ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
যখন এই প্রতিবেদনটা লেখা হচ্ছে তার আগের ২৪ ঘন্টায় এই রাজ্যে দুটো শ্যুট আউটে ৪ জন আহত।এই বছরের মার্চ এবং এপ্রিল মাসে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড এবং ধর্ষণ ও হত্যা সহ মহিলাদের বিরুদ্ধে হিংসার অপরাধের ঘটনাগুলোর একটা ধারা পশ্চিমবঙ্গকে হতবাক করেছে৷ মিডিয়া রিপোর্ট অনুসারে, মার্চ মাসে ২৫ টিরও বেশি রাজনৈতিক হত্যা হয়েছে, যেখানে দুই মাসে ১৫ টিরও বেশি ধর্ষণের মামলা নথিভুক্ত হয়েছে।
বিরোধীরা নারীদের নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক আক্রমণ ও হত্যা নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শুরু করে এবং একটা ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিরতা রাজ্যটাকে গ্রাস করেছে।পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতে বলেছেন যে রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা অন্যান্য রাজ্যে অনেক বেশি হয়। অভিযুক্তদের শাস্তি হবে বলেও জানান তিনি - কথা ও কাজের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে।বগটুই থেকে তপন কান্দু হত্যা সর্বত্রই দেখা গেছে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা।
মুখ্যমন্ত্রীর এই বিবৃতির মাসখানেকের মধ্যে টিএমসির সাধারণ সম্পাদক এবং মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছিলেন যে "মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মহিলারা পশ্চিমবঙ্গে নিরাপদ এবং সুরক্ষিত"।
FactChecker নামক একটি সংস্থা পশ্চিমবঙ্গের বাস্তব পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়িয়েছে তা দেখতে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, মহিলাদের ওপর ঘটে যাওয়া অপরাধ এবং দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হারের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে। এই বিশ্লেষণের থেকে যে ছবি উঠে আসে তা মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "আমি বীরভূমের গণহত্যাকে সমর্থন করছি না, কিন্তু এই ঘটনাগুলো উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ এবং বিহারে বেশি ঘটছে।"
বাস্তব কী ? ২১ মার্চ বীরভূম জেলার বগটুই গ্রামে টিএমসি নেতা ভাদু শেখের হত্যার পরে একটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অঙ্গ হিসাবে নয়জনকে পুড়িয়ে মারার পরে তার এই বিবৃতি এসেছে।যদিও ঘটনা হল ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর থেকে পাওয়া নথি অনুসারে (২০১১-২০২০) গোটা দেশে বিহারের (১৫০টি রাজনৈতিক হত্যা) পরেই রাজনৈতিক হত্যায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। ১১৪টি রাজনৈতিক হত্যা নথিভুক্ত হয়েছে এই বাংলায়। ২০১৮ সালে এনসিআরবি রিপোর্টের জন্য এই রাজ্য থেকে তথ্য সরবরাহ করা হয়নি, ২০১৪,২০১৫,২০১৬ তে একটি করে এবং ২০১৯ সালে তিনটি মামলা রেকর্ড করা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ এই সন্দেহজনক তথ্যের ভিত্তিতেই দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে।NCRB রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ১৯৯৯ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে, পশ্চিমবঙ্গে বছরে গড়ে ২০টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
এটা স্পষ্ট যে রাজনৈতিক হত্যাকান্ডে পশ্চিমবঙ্গ গোটা দেশের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে, বিহারের ঠিক পরেই। তিন এ রয়েছে মধ্যপ্রদেশ, ৮৮টি ঘটনা। উত্তরপ্রদেশ(৭২),গুজরাট(২১) প্রথম পাঁচটি রাজ্যের মধ্যেই নেই। মমতা ব্যানার্জীর এই দাবি দৃশ্যতই মিথ্যা।
“আইন আছে, কিন্তু তার প্রয়োগ নেই। স্থানীয় প্রশাসন এবং পুলিশ রাজনীতির বোড়েতে পরিণত হয়েছে… পশ্চিমবঙ্গে আইন ও সংবিধানের শাসন আর প্রযোজ্য নয় কারণ প্রশাসন অর্থ ও রাজনৈতিক সংযোগ ছাড়া সাধারণ নাগরিকদের পরিসেবা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রভাবশালীরা আইন নিয়ন্ত্রণ করে এবং সেই প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা পাওয়ার লড়াইয়ের ফলে রাজনৈতিক হিংসা দেখা দেয়,” বলেছেন কিরীটি রায়, একজন প্রবীণ মানবাধিকার কর্মী এবং বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) প্রতিষ্ঠাতা।
হিংস্র অপরাধের রাজ্যভিত্তিক চিত্র
এনসিআরবি-এর হিসাব মত প্রতি এক লাখ জনসংখ্যায় হিংস্র অপরাধের হারের নিরিখে, পশ্চিমবঙ্গ উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ এবং বিহারের চেয়ে অনেক এগিয়ে।মমতা ও তার সরকার যতই নিরাপত্তার কথা বলুক না কেন এই রাজ্যে আইনের শাসন আজ প্রহসনে পরিণত হয়েছে তথ্যই সেই কথা বলে দিচ্ছে। সর্বশেষ এনসিআরবি রিপোর্টে দেখা গেছে যে ২০২০ সালে, পশ্চিমবঙ্গে প্রতি এক লক্ষ জনসংখ্যা পিছু ৫১টিরও বেশি হিংস্র অপরাধের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে, যা আসামের ৭৩.৭-এর পরেই, দ্বিতীয়।অন্যদিকে, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ এবং বিহারে ১ লক্ষ জনসংখ্যা পিছু হিংস্র অপরাধের হার ছিল যথাক্রমে ২২.৭, ১২.১, ২৭.৮ এবং৪১.৯।
“বীরভূমের ঘটনার জন্য দায়ী সকলের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তাদের (রাজনৈতিক) রঙ নির্বিশেষে,” সংবাদ সংস্থা পিটিআই-মমতা ব্যানার্জীকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছিল।বাস্তব কিন্তু একদম এর উল্টোটাই দেখায়।
উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, বিহার এবং মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলোর তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে সমস্ত অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার অত্যন্ত কম।সর্বশেষ এনসিআরবি রিপোর্ট অনুসারে, আইপিসি অপরাধের জন্য পশ্চিমবঙ্গে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার ছিল মাত্র ১৩.৪%, যেখানে এসএলএল অপরাধের [Special and Local Laws (SLL) যেমন Arms Act, 1959;Narcotic Drugs & Psychotropic Substances Act, 1985; Gambling Act, 1867; Excise Act, 1944 ইত্যাদি] ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ছিল ২২.৭%।উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট এবং বিহারে আইপিসি অপরাধের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার ছিল যথাক্রমে ৬৩.২%, ৫৭.৯%, ৪০.৭% এবং ৩০.৫%। এসএলএল অপরাধের জন্য, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট এবং বিহারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার ছিল যথাক্রমে ৮৮.৫%, ৯৬.৪%, ৫৪.৯% এবং ৩৪.৫%।
"দায়িত্বজ্ঞানহীনতা শাসক রাজনৈতিক শ্রেণীকে কাবু করেছে। প্রতিবারই হিংসার ঘটনা ঘটে, ক্ষমতাসীন দলের নেতারা হয় দাবি করেন 'কিছুই ঘটেনি' বা 'এটি ছোট ঘটনা'… শুধুমাত্র বিরল ক্ষেত্রেই আমরা দোষী সাব্যস্ত হতে দেখি। ৭০ বছর বয়সী মানবাধিকার কর্মীর আক্ষেপ।
নারী সুরক্ষার অবস্থাও রীতিমত ভয়াবহ। কুনাল ঘোষ দাবি করেছেন, "মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজ্যের মহিলারা পশ্চিমবঙ্গে নিরাপদ এবং সুরক্ষিত। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই পুলিশকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পুলিশ ও প্রশাসন সবসময় দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। উন্নাওয়ের মতো এখানে নির্যাতিতাদের অত্যাচার করা হয় না। মমতা ব্যানার্জির প্রশাসন সহানুভূতিশীল"।
তিনি ১৯ এপ্রিল এই দাবির পুনরাবৃত্তি করে বলেন, "মহিলারা পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে নিরাপদ"। "প্রশাসন যেকোনো অপরাধ আটকানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা যথেষ্ট ইতিবাচক। এই জন্যই বাংলা গোটা দেশের মধ্যে নারীদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ।"
কিন্তু বাস্তব হল এটাই যে পশ্চিমবঙ্গে নারীদের ওপর অত্যাচারের ঘটনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সর্বশেষ এনসিআরবি রিপোর্ট অনুসারে, মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের ওপরে রয়েছে শুধুমাত্র উত্তরপ্রদেশ।মানে এই নিরিখেও পশ্চিমবঙ্গ গোটা দেশে দ্বিতীয়।যেখানে উত্তরপ্রদেশে ২০২০ সালে মহিলাদের বিরুদ্ধে ৪৯,৩৮৫টি অপরাধের ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে ৩৬,৪৩৯টি এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে।এদিকে, ওড়িশার সাথে পশ্চিমবঙ্গ, ২০১৯ সালের তুলনায় মহিলাদের বিরুদ্ধে ঘটা অপরাধের সর্বাধিক বৃদ্ধির রেকর্ড করেছে, যখন উত্তর প্রদেশ এবং অন্যান্য রাজ্যগুলো, যেগুলো ২০১৯ সালে মহিলাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অপরাধের রেকর্ড করেছে, সেইখানে এই সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে।
অপরাদীদের কোন রেয়াত করা হবে না, মুখ্যমন্ত্রীর এই আশ্বাস সত্ত্বেও এইধরণের অপরাধের ঘটনা বেড়েই চলছে।যাইহোক, রাজ্যে নারীদের নিরাপত্তা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত সত্য আরও উন্মোচিত হয়ে যায় যখন তাদের ওপর ঘটা অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার বিবেচনা করা হয়।তৃণমূল-শাসিত রাজ্যে এই জাতীয় অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার সর্বনিম্ন,২%। যেখানে গোটা দেশের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার ২৯.৮%। আবার এরমধ্যে খোদ কোলকাতায় এইধরণের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার ৭.৮%। এই সমস্ত পরিসংখ্যানই থানায় ও আদালতে নথিভুক্ত অভিযোগের ভিত্তিতে পাওয়া গিয়েছে, যেখানে আমরা সবাই জানি এই দেশের, বিশেষ করে আমাদের রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসন কীভাবে রাজ্যের শাসকদলের তল্পীবাহকের ভূমিকা পালন করে থাকে। যেখানে পোস্ট-মর্টেমের আগেই মুখ্যমন্ত্রী এক মৃতা ধর্ষিতা নাবালিকার ‘চরিত্র’ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।সেই রাজ্যের শাসক দলের মুখে আর যাই মানাক নারীদের সুরক্ষা বা আইন শৃঙ্খলা নিয়ে গর্ব করা মানায় না।
ওয়েবডেস্কের পক্ষেঃ সরিত মজুমদার