অর্কপ্রভ সেনগুপ্ত
“যন্ত্রটা থেকে বেরিয়ে-আসা কথাগুলো এরকম –
‘২১-এ জানুয়ারি সন্ধ্যে ৬টা ৫০ মিনিটে…’
তাড়াতাড়ি এই কথাগুলো টুকে নিয়ে ফিতেটা ছেড়ে দিয়ে টেলিগ্রাফার হাতের ওপর মাথাটা রেখে ফের শুনতে থাকল।
‘…গতকাল গোর্কিতে মারা গেছেন…’
ধীরে ধীরে সে অক্ষরগুলো টুকে নিতে লাগল কাগজের বুকে।
দীর্ঘ জীবনে এ রকম কতো খবর সে টুকেছে – আনন্দের খবর আর মর্মান্তিক দুঃখের খবর – অন্যের আনন্দ কিংবা বেদনার সংবাদ – সে যে আর-সবার আগের কতোবার পেয়েছে তার হিসেব নেই ! এই সব কাটছাঁট সংক্ষিপ্ত কথাগুলোর মানে নিয়ে ভাবতে বসার অভ্যাসটা সে অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছে। এখন সে শুধু আওয়াজটা শুনে যায় আর যান্ত্রিকভাবে অক্ষরগুলো লিখে চলে কাগজের বুকে।
এবারও কেউ একজন মারা গেছে, এবং সেই ঘটনাটা আর-কাউকে জানানো হচ্ছে। টেলিগ্রাফার বৃদ্ধটি গোড়ার কথাগুলো ভুলে গেছে : ‘সবাইকে জানানো যাচ্ছে ! সবাইকে জানানো যাচ্ছে ! সবাইকে জানানো যাচ্ছে !’ টরেটক্কা আওয়াজে যন্ত্রটার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে অক্ষরগুলো : ‘ভ্লা-দি-মি-র্ ই-লি-চ্’, আর বৃদ্ধ টেলিগ্রাফারটি কানে-শোনা সেই টকাটক আওয়াজগুলোকে লিখিত হরফে অনুবাদ করে চলেছে। নিরুদ্বেগ মনে বসে আছে সে, সামান্য একটু ক্লান্তিও বোধ করছে। ভ্লাদিমির ইলিচ নামে কেউ একজন কোনো এক জায়গায় মারা গেছে – এই বেদনাতুর সংবাদটি কেউ একজন পাবে, তার হৃদয় নিংড়ে বেরিয়ে আসবে একটা ব্যাথাভরা যন্ত্রণার আর্তস্বর – কিন্তু এ ঘটনার সঙ্গে টেলিগ্রাফারের কোনো সম্পর্ক নেই, কারণ সে তো এই ঘটনার পেছনে একজন আকস্মিক দর্শক মাত্র। যন্ত্রের মুখে বেরিয়ে এল একটা বিন্দু-চিহ্ন, তারপরে একটা ড্যাশ্-চিহ্ন, তারপরে আরও কয়েকটা বিন্দু, আরেকটা ড্যাশ্… পরিচিত আওয়াজগুলোর মধ্যে দিয়ে সে প্রথম অক্ষরটা বুঝে নিল, টেলিগ্রামের ফরমটার ওপরে লিখে ফেলল ‘ে’ অক্ষর-চিহ্নটি। তারপরে শোনা গেল দ্বিতীয় অক্ষরের আওয়াজ – ‘ল’। এর পাশেই সে পরিষ্কার হাতে লিখে ফেলল ‘ি’ অক্ষর-চিহ্নটি। খাড়া সোজা রেখার টানটি দিয়েই তাড়াতাড়ি বসাল একটি ‘ন’। তারপরে অন্যমনস্কভাবে যন্ত্রের আওয়াজ শুনে শেষ অক্ষরটি বসাল – আরেকটি ‘ন’।
যন্ত্রটির মুখ থেকে একটি বিরতির চিহ্ন বেরিয়ে এল এবং মুহূর্তের জনে টেলিগ্রাফারের দৃষ্টি পড়ল তার লেখা এই শব্দটির ওপরে: ‘লেনিন’।
টরেটক্কা আওয়াজ করেই চলেছে যন্ত্র – কিন্তু এতক্ষণে এই অতি-পরিচিত নামটি টেলিগ্রাফারের চেতনা চিরে ঢুকে পড়ল। খবরটার শেষ শব্দটার ওপর সে আরেক নজর তাকাল – ‘লেনিন’। এ কী ! লেনিন ? টেলিগ্রামের সমস্ত কথাগুলো তার মনের পটে ঝিলিক মেরে গেল। অপলক চোখে তাকিয়ে রইল সে টেলিগ্রাম ফরমটার ওপর – টেলিগ্রাফ অপারেটর হিসেবে তার বত্রিশ বছরের কর্মজীবনে সে এই প্রথম নিজের হাতে লেখা অক্ষরগুলোকে বিশ্বাস করতে পারল না।
লাইনগুলোর ওপরে তিনবার সে দ্রুত চোখ বুলিয়ে গেল, কিন্তু অক্ষরগুলো কিছুতেই বদলে যাবে না বলে গোঁ ধরেছে: ‘মারা গেছেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন’। লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল বৃদ্ধ টেলিগ্রাফার, পাক খেয়ে পেঁচিয়ে যাওয়া ফিতেটাকে এক হেঁচকা টানে ছিঁড়ে নিয়ে তার গায়ের চিহ্নগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল সে। যে কথাটা সে বিশ্বাস করতে চাচ্ছিল না, সেই কথাটা সুস্পষ্টভাবে লেখা রয়েছে প্রায় দু’মিটার লম্বা এই ফালিটার গায়ে। মড়ার মতো মুখ নিয়ে ফিরে তাকাল সে সহকর্মীদের দিকে, তাদের কানে বাজল বৃদ্ধের আর্ত চিৎকার, ‘লেনিন মারা গেছেন !’
এই মর্মান্তিক বিয়োগ-বেদনার খবরটা টেলিগ্রাফের অফিসের চওড়া খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসে ঘূর্ণির গতিতে ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র – স্টেশন পার হয়ে তুষার-ঝড়ের মধ্যে দিয়ে রেল-পথ বেয়ে সিগন্যাল-ঘরে, বরফ-ঝরে-পড়া হাওয়ার ঝাপ্টায় রেল-কারখানার লোহার দেউড়ি ভেঙে কারখানা-ঘরের ভেতরে।”
নিকোলাই অস্ত্রভ্স্কি তাঁর কালজয়ী ‘ইস্পাত’ উপন্যাসে লেনিনের প্রয়াণের প্রতিক্রিয়ার উপরে বর্ণিত যে ছবি এঁকেছেন, তা এক কথায় অনবদ্য। আমরা, মার্কসবাদীরা, ইতিহাসে ব্যক্তির গুরুত্বকে চিরকালই গৌণরূপেই দেখে এসেছি। মার্কস তাঁর বিখ্যাত ‘লুই বোনাপার্টের অষ্টাদশ ব্রুমেয়ার’-এ লিখেছিলেন, ‘স্বীয় ইতিহাস মানুষই রচনা করে বটে, কিন্তু ঠিক আপন খুশিমতো নয়, নিজেদের নির্বাচিত পরিস্থিতিতে নয়, প্রত্যক্ষবর্তী, অতীত থেকে প্রদত্ত ও আগত পরিস্থিতিতে।’ অর্থাৎ, মার্কসবাদ আমাদের যে ইতিহাসচিন্তা শেখায়, সেখানে কোনও মহামানবের স্থান নেই এবং ইতিহাসের গতির নিয়ন্ত্রক কোনও ‘Great Man’ নয়। লেনিন নিজেও এই ইতিহাসচিন্তায় আস্থা রাখতেন, বিশ্বাস করতেন ব্যক্তির ভূমিকার সীমাবদ্ধতায়। এ’কথা মানতেন বলেই শোনা যায় সদ্যজাত সোভিয়েতের প্রথম মে দিবসের মিছিলে বিদেশী ফিল্ম ক্র্যু-দের ক্যামেরা তাঁর দিকে তাক করা দেখে ছুটে গেছিলেন লেনিন। ‘কি করছেন আপনারা ?’ এই প্রশ্নের উত্তরে যখন ক্যামেরাম্যান জানালেন তাঁরা বিপ্লবের নায়কদের ছবি তুলছেন, সহাস্যে লেনিন লাল পতাকায় মোড়া জন জোয়ারের দিকে আঙুল তুলে জবাব দিয়েছিলেন, ‘তাহলে আপনাদের ক্যামেরা আমাদের দিকে তাক করা কেন কমরেড ? বিপ্লবের নায়করা ঐদিকে।’
এই অবধি কথা ঠিকই। একথা ঠিক যে ইতিহাসের ‘Great Man’ তত্ত্ব ভুল। একথাও ঠিক মহামানবরা ইতিহাস নির্মাণ করেন না। ইতিহাস আদতে নির্মিত হয় শ্রমজীবী মানুষের কড়া পড়া হাতের ছোঁয়ায়। এই দিক থেকে লেনিনের মূল্যায়নের বা মার্কসের চিন্তায় কোনও ভুল নেই। তারপরেও এই বক্তব্যে একটা ‘কিন্তু’ রয়ে যায়। সেই ‘কিন্তু’ হল, কখনও কখনও ইতিহাসে এমন ব্যক্তির আবির্ভাব হয় যাঁরা ইতিহাসকে চালনা না করলেও তাঁদের মধ্যে দিয়ে প্রকট হয় সেই যুগের বিশেষ ধারা। তাঁরা দেবী ক্লিও-কে নির্দেশ প্রদান করেন না ঠিকই, কিন্তু দেবী ক্লিওর ইচ্ছা মূর্ত হয় তাঁদের মধ্যে দিয়েই। যা সমষ্টির আকাঙ্ক্ষা, তাই-ই প্রকাশিত হয় তাঁদের কর্মের মাধ্যমে। লেনিন, আমাদের ইলিচ, ছিলেন এইরকমই মানুষ। তিনি মহামানব ছিলেন না, মহামতিও ছিলেন না। কিন্তু দীর্ঘকালের শ্রেণি শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ১৯১৭ সালে রাশিয়ার শ্রমজীবী জনতার ক্ষোভের যে আগ্নেয়গিরি ফেটে পড়েছিল, ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে যে বিপুল গণ-শক্তির আবির্ভাব হয়েছিল, ইতিহাস স্বয়ং তাঁকে আহ্বান জানিয়েছিল সেই শক্তিকে সঠিক দিকে পরিচালনা করার জন্য। এই আহ্বান অকুতভয় লেনিন স্বীকার করেছিলেন এবং নিজেকে রূপান্তরিত করেছিলেন রাশিয়ার শ্রমজীবী জনতার সবচেয়ে ধারালো, সবচেয়ে তীক্ষ্ণ তরবারিতে। যে সময় ধ্রুপদী মার্কসবাদীরা একপ্রকার অদৃষ্টবাদী হয়ে এই দায়িত্ব নিতে বারে বারে অস্বীকার করেছিলেন, মার্কসীয় ইতিহাসচিন্তার গোঁড়া ব্যাখ্যার মাধ্যমে বারংবার বলার চেষ্টা করেছিলেন ইতিহাসের ‘স্টেপ জাম্প’ হয় না, তখন আমাদের ইলিচ-ই সাহস দেখিয়েছিলেন সমস্ত বিপদ ও ব্যর্থতার আশঙ্কা মাথায় নিয়েই অন্ধকারে ঝাঁপ দেওয়ার। সাহস দেখিয়েছিলেন এমন পথে পা রাখার যে পথে এর আগে কেউ হাঁটেনি, প্রচুর ভুলভ্রান্তি হবে এবং সেই গরল তাঁকেই কন্ঠে ধারন করতে হবে জেনেই। ইলিচের এই সিদ্ধান্তই, যা তাঁর ব্যক্তিগত সাহসের ও ইতিহাসের প্রতি কর্তব্য সম্পর্কে সচেতনতার পরিচায়ক, তাঁকে ইতিহাসে অমর করেছে। এরই স্বীকৃতি হিসেবে তিনি স্থান পেয়েছেন সেই সকল মানুষের তালিকায়, যাঁদের মৃত্যু ছিল ‘পাহাড়ের থেকেও ভারী’। ‘ইস্পাত’-এর বৃদ্ধ টেলিগ্রাফার, যাকে বছরের পর বছর অসংখ্য ব্যক্তির অসংখ্য মৃত্যুসংবাদ বিচলিত করতে পারেনি, ঠিক এই কারণেই ডুকরে উঠেছিল টেলিগ্রাফের মৃত্যু বার্তায় ‘লে-নি-ন’ কথাটি দেখে। কারণ এই মৃত্যু ব্যক্তির নয়, এমনকি মহামানবেরও নয়। এই মৃত্যু ছিল এমন একজনের যাঁর মধ্যে দিয়ে রুশ বিপ্লবের সামগ্রিক গণ-শক্তি ও গণ-ইচ্ছা মূর্ত রূপ পেয়েছিল। এমন একজনের যিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থেকে তার প্রতি নিষ্ঠা অটুট রেখেছিলেন।
এই সার-সত্যটি যাঁরা বোঝেন, তাঁরা এ-ও বোঝেন ইলিচ-কে মুছে ফেলা যাবে না। যতদিন সাম্যবাদ থাকবে, যতদিন নতুন প্রকার সমাজের স্বপ্ন থাকবে, থাকবেন লেনিনও। তাঁর এই প্রাসঙ্গিকতার কথা, মুখে অন্যরকম বললেও, তাঁর বিরোধীরাও জানেন। এই বছর, ২০২৪ সাল, ইলিচের চলে যাওয়ার ১০০ বছর। বৃদ্ধ টেলিগ্রাফারের হাতে ‘মারা গেছেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন’-এই বার্তা আসার এক শতক। আমাদের বিগত তিন দশক ধরে বলা হচ্ছে লেনিন আর প্রাসঙ্গিক নন, প্রাসঙ্গিক নয় লেনিনের আদর্শও। সোভিয়েতের পতনের পর দুইয়েরই নাকি স্থায়ী স্থান হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে। তা বেশ তো, যা অপ্রাসঙ্গিক তা তো স্বতঃসিদ্ধ ভাবেই অপ্রাসঙ্গিক। তাকে তো বারে বারে ঢাকঢোল পিটিয়ে অপ্রাসঙ্গিক বলতে হয় না। অথচ ইলিচের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি তার বিলক্ষণ প্রয়োজন পড়ছে। তাঁর জন্মের ১৫০ বছর উপলক্ষে বৃহৎ পুঁজির মুখপত্রগুলি একরাশ নিন্দা-বাদ বমন করেছিল। আর এই বছরও, তাঁর মৃত্যু শতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত কুৎসামূলক অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধর বহর দেখে ঠাওর করা মুশকিল যে লেনিন অপ্রাসঙ্গিক। এইরকম আক্রমণ মার্কসকেও সহ্য করতে হয়নি কোনওদিন।
এর কারণ আছে। লেনিন ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’-এ লিখেছিলেন, ‘মহান বিপ্লবীদের জীবদ্দশায় উৎপীড়কেরা তাঁদের ওপর অবিরাম নিগ্রহ চালিয়েছে, তাঁদের মতবাদকে আক্রমণ করেছে হিংস্র বিদ্বেষে, ক্ষিপ্ত ঘৃণায় এবং মিথ্যা ও কুৎসার বেপরোয়া প্রচারে। মৃত্যুর পর আবার নিপীড়িত শ্রেণিকে ‘সান্ত্বনা’ প্রদানের জন্য, তাদের বোকা বানাবার নিমিত্ত চেষ্টা হয়েছে এই বিপ্লবীদের নিরীহ দেবমূর্তিতে পরিণত করার, তাঁদের উপর সাধুর মাহাত্ম্য আরোপ করার। এই জন্য চেষ্টা করা হয়েছে মহান বিপ্লবীদের নামের পাশে খানিকটা জ্যোতি আরোপ করে তাঁদের বৈপ্লবিক মতবাদের মর্মবস্তুকে বিসর্জন দেওয়ার, তার বৈপ্লবিক ধার ভোঁতা ও ছেঁদো করে তোলার।’ মার্কসকে এই প্রকার এক ‘তত্ত্বজ্ঞানী সাধু’ হওয়ার ভবিতব্য থেকে বাঁচাতে ও তাঁর মতাদর্শের বিপ্লবী ধার রক্ষা করতে আজীবন লড়াই চালিয়েছেন লেনিন এবং একই সঙ্গে সতর্ক থেকেছেন যাতে কোনওদিন তাঁর আদর্শের ধার রক্ষা করার জন্য কাউকে এই প্রকার লড়াই চালাতে না হয়। এই সতর্কতারই ফলস্বরূপ আজও পুঁজিবাদী বিশ্বে মার্কসের চিন্তাকে ভোঁতা করার প্রচেষ্টা অব্যহত থাকলেও, লেনিনের গায়ে কেউ হাত দিতে পারেননি। তাঁকে ‘মহাপুরুষ’ বা ‘সাধু’-তে পরিণত করার বা তাঁর মতাদর্শকে নির্বিষ করে দেওয়ার কেউ প্রচেষ্টাও করেনি। কারণ ওই পক্ষও জানে, মৃত্যুর একশো বছর পরেও তাঁদের ভয়ংকরতম শমনের বিষদাঁত ভাঙা বা তাঁর ভাবমূর্তিকে পোষ মানিয়ে নিজেদের কাজে ব্যবহার করা – এ এক অসাধ্য কাজ।
কিছু মাস আগে লেনিন সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দেখছিলাম ‘Radio Free Europe’-এ। এই সংস্থাটি প্রত্যক্ষ ভাবে C.I.A-এর অর্থে বলীয়ান হয়ে ঠান্ডা লড়াই-এ মার্কিন প্রচারনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমানেও তার ভূমিকা সেইরকমই। সুতরাং তাঁরা ‘অপ্রাসঙ্গিক’ লেনিন সম্পর্কে কি-রকম প্রতিবেদন করবেন, পাঠক সহজেই অনুমান করতে পারেন। প্রতিবেদনটি শেষ হল এই বলে, যে লেনিন-কে কেউ রাশিয়ায় এখন আর মনে রাখেনি, অধিকাংশ মানুষই তাঁকে ভুলে গেছে। কি আশ্চর্য ! ইউটিউবে থাকা প্রতিবেদনটির ঠিক নিচেই প্রথম ও সর্বাপেক্ষা সমর্থিত রাশিয়ান ভাষায় লেখা মন্তব্যটিই হল, ‘ইলিচ, সবাই ভুলে গেলেও রাস্তা আপনাকে মনে রাখবে। ভুলবে না কোনওদিন।’ ২২ তারিখ, ২২-শে এপ্রিল, লেনিনের ১৫৫-তম জন্মদিবস। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ‘একটু পা চালিয়ে ভাই’-এ অভিযোগের আর হতাশার সুরেই লিখেছিলেন ধর্মতলায় ট্রামের গুমটির পাশে লেনিনকে দাঁড় করিয়ে রেখেই আমরা খুশি। খুশি না হলেও, আমরা কিঞ্চিৎ আত্মতৃপ্ত ছিলাম, এতে বোধ হয় সন্দেহ নেই। শতাব্দী ঘুরে নতুন শতাব্দী পড়েছে। বিশ্বজুড়ে নতুন ঘূর্ণন। আমাদেরও আর আত্মতৃপ্তির অবকাশ নেই। নেই বলেই লেনিন আরও প্রাসঙ্গিক। তাঁর যে গুণগুলির জন্য রাশিয়ার গণ-শক্তি তাঁর হাতে দায়িত্বভার তুলে দিয়েছিল আর নির্ভিক ভাবে ভীষ্ম-সম প্রতিজ্ঞায় অটল থেকে যে দায়িত্ব তিনি পালন করেছিলেন, তার অনুশীলন আজকে ভয়ংকর জরুরি। লেনিনকে ‘মহামতি’ রূপে বসিয়ে তাঁর পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছি, এই ভেবে সন্তুষ্ট থাকার দিন শেষ। বরং আমাদের প্রত্যেককেই শিখতে হবে এবং প্রয়োগ করতে হবে সেই গুণগুলি যার জন্য আজও বিশ্ব পুঁজিবাদী শক্তি তাঁর ভয়ে ভীত। তাঁর বিপ্লবী আশাবাদ, তাঁর বজ্র কঠিন দায়িত্ববোধ, তাঁর তাত্ত্বিক সৃজনশীলতা, তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের ক্ষমতা, তাঁর আদর্শের সঙ্গে আপোষ না করার জেদ – এই প্রত্যেকটি গুণ আজ ততটাই প্রাসঙ্গিক, যতটা এক শতক আগে ছিল। আমাদের আশা রাখতে হবে, এই গুণগুলির অনুশীলনের মাধ্যমেই ব্যক্তি লেনিন ছড়িয়ে পড়বেন সমষ্টির মধ্যে। বিপ্লবী আশাবাদ ছড়াবে দাবানলের মতো, শত শত মননে জাগবে নতুন ভোরের জন্য পরিশ্রমের ক্ষমতা, লক্ষ চোয়াল শক্ত হবে আপোষহীন আদর্শের জেদে। তারপর, তারপর একদিন শেষ যুদ্ধের ময়দানে কোটি কণ্ঠে ধ্বনিত হবে সুকান্তর অগ্নি অক্ষরে লেখা পঙক্তিগুলি –
“মৃত্যুর সমুদ্র শেষ; পালে লাগে উদ্দাম বাতাস
মুক্তির শ্যামল তীর চোখে পড়ে, আন্দোলিত ঘাস।
লেনিন ভুমিষ্ঠ রক্তে, ক্লীবতার কাছে নেই ঋণ,
বিপ্লব স্পন্দিত বুকে, মনে হয় আমিই লেনিন”