অঘোষিত যুদ্ধ
শান্তনু দে
আমেরিকার কাছে কোনও উপহার আশা করে না কিউবা। কিংবা চায় না কোনও বিশেষ বাণিজ্যিক সুবিধা। নরম সুদে ঋণ। চায় না কোনও অনুগ্রহ, আনুকূল্য। কোনও দান। অথবা কোনও কারিগরি সহায়তা।
কিউবার দাবি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু সম্মান করুক দ্বীপরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে। অবিলম্বে প্রত্যাহার করুক বর্বর অবরোধ। বন্ধ করুক অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা যখন কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক ‘স্বাভাবিক’ করার নীতি নিয়েছিলেন, তখনও কিউবার সরকার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছিল, ‘যতদিন অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও আর্থিক অবরোধ থাকবে, ততদিন কিউবা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক এতটুকু স্বাভাবিক হতে পারে না, যা এখনও কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে, যেকারণে কিউবার জনগণকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এটিই অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে প্রধান বাধা, যা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং যা প্রভাব ফেলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সমস্ত দেশের উপর।’
শুধু তাই নয়, সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে হলে ফিরিয়ে দিতে হবে কিউবার ভূখণ্ডে অবৈধভাবে দখল করে থাকা গুয়ানতানামো নৌ ঘাঁটি। বন্ধ করতে হবে রেডিও ও টেলিভিশন (কিউবা-বিরোধী) সম্প্রচার, যা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন, ক্ষতি করছে কিউবার সার্বভৌমত্বকে। বন্ধ করতে হবে কিউবার অভ্যন্তরে নাশকতা চালানো ও অস্থিরতা তৈরির লক্ষ্যে যাবতীয় পদক্ষেপ। মার্কিন নীতির কারণে কিউবার জনগণকে দিতে হবে তাবৎ মানবিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণ।
হোয়াইট হাউস থেকে বিদায় নেওয়ার আগে রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প আবার কিউবাকে যুক্ত করে যান ‘সন্ত্রাসে মদতদাতা রাষ্ট্রের’ তালিকায়। ২০১৫-তে, ওবামা এই তালিকা থেকে কিউবাকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। তার আগে ৩৩ বছর ধরে মার্কিন প্রশাসন সম্পূর্ণ অন্যায্যভাবে কিউবাকে রেখে দিয়েছিল এই তালিকায়। ১৯৮২-তে, কিউবাকে প্রথম এই তালিকাভুক্ত করা হয়। যখন কিউবা লাতিন আমেরিকাসহ নেলসন ম্যান্ডেলার আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস ও আফ্রিকার জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে সাহায্য করছে।
অথচ, যে একরত্তি দ্বীপরাষ্ট্রটি কয়েকশ সন্ত্রাসবাদী হামলার শিকার, যাতে প্রাণ দিয়েছেন ৩,৪৭৮ জন। যেমন, ১৯৭৬ সালের অক্টোবরে উড়িয়ে দেওয়া হয় কিউবার বিমান। মারা যান ৭৬ জন। এই সন্ত্রাসবাদী হামলার মূল ষড়যন্ত্রী ছিল লুই পোসাদা। ছয়ের দশকে মার্কিন সেনাবাহিনীর থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়া পোসাদা থাকতেন মিয়ামিতে।
কিউবা বার বার বলে এসেছে এই ঘটনার সঙ্গে সিআইএ জড়িত। অন্যদিকে, ওয়াশিংটন অস্বীকার করেছে। চল্লিশ বছর পর ফিদেল কাস্ত্রোর কথাই সত্যি বলে প্রমাণিত হয়। সিআইএ’র প্রশিক্ষিত এজেন্টরাই যে সেদিন কিউবার বিমানে বোমা হামলা চালিয়েছিল— মার্কিন ইতিহাসবিদদের জন্য প্রকাশ করা গোপন নথিতে এখন তা স্পষ্ট। গোটা বিষয়টি দস্তুরমতো জানতো মার্কিন প্রশাসন। সিআইএ’র দুই উচ্চপদস্থ কর্তা তৎকালীন বিদেশসচিব হেনরি কিসিঞ্জারকে পাঠানো এক গোপন নোটে সেকথা জানিয়েছিলেন।
সন্ত্রাসবাদের পয়লা নম্বর মদতদাতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ভন্ডামির বিপরীতে কিউবা বরাবরই সমালোচনা করে আসছে সন্ত্রাসবাদকে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের এই সংক্রান্ত সমস্ত সনদকে অনুমোদন করেছে কিউবা সরকার। তবু কিউবা ‘সন্ত্রাসে মদতদাতা রাষ্ট্রের’ মার্কিন তালিকায়!
ওবামার সময় দু’দেশের সম্পর্ক পুনর্প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ সম্পর্কে রাউল কাস্ত্রো জানিয়েছিলেন, ‘এক আউন্স নীতিও পরিত্যাগ না করেই এই সম্পর্ক স্থাপন।’ হাভানার বোঝাপড়ায় স্পষ্ট ছিল ওয়াশিংটন শুধুমাত্র তার কৌশল পালটেছে, উদ্দেশ্য নয়।
পরে কিউবার সংসদে আরও সুনির্দিষ্ট করে রাউল বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার সরকারের মধ্যে পার্থক্যগুলি প্রকট। অন্যান্যগুলির মধ্যে রয়েছে জাতীয় সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, রাজনৈতিক মডেল এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অবস্থান সংক্রান্ত অনুশীলনের প্রভেদ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোঝা উচিত কিউবা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। যার জনগণ অবাধ শান্তিপূর্ণ গণভোটে অনুমোদন করেছে তার সংবিধানকে। সমাজতন্ত্রের পথে চলা, এই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ব্যবস্থা সম্পর্কে নিয়েছে সিদ্ধান্ত।’
সেকারণে এই দ্বীপরাষ্ট্রের সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্মান দেখানো উচিত। একইভাবে কিউবাও কখনও দাবি করবে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করুক। কিউবা শুধু দাবি করবে তার সম্মান।
এই ১১ জুলাই, কিউবায় কিছু মানুষের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দেখে দৃশ্যতই অভীভূত মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন কিউবার জনগণকে ‘ত্রাণ’ দেওয়ার কথা বলেছেন। অথচ, অবরোধ প্রত্যাহারের কথা একবারও বলেননি। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন পিসাকি আশ্বাস দিয়েছেন, ‘আমরা দেখছি, কীভাবে কিউবার জনগণকে সাহায্য করতে পারি।’ কিন্তু বলেননি অবরোধ তোলার কথা।
জবাবে কিউবার রাষ্ট্রপতি দিয়াজ ক্যানেল বলেছেন, ‘ওরা (পশ্চিম) যদি কিউবার জন্য কিছু করতেই চায়, ওরা যদি সত্যিই আমাদের জনগণের জন্য উদ্বিগ্ন হয়, ওরা যদি কিউবার সমস্যার সমাধান করতে চায়, তাহলে আগে ওরা অবরোধ প্রত্যাহার করুক, তারপর আমরা দেখব।’
আজ কিউবার এই দুর্দশার জন্য দায়ী কে?
টানা ৬০-বছর অবরুদ্ধ একরত্তি দ্বীপরাষ্ট্র কিউবা। এই অবরোধে কিউবার অর্থনৈতিক লোকসানের পরিমাণ ৭৫,৪০০ কোটি ডলার। এক ডলার ৭৪ টাকা ধরলে ৫৫ লক্ষ ৮০ হাজার কোটি টাকা! যার প্রভাব পড়েছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্রীড়া-সংস্কৃতিসহ অন্যান্য স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্রের উন্নয়নে।
যে অবরোধের কারণে আজ মারাত্মক তেলের সংকটে কিউবা। যে কারণে তৈরি করতে পারছে না যথেষ্ট পরিমাণে টিকা। এখনও পর্যন্ত কিউবা নিজেদের গবেষণাগারে পাঁচটি করোনার টিকা তৈরি করেছে। এর মধ্যে একটি আবদালা। এই টিকাটি ৯২.২৮ শতাংশ কার্যকরী বলে জানিয়েছে কিউবার সরকার। অন্যটি সোবেরানা-০২। সোবেরানা শব্দের অর্থ সার্বভৌমত্ব। অথচ, এই কিউবাই কোভিড মোকাবিলায় ইউরোপ, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের ২৩টি দেশে পাঠিয়েছে তাদের আন্তর্জাতিক মেডিকেল ব্রিগেড। পাঠিয়েছে ১৫০০ চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীকে।
এই করোনার সময়েও অবরোধের কারণে গতবছর কিউবার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৯০০ কোটি ডলার। খাবার ও ওষুধ আমদানির জন্য ডলারের চাহিদা যখন অন্য যে কোনও সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। এমনকি বিদেশে বসবাসকারী কিউবানদের দেশে ডলার পাঠানো পর্যন্ত নির্মমভাবে ব্লক করা হচ্ছে। ব্যবহার করতে পারছে না আন্তর্জাতিক অর্থ প্রতিষ্ঠানকে। অথচ, যে কিউবাকে তার খাবারের ৭০ শতাংশই আমদানি করতে হয়।
কে না জানেন কিউবায় অভাব এবং সামাজিক অস্থিরতা তৈরির লক্ষ্যেই ব্যবহার করা হচ্ছে অবরোধের মারণ অস্ত্র। এই অবরোধ আসলেই ষাট বছর ধরে কিউবার বিরুদ্ধে এক অঘোষিত যুদ্ধ। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অন্তর্ঘাত। যেমন মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ার ভেবেছিলেন, ‘যদি ওরা (কিউবানরা) ক্ষুধার্ত হয়, তবে অনায়াসে হটিয়ে দেবে কাস্ত্রোকে।’
১৯৯২ থেকে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদ ভোট দিয়ে আসছে কিউবার বিরুদ্ধে মার্কিন অবরোধের অবসান চেয়ে। ২০২১, সর্বশেষ ভোটের ফলাফল ১৮৪-২। কিউবার সঙ্গে গোটা বিশ্ব। আরও একঘরে বাইডেন। অবরোধের অবসান চেয়ে ভোট দিয়েছে বিশ্বের ১৮৪ টি দেশ। বিপক্ষে মাত্র দু’টি দেশ। ট্রাম্পের উত্তরসূরী বাইডেনের আমেরিকা এবং ইজরায়েল। ভোটদানে বিরত থেকেছে ‘লাতিনের ট্রাম্প’ বোলসোনারোর ব্রাজিল, কলম্বিয়া এবং ইউক্রেন।
তবু নির্বিকার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। স্বাভাবিক। একরত্তি কিউবা না। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্য আসলে কিউবার সমাজতন্ত্র। আর সেকারণে কোনওভাবেই পেরে না উঠে কিউবাকে ভাতে মারতে চায়।
আজ যদি টানা ষাট বছর আমেরিকা অবরুদ্ধ থাকত, তাহলে মার্কিনমুলুকের অবস্থা এখন কেমন হতো?