সৌভিক ঘোষ
আলেকজান্দার পুশকিনের লেখা পড়তে বড় ভালবাসতেন।
১৯২১ সাল নাগাদ রাশিয়া। চারিদিকে শুধুই অভাব, আরও বিশেষ করে খাবারের অভাব। জনসাধারণের শরীরে পুষ্টির অভাব দেখা দিয়েছে জানতে পারলেন, জানার পরে নিজে কমলালেবু খাওয়া বন্ধ করে দিলেন। আগে যা কখনো দেখা যায়নি, খাওয়ার সময় ঘরের দরজা বন্ধ রাখতে শুরু করলেন। পার্টির ভিতরে চাপা স্বরে গুঞ্জন শুরু হল- দরজা বন্ধ করে খাচ্ছেন যখন, খাবারের টেবিলে নিশ্চয়ই ভালো কিছু রয়েছে! এসব কথা শুনে দেহরক্ষী কমরেডের মেজাজ ভালো নেই। একদিন আর থাকতে না পেরে আচমকাই দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লেন। তখনও খাওয়া শেষ হয়নি।
খাবারের নামে তার টেবিলে তখনও একবাটি কালো কফি আর পোড়া পাউরুটি দেখা যাচ্ছিল। ইলিচ খাচ্ছেন! আগেরবারের মতো এবারেও খবর চাপা রইল না। সবাই জানলো খাওয়ার সময় দরজা কেন বন্ধ থাকছে। সারা দেশ থেকে টিফিন আসা শুরু হল, টেবিল ভরে গেল খাবারে।
এবার সেই দেহরক্ষীর ডাক পড়ল ঘরের ভিতর থেকে।
কি করতে হবে?
আশেপাশের এলাকার যত শিশু, অসুস্থ ও বয়স্ক মানুষ রয়েছেন সবার জন্য সেই খাবার বিলির নির্দেশ এল।
মাইকেল ক্রপ্টকিন কোনদিনও কমিউনিস্ট ছিলেন না। রাশিয়ায় বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদের অন্যতম নেতা, মতাদর্শগতভাবে ছিলেন নৈরাষ্ট্রবাদী। ১৯১৭ সালের জুন মাস নাগাদ ইংলন্ড থেকে রাশিয়ায় ফিরে আসেন। ১৮৪২ সালে তার জন্ম, অক্টোবর বিপ্লবের সময় স্বাভাবিক নিয়মেই তিনি বৃদ্ধ, তাও ফিরে এসেছিলেন কারণ দেশমুক্তির আহ্বান তার অভিজ্ঞ কানে পৌঁছেছিল। বিপ্লবের প্রশ্নে প্রায় একই অবস্থান থাকা স্বত্বেও ক্রপ্টকিন কিন্তু বলশেভিকদের হাতে গড়া সোভিয়েত রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে সমর্থন করতে পারলেন না!
কেন?
তিনি নৈরাষ্ট্রবাদী, সোভিয়েতই হোক আর যাই হোক- রাষ্ট্র যে!
বয়স হয়েছে, অনেকদিন ধরে লড়াই করতে করতে শরীরও ভেঙ্গে পড়েছে। ক্রুপস্কায়ার অভ্যাস ছিল পুরানো বিপ্লবীদের সম্পর্কে তিনি নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন। সোভিয়েত সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিপ্লবীদের জন্য মস্কোতে নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটের বন্দোবস্ত হয়েছিল। খবর পেলেন ঠিকঠাক কাগজপত্র দেখাতে পারছেন না বলে ক্রপ্টকিনকে বারংবার মস্কোয় আসা যাওয়া করতে হচ্ছে। ক্রুপস্কায়া সে কথা জানালেন লেনিনকে, সমস্যা মিটে গেল। পরে ১৯১৮-র বসন্তকালে মস্কোর ফ্ল্যাট ছেড়ে দমিত্রভে, নিজের গ্রামে থাকতে শুরু করেন। মাঝে মাঝে মস্কোয় আসতেন, শিক্ষকদের সাথে আলোচনা করতেন, শ্রমিক কো-অপারেটিভের সভায় উপস্থিত হতেন। তিনি ক্রুপস্কায়ার সাথে কথা বলার সময় জানিয়েছিলেন ইলিচের লেখা রাষ্ট্র ও বিপ্লব বইটি সম্পর্কে তিনি জেনেছেন, পড়া হয়নি তখনও কিন্তু যা শুনেছেন তাতে এটুকু নিশ্চিত এই বইয়ের জন্য লেনিন ও সোভিয়েত ব্যবস্থা দুটিই দুনিয়ার সর্বহারা শ্রেণীর চোখে চিরায়ত মর্যাদার আসনে রয়ে যাবে।
ক্রপ্টকিন নিজেও ফরাসী বিপ্লবের ইতিহাস সম্পর্কে একটি বই লিখেছিলেন। লেনিন সে বইটির ভূয়সী প্রশংসা করতেন। ক্রুপস্কায়া’কে বিশেষভাবে বলে রেখেছিলেন ক্রপ্টকিন মস্কোতে এলে যেন তাকে অবশ্যই খবর দেওয়া হয়। ১৯১৯ সালের এক বিকালে লেনিন তার সঙ্গে দেখা করতে এলেন।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে দুতলার ঘরে বসে-
ক্রপ্টকিন- ‘আমার মনে হয়েছিল কো-অপারেটিভ ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার প্রসঙ্গে আমাদের কোনও মতপার্থক্য নেই। কিন্তু আমি লক্ষ্য করছি সেকাজে বাধা আসছে। এমনটা কেন হবে?’
লেনিন- ‘আমরাও চাই কো-অপারেটিভ আরও এগিয়ে চলুক। কিন্তু কো-অপারেটিভের আড়ালে কুলাক (বিরাট জমির মালিক এমন কৃষক পরিবার), জমিদার, ব্যবসাদারদের আখের গুছিয়ে নিতে দেওয়া যায় না। কো-অপারেটিভের নামে সিন্ডিকেটরাজ চলতে দেওয়া যায় না। সাধারণ মানুষ যাতে আরও বেশি করে কো-অপারেটিভের সাথে যুক্ত হন সেটা সুনিশ্চিত করতেই হবে।’
ক্রপ্টকিন- ‘আপনি নিশ্চয়ই মানবেন যারাই ক্ষমতাসীন হবে, ক্ষমতা তাদের দূষিত করবেই।’
লেনিন- ‘এ সম্পর্কে বাড়তি দুশ্চিন্তায় কিছু হওয়ার না। হাতের গ্লাভস সাদা, পরিস্কার রেখে বিপ্লব করা যায় না।’
একজন প্রাক্তন সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী, আরেকজন দুনিয়ার বুকে প্রথম সর্বহারা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কারিগর। একদিকে রাষ্ট্র ও তার বিপদ সম্পর্কে সন্দেহের বাতিক আরেকদিকে রাষ্ট্র ও বিপ্লব সম্পর্কে সচেতন মার্কসবাদী কর্তব্য। দুয়ের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব চলে, অন্ধের ন্যায় বিরোধিতা চলে না।
এমন দ্বন্দ্বের শেষ লগ্নে ক্রপ্টকিনের উপলব্ধিটি আজও প্রাসঙ্গিক- ‘যদি আপনি ও আপনার কমরেডরা সতর্ক থাকেন যাতে তারা কোনোভাবেই রাষ্ট্রক্ষমতার মোহে আবিষ্ট হয়ে পড়বেন না, যদি তারা এমনটা নিশ্চিত করতে পারেন তাহলে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি বিপ্লব আপনাদের হাতে সত্যিই সুরক্ষিত থাকবে।’
লেনিনের উত্তর- ‘আমরা সেই চেষ্টাই করব।’
বিদায় জানানোর আগে ফরাসী বিপ্লবের ইতিহাস সম্পর্কে ক্রপ্টকিনের লেখা সেই বইটি নতুন করে প্রকাশ করার প্রয়োজন রয়েছে বলে লেনিন ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। ক্রপ্টকিনও লেনিনের প্রস্তাবে উৎসাহ জানান, কিন্তু তার দুশ্চিন্তা – ‘আমার লেখা বই তো আর রাষ্ট্রীয় সহায়তায় প্রকাশিত হতে দিতে পারি না!’
হাসিমুখে লেনিনের সহজ সমাধান- ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। রাষ্ট্র নয়, আপনার বই প্রকাশ করবে কোনও এক কো-অপারেটিভই।’
মাইকেল ক্রপ্টকিনের মৃত্যুর খবর এলে ইলিচ ও ক্রুপস্কায়া দুজনেই শেষকৃত্যে উপস্থিত ছিলেন। সেদিনই বিকালের পরে শিশু-কিশোরদের জন্য কমিউনিস্ট পার্টির কমিউনে গেছিলেন লেনিন। সকলেই উত্তেজিত, সবাইকে ডেকে ডেকে লেনিন জিজ্ঞাসা করছেন ‘কি কি বই পড় তোমরা?’
‘আমরা মায়াকোভস্কি পড়ি!’
‘পুশকিনের লেখা পড় না?’ – লেনিন প্রায় উত্তেজিত হয়ে জানতে চান।
‘না! আমরা ওসব আর পড়ি না! আর উনি তো একজন বুর্জোয়া লেখক! তাই আমরা সবাই মায়াকোভস্কি পড়ি!’
‘আমার মনে হয় পুশকিনের লেখা বেশি ভাল।’
উজ্জ্বল একজোড়া চোখে তাকিয়ে থাকা, স্মিত হাসি ঠোঁটে নিয়ে বিরলকেশ লেনিনের ছবিটাই আমরা মনে রাখি। ঐ ছবি সেই নেতার যিনি পাহাড় চূড়ায় বসে থাকা ঈগলপাখির ন্যায় শ্যেন। যুক্তিজাল বিস্তার করে তিনি সবাইকে নিজের পক্ষে টেনে আনেন। একেই অক্টোপাসের পেঁচিয়ে ধরার সাথে তুলনা করেছিলেন স্তালিন।
মার্কসবাদী দার্শনিক, প্রখর রাজনীতিবোধ সম্পন্ন লেনিন, সারা দুনিয়ায় বিপ্লবী সর্বহারা শ্রেণীর মহান নেতা লেনিন’কে নিয়ে লেখা কিছু কম নেই। সেইসব ইতিহাসের ভারে কিছুটা হারিয়ে যেতে বসা যে মানুষটির প্রকৃত নাম ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ, তিনি কেমন ছিলেন?
মানুষ লেনিনের খোঁজ পেতে আমাদের নির্ভর করতে হয় তার পাশে থাকা এমন কিছুজনের স্মৃতিচারণায় যারা তাকে উলিয়ানভ থেকে লেনিন হয়ে উঠতে দেখেছেন, যারা তাকে পরিশ্রমে শ্রান্ত হতে দেখেছেন, উত্তেজিত হতে দেখেছেন, আনন্দে হাসতে দেখেছেন – তার দুঃখের সাক্ষী থেকেছেন। নাঝেদজা ক্রুপস্কায়া তেমনই একজন, কমরেড ইন আর্মস বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই।
লেনিনের স্ত্রী হিসাবে তার যে পরিচিতি সেসব অনেক পরের কথা।
আজকের প্রজন্মের জেনে রাখা উচিত লেনিনকে পার্টিতে এনেছিলেন ক্রুপস্কায়াই।
তারই লেখা ‘রেমিনিসেন্সেস অফ লেনিন’, লেনিন-স্মৃতিচারণা। পাতায় পাতায় আমরা খুঁজে পাই মানুষ লেনিনকে যাকে ক্রুপ্সকায়া সারা জীবন ইলিচ বলেই সম্বোধন করেছেন। বিপ্লবী জীবনে বেশ কয়েকবার তাদের দুজনকেই নিজেদের দেশ ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় গ্রহন করতে হয়েছিল। লেনিনকে ভাল করে চিনতেন না নাঝেদজা, ঘনিষ্ঠ এক কমরেডের থেকে শুনেছিলেন ‘বিজ্ঞান-যুক্তিবাদে লোকটি ভীষণরকম দক্ষ, কিন্তু সাহিত্য বলতে প্রায় কিছুই জানে না, ওসব কবিতা-উপন্যাস পড়ে না’। যাকে পার্টিতে নিয়ে আসার কথা ভাবছেন, তরুণ বিপ্লবীর মানসিক গড়ন সম্পর্কে এমন কথা শুনে ক্রুপস্কায়া কিছুটা হতাশই হন। নিজের মনে লেনিন সম্পর্কে সেই হতাশা চেপে রেখেই দেখা করেন লোকটির সাথে।
কিছুক্ষন কথা বলেই বুঝলেন রাশিয়ার সর্বহারা জনসাধারণের জীবনযাপনের প্রায় প্রতিটি খুঁটিনাটি সম্পর্কে ইনি যথেষ্ট ওয়াকিফহাল। পার্টির যে কোনও কারও চাইতে তিনি দেশের জনসাধারণকে অনেক ভালো চেনেন। সাইবেরিয়াতে নির্বাসনে থাকাকালীন তারা দুজনে প্রথমবার একে অন্যকে কাছ থেকে দেখার, জানার, বোঝার সুযোগ পেয়েছিলেন। ক্রুপস্কায়া লিখেছেন, ‘ইলিচের মাথার কাছেই রাখা থাকতো তুর্গেনেভ, পুশকিন, লের্মেন্তভ, নেক্রাসভের লেখা বই। সাহিত্যে তার দখল পরীক্ষা করতে গিয়ে বুঝলাম যাবতীয় ধ্রুপদী সাহিত্য সে একেবারে গুলে খেয়েছে’। কিছুদিন পরেই লেনিনের বাক্সর ভিতর থেকে একটি অ্যালবাম খুঁজে পেলেন, তাতে এমিল জোলা, চের্নিসেভস্কি, হার্জেন ও পিসারেভের ছবি সেঁটে রাখা। সেই সময় লেনিন আরেকবার গ্যেটে’র ‘ফাউস্ট’ পড়তে শুরু করেছেন, তারই সাথে পড়ছেন জার্মান ভাষায় ছাপা হাইনে’র কবিতা। মিউনিখে থাকার সময় দুজনে একসাথে পড়েছেন জেরহার্তের ‘ব্যেই মামা’, পোলেঞ্জের ‘ব্যুনার বাউয়ার’।
প্যারিসে থাকাকালীন লেনিন ও ক্রুপস্কায়া সারাদিনের বেশিরভাগ সময়টাই ব্যয় করতেন বিভিন্ন শ্রমিক মহল্লায় ঘুরে বেড়িয়ে, না হলে কম খরচে বাসের টিকিট কেটে চলে যেতেন দূরের গ্রামগুলিতে। ঢুকে পড়তেন মজদুরদের জন্য নির্মিত সস্তার যত সব হোটেলে, পানশালায়। আসলে খুঁটিয়ে দেখতে চাইতেন সেইদেশে সর্বহারা জীবন কিভাবে চলছে, তারা কি বলছে, কি করছে এমনকি কি পড়ছে বা কি গান গাইছে অবধি। এভাবেই একদিন পরিচিত হলেন প্যারি কমিউনের একজন বিপ্লবী কমিউনার্ডের সন্তান মন্তেগু’র সাথে। দুজন একে অন্যের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতেন, ভাষার ব্যবধান পেরিয়ে দুজনেই বিভোর হতেন আগতপ্রায় বিপ্লবের স্বপ্নে।
সে আড্ডার বর্ণনা দিতে গিয়ে ক্রুপস্কায়া লিখেছেন ‘একে অন্যের কথা সবটা বুঝতে না পারলেও তারা দুজনেই বিপ্লবের স্বপ্নে ডুবে যেতে ভালবাসতেন, আর কে না জানে অন্য ভাষায় স্বপ্ন দেখা আরোই সহজ’।
লেনিন মন্তেগু’কে বিশেষভাবে পছন্দ করতেন। পরবর্তীকালে মন্তেগু নিজের রাজনৈতিক অবস্থান বদলে ফেলেন, শোভিনিস্টদের দলে ভিড়ে যান। অনেকদিন পরেও একা চুপচাপ থাকার সময় ‘….বাট নেভার উইল ইউ হ্যাভ আওয়ার হার্টস’ গুনগুন করে গাইতেন লেনিন। বিশেষ করে ১৯০৯ সাল নাগাদ দেশের বাইরে থাকার সময়, রাশিয়াতে বিপ্লব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
থিয়েটার দেখতে বিশেষ পছন্দ করতেন, দেশে বাইরে নির্বাসিতের জীবনযাপনের সময়েও নিজেদের অন্যান্য খরচ বাঁচিয়ে দুজন একসাথে থিয়েটার দেখতে যেতেন। অনেক সময়েই প্রথম দৃশ্য শেষ হওয়ার পরেই থিয়েটার ত্যাগ করে বেরিয়ে যেতেন, সারা জীবন বাহুল্যতা, অতিকথন ও যা কিছু অহেতুক, বাড়তি সেইসব এড়িয়ে চলেছেন লেনিন। থিয়েটারে অভিনেতারা এমন কিছু করলেই তিনি রীতিমত বিরক্ত হতেন। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় লেনিনের জীবন নিয়ে একটি থিয়েটার প্রদর্শিত হওয়ার সময়েও বিরক্তিতে হল ছেড়ে বেরিয়ে গেছিলেন। ক্রুপস্কায়া লিখেছেন, ‘সাইবেরিয়াতে আমরা সবে একে অন্যকে কাছ থেকে জানার সুযোগ পেয়েছি, একে অন্যকে ভালবেসেছি – দুজনের বয়সও তখন কিছুটা কম, আর থিয়েটারে নির্দেশক মশায় কিনা আমাদের দিয়ে কবিতা অনুবাদ করিয়েই গোটা পর্বটা কাটিয়ে দিলেন’!
এই ছিল লেনিন চরিত্রের বৈশিষ্ট। অমানবিক, অতিপ্রাকৃত কোনকিছুতে আগ্রহ ছিল না তার। সেই কারণেই অন্য অনেকের থেকে ভাল বুঝতেন রাশিয়ার জনসাধারণ কি চায়।
টলস্টয়’কে বলতেন ‘রাশিয়ার আয়না’, ম্যাক্সিম গোর্কি সম্পর্কে ছিলেন বিশেষ উৎসাহী।
১৯১৫ সালে বার্নে থাকার সময় টলস্টয়ের নাটক ‘দ্য লিভিং কর্পস’ অভিনীত হচ্ছে শুনে দুজনে হলে এসে হাজির হলেন এবং সেই অভিনয় অনেকদিন অবধি লেনিনের মনে ছিল, বারে বারে সেকথা উল্লেখ করতেন তিনি। ১৯২২ সালে শেষ থিয়েটার দেখতে গেছিলেন, সেবার চার্লস ডিকেন্সের ‘ক্রিকেট অন দ্যি হার্থ’ নাটক মঞ্চস্থ হয়।
বিপ্লবোত্তর রাশিয়াতে শিল্প-সাহিত্যে নতুন ধারা চর্চার জোয়ার এসেছিল। সেই চর্চায় কিছুটা নৈরাজ্য আর বাকি সবটুকুতেই ইউরোপের অন্ধ অনুসরণ খুঁজে পেয়েছিলেন। ক্লারা জেটকিনের সাথে আলোচনার সময়ে ব্যাখ্যা দিলেন – ‘যুগ যুগ ধরে যে দেশে জনসাধারনের সমস্ত মানবিক উচ্চাশাকে দাবিয়ে রাখা হয়েছে বুটের তলায়, বাধ্য করা হয়েছে ইতর জীবনযাপনে সেই দেশে বিপ্লবের পরে কিছুদিন এমনটা হতে বাধ্য। এখন কিছুটা ধৈর্য সহ চলতে হবে। কিন্তু কমিউনিস্টরা কিছুতেই নৈরাজ্য প্রতিষ্ঠা হতে দেবে না, তারা সেই ব্যাপারে সতর্ক রয়েছে’।
নতুন ধারার শিল্প-সাহিত্য চর্চার নামে পুরাতন যা কিছু সবই গোল্লায় যাক এহেন মনোভাবের প্রতি তীব্র বিরক্তি প্রকাশ করে বলেছিলেন ‘একি ঈশ্বরের সমীপে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ নাকি যে সুন্দর হওয়া স্বত্বেও কোনকিছুকে শুধুমাত্র এইজন্য বাতিল করতে হবে কারন সেটি পুরানো! বলা হচ্ছে যা কিছু নতুন তাই নাকি সুন্দর - এমন মনোভাব একেবারেই ছাইপাঁশ! এসব আসলে ইউরোপীয় হাল ফ্যাশনের অন্ধ অনুকরণ ব্যাতিত আর কিছুই না। শিল্প-সাহিত্যে সুন্দর যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে সেইসবই সংরক্ষণ করে রাখা হবে। পুরানো বলেই বাতিল করে দেওয়া কোন নীতি হতে পারে না’।
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে ক্লারা জেটকিন’কে বললেন ‘তাহলে তো এখন আমায় নিজেকে বর্বর ঘোষণা করতে হবে! এক্সপ্রেশনিজম, ফিউচারিজম, কিউবিজম এবং অন্যান্য সব ইজমের নামে যা সব চলছে আমি তো তার কিছুই বুঝতে পারি না। এসব থেকে আমি কোন আনন্দই পাই না। বিপ্লবের আশায় অনুপ্রাণিত মানবীয় মুখের ছবি আঁকতে কেন যে ত্রিভুজের ব্যবহার করা হবে অথচ কোন নাক থাকবে না অথবা বিপ্লবী মেজাজ বোঝাতে কয়েকটি বর্শামুখের প্রলম্বিত দাঁড়িযুক্ত জটিল চেহারাতেই কেন যে একটি মানবশরীর রূপান্তরিত হবে সেইসব উপলব্ধি করতে আমি অক্ষম’।
এহেন শ্লেষ স্বত্বেও সোভিয়েতে শিল্প-সাহিত্যিকদের প্রসঙ্গে ব্যখ্যা করতে গিয়ে বললেন ‘ব্যাক্তিমালিকানা নির্ভর সমাজে একজন শিল্পী বাজারের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করতে বাধ্য হয়। আমরা যে বিপ্লব সংগঠিত করেছি তাতে শিল্পী-সাহিত্যিকেরা সেই বাধ্যবাধকতা হতে মুক্তি পেয়েছেন। এখন রাষ্ট্র শিল্পী-সাহিত্যিকদের জীবনরক্ষার দায় স্বীকার করে, জনসাধারণের উদ্দেশ্যে তারা সৃষ্টি করছেন বিনা বাধায়। নতুন কিছু সৃজনে সক্ষম এমন যেকোনো ব্যাক্তিই মুক্তমনে নিজের সৃজনে মনোযোগ দিতে পারছেন, পারবেন – তাদের সেই অধিকার রয়েছে, তাদের নিজস্ব মতাদর্শ যাই হোক না কেন, কাজের ক্ষেত্রে সেসব কোন বাধা হবে না।’ রাশিয়ায় কিশোরদের কমিউনে বারে বারে মায়াকোভস্কির নাম শুনেও মজাই পেয়েছিলেন লেনিন। কিন্তু নিজের পছন্দ বলে পুশকিনের লেখা অন্যদের পড়ার জন্য চাপিয়ে দেন নি, আবার সবাই বলছে বলেই মায়াকোভস্কি’র লেখার অহেতুক প্রশংসাও করেন নি। কিছুদিন পরে মায়াকোভস্কি যখন সোভিয়েত আমলাতন্ত্র নিয়ে তীক্ষ্ণ ব্যাঙ্গকাব্য প্রকাশ করলেন অন্য অনেকে চুপ থাকলেও সেই লেখার পক্ষে সোচ্চার প্রশংসা এল ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের থেকেই।
মৃত্যুশয্যায় লেনিনের পাশে ছিলেন ক্রুপস্কায়া। তখনও তার বই পড়ার ইচ্ছা কমেনি। নাঝেদজা’কে বই পড়ে শোনাতে হত, শেদ্রিনের রচনা কিংবা গোর্কির ‘মাই ইউনিভার্সিটিজ’ শোনার জন্য লেনিন বিশেষভাবে অনুরোধ করতেন। মৃত্যুর ঠিক দুদিন আগেও বই পড়ার অভ্যাস জারী ছিল, জ্যাক লন্ডনের লেখা ‘লভ অফ লাইফ’ লেনিনকে বিশেষ আনন্দ দিয়েছিল। মৃত্যুমুখে পতিত আহত একজন মানুষ তুষারাবৃত প্রান্তরে মাটিতে পড়ে রয়েছে, হাঁটার ক্ষমতা নেই – মাটিতে শুয়েই হাতের সাহায্যে শরীরটাকে টেনে নিয়ে চলেছে সেই মানুষটি, তার পাশেই চলছে একটি আহত শ্বাপদ। জীবনের আশায় দুজনের মৃত্যুপণ লড়াইয়ের কাহিনী যার শেষে মানুষ জিতে যায় লেনিনের মুখে হাসি এনে দিয়েছিল। এর ঠিক পরের গল্পেই জ্যাক বর্ণনা দিলেন কিভাবে এক জাহাজের নাবিক নিজের জীবন বিপন্ন করেও মালিকের সম্পত্তি রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল এবং শেষে নিজের জীবন হারাল।
শেষটুকু শুনেই একটি হাত তুলে, হাসি মুখে নিজের অসম্মতি জানালেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। মালিকের স্বার্থরক্ষায় শ্রমজীবী মানুষ নিজের জীবন ত্যাগ করছে আর সে কথা গল্পে লিখছেন একজন সাহিত্যিক! সারা জীবন সর্বহারা মানুষের মুক্তির পথ খুঁজতে জীবন বাজি রেখে এগিয়েছেন যিনি, আততায়ীর গুলির আঘাতে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে থাকা অবস্থাতেও এমন কথা মানতে লেনিন রাজি নন।
সে সময় কথা বলার ক্ষমতা ছিল না লেনিনের। তবে তার মনের কথা ক্রুপস্কায়া বুঝলেন কি করে?
লেনিনের ওভাবে হাত তুলে হাসির অর্থ আসলে কী একমাত্র নাঝেদজার পক্ষেই তা বোঝা সম্ভব ছিল।
ঐ হাসিতেই, অমন হাত তোলার জোরেই পৃথিবীর বুকে প্রথম সর্বহারার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
ইলিচ থেকে লেনিন হয়ে ওঠার প্রতিটি বাঁক ও মোড়ে তার পাশেই ছিলেন ক্রুপস্কায়া, এক সময় থেকে স্ত্রী হয়ে আর সমস্ত সময়টায় কমরেড ইন আর্মস হয়েই।
ব্যবহৃত ছবি- সোশ্যাল মিডিয়া সুত্রে সংগৃহীত
লেখায় ব্যবহৃত তথ্যসুত্র-
১) রেমিনিসেন্স অফ লেনিন; নাঝেদজা ক্রুপস্কায়া; প্রোগ্রেস পাবলিশার্স
২) দ্য আদার লেনিন, নট বাই পলিটিক্স অ্যালোন; সম্পাদনা- তামারা ডয়েটসার; লরেন্স হিল অ্যান্ড কো
৩) লাইফ অ্যান্ড ডেথ অফ লেনিন; রবার্ট পেইন; গ্রাফটন বুকস
৪) দ্য লাইফ অফ লেনিন; ল্যুইস ফিশার; ফিনিক্স প্রেস