Marx Birthday

মার্কস - ২০৪

সোমনাথ ভট্টাচার্য

আজ ৫মে ২০২১,পৃথিবীর মহান দার্শনিক কার্ল মার্ক্সের (১৮১৮-১৮৮৩) ২০৪তম জন্মদিন।

নিপীড়িত মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রতীক্ষায় ছিল তাদের মুক্তির দর্শনের, দর্শনও খুঁজে পায়নি নিপীড়িত মানুষের ঠিকানা। মার্ক্স এঙ্গেলস দেখা করিয়ে দিলেন একের সঙ্গে অপরকে। অবশেষে দর্শন খুঁজে পেল প্রলেতারিয়েতকে আর শোষিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত প্রলেতারিয়েত পেল তাদের মুক্তির দর্শন মার্কসবাদ।

কার্ল মার্ক্স এবং তার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু, সংগ্রামের সাথী, কমরেড ইন আর্মস, তার চিন্তার পরিপূরক চিন্তাবিদ ফ্রেডরিক এঙ্গেলস (১৮২০-১৮৯৫) এই দুজনে মিলে সমাজ, দর্শন, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব প্রভৃতি সম্পর্কে যে যে ভাবনা চিন্তাকে সূত্রায়িত করেছেন সেটাই সম্মিলিতভাবে মার্কসবাদ।

এখন প্রশ্ন আমরা মার্ক্সবাদকে গ্রহণ করব কেন?
এক কথায় উত্তর মার্কসবাদ মানুষের কল্যাণের কথা ভেবেছে।এ কথা যদি সত্য হয় তবে আবারও প্রশ্ন আসে, তাহলে মার্ক্স-এঙ্গেলস এর আগে এই পৃথিবীতে কি কেউ মানুষের মঙ্গলের কথা ভাবেননি? নিশ্চয়ই ভেবেছেন। মার্ক্স এঙ্গেলস এর জন্মের হাজার হাজার বছর আগে থেকে ভেবেছেন। গ্রিসের সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল, এপিকিউরাস, চীনের কনফুসিয়াস, ভারতের গৌতম বুদ্ধ, ইউরোপের টমাস মুর, চার্লস ফুরিয়ে, রবার্ট ওয়ান, হেগেল, ফয়েরবাখ সহ আরও অনেকে।এরা সকলেই আন্তরিকভাবেই মানুষের কল্যাণের কথা ভেবেছেন।এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, এত মনীষী যদি মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে থাকেন তবে তাদের বাদ দিয়ে মার্কসের মতবাদ কেন?

এর সুনির্দিষ্ট দুটি কারণ।
এক) মার্ক্স-এঙ্গেলস তাদের পূর্ববর্তী পৃথিবীর যা কিছু শিক্ষা এবং মূল্যবোধ প্রগতির সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তখনও প্রাসঙ্গিক সেগুলিকে তারা গ্রহণ করেছেন।

দুই) মানুষের কল্যাণের কথা ভাবার প্রশ্নে মার্ক্স এঙ্গেলস এর ভাবনাটা ছিল তাদের পূর্বসূরিদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক।পূর্বসূরিরা চেয়েছিলেন প্রচলিত ব্যবস্থাকে অক্ষুন্ন রেখে নির্যাতিত মানুষের খানিকটা বাড়তি স্বাচ্ছন্দ্য। বাড়তি কল্যাণ।
মার্ক্স-এঙ্গেলস ও পথেই যাননি। তারা বললেন যে ব্যবস্থা দেশের ৮০% বা ৯০% মানুষকে কষ্টে রাখে সেই ব্যবস্থাটাকেই বদলাতে হবে।থিসিস অন ফয়েরবাখে তাই মার্ক্স বলেছিলেন, "The Philosophers have so far interpreted the world in various ways, the point, however is to change it."
অর্থাৎ দার্শনিকরা নানাভাবে এই জগৎটাকে ব্যাখ্যা করেছেন কিন্তু আসল কথা হলো একে পরিবর্তন করা।

এই 'পরিবর্তন' কথাটা মার্কসবাদে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রগতির স্বার্থে, সচেতনভাবে রাষ্ট্র ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনই হলো বিপ্লব। যে কারণে মার্কসবাদ বিপ্লবী মতবাদ।এর আগে এই পরিবর্তন বা সমাজবদলের কথা কেউ কখনো বলতে পারেননি। আসলে ভাবতেই পারেননি। এখানেই মার্কসবাদের স্বাতন্ত্র্য এবং শ্রেষ্ঠত্ব।

মানব সমাজের ইতিহাসে শ্রেণী কতটা গুরুত্বপূর্ণ, শ্রেণিসংগ্রাম এর ভূমিকা কি? এইসব প্রশ্নের সাবলীল উত্তর দিলেন মার্ক্স-এঙ্গেলস' কমিউনিস্ট ইশতেহার পাতায়। সেখানে তাদের সুস্পষ্ট উচ্চারণ, "The History of all hitherto existing society is the History of Class Struggles." অর্থাৎ আজও পর্যন্ত মানবসমাজের সমগ্র ইতিহাস হল শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। এইটিন্থ ব্রুমেইয়ার অব লুই বোনাপার্ট এ মার্ক্স লিখলেন, মানুষই ইতিহাস রচনা করে কিন্তু তার মানে এই নয় যে মানুষের সৃষ্ট ইতিহাস সবসময়ই প্রগতির পথ অনুসরণ করে। অনেক সময় পরিস্থিতির শিকার হয়ে সেই ইতিহাস মানব সভ্যতার কানাগলিতে পথ হারায়। আর তখনই ইতিহাসের পাতা জুড়ে অবস্থান করে হিটলার-মুসোলিনি-তোজো-ফ্র্যাঙ্কোরা।

ফরাসি দার্শনিক প্রুধোঁ 'ফিলোসফি অফ পভার্টি' গ্রন্থে মার্ক্সের মতবাদকে দারিদ্র্যের দর্শন বলে তাচ্ছিল্য করেন। এই বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে প্রত্যুত্তরে মার্ক্স লিখলেন, 'পভার্টি অফ ফিলোসফি' বা 'দর্শনের দারিদ্র্য'।সেখানে তিনি বললেন, যে দর্শন সাধারণ মানুষকে এগোনোর দিশা দেখাতে পারেনা, ইহকালের থেকে পরকাল নিয়ে বেশি ভাবে সেইসব দর্শনই আসলে দারিদ্র্যে পরিপূর্ণ। এভাবেই মার্ক্স সওয়াল করলেন হতদরিদ্র-নিপীড়িত-বঞ্চিত-শোষিত সাধারণ মানুষের পক্ষে।তাই মার্কসবাদ সাধারণ মানুষের মতবাদ।

পৃথিবীটা কেমন হওয়া উচিত বা কেমন হলে ভালো হয় এ ব্যাপারে কোনো সুসমাচার মার্ক্স-এঙ্গেলস দেননি। তারা ইতিহাসের ফেলে আসা পথের বিভিন্ন বাঁক মোড়ে আলো ফেলে বোঝার চেষ্টা করেছেন অতীত থেকে বর্তমানে এর গতিপথটা কী? আর তারই ভিত্তিতে চিনতে চেয়েছেন ভবিষ্যতের অভিমুখ কোন দিকে হতে পারে। এ ব্যাপারে নিজেদের মনগড়া কোন কথা তারা বলেন নি। এ হেন বস্তুনিষ্ঠ, বৈজ্ঞানিক, নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজটাকে দেখেছেন বলেই তাদের দর্শন সত্যের খুব কাছাকাছি অবস্থান করে।
মার্ক্স-এঙ্গেলসের অসামান্য অবদান শ্রেণীর ধারণা। শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত করবার লক্ষ্যে মার্ক্স-এঙ্গেলস জার্মানির শ্রমিক সংগঠন 'লিগ অব জাস্ট' এর সাথে যুক্ত হন। এই সংগঠনের স্লোগান ছিল, 'সব মানুষ ভাই ভাই'। আপাতদৃষ্টিতে এটি খুব সুন্দর স্লোগান বলেই মনে হয়। কিন্তু মার্ক্স-এঙ্গেলস দেখালেন শ্রমিক শোষণকারী মালিক এবং শোষিত শ্রমিক কখনোই ভাই ভাই হতে পারে না। শ্রমিক শোষিত হয় বলেই উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি হয়। তাই মালিক মুনাফা করতে পারে। শ্রমিক শোষিত না হলে মালিকের মুনাফা অর্জন করা সম্ভব হয় না। শুধু তাই-ই নয়, শ্রমিক যত বেশি শোষিত হবে মালিকের ততো বেশি মুনাফা হবে। অর্থাৎ শ্রমিক যত বেশি অত্যাচারিত হবে মালিক ততই লাভবান হবে। সেক্ষেত্রে শ্রমিক আর মালিক কি ভাই ভাই হতে পারে?

এই নতুন শ্রেণী চেতনায় সমাজকে শিক্ষিত করলেন মার্ক্স-এঙ্গেলস। উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টিকারী নিপীড়িত, বঞ্চিত, অত্যাচারিত শ্রমিকরা হলো শোষিত শ্রেনী। আর অত্যাচারী উদ্বৃত্ত মূল্য ভোগকারী মালিকরা হলো শোষকশ্রেণী। দেশ-কাল-জাত-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা নিরপেক্ষভাবে শ্রমিকরা যুগ যুগ ধরে শোষিত আর মালিকরা শোষক।

মার্ক্স শেখালেন শ্রেণী সম্পর্কে এই বৈজ্ঞানিক, বস্তুনিষ্ঠ সম্যক চেতনাই হল শ্রেণীচেতনা। এর নিরিখে সহজেই বোঝা যায় কে আমার বন্ধু আর কে নয়। লড়াইয়ের সময় কাকে সঙ্গে নিতে হবে আর কার বিরুদ্ধে লড়তে হবে। ব্যারিকেডের এপারে কে আর ওপারেই বা কে। এই শ্রেণী চেতনার কষ্টিপাথরে বিচার করেই কমিউনিস্ট ইস্তেহার এর শেষ লাইনে মার্ক্স এঙ্গেলসের দৃপ্ত আহ্বান, 'দুনিয়ার মজদুর এক হও'।
এখানে লক্ষণীয় মার্ক্স-এঙ্গেলস কখনোই ঝান্ডার রং বিচার করে শ্রমিককে ঐক্যবদ্ধ হতে বলেননি।আবিশ্ব শ্রমিকশ্রেণী শোষণের শিকার তাই শোষণহীন সমাজ গড়ার সংগ্রামে তাদের সকলকেই প্রয়োজন সে ক্ষেত্রে শ্রমিকের দেশ-কাল-ভাষা-ধর্ম-বর্ণ এবং পতাকার রং কোনটাই এই শ্রেণীবোধের উর্ধ্বে নয়।

যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটাকে বদলাতে হবে তার স্বরূপটা কেমন? তন্নিষ্ঠ অনুসন্ধান করে সেই সত্যকেই তুলে ধরলেন 'দাস ক্যাপিটাল' এর পাতায় পাতায়। মার্ক্স এই গ্রন্থে আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, প্রতারণা বা অসম বিনিময়ের জন্য শোষণ ঘটে না। বাজারে শ্রমিক প্রতারিত হয়েছে বলে উদ্বৃত্তমূল্য সৃষ্টি হয় না। কারণ এটি কোন নীতি নৈতিকতার প্রশ্ন নয়। আসলে পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যেই নিহিত থাকে শোষণ। পুঁজিবাদ থাকবে অথচ শোষণ থাকবে না - এ কখনো সম্ভব নয়। এটাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অনিবার্যতা এবং একই সঙ্গে কদর্যতা।

das capital

মার্ক্স বললেন পুঁজি হল মৃত শ্রম। রক্তচোষা বাদুড়ের মত জীবন্ত চরম শুষে সে বেঁচে থাকে। পুঁজির মাথা থেকে পা পর্যন্ত প্রতিটি রন্ধ্র দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে ক্ষেপণাস্ত্র পুঁজ-রক্ত।পুঁজির এই চরিত্রকে আরো পরিষ্কার করে তুলে ধরতে তিনি ক্যাপিটাল গ্রন্থের প্রথম খন্ডের ৩১ তম অধ্যায়ের পরিশেষে একটি ফুটনোটে তুলে ধরলেন টি.জে. ডানিংয়ের একটি মূল্যবান বক্তব্য। সেখানে বলা হলো, যথেষ্ঠ মুনাফা পেলেই পুঁজি খুবই সাহসী হয়। ১০ শতাংশ মুনাফা নিশ্চিত জানলে সে যেকোন জায়গায় ব্যবসা করতে পারে। ২০ শতাংশ মুনাফায় তার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। ৫০ শতাংশ মুনাফা দেয় ঔদ্ধত্য। ১০০ শতাংশ মুনাফা মানবিকতার সব নীতিগুলিকে পদদলিত করবার সাহস জোগায়। ৩০০ শতাংশ মুনাফা নিশ্চিত জানলে হেন কোন অপরাধ নেই যা সে করতে পারে না। এমনকি মালিককে ফাঁসিকাঠে পর্যন্ত ঝোলাতে পারে। এভাবেই মার্ক্স আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন পুঁজি ও পুঁজিবাদের আসল নগ্ন চেহারা। শোষণ ছাড়া পুঁজিবাদ টিঁকতে পারেনা। তাই শোষণহীন সমাজ গড়ার লড়াই মানে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই।

পুঁজি সম্পর্কে মার্কসের ন্যায় নির্মোহ ব্যাখ্যা আর কেউ করতে পারেননি। যা এতদিন বাদেও সারা পৃথিবীকে স্বীকার করতে হচ্ছে। সেকারণেই ২০০৮ সালে বিশ্বের আর্থিক মন্দার কারণ খুঁজতে গিয়ে ভ্যাটিকানের প্রাসাদে বসে পোপকে উল্টাতে হয় ক্যাপিটালের পাতা। মিউনিখের আর্চবিশপ কার্ডিনাল রেইনহার্ড জার্মান সাপ্তাহিক 'দ্য মিরর'কে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেন পুঁজিবাদ নিয়ে কার্ল মার্কসের ব্যাখ্যা নির্ভুল। ব্রিটেনের কুলীন পত্রিকা 'গার্ডিয়ান' লিখল বিশ্বমন্দার ছয় মাসের মধ্যে মার্ক্স এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট ইস্তেহারের বিক্রি বেড়েছে ৯০০ শতাংশ আর ক্যাপিটালের বিক্রি বেড়েছে ৩০০ শতাংশ।

বিবিসি সমীক্ষা করে ২০০০ সালে ঘোষণা করেছিল, সহস্রাব্দের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ, Thinker of the Millennium হলেন কার্ল মার্ক্স।

মার্কসবাদ সম্পর্কে বলা হয়, কেউ মার্ক্সের মতবাদ সমর্থন করতে পারে কেউ বিরোধিতা করতে পারে কিন্তু কেউ একে অস্বীকার করতে পারে না।

এখানেই মার্কসবাদের শক্তি এই মার্ক্সবাদকে পাথেয় করেই জারি থাকুক শোষণমুক্ত সমাজ এর জন্য মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন