কিষান যখন আস্ত ফিরে, ঘি মৌ মৌ আম-কাঁঠালে পিঁড়ি পেতে বসতো, তখন সব খানি মন উজার করে দিতো তাকে কিষানী। সেই কাহিনী শোনাই শোনো...
চাষের মাঠের কাজে কৃষক ও কৃষক রমনী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলে। এই খেটে খাওয়া কিষান- কিষানী আমার দেশের চিরায়ত গল্পের পটভূমি।
সময়ের সাথে যুক্ত হয়েছে শ্রমিক পরিবার। সারাদিন কলে কারখানাতে হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর ঘরে পাতা শিতলপাটিতে গা এলিয়ে দিতেই মাটির কলসির থেকে ঠান্ডা জল এনে ,তালপাতার পাখার হাওয়া দিয়ে শরীর জুড়িয়ে দেয় তার স্ত্রী।
সভ্যতা এগিয়ে চলে খেটে-খাওয়া মানুষের শ্রমের দ্বারা উৎপাদনের ফলে। খেটে-খাওয়া মানুষের শ্রমের মূল্য ঠিক হয় শ্রমশক্তি ( কায়িক ও বৌদ্ধিক) বিক্রির ক্ষমতার উপর। শ্রমশক্তির স্বাভাবিক ক্ষয় আছে। আমি তার মধ্যে যাচ্ছি না। কিন্তু এটা তো ঠিক কায়িক বা বৌদ্ধিক শ্রম করার পর, বাড়ি ফিরে রান্না করে খেতে হলে ও পরের দিন ঘরের সমস্ত কাজ( রান্না,বাসন মাজা, ঘর মোছা...) করে কাজে বেরুতে হলে তাহলে কাজের জায়গা তে শ্রমশক্তি বিক্রির ক্ষমতা কমবে। অর্থাৎ শ্রম দান করার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চাইলে, বাড়ির অন্য লোকের গৃহকাজের শ্রমে যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এই গৃহশ্রম যা উৎপাদন ব্যবস্থায় যুক্ত তার মূল্য দেওয়া হয় না। বাড়ির মেয়েদের বাড়িরকাজের সেই অর্থে কোনো মূল্য থাকে না।
কিন্তু সংসারের অসংখ্য দায়িত্ব মেয়েদের নিতে হয়।
যুগের পর যুগ ধরে রান্নার জ্বালানির জন্য কাঠ কেটে আনা, পাতা কুড়ানো, মাইলের পর মাইল হেঁটে পানীয় জল আনা, রান্না করা, বাসন মাজা, কাপড় কাচা.... এই গুলি বাড়ির মেয়েদের কাজ - এমনটাই সমাজের চিত্র। এই কাজের জন্য তাদের আলাদা কোনো পারিশ্রমিক নেই। যদিও এরা উৎপাদন ব্যবস্থার অন্যতম সহায়ক শক্তি।
এই কাজ গুলি সমাজের গতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সহজাত ভাবে এই কাজ গুলির মূল্য না থাকলেও এই কাজ গুলিই যখন বাড়ির লোককে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে করাতে হয় তখন তাকে পারিশ্রমিক দিতেই হয়। এ ক্ষেত্রেও এই কাজ করেন মহিলারাই। এই পেশার পোশাকি নাম গৃহসহায়িকা। এই পেশার মানুষের সমাজে প্রয়োজন অপরিসীম। কিন্তু সম্মান? না বলাই ভালো। গৃহসহায়িকাদের কেউ আপনি বলে ডাকেন?? পারিশ্রমিক?? তার অবস্থা ও খুব খারাপ। তার সাথে জোটে মুখঝামটা। যৌনহেনস্থা। কোথাও চোরের বদনাম।
কিন্তু গৃহসহায়িকারা কাজে না এলে সংসার চালানো দায়।
কেবল গৃহসহায়িকা নয়, আমাদের সমাজের অগ্রগতি তে মহিলারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এমন কত গুলি পেশা আছে সেই ক্ষেত্রে মহিলারাই করে থাকেন। নার্সিং, গ্রামসেবিকা, বিমান সেবিকা, রিসেপশনিস্ট আই সি ডি এস, আশাকর্মী, মিডে মিল কর্মী.....
এ ছাড়াও পুরুষদের সাথে সমান তাল মিলিয়ে শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা, বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী, সেলস কর্মী, বিড়ি শ্রমিক, সেলাইয়ের কর্মী, নির্মান কর্মী, সবজি বিক্রতা, হকারি..... সব করছে।
আধুনিক শ্রম বাজার যন্ত্র নির্ভর, যেখানে কায়িক শ্রম কম সেখানে মহিলারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিমান চালানো পর্যন্ত করছে। আই টি সেক্টরে অংশগ্রহণ উল্লেখ্য যোগ্য।
আজকের অন্য ধরনের কাজের ক্ষেত্রে ও মহিলাদের অংশগ্রহণ ব্যাপক। ওলা, বাইক চালক, ডেলিভারি সার্ভিস, শপিংমল, হোটেল, টুরিজম বিমা এজেন্ট... সব ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য।
স্বনির্ভর ক্ষেত্রে ও মহিলাদের ভুমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আজকের দিনে বুটিক চালানো, বিউটিশিয়ান, হ্যান্ডিক্রাফ্ট...
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতেই হবে মহিলার যে পেশার সাথে যুক্ত হোক না কেন বাড়ির বেশির ভাগ কাজের দায়িত্ব তাঁদেরই পালন করতে হয়। এবং টানাটানির সংসারে খাবার থেকে পোশাক শিক্ষার অধিকার সব ক্ষেত্রে মেয়েদের ভাগিদারী কম। তীব্র সামাজিক শোষণ। এখনো বিভিন্ন পেশায় পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় মহিলাদের বেতন কম। কাজের নিরাপত্তা কম। কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের শিকার অনেকেই। এই সব ক্ষেত্রে আমাদের দেশে আইন থাকলেও তা কার্যকর করার ক্ষত্রে অনেক দূর্বলতা থাকছে । আমাদের দেশে শ্রম আইনে মহিলা শ্রমিকদের সুরক্ষার যা ব্যবস্থা ছিলো বর্তমান বিজেপি সরকার নূতন শ্রম কোডের মাধ্যমে তা তুলে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
সব ধরনের কাজে সকাল ৬টার আগে ও রাত ৭ টার পর মহিলাদের কাজে আসতে বলা যাবে। নাইট ডিউটি করানো যাবে। নিরাপত্তার বিষয়টি কোথায় যাবে তা ভাবা হচ্ছে না। সামাজিক ও পুঁজিবাদী শোষণ একসাথে চলে। কিন্তু নারী অবলা নয়। সারা দেশ জুড়ে আজ লড়াই চলছে। সকলে তাদের ন্যায্য দাবী নিয়ে লড়াই করছে। সারা দেশে আজ অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের সুসংগঠিত লড়াই দেখছে। মিডে মিল আশা কর্মীরা লড়ছে। গৃহসহায়িকারা তাঁদের নিজেদের ন্যায্য মজুরি, সম্মান ও নিরাপত্তার দাবী নিয়েই তারা তৈরী করেছেন পশ্চিম বঙ্গ গৃহসহায়িকা ইউনিয়ন। লড়াই চলছে। ব্যাংক, বিমা, রেল সহ সব ক্ষেত্রে লড়াই অন্য মাত্রায় চলছে। সারা দেশ জুড়ে শ্রমজীবী মহিলারা নিজেদের অধিকারে ব্যাপক লড়াই চালাছে।
আজ ভারতবর্ষের রাজধানীর বুকে ১০০ দিন অতিক্রম করে বসে আছে যে কৃষক, সাথে ক্লান্তিহীন তার ছায়াসঙ্গী মা বৌ নয় মেয়ে। তেভাগা তেলেঙ্গানার পূনরাবৃত্তি। রবিঠাকুরের এর ভাষায়, "ঝিনুকের দুটি খোলা মাঝখান টুকু তার ভরা থাক একটি ছোট মুক্ত বিন্দু দিয়ে, দুর্লভ, মূল্যহীন।" ৮ মার্চ সারা বিশ্বে পালিত হবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ক্লারা জেটকিনদের লড়াই আজ ও অব্যাহত। সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শোষণের বিরুদ্ধে সামগ্রিক লড়াইয়ের অন্যতম শক্তি হিসাবে এ লড়াই চলবে।
শেয়ার করুন