kalpana dutta

কল্পনা দত্তঃ এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক

বাবিন ঘোষ

I am glad to get your letter. You have got back your freedom after a long time. Now may you gain in peace and strength day by day. Many a task is yet to be done in our country and they demand an unruffled and disciplined mind. May the experience of suffering bring fullness to your life- this is my blessing to you.

২৪শে জুন, ১৯৩৮-এ কল্পনা দত্তকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি

১৯৩৯ এর পয়লা মে’ কল্পনা দত্ত প্রায় ৬ বছরের বেশি সময় জেলে থেকে মুক্তি পা’ন। ২৭শে জুলাই ১৯১৩ সালে জন্ম। মানে, মাত্র কুড়ি বছর বয়সে যাবজ্জীবন কারাবাসের আদেশ আর ছাব্বিশ বছরের কিছু মাস পরে জেল থেকে বের’তে পারলেন। চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ এবং সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরবর্তী পর্বে যখন হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাব্লিকান আর্মির সংঠনে নারীদের যোগদান মেনে নিলেন সূর্য সেন, সে’টি সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একটা মাইলফলক তৈরি করল’। প্রীতিলতার শাহাদাৎ, নাম জানা অথবা না জানা আরো বহু হিন্দু মুসলমান নারীর সহযোগিতা, আধুনিক ভারতের রাজনীতিতে একটা নতুন মাত্রা যোগ করল। ১৯৩২ এর ১৭ই সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর ইউরোপীয়ান ক্লাবে আক্রমণ ঘটল’ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নেতৃত্বে।  পুলিশের নজর পড়ল’ কল্পনার ওপর, কিন্তু সশস্ত্র বিপ্লবীদের সাথে তাঁর যোগাযোগের পাকা প্রমাণ নেই তেমন কিছু। নিজেকে প্রচ্ছন্ন রেখে বিপ্লবী সংঠনের কাজ প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে করার হাতে কলমে তালিম সেই সময় থেকেই কল্পনা রপ্ত করতে শুরু করেন। হাস্যকর এক চার্জে তাঁকে গ্রেপ্তার করেও শেষমেষ জামিনে ছেড়ে দিতে বাধ্য হল’ পুলিশ। তাঁর গতিবিধির ওপর নজর রাখতে রাখতে গোয়েন্দা বিভাগ রোজকার একঘেয়ে রিপোর্ট লিখে গেল দিনের পর দিন।

জামিনে মুক্ত হওয়ার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই সূর্য সেনের চিঠি পেলেন কল্পনা। আত্মগোপনে চলে যাওয়ার নির্দেশ। ১৯৩২ এর ডিসেম্বর মাস থেকে কল্পনা’র আন্ডারগ্রাউন্ড জীবনের শুরু। জালালাবাদের বিখ্যাত সম্মুখ সমরের পরে সংঠনকে ধরে রাখতে, বড় করতে সূর্য সেন গোপনে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন গোটা চট্টগ্রাম। তাঁর আরো বেশ কিছু সহকর্মীর সাথে কল্পনা’ও চষে ফেলেছেন গোটা চট্টগ্রাম সেই সময়। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে কল্পনা’র সেই প্রথম গরিব কিসান মজদুরদের সাথে পরিচিতি ঘটল’, একাত্মতা গড়ে উঠল’, যে একাত্মতা তাঁর গোটা জীবন তাঁকে চালিত করেছে।

১৯৩৩ এর ফেব্রুয়ারিতে গ্রেপ্তার হলেন সূর্য সেন আর তার তিন মাস বাদেই তারকেশ্বর ঘোষদস্তিদার আর কল্পনা দত্ত গ্রেপ্তার হলেন। অল্প বয়স আর মেয়ে বলে ফাঁসির আদেশের বদলে যাবজ্জীবন কারাবাসের আদেশ হল’। গণ আন্দোলনের চাপে আর ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক আইনসভা নির্বাচনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ছাড়া পেলেন সেই ১৯৩৯ সালের পয়লা মে’। গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, এন্ড্রুজের মত মানুষ তাঁর মুক্তির দাবি জানান বারংবার। সেই ছাড়া পাওয়ার পরে আস্তে আস্তে চলে এলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে।

কমিউনিস্ট পার্টি কেন?

ঐ যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিঠিতে লিখেছিলেন “May the experience of suffering bring fullness to your life”, সেইটিই কল্পনা দত্ত’র বাকি জীবন জুড়ে সত্যি হয়ে গেল’। সশস্ত্র বিপ্লবী গুপ্তসমিতির কাজ, সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র অংশের সাথে মেলামেশা, তাদের শেল্টারে দিনের পর দিন লুকিয়ে থেকে কাজ করা, জেলের অভিজ্ঞতা, সব মিলিয়ে ১৯৩৯ এ ছাড়া পাওয়ার সময় কল্পনা’র মানসিক গঠন রাজনৈতিক ভাবে একরকম তৈরি হয়েই গেছিল’।  নিপাট, সুখী, মধ্যবিত্ত গৃহস্থ জীবনে ঘরণী’র ভূমিকায় নিজেকে ভাবা আর সম্ভব ছিল না কল্পনা’র পক্ষে। দেশের স্বাধীনতার কাজে নিজের সবটুকু ঢেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ততদিনে তাঁর নেওয়া হয়ে গেছে। কাজেই জেল থেকে বেরনোর একেবারে পরের দিন থেকেই তাঁর কাছে প্রশ্নটা হয়ে দাঁড়ালো, এইবার কী করবেন? রাজনীতির কোন দিকে যাবেন? জেলে থাকার সময় জেনেছিলেন ‘কম্যুনিজম’ নামের এক ধরণের রাজনীতির কথা। জেলের কড়াকড়ির মধ্যেও “পরিচয়” পত্রিকা’র পাতায় কম্যুনিজম সম্বন্ধে কিছু কিছু ধারণা তৈরি হওয়া শুরু হল’। কিন্তু সে সুযোগ বেশিদিন রইল’ না। এক জেল থেকে আরেক জেলে স্থানান্তরিত হতে গিয়ে পত্রিকা’ও পালটে গেল’। ইংরেজদের তাঁবেদার সেই সময়ের ইংরিজি স্টেটসম্যান আর বাংলায় হিন্দু রক্ষণশীল ধ্যানধারনার ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকা ছাড়া আর কিছু পেলেন না পড়ার জন্য মাঝে বেশ কিছুটা সময়। উল্লেখ্য, সঞ্জীবনী মেয়েদের রাজনীতিতে অংশগ্রহনের বিশেষভাবে বিরোধী ছিল! এই সব প্রতিক্রিয়াশীল পত্রিকায় ছাপা বেশ কিছু লেখালিখি ছিল’ সে সময় বাম-বিরোধী এবং বিশেষভাবে স্তালিনের কুৎসায় মুখর। এর কিছুটা প্রভাব কল্পনা’র ভাবনায় পড়ে! সমাজতান্ত্রিক ধ্যান ধারনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া সত্ত্বেও খানিক সোভিয়েত-বিরোধী মনভাব তৈরি হয় তাঁর! রম্যা রোঁলার “আই উইল নট রেস্ট” এই পরিস্থিতিতে হাতে পা’ন কল্পনা। রুশ বিপ্লবের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠেন তিনি। লেনিন, স্তালিন ও তাঁদের রাজনীতির প্রতি এই শ্রদ্ধা পরবর্তী জীবনে তাঁর অটুট ছিল।

১৯৩৯ সালের মে’দিবসে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরেই কল্পনা খোঁজ করেন তাঁর পুরনো রাজনৈতিক সহকর্মীদের। দেখলেন, সূর্য সেনের পুরনো দলের প্রায় সকলেই হয় কম্যুনিস্ট রাজনীতির দিকে এসে গেছেন (জেলে থেকে বা জেলের বাইরে থেকে) আর নয়ত’ স্রেফ ব’সে গেছেন। লক্ষ্য করলেন যে কমিউনিস্ট পার্টিতে থেকে সেই সকল পুরনো সহকর্মীদের কাজের পদ্ধতি আগের চেয়ে অনেক পালটে গেছে। তাঁরা রেল আর বন্দরের শ্রমিকদের নিয়ে ইউনিয়ন করেন, চাষীদের মাঝে কিসানসভা করছেন, কিসান মজদুরদের দাবি দাওয়া নিয়ে জমিদার বা প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে আন্দোলন করছেন। প্রশাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থান বা প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের গুপ্তহত্যা’র লাইন না নিয়ে বরং ঝোঁকটা তখন ঘুরে গিয়েছে গণআন্দোলন গ’ড়ে তোলার দিকে। যত ব্যাপক গণআন্দোলন, তত বেশি বিপাকে পড়ছে সরকার। যত বড় গণআন্দোলন, তত বেশি মানুষ তাতে অংশ নিচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা জরুরি যে জেল ফেরৎ কল্পনা দত্ত একরকম Heroes’ welcome পেয়েছিলেন। সে সময়ের প্রায় সব ক’টি রাজনৈতিক দল/ গোষ্ঠী কল্পনা’কে নিজেদের দিকে টেনে নিতে চেয়েছিল’। কিন্তু কল্পনা’র রাজনৈতিক মননে কম্যুনিস্ট পার্টির বক্তব্য এবং ‘এপ্রোচ’ সবচাইতে পরিষ্কার বলে মনে হয়েছিল’। কল্পনা’র এই রাজনৈতিক ‘কনভিকশন’ আরো পাকাপোক্ত হয় ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষের বীভৎস সময়ে।

প্রায় দু’ লক্ষ মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা যায় চট্টগ্রামে। কল্পনা লিখেছিলেন যে ১৯৩০ আর ১৯৪৩ এক ছিল না। ১৯৩০ এ বিদেশী সরকারের বিরুদ্ধে অল্প কয়েকজন কম বয়সী মানুষের অসমসাহসী লড়াইয়ের পাশে শ্রেণী নির্বিশেষে মানুষের স্নেহ বা সমর্থন (প্রত্যক্ষ হোক বা প্রচ্ছন্ন) পাওয়া গেছিল’। কিন্তু ১৯৪৩ সাল শ্রেণীর প্রশ্নটাকে একেবারে সামনে টেনে এনে নগ্নভাবে দাঁড় করিয়ে দিল’। দেশাত্মবোধ, পরার্থপরতা, এসব বিসর্জন দিয়ে মধ্যবিত্তের বড় অংশ পিঠ বাঁচানোর তাগিদে একরকম বোঝাপড়া করে নিল’ মজুতদারদের সাথে। মজুতবিরোধী বিশেষ কোনো আন্দোলন মধ্যবিত্তের মধ্যে থেকে তৈরি হল’না। দেশের মানুষের ভেতরেই গণশত্রুদের দেখা পাওয়া গেল’। কল্পনা দত্ত’র বর্ণনায় ১৯৪৩ এর পরিস্থিতি ১৯৩০ এর তুলনায় প্রায় দশগুন বেশি খারাপ ছিল’। এই পরিস্থিতিতে কম্যুনিস্ট পার্টিই দেখা গেল’ একমাত্র দল যারা মজুতবিরোধী আন্দোলনে কোনো আপোষ করল’ না। মজুতদারদের সাথে সরাসরি সঙ্ঘাত হোক বা রিলিফ হিসাবে ‘খিচুড়ি সেন্টার’ চালানো হোক, কম্যুনিস্ট পার্টি তার সবটুকু শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল’। এই দ্রোহকাল শিখিয়ে দিল’ কল্পনা দত্তদের যে “communism is real patriotism and that patriotism does not mean a superficial and sentimental trust in the people nor blindly following the leaders, but the rousing of that self-confidence in the people which makes them the masters of their own destiny and conscious creators of their own future

Dutt, Kalpana, (1945),

Chittagong Armoury Raiders: Reminiscences”,

People’s Publishing House, pg. 88.

কম্যুনিস্ট পার্টির নাছোড় লড়াইয়ের ফলেই চট্টগ্রামে রেশন ব্যবস্থা শুরু করতে বাধ্য হল’ সরকার। খাদ্যের দুর্ভিক্ষের পরেই উপস্থিত হল’ কাপড়ের দুর্ভিক্ষ। গরিব মহিলাদের লজ্জা নিবারণ-টুকুও দুরূহ হয়ে উঠল’। সেসব মহিলাদের সংগঠিত করতে শুরু করেন কল্পনা। এর পরে আরো অনেক অন্দোলন, সংগ্রাম। আস্তে আস্তে বাংলার এই সত্যিকারের ‘অগ্নিকন্যা’ কম্যুনিস্ট পার্টির ইতিহাসে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হয়ে ওঠেন। কল্পনা’র ভাষায়ঃ “Terrorism gave us confidence in our own selves and Communism confidence in people. Terrorism teaches us to rely on our own moral virtues alone. Communism goes beyond that and teaches us to know the people and the country and also to change the people and with them, ourselves.”


শেয়ার করুন

উত্তর দিন