আলেকজান্ডার লিও ট্র্যাকটেনবার্গ
রাশিয়ায় বিপ্লবী আন্দোলনের শুরুর দিকে মে দিবস ও তার গুরুত্ব সম্পর্কে শ্রমিকদের অবহিত করতে লেনিন একটি লিফলেট লেখেন। ছোট আকারের সেই প্রচারপত্রটি ‘মে ডে লিফলেট’ নামে পরিচিতি পায়। ১৯৮৬’তে লেনিন তখন কারাগারে আটক, বন্দী অবস্থাতেই লিখেছিলেন। গোপনে জেলের বাইরে এনে প্রকাশ করা হয়। লিফলেট’টি লেখা হয়েছিল সেন্ট পিটার্সবার্গের শ্রমিক মুক্তি সংঘের জন্য, ঐ সংঘ ছিল রাশিয়ায় প্রথম দিকের মার্কসবাদী রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে অন্যতম। দু’হাজার কপি ছাপা হয়েছিল, সবটাই মিমিওগ্রাফ মেশিনের সাহায্যে। চল্লিশটি কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে সেই লিফলেট বিলি করা হয়। লেনিন নিজের স্বভাবসিদ্ধ সহজ-সরল ভাষায় বয়ান লিখেছিলেন, উদ্দেশ্য ছিল পড়তে পারে এমন শ্রমিকরা যেন সহজেই বক্তব্যের অর্থ বুঝতে পারে। সেই সময় ঐ সংঘের হয়ে লিফলেট প্রচারের কাজে যুক্ত ছিলেন এমন একজন পরে আমাকে বলেন- ‘১৮৯৬ সালে বস্ত্রশিল্পের শ্রমিকেরা ধর্মঘট শুরু করে। লিফলেট প্রচারের পরে একমাস কেটে গেছে। এ ধর্মঘটের বুনিয়াদী প্রেরণা এসেছিল লেনিনের লেখা সেই ছোট্ট লিফলেট পড়েই।’

শ্রমিকদের নিজের কাজের জায়গায় অর্থাৎ কারখানার মালিকদের স্বার্থে কীভাবে শোষণ করা হয় এবং যারাই নিজেদের জঘন্য অবস্থা উন্নতির জন্য দাবি তোলে, তাদেরকেই সরকার কীভাবে দমন করে, সে কথা বোঝানোর পর লেনিন মে দিবসের গুরুত্ব নিয়ে লিখতে শুরু করেন।
ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানি এবং অন্যান্য যেসমস্ত দেশে শ্রমিকরা ইতিমধ্যেই শক্তিশালী ইউনিয়ন গঠন করেছেন, নিজেদের জন্য একাধিক অধিকারও অর্জন করেছেন। এ সকল দেশে ১৯শে এপ্রিল তারিখটিকে শ্রমিকরা নিজেদের জন্য একটি সর্বজনীন ছুটির দিন হিসাবে পালন করে। ইউরোপীয় ক্যালেন্ডারের তুলনায় তৎকালীন রাশিয়ান ক্যালেন্ডার ১৩ দিন পিছনে ছিল। দমবন্ধ করা কারখানার পরিসর ছেড়ে বেরিয়ে এসে ঐ দিন তারা সংগীতের সুরে, উড়ন্ত পতাকা হাতে শহরের প্রধান রাস্তাগুলিতে মিছিল করে, মালিকদের সামনে নিজেদের ক্রমবর্ধমান শক্তির পরিচয় দেয়। বিশাল জনসমাবেশগুলিতে তারা একত্রিত হয়, বক্তৃতার মাধ্যমে বিগত সময়ে অর্জিত বিজয়গুলিকে তুলে ধরা হয় এবং ভবিষ্যৎ সংগ্রামের পরিকল্পনাও নির্ধারণ করা হয়। ধর্মঘট হওয়ার ভয়ে মালিকেরা ঐ দিন কারখানায় অনুপস্থিত থাকার কারণে শ্রমিকদের জরিমানা করার সাহস দেখায় না। এ দিনটিতে মালিকদের সামনে শ্রমিকেরা নিজেদের প্রধান দাবিটি পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেয়: ৮ ঘণ্টার কাজ, ৮ ঘণ্টার বিশ্রাম, এবং ৮ ঘণ্টার বিনোদন। আজ বিশ্বের অন্যান্য দেশেও শ্রমিকদের দাবি তাই।
রাশিয়ার বিপ্লবী আন্দোলন মে দিবসকে অত্যন্ত পরিকল্পিত ও কার্যকরী হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছিল। ১৯০০ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত একটি পুস্তিকা ‘মে ডে’জ ইন খারকভ’–এর ভূমিকায় লেনিন লিখেছিলেন: ‘আর ছ-মাসের মধ্যে রাশিয়ার শ্রমিকরা নতুন শতাব্দীর প্রথম বছরের ১লা মে উদযাপন করবে। এইবার যত বেশি সংখ্যক কেন্দ্রে এবং যতটা সুন্দর করে সম্ভব মে দিবসের উদ্যাপন আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় হয়েছে। এই আয়োজনে শুধুমাত্র অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা দিয়ে নয় বরং এ সকল উদ্যাপনের সংগঠিত চরিত্র, যে শ্রেণি-সচেতনতাকে তারা উর্ধে তুলে ধরবে এবং যে দৃঢ় সংকল্প তারা দেখাবে তাকেও বিবেচনায় রাখতে হবে। এ সংগ্রাম হবে রাশিয়ার জনগণের রাজনৈতিক মুক্তির জন্য এবং তারই ফলশ্রুতিতে শ্রমিকশ্রেণির বিকাশ ও সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের প্রকাশ্য সংগ্রামের এক মুক্ত পথ তৈরি করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে।’
এ বয়ান থেকে বোঝা যায় লেনিন মে দিবস উদ্যাপনকে কতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। ছ-মাস আগেই তিনি ঐ লড়াইয়ের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তাঁর কাছে মে দিবস ছিল ‘রাশিয়ায় জনসাধারণের রাজনৈতিক মুক্তিকে কিছুতেই দমিয়ে রাখা যায় না এমন সংগ্রামের’ এক সংগঠিত প্রাণকেন্দ্র এবং একইসাথে ‘শ্রমিকশ্রেণির বিকাশ ও সমাজতন্ত্রের জন্য তাদের প্রকাশ্য সংগ্রামের’ প্রতীক।
মে দিবসের উদ্যাপন ‘একটি মহৎ রাজনৈতিক প্রদর্শনীতে রূপ নিতে পারে’ বলার সময়ই লেনিন প্রশ্ন তোলেন— ১৯০০ সালে খারকভের মে দিবস উদ্যাপনকে কেন ‘একটি ব্যতিক্রমী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা’ হিসাবে বিবেচনা করা হয়? এর উত্তরে তিনি নিজেই লিখলেন, ‘ধর্মঘটে শ্রমিকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ, রাস্তায় বিশাল আকারের জনসমাবেশ, লাল পতাকা উত্তোলন, লিফলেটে উল্লিখিত দাবিসমূহ পেশ করা এবং সেই সমস্ত দাবির বিপ্লবী চরিত্র— যেমন আট ঘণ্টার কর্মদিবস ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবি— এসবই ঐ গুরুত্বকে প্রকাশ করে।’
খারকভের স্থানীয় পার্টির নেতৃত্ব আট ঘণ্টা কর্মদিবসের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবিকে কয়েকটি তুচ্ছ, নিছক অর্থনৈতিক দাবিসমূহেরর সঙ্গে জুড়ে দেয়। লেনিন তাদের তিরস্কার করেন। মে দিবসের রাজনৈতিক চরিত্র কোনোভাবে মলিন হোক, লেনিন কিছুতেই এমনটা চাইতেন না। ঐ পুস্তিকার ভূমিকায় তিনি লেখেন: ‘এ দাবিগুলির প্রথমটি (আট ঘণ্টার কর্মদিবস) হলো সেই সাধারণ দাবি যা বিশ্বের সমস্ত দেশেই প্রলেতারিয়েতরা পেশ করে আসছে। ঐ দাবি উত্থাপন করাই প্রমাণ করে যে খারকভের এগিয়ে থাকা শ্রমিকরা আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের সংহতিকে উপলব্ধি করে। কিন্তু ঠিক এই কারণেই এমন একটি দাবি, যা এত গুরুত্বপূর্ণ- তাকে তুচ্ছ দাবিসমূহের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া উচিত হয়নি। সুপারভাইজারদের ভালো ব্যবহার বা মজুরিতে দশ শতাংশ বৃদ্ধির ন্যায় দাবির সঙ্গে একে মিশিয়ে দেওয়া উচিত হয়নি। আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবি আসলে সার্বিক শ্রমিক শ্রেণির দাবি যা কেবল একক কোনও মালিকের সমীপে নয় বরং দেশের সরকারের কাছে পেশ করা হয়। যারা উৎপাদনের যাবতীয় উপকরণের মালিক সেই পুঁজিপতি শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে যে সরকার বর্তমানে বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব করছে।’
১৯৩২ সালে প্রকাশিত পুস্তিকা দ্য হিস্ট্রি অফ মে ডে’র অংশবিশেষ
বাংলা অনুবাদের জন্য ১৯৩৪ সালে নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বইটির ষষ্ঠ ইংরেজি সংস্করণ ব্যবহৃত
ঐ ষষ্ঠ সংস্করণের মুদ্রক ও প্রকাশক ছিল ইউনিয়ন লেবর
ব্যবহৃত ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া সুত্রে সংগৃহীত, ভারতে শ্রমজীবীদের মেহনতের সাক্ষ্য
ওয়েবডেস্কের পক্ষে ভাষান্তরঃ সৌভিক ঘোষ