লক ডাউন ও অর্থনীতি - সুমিত দে...

২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১,রবিবার

লকডাউন শব্দটি এখন আমাদের কাছে বহুল চর্চিত ও পরিচিত। গতবছর মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে দেশজুড়ে আগাম প্রস্তুতি ছাড়া দেশের প্রধানমন্ত্রী নাটকীয় ভঙ্গিতে টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে উঠে লকডাউনের ঘোষণা করলেন।
তারপরেই শুরু হল করোনা ভাইরাস খতমের নামে প্রদীপ প্রজ্বলন, শঙ্খধ্বনি আর পুষ্পবৃষ্টি কর্মসূচী; এ যেন লকডাউন নামক নতুন অতিথিকে সূচনা পর্বে আবাহন!
লকডাউনের নির্মম পরিণতি কিছুদিনের মধ্যেই জনমনে বোধগম্য হল।এক ঝটকায় কাজ হারালো কয়েক লক্ষ মানুষ। হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক শত শত যোজন পথ অতিক্রম করে অনিশ্চিত ভবিষ্যতকে সাথে নিয়ে পাড়ি দিলেন এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে। রেল স্টেশনে মৃতা মা'র আঁচল ধরে ছোট্ট শিশুর কাতর আকুতি বা রেল লাইনের ধারে পরিযায়ী শ্রমিকদের লাশ আর রুটির রক্তমাখা টুকরো মাখামাখি করেপড়ে থাকল- চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল লকডাউনের নিদারুন মহিমা।

করোনা ভাইরাসকে কৌরব পক্ষে রেখে দেশের প্রধানমন্ত্রী পান্ডব পক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে কল্পিত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ জয়ের ঘোষণা সেরে ফেললেন।আর যুদ্ধ জয়ের আবহে মাত্র সত্তর কোটি টাকা খরচ করে রেলের ব্যবস্থাপনায় কাজ হারানো পরিযায়ী শ্রমিকদের নিজের রাজ্য ফেরানো যায় না কিন্তু রাজধানী সাজাতে কুড়ি হাজার কোটি টাকা খরচে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের সেন্ট্রাল ভিস্তা নির্মান চলতে থাকে। লকডাউন ঘোষণার এক মাসের মধ্যে দেশের বাছাই করা ৫০ জন কর্পোরেট মালিকের ৬৮ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মুকুব অবলীলাক্রমে কার্যকর হয়।

মানব ইতিহাসে সময়ের ব্যবধানে অতিমারীর দাপট নতুন কিছু নয়। যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব জৈবিক নিয়মেই সেখানে ভাইরাসের অবস্থান অবশ্যম্ভাবী। এ কথা ঠিক যে, সম্পূর্ণ অপরিচিত এই ভাইরাস সারা পৃথিবীকে স্তব্ধ করে দিয়ে কেড়ে নিয়ে চলেছে বহু জীবন।

বিশ্বায়ন-উদারীকরণের হাত ধরে ভারতের অর্থনীতিতে সংস্কারের পর্ব ১৯৯১ সাল থেকে শুরু হয়ে তা এখন ৩০ বছরের যুবক। অর্থনীতির তথাকথিত সংস্কার ভারতের জনগণের বিভিন্ন অংশে বহুমাত্রিক অভিঘাত সৃষ্টি করেছে;যা বর্তমান সময়ে চরম আগ্রাসী।

২০০৮ সাল থেকে বিশ্ব পুঁজিবাদ মন্দায় নিমজ্জিত। নয়া উদারীকরণের পথ ধরে চলা ভারতীয় অর্থনীতি অনিবার্যভাবেই সংকটে জর্জরিত। কমছে জনগণের জীবনমান,চওড়া হচ্ছে আর্থিক বৈষম্য। কমছে আয়, কমছে চাহিদা আর বাড়ছে দারিদ্র। এহেন পরিস্থিতিতে অতিমারীর প্রভাব অর্থনীতির গতিধারায় বড়সড় নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করেছে। ভারতের অর্থনীতিতে কোভিড জনিত অতিমারী পরিস্থিতির আগে ২০১৬ সাল থেকেই অাভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির হার ক্রমাগত কমেছিল। 'যত দোষ নন্দ ঘোষ' এর মত কোভিড পরিস্থিতিকে দায়ী করে সরকার যতই মিথ্যার ফানুস রচনা করুক না কেন সরকারী বচন প্রকৃত সত্যের থেকে বহু যোজন দূরে। ২০১৮ সাল থেকে বিনিয়োগের হার ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধির হার ক্রমহ্রাসমান। কোভিড পরিস্থিতি শুরুর আগেই কর বাবদ রাজস্ব আদায় কমতে শুরু করে। কমতে থাকে বিদ্যুতের চাহিদাও। ২০১৭-১৮ আর্থিক বছরের চতুর্থ ত্রৈমাসিকে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের রেখচিত্র কেবলই নিম্নমুখী ছিল।
লকডাউন ঘোষণার মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাধা পায়। দৈনিক মজুরি উপর নির্ভরশীল মানুষের কাজ হারানোর ফলে আয় কমে।২০১৯ সালের এপ্রিল মাসের তুলনায় সম্পূর্ণ লকডাউন পর্বে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে শিল্প উৎপাদন কমে প্রায় ৫৫ শতাংশ, পরিষেবা ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে নিচে নেমে আসে। পরিবহন,পর্যটন, বিনোদন, নির্মাণ সমস্ত ক্ষেত্রে সংকট ঘনীভূত হয়।

কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী ২০২১ আর্থিক বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে ভারতীয় অর্থনীতি ৭.৩ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে, বেকারি বৃদ্ধির হার ৭.৯ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ হয়েছে। এযাবৎ কালে ব্যতিক্রমী কিছু জরুরী পরিষেবা ক্ষেত্র ছাড়া সর্বত্র অর্থনীতির বদ্ধ দশা সৃষ্টি হয়েছে। কৃষি ক্ষেত্র ছাড়া দেশের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে মন্দার প্রভাব বিদ্যমান।আগামী বছরগুলিতে এই গতি অব্যাহত থাকবে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকরা; এদের মধ্যে রয়েছে চুক্তি শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, ঠিকা শ্রমিক, সহ পরিষেবা ক্ষেত্র সহ বিভিন্ন ছোট শিল্পের শ্রমিকরা। শিল্প ক্ষেত্রের ৫০ শতাংশ এবং পরিষেবা ক্ষেত্রের ৮০ শতাংশ এই ধরনের শ্রমিক॥ এদের আয় বন্ধ হওয়া বা বড়সড় হারে কমার জন্য প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে।

নয়া উদারবাদী সংস্কারের পথ হল আর্থিক নীতির প্রশ্নে জনমুখী অবস্থান প্রত্যাহার করে মুনাফা কেন্দ্রিক অবস্থান গ্রহণ করা। মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের হার নিম্নমুখী হওয়ার কারণে বাজারে ক্রয়- বিক্রির পরিমাণের বৃদ্ধির হার ক্রমাগত কমছে। কর্পোরেটের মুনাফা যখন সংকটে পড়েছে তখন সরকার কর্পোরেটের মাসিহা হয়ে তাদের মুনাফাকে সুনিশ্চিত করতে যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। ন্যাশানাল মনিটাইজেশন পাইপলাইনের নামে রাষ্ট্রায়ত্ত রেল,বন্দর, বিমান, টেলি পরিষেবা, ব্যাংক, বীমা, জাতীয় সড়ক, খাদ্য নিগমের গুদাম, প্রতিরক্ষা উৎপাদন, এমন কি স্টেডিয়াম পর্যন্ত বিক্রির জন্য চৈত্র সেল বা ধনতেরাসের আদলে লাগামহীন বিক্রির দরজা খুলে বসেছে। সম্প্রতি টেলিকম ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ৪৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০০ শতাংশ করার ছাড়পত্র অনুমোদন করেছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। সরকারি ব্যয় কমেছে ৪১ শতাংশ, নতুন বিনিয়োগ কমেছে ১৮ শতাংশ। অতিমারী কালে লোকসানের অজুহাতে ১৯টি বিমানবন্দর বিক্রি চূড়ান্ত। এমন কি মহাকাশ গবেষণা সংস্থার মত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নিয়োগও বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। ৪১টি প্রতিরক্ষা উৎপাদন কেন্দ্র বেসরকারীকরণের পথে।
যখন শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্রে মুনাফা সংকুচিত তখন ধান্দার পুঁজির কেষ্ট-বিষ্টুদের নজর কৃষিক্ষেত্রে। কৃষি ব্যবস্থার উপর কর্পোরেটের দখল নিশ্চিত করতে সংশোধনী এনে নতুন কৃষি আইন লাগু হয়েছে। নতুন শ্রমকোড চালুর নামে শ্রমিকদের শ্রম আরো আঁটোসাঁটো ভাবে লুটের জন্য পাকাপোক্ত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে।

জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থার তথ্য হলো ভারতের ১০ শতাংশ মানুষের হাতে ৫০ শতাংশ সম্পদ, আর দরিদ্রতম ভারতবাসীর ৫০ শতাংশের হাতে মাত্র ৬.২ শতাংশেরও কম সম্পদ। আয় ও সম্পদের অসম বন্টন, এর অনিবার্য ফল বৈষম্যের তীব্রতা। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ইতিমধ্যে জানিয়েছেন ১৯৯১ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ বেকারী বৃদ্ধির হার ভারতের।

কাজ হারানো মানুষকে রক্ষা ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে অর্থনীতিকে কিছুটা চাঙ্গা করার লক্ষ্য নিয়ে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা বারবার পরামর্শ দিয়েছেন যে,নানা সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে মানুষের কাছে অর্থ পৌঁছাও, বাড়াও চাহিদা,ঘুরবে অর্থনীতির চাকা।

আম আদমীর আর্থিক জীবনে স্থবিরতা সম্প্রসারিত হচ্ছে। শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্রে ক্রম- বর্দ্ধমান সংকটের কারণে কৃষিক্ষেত্রে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শ্রমিক সংখ্যা বাড়বে;ফলতঃ গ্রামীণ ক্ষেত্রে মজুরি আগামীতে কমবে।

পেট্রোল,ডিজেল সহ সমস্ত প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েই চলেছে। ২০২১ সালের আগস্ট মাসের মূল্য বৃদ্ধির হার ১১.৩৯ শতাংশ, বিগত ১৫ মাস ধরে দাম বেড়েই চলেছে। এক দিকে দাম বৃদ্ধি আরেক দিকে আয় হ্রাস- নিত্য জীবনের অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ ক্ষতিকর প্রভাব।

দেশের পাঁচশোর বেশি কৃষক সংগঠন বিগত প্রায় নয় মাস ধরে তিনটি কৃষি আইন বাতিল, বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল বাতিল ও ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবিতে আন্দোলনে রাস্তায়। ৬০০-র বেশী কৃষক আন্দোলনের রাস্তাতেই মৃত্যু বরণ করেছেন। শ্রমিক সংগঠনগুলো গত বছরের ২৫ নভেম্বর দেশ জোড়া ধর্মঘটে শামিল হয়েছেন। আন্দোলনের পথে ছাত্র,যুব,মহিলা সহ সর্বস্তরের শ্রমিক-কর্মচারী সংগঠনগুলি।

নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষ কাছে দেশের অর্থনীতি ক্রমশঃ অর্থহীন হয়ে পড়ছে।
হীরক রাজার দেশের চরণদাসের সুরে সুর মিলিয়ে আপামর জনগণ মোদি সরকারের রাজ সভায় সোজাসাপটা গেয়ে উঠছেন-

"....ও ভাইরে ও ভাই কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়। আমি যেই দিকেতে চাই দেখে অবাক বনে যাই আমি (নীতির)অর্থ কোনো খুজি নাহি পাইরে,........

দেখ ভালো জনে রইল ভাঙা ঘরে, মন্দ যে সে সিংহাসনে চড়ে। ও ভাই সোনার ফসল ফলায় যে তার দুই বেলা জোটেনা আহার,......

হীরার খনির মজুর হয়ে কানাকড়ি নাই,..."
আর প্রস্তুতি নিচ্ছেন ২৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী ধর্মঘট ও হরতালের।




শেয়ার করুন

উত্তর দিন