্পর্কে একটি প্রচলিত প্রবাদ হল “শোষণ কিংবা সংকট কোন ক্ষেত্রেই পুঁজিবাদ সমস্যার সমাধান করতে পারে না”। মার্কস খুব সিথিকভাবেই উল্লেখ করেছিলেন “এযাবতকাল অবধি দার্শনিকেরা জগতকে শুধু ব্যাখ্যাই করে গেলেন, যদিও আসল কথাটা হল এর পরিবর্তন সাধন” – পুঁজিবাদকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াই সঠিক রাস্তা।

কিভাবে এই পরিবর্তন সাধিত হবে ? মার্কসবাদই হল একমাত্র সেই মতবাদ যেখানে শোষণের অবসান ঘটিয়ে মানবমুক্তি সম্পর্কে একটি যথাযথ ধারণা দেওয়া হয়েছে। এই একটিই দর্শন বিদ্যমান যা সর্বহারা শ্রেণীর মানুষের জন্য আকর্ষণীয়। এমন হবার কারন হিসাবে লেনিন অত্যন্ত সঠিকভাবেই উল্লেখ করেছিলেন “এই মতবাদের প্রতি সারা পৃথিবীর সমস্ত সমাজতান্ত্রিকরা আকৃষ্ট হন কারন এমন একটিই মতবাদ রয়েছে যা গুনগত দিক থেকে একইসাথে বিপ্লববাদী এবং সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে বিজ্ঞানসম্মত। এই দুটি গুণের সম্মিলন আকস্মিকভাবে ঘটেনি আবার একথাও বলা যাবেনা যে এই মতবাদের রচয়িতাদের মধ্যে বিপ্লবপন্থা এবং বিজ্ঞানের বিশেষ দক্ষতা ছিল তাই এমনটা হয়েছে। বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এবং বিপ্লববাদীতা এই মতবাদে একে অন্যের সাথে অঙ্গাঙ্গিকরুপে নিহিত রয়েছে যাদের আলাদা করা যাবেনা”।

আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য হল নিজেদের দেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতি অনুযায়ী এই মতবাদের প্রয়োগ ঘটানো। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) মনে করে মার্কসবাদকে কেবলমাত্র তখনই অতিক্রম করা যাবে যখন এই মতবাদের লক্ষ্য ইতিমধ্যেই অর্জিত হয়েছে। সেই লক্ষ্য হল শ্রেণীহীন কমিউনিস্ট সমাজের প্রতিষ্ঠা। আরও নির্দিষ্ট করে বলা যায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তর্বস্তু আত্মস্থ করতে ইতিমধ্যে একমাত্র মার্কসবাদই সফল হয়েছে এবং এই মতবাদের উপরে ঐতিহাসিকরুপে ন্যস্ত আগামী কর্তব্যসমূহের পালনেও এই মতাদর্শ যথেষ্টই মজবুত।

মার্কসবাদ কোনও নিরেট ধর্মীয় আদর্শ নয়, এ হল সৃজনক্ষম বিজ্ঞান। মতবাদ অনেক রয়েছে, সেইসবের মধ্যে মার্কসবাদই হল সেই দর্শন যা “নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ” করতে শেখায়। মার্কসবাদের সাধারণ বৈশিষ্ট হল ইতিহসের বিশ্লেষণ এবং নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট হল পুঁজিবাদের অন্তর্বস্তু পর্যালোচনা। এই মতবাদের ভিত প্রতিষ্ঠা হয়েছিল মার্কসের হাতে যাকে আমরা ক্রমাগত আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে আরও সমৃদ্ধ করে চলি যাতে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায়। ক্রমান্বয়ী উন্নতিসাধনের সম্ভাবনা রহিত মতবাদসমূহের তুলনায় মার্কসবাদ অনেকটাই আলাদা – তত্বগতভাবে মার্কসবাদ প্রতিনিয়ত নিজের উৎকর্ষ সাধন করে চলে।

‘সৃজনক্ষম বিজ্ঞান’ বলেই মার্কসবাদ মানবিক প্রয়াসসমূহের যাবতীয় আধুনিক কর্মকাণ্ড এবং মানবসভ্যতার চিরায়ত অন্তর্দন্দ্বের ফলাফল হিসাবে আমাজিক অগ্রগতির আগামী সবরকম বাঁক ও মোড় সম্পর্কে যথাযথ সম্ভাবনাগুলি অনেক আগে থেকেই চিহ্নিত করতে পারে। মহাকাশ বিজ্ঞান থেকে শুরু করে ন্যানো প্রযুক্তি অবধি বিজ্ঞানের প্রতিটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের নতুন কোন আবিষ্কার কিংবা প্রগতি বারংবার দ্বন্দ্বমূলক-বস্তুবাদের তত্বকেই যথার্থ প্রমান করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমতার উন্নতিসাধনে মানবসভ্যতার অস্তিত্বে যে ঝুঁকির সম্ভাবনা থাকে তার সম্পর্কে একমাত্র মার্কসবাদই আগাম সতর্কতা জানায় এবং উদ্ভুত পরিস্থিতির মোকাবিলা করতেও আমাদের হাতিয়ার হিসাবে কাজে দেয়।

আমরা আজ সেই ভূখণ্ডের উপরে দাঁড়িয়ে আলোচনা করছি যেখানে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সি পি সি) ইতিমধ্যেই মার্কসীয় বিজ্ঞানকে আত্মস্থ করেছে, দেশের মাটিতে বিপ্লবসাধনে সফল হয়েছে এবং চীনের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট অনুযায়ী সমাজতন্ত্র নির্মাণে ব্রতী রয়েছে। তত্ত্ব এবং প্রয়োগের এই যে সম্মিলন যাকে আন্তোনিও গ্রামশি প্র্যাক্সিস বলে উল্লেখ করেন, চর্চার সেই ধারা বেয়েই চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সি পি সি)’র সাধারণ সম্পাদক শি জিনপিং “চীন নিজেই মার্কসবাদের বিজয়ী হবার লৌহপ্রাকারসম প্রমাণ” বলে উল্লেখ করেছেন। বিংশ শতাব্দী অবধি যে দেশকে “প্রাচ্যের দুর্দশাগ্রস্থ মানুষ” বলে চিহ্নিত করা হত আজকের পৃথিবীতে সেই চীন দ্বিতীয় সুপার পাওয়ার এবং আগামিদিনের বিশ্বে অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে ক্রমবর্ধমান। চীনের নির্দিষ্ট পরিস্থিতি অনুযায়ী সমাজতন্ত্র নির্মাণের লক্ষ্যেই চীনের কমিউনিস্ট পার্টি কাজ করে চলেছে – “আধুনিক পৃথিবীতে চীনের বৈশিস্ট অনুযায়ী সমাজতন্ত্র সম্পর্কে শি জিন পিং চিন্তাধারা এবং মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতা” শীর্ষক আলোচনা সেই অভিমুখেই আয়োজিত হয়েছে।

আমাদের প্রত্যেকের কাজ হল যথাযথভাবে নিজেদের দেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ সাধন। সংকট যতই তীব্র আকার নিক না কেন পুঁজিবাদ কখনো স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে উৎখাত হয় না। যতদিন না পুঁজিবাদের বিকল্প হিসাবে উপযুক্ত কোন রাজনৈতিক শক্তি গড়ে ওঠে ততদিন অবধি শ্রমজীবী মানুষের উপরে শোষণের মাত্রা বাড়িয়ে পুঁজিবাদ নিজেকে বারংবার পুনরুজ্জীবিত করে। আবার এরই ফলশ্রুতিতে সমাজতান্ত্রিক শক্তি রাজনৈতিক বিকল্প হিসাবে বিস্তার লাভ করে।

একারনেই পুঁজিবাদকে উৎখাত করতে হয়। উপড়ে ফেলার সেই কাজ মূলত নির্ভর করে পূঁজির শাসনের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষদের নেতৃত্বে সংগঠিত আন্দোলনসমূহের উপরে যা ক্রমাগত চলতি সমাজে শ্রেণিসংগ্রামের তীব্রতা বস্তুগতভাবে বাড়িয়ে চলে। আন্দোলনের বস্তুগত সামর্থ্যলাভ আসলে সমাজ বদলের লড়াইতে ‘বিষয়ীগত উপকরন’ যোগান দেয় এবং সেই সামর্থ্য অর্জনের জন্যই নিরন্তর সংগ্রাম একান্ত প্রয়োজন। সংকটকালীন পরিস্থিতি, যা হল সমাজ বদলের লড়াইয়ে ‘বিষয়গত উপাদান’ তা যতই তীব্র আকার নিক না কেন যদি পূঁজির শোষণ উচ্ছেদের লক্ষ্যে পূর্বোক্ত ‘বিষয়ীগত উপকরন’ যথাযথরুপে প্রস্তুত না থাকে তবে সমাজ বদলের সংগ্রাম সমাজবিপ্লবের স্তরে উন্নীত হতে পারে না।

এই সমস্যার সমাধান করাই আজ আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য ।

মানবমুক্তির সংগ্রামকে শ্রেণীসংগ্রামের স্তরে উন্নীত করতে উদ্ভুত পরিস্থিতির বিশ্লেষণে যে তাত্বিক বোঝাপড়ার প্রয়োজন হয় তারই মতাদর্শগত ভিত্তি হল মার্কসবাদ। সমাজতন্ত্রই যে আগামিদিনে মানুষের ভবিষ্যৎ তাকে সুনিশ্চিত করতে এই উপলব্ধিই হল ২১ শতকের মার্কসবাদ।

ওয়েবডেস্কের পক্ষেঃ সৌভিক ঘোষ


শেয়ার করুন

উত্তর দিন