৫ মে,২০২১ বুধবার
এখনও নজরদারির বাইরে নন তিনি।
একমাসের মধ্যে দু’বার ভাঙচুর। রাতের অন্ধকারে কারা যেন তাঁর স্মৃতিস্মারকে লেপটে দিয়ে গিয়েছে ‘ঘৃণার তত্ত্ব’, ‘গণহত্যার স্থপতি’। শেষে লন্ডনের হাইগেটে মার্কসের সমাধিক্ষেত্রে চব্বিশ ঘণ্টা নজরদারির জন্য বসানো হয়েছে ভিডিও ক্যামেরা।
খুব সম্ভবত, এই প্রথম অস্কার মঞ্চে কমিউনিস্ট ইশতেহারের প্রত্যয়ী উচ্চারন। অস্কার নিতে উঠে ‘আমেরিকান ফ্যাক্টরি’ অন্যতম পরিচালক জুলিয়া রেইচার্ট শুনিয়েছেন কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর অমোঘ আহ্বান,
‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’।
সঙ্কট থেকে রেহাই পেতে দু’বছর আগে দ্য ইকনমিস্টের পরামর্শ, মার্কসকে পড়ুন। ‘বিশ্বের শাসকরা: কার্ল মার্কস পড়ুন!’অষ্টাদশ ব্রুমেয়ারে মার্কসের অমোঘ লাইন ইতিহাস তার পুনরাবৃত্তি ঘটায় বটে, তবে ‘প্রথমবার যা হয় ট্র্যাজেডি, দ্বিতীয়বার তা হয়ে পড়ে প্রহসন।’
সেই বক্তব্য ধরেই উপশিরোনাম, ‘দ্বিতীয়বার, প্রহসন।’
নিবন্ধের সারকথা: ‘তাঁর দ্বিশতবর্ষে, পুঁজিবাদের ত্রুটি সম্পর্কে মার্কসের রোগ নির্ণয় এখনও বিস্ময়করভাবে প্রাসঙ্গিক।’
কেন, তা সবিস্তারে জানিয়ে ইকনমিস্ট বলেছে, ‘ব্রিটেনে বাড়ির দাম এখন এতটাই চড়া, যে ৪৫ বছরের নিচে থাকা কেউ তা কেনার আশাই প্রায় করেন না। মার্কিন শ্রমিকদের অধিকাংশ জানিয়েছেন ব্যাঙ্কে তাদের রয়েছে সাকুল্যে কয়েকশ ডলার।’
ইকনমিস্টের ব্যাখ্যায়, ‘মার্কসের প্রলেতারিয়েত পুনর্জন্ম নিয়েছে প্রিক্যারিয়েতে।’
প্রিক্যারিয়েত মানে হলো সেই জনগণ, যাদের কর্মসংস্থান ও আয় টলোমলো, নিতান্তই অনিশ্চিত, বিশেষ করে যখন তাদের একটি শ্রেণি হিসেবে দেখা হয়।
এবং কী আশ্চর্য, কমিউনিস্ট ইশ্তেহারের লাইন ইকনমিস্টে।
‘নিজেদের প্রস্তুত মালের জন্য অবিরত বর্ধমান এক বাজরের তাগিদ বুর্জোয়াশ্রেণিকে সারা পৃথিবীময় দৌড় করিয়ে বেড়ায়।’ বিশ্বায়নের যুগে মার্কসের প্রাসঙ্গিকতা বোঝাতে এর শেষাংশ যুক্ত করে পত্রিকা বলেছে, ‘সর্বত্র তাদের ঢুকতে হয়, সর্বত্র গেড়ে বসতে হয়, যোগসূত্র স্থাপন করতে হয় সর্বত্র।’
এটা যেমন ভিক্টোরীয় যুগে সত্য ছিল, তেমনই আজ। বিশ্লেষণ ইকনমিস্টের। গত ৩০ বছরে সবচেয়ে বেশি তাক লাগিয়ে দেওয়া দু’টি অগ্রগতি হলো পণ্য, পুঁজি ও কিছু ক্ষেত্রে জনগণ— বাধার প্রাচীরকে গুঁড়িয়ে উৎপাদনের উপকরণের অবাধ গতিবিধি— এবং উদীয়মান এক বিশ্বের উত্থান। বিশ্বায়িত সংস্থাগুলি সেখানেই তাদের পতাকা পুঁতছে, যেখানে লাভ সবচেয়ে বেশি। সীমান্তপার সিইও’রা তুরি মেরে এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি দিচ্ছে। সুইজারল্যান্ডের দাভোসে, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের নাম অনায়াসে বদলে হতে পারে,‘মার্কস ছিলেন সঠিক’।
অন্য কেউ না, ইকনমিস্ট বলছে, তিনি (মার্কস) ভেবেছিলেন পুঁজিবাদের প্রবণতা হলো একচেটিয়া কারবারের অভিমুখে। সফল পুঁজিবাদীরা ব্যবসা থেকে হটিয়ে দিচ্ছে তাদের দুর্বল প্রতিদ্বন্দ্বীকে। ‘ফেসবুক এবং গুগল চুষে নিচ্ছে মার্কিন অনলাইন বিজ্ঞাপন-আয়ের তিনভাগের দু’ভাগ। দেশের ফুলেফেঁপে ওঠা অনলাইন-শপিং মার্কেটের ৪০ শতাংশের বেশি নিয়ন্ত্রণ করছে অ্যামাজন। বেশকিছু দেশে, ওয়েব সন্ধানের ৯০ শতাংশের মালিক গুগল।’হলো কী ইকনমিস্টের!
এই তো সেদিন রেগান বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্র কোনও সমাধান নয়, সমস্যা’। থ্যাচার শুনিয়েছিলেন, বাজারের ‘কোনও বিকল্প নেই’।বাজারের হাতে সব ছেড়ে দাও। বাজারকে নিজের মতো চলতে দাও। নিজের যত্ন নিজেকে নিতে দাও। বাজারকে দাও স্বাধীনতা। ব্যবসা-বানিজ্যকে বুঝে নিতে দাও নিজেদের ষোলআনা। উদারীকরণ করো। হাট করে খুলে দাও বাজার। দেখবে বাগে আসবে মুদ্রাস্ফীতি। নেমে আসবে তলানিতে। সরকারের ভূমিকা যতটা সম্ভব কাঁট-ছাট করো। ন্যূনতম ভূমিকা থাকুক সরকারের। দেখবে বিকাশ লাফিয়ে-লাফিয়ে বাড়ছে। ঢালাও বেসরকারীকরণ করো। দেখবে অপচয় কমছে। লাভ হচ্ছে সরকারের। কমছে দারিদ্র্য, কমছে বেকারি। সমৃদ্ধি আসছে অর্থনীতিতে।
নিও-লিবারেল মিডিয়া শুনিয়েছিল, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ইতিহাসের ‘একটি দুর্ঘটনা।’ পুঁজিবাদেরই একটি ‘অস্থায়ী উত্তরণ পর্ব’ মাত্র।
ঘোষণা করা হয়েছিল ‘সমাজতন্ত্র হচ্ছে পুঁজিবাদ থেকে পুঁজিবাদে রূপান্তরের দীর্ঘতম উত্তরণ পর্ব।’
নিও-লিবারেল অর্থনীতিবিদরা আমাদের শুনিয়েছিলেন, ‘বাজার’, ‘ব্যক্তি মালিকানা’ ঈশ্বরের মতো পবিত্র। কোনও অর্থনীতি ও সমাজকে সীমাহীন বিকাশের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য এদের হাতে রয়েছে সর্বময় ক্ষমতা। বলা হয়েছিল, ‘নো লাঞ্চ ইজ ফ্রি।’ অর্থনীতি কখনোই বিনামূল্যে বা ভরতুকি দিয়ে চালানো উচিত নয়।
কে জানতো এত দ্রুত খসে পড়তে শুরু করবে অ-বিকল্প বলে ঘোষিত বিশ্বায়িত পুঁজিবাদের এহেন বাহারি পলেস্তারা।
আজ কোন আহাম্মক বলবে ইতিহাসের অবসান হয়েছে? তিনদশক আগের সেদিন ইতিহাসের অবসান হয়নি, বরং ইতিহাস রচিত হয়েছে।
ওয়াল স্ট্রিটের সেই ‘সোনালি দিন’ আর নেই। বিপর্যয় আজ বিশ্ব পুঁজিবাদের দুর্ভেদ্য, দুর্জয় প্রাচীর— ওয়াল স্ট্রিটে। এবং এই বিপর্যয় বাইরের কোনও আগ্রাসনের কারণে নয়। ‘অজেয়, অনড়’ এই প্রাচীরের পতনের কারণ আসলে পুঁজিবাদের জঠরেই রয়েছে সংকটের বীজ।
গুরুতর সংকটে বিশ্ব পুঁজিবাদ।
সংকট চলছে তেরো-বছর ধরে। সুরঙ্গের শেষে দেখা যাচ্ছে না তেমন কোনও আলোর রেখা।এই আর্থিক সংকট অন্তত দু’টি কারণে ঐতিহাসিক।
প্রথমত, এটি আবারও প্রমাণ করেছে কার্ল মার্কস এখনও সমান প্রাসঙ্গিক। এবং তাঁর পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশ্লেষণ এখনই ইতিহাসের আস্তাকূঁড়ের জন্য প্রস্তুত নয়।
দ্বিতীয়ত, ব্যাঙ্ক ও খোলা বাজারকে তার নিজের থেকে বাঁচাতে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ, অন্তত নয়া উদারবাদের বৌদ্ধিক নির্মাণে এখনও যতটুকু অবশেষ রয়েছে— তৈরি করেছে নতুন বিশ্ব বীক্ষার জন্য একটি মঞ্চ— যা গত শতকের তিনের দশকের পর থেকে আর কখনও দেখা যায়নি।
সেকারণেই কার্ল মার্কসকে পড়ার পরামর্শ। এবং শুধু ইকনমিস্ট নয়। দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট থেকে নিউ ইয়র্ক টাইমস— সকলের।
যদিও, এই সংকটের আগেও মার্কস ছিলেন একনম্বরে।
সেপ্টেম্বর, ১৯৯৯। বি বি সি’র অনলাইন ভোট। বেছে নিতে হবে ‘সহস্রাব্দের সর্বকালীন সেরা চিন্তাবিদ’। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, আইজ্যাক নিউটন, এমনকি চার্লস ডারউইনকে বিরাট ব্যবধাণে পিছনে ফেলে একনম্বরে মার্কস।
আর এখন ‘ক্যাপিটাল’ পড়ার হিড়িক।২০১৫, মেরিয়াম ওয়েবস্টার অনলাইন অভিধানে সবচেয়ে সন্ধানী শব্দ ছিল ‘সমাজতন্ত্র’।
২০১৬, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষা, এই সহস্রাব্দের তরুণদের অধিকাংশই প্রত্যাখ্যান করেছে পুঁজিবাদকে। তিনভাগের একভাগ সমাজতন্ত্রের পক্ষে।
ব্রিটিশ গার্ডিয়ানে শিরোনাম, ‘দুই শতাব্দী হয়ে গেল, যে কোনও সময়ের তুলনায় মার্কস এখন নিজেকে মনে করছেন অনেক বেশি বিপ্লবী।’
নিউ ইয়র্ক টাইমসের উপসম্পাদকীয় পাতায় শিরোনাম ‘শুভ জন্মদিন, কার্ল মার্কস। আপনি ছিলেন সঠিক!’
সংকটের প্রথম বছর, ২০০৯। এই প্রথম দাস ক্যাপিটাল নিয়ে ছবি। করেছেন জার্মান পরিচালক আলেকজান্ডার ক্লুগ। ৫৭০-মিনিট, সাড়ে ন’ ঘন্টার দীর্ঘ ছবি। এবং ‘এক মিনিটও বাড়তি নয়।’ বলেছেন হেলমুট মার্কার, ডাকসাইটে জার্মান দৈনিক ‘তাগেসপিগেল’-এ।
বি বি সি’র ২০১৬’র খবর। অক্সফামের প্রতিবেদনে আর্তনাদ: ধনীশ্রেষ্ঠ ১ শতাংশের সম্পদের পরিমাণ বাকি ৯৯ শতাংশের চেয়ে বেশি। জোশেফ স্টিগলিৎজের কথায়, ‘এক শতাংশের, এক শতাংশের দ্বারা, এক শতাংশের জন্য।’
ভাবা যায় কোন বিশ্বে আমরা বাস করছি?
ভেবেছিলেন মার্কস। স্টিগলিৎজ আসলে নতুন কিছু বলেননি। বলে গিয়েছিলেন মার্কস। আজ থেকে ১৭৩ বছর আগে। সেই ১৮৪৮ সালে। কমিউনিস্ট ইশ্তেহারে। ১ শতাংশ বনাম ৯৯ শতাংশের ভবিষদ্বাণী। জনসংখ্যার দশভাগের একভাগ বনাম নয়ভাগের কথা। উৎপাদন উপায়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসানে কমিউনিস্টদের কর্মসূচী নিয়ে পুঁজিবাদীদের অভিযোগের জবাবে মার্কস বলেছিলেন:
‘আমরা ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসান চাই শুনে আপনারা আতঙ্কিত হচ্ছেন। অথচ, আপনাদের বর্তমান সমাজে জনগণের নব্বই জনের ব্যক্তিগত সম্পত্তি তো ইতিমধ্যেই লোপ পেয়েছে। অল্প কয়েকজনের হাতে সম্পত্তি থাকার একমাত্র কারণ হলো ওই দশভাগের নয়ভাগ লোকের হাতে কিছুই না থাকা। সুতরাং, আমাদের বিরুদ্ধে আপনাদের তীব্র ভৎসনা এই কারণে যে, সম্পত্তির অধিকারে এমন একটা রূপ আমরা তুলে দিতে চাই, যা বজায় রাখার অনিবার্য শর্ত হলো সমাজের বিপুল সংখ্যাধিক্য লোকের কোনও সম্পত্তি না থাকা।
পুঁজিবাদের একেবারে গোড়ায় লিখেছিলেন মার্কস। যে বছর মার্কসের জন্ম, ব্রিটেন তখন সবে বিশ্বের প্রথম রেলপথ তৈরির পরিকল্পনা করছে। আ মার্কসের বয়স যখন সাত, তখন এই বিশ্বে প্রথম চলতে শুরু করেছে রেল। তখনও টেলিফোন আবিষ্কার হয়নি। ব্রিটিশ শিশুদের অর্ধেকই মারা যায় পাঁচ বছরের জন্মদিনের আগে। সেসময় কমিউনিস্ট ইশ্তেহার।
আর এখন, এই আই-ফোনের যুগেও তিনি সমান প্রাসঙ্গিক। এটা ঠিক, মার্কস ফেসবুকের দূরদর্শন করেননি। কিন্তু তাঁর উপলব্ধিতে ছিল জুকেরবার্গের ‘বিজনেস মডেল’।
‘পুঁজিবাদ পৌছছে শিখরে, শেষে বিশ্ব প্রস্তুত মার্কসের জন্য।’
শিরোনাম ব্রিটিশ ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকায়। নিবন্ধের মূলকথা, ‘দার্শনিকের (মার্কসের) পূর্বাভাস ছিল কেন্দ্রীভবন নিয়ে যাবে বিপ্লবের দিকে এবং জন্ম দেবে পুঁজিবাদ-উত্তর সমাজের— বিশ্বায়ন আমাদের নিয়ে চলেছে সেই অভিমুখে।’মার্কস ২০৩। এখনও ক্রিজে। এখনও নট আউট। এবং ফুল ফর্মে। এঙ্গেলসের সেই অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণী: ‘যুগে যুগে বেঁচে থাকবে মার্কসের নাম, তেমনি তাঁর কাজও।’