শুভজিৎ সরকার
স্বাধীনতার লড়াইয়ে শহীদ হওয়া হাজারো বীর শহীদদের সম্মানের থেকেও বর্তমানে স্বাধীনতার সংগ্রামে অংশ না নেওয়া ব্রিটিশদের অনুগত চরের কাজ করা শক্তিদের মাথায় তুলে রাখার এক সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। আমাদের দেশে স্বাধীনতার জন্য একাধিক মানুষ শহীদ হয়েছেন, সর্বস্ব হারানোর সংখ্যাও অনেক। এরই মধ্যে আজকের দিনটার তাৎপর্য এটাই যে যুব সমাজের তিন প্রতিনিধি রাজগুরু, সুখদেব এবং ভগৎ সিংহদের আত্মবলিদান দিবস আজ, ২৩শে মার্চ। ১৯৩১ সালে আজকের দিনেই এই তিন বিপ্লবীকে ফাঁসি দেয় সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার। তাদের অপরাধ তারা নিজেদের কথা না ভেবে দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন। শেষদিন অবধি একবারের জন্যও ব্রিটিশ সরকারের কাছে মাথা নত করেনি এই যুবকরা। এদের ফাঁসির অন্যতম কারণ সেই বিখ্যাত লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা।

ঘটনার সূত্রপাত ১৭ই ডিসেম্বর, ১৯২৭ সালে জন পি স্যান্ডার্স নামক এক ব্রিটিশ অফিসারকে হত্যা করে ভগৎ সিংহ , সুখদেব, রাজগুরু এবং তাদের সাথীরা। এই হত্যার কারণ ছিল প্রতিশোধ। বলা হয় স্বাধীনতা সংগ্রামী লালা লাজপত রাইয়ের নির্মম হত্যার নেপথ্যে ছিল এই ব্রিটিশ অফিসার। এই হত্যাকাণ্ডের পর, ব্রিটিশ সরকার ভগৎ সিং এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়। ১৯২৯ সালে ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত কেন্দ্রীয় বিধানসভায় বোমা নিক্ষেপ করেন এবং গ্রেফতার হন। এই ঘটনার পর লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয়। যেখানে ভগৎ সিং, রাজগুরু, সুখদেব এবং অন্যান্য বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। ১৯৩০ সালে এই মামলার রায়ে ভগৎ সিং, রাজগুরু এবং সুখদেবকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ভগৎ সিংহ কোর্টে সওয়াল করেন এবং বলেন কাউকে মারা তাদের উদ্যেশ্য ছিল না বরং তারা চেয়েছিলেন ব্রিটিশ হুকুমতের বিরুদ্ধে ভারতের যুব সমাজ বিপ্লব গড়ে তুলতে প্রস্তুত- সেই আওয়াজ গোটা বিশ্বে পৌঁছে দিতে। সেই সময় ভারতের সাধারণ জনগণের চোখে ভগৎ সিংহ এবং তার সাথীরা নতুন এক স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ব্রিটিশ হুকুমত তাদেরকে নিশ্চিতভাবে ভয় পেয়েছিল বলেই রাষ্ট্রদ্রোহিতা বা সিডিসনের মামলায় যুক্ত করে। কিন্তু সেদিনের ভগৎ সিংহ’দের লড়াই দেশদ্রোহীতা ছিলনা, ছিল স্বাধীনতার লড়াই। গোটা দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন। উল্লেখ্য আরেকটি বিষয় ভগৎ সিংহই প্রথম সেই বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামী যিনি এতটাই দূরদর্শী ছিলেন যে সেই বয়সেও বারংবার বলেছেন যে আমাদের লক্ষ্য কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয় বরং রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক স্বাধীনতা। সত্যি বলতে গেলে এই সামাজিক এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তো অমরা আজও অর্জন করতে পারিনি স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরেও।
আর বর্তমান পরিস্থিতিতে আপনি আজাদীর কথা বললে আপনাকে দেশদ্রোহী ট্যাগ করে দেবে। কে দেবে! আরএসএস এবং বিজেপি এবং তাদের তৈরি করা কিছু বাজারি মিডিয়া এবং লোকজন। যেই আরএসএস, হিন্দুমহাসভা দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিল এবং অনবরত ব্রিটিশ হুকুমতের দালালি করে গেল দুর্ভাগ্যবশত সেই সাম্প্রদায়িক শক্তিরা এই দেশের ক্ষমতায়। আর যাদের জন্য দেশটা পেলাম সেই ভগৎ সিংহ, সুখদেব, রাজগুরুদের উত্তরাধিকার বহন করা বিপ্লবী আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হওয়া ছাত্র সমাজকে আজ বারবার পরীক্ষা দিতে হয় দেশপ্রেমের।
সাম্প্রতিক সময়ের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিক্ষোভের ঘটনা যা না বললেই নয়, যেই ঘটনা চারিদিকে সোরগোল ফেলেছে। গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বলতে গিয়ে একজন সাধারণ ছাত্রকে রাজ্যের মন্ত্রীর গাড়ির তলায় পড়ার ঘটনা সত্যিই আমাদের সকলকে নাড়িয়ে দেয়। ঠিক যখন ছাত্র সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়ছিল, প্রতিবাদ করছিল ঠিক তখনই দেখা গেল দেশের এবং রাজ্যের শাসক একই সুরে সুর মিলিয়ে জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ, দেশবিরোধী এসব কিছু শব্দ আমাদের ভাষ্যে নিয়ে এল। টিভির সামনে সারাক্ষণ একে অপরের বিরোধিতা করা তৃণমূল এবং বিজেপির নেতারা কিরকম একই সুরে কথা বলতে লাগলো। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গোদি মিডিয়া নোংরা ক্যাম্পেনে নেমে পড়লো। আজাদ কাশ্মীর নিয়ে তত্ত্ব এল। আজাদ কাশ্মীরকে আমরা সমর্থন করি না কিন্তু যদি ভারতের প্রতিটা অঞ্চলের, পরিসরের মানুষ সামাজিক, অর্থনৈতিক, অসাম্যের ব্যাধি থেকে আজাদী চায় তাহলে অবশ্যই আজাদীর স্লোগান আমাদের জীবনীর সম্বল হবে। সেই স্লোগান ভারতবর্ষ থেকে আলাদা হয়ে আজাদ হওয়ার স্লোগান নয়। এই আজাদীর স্লোগান ভগৎ সিংহ, রাজগুরু, সুখদেবদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দেওয়া আজাদীর স্লোগান। এই স্লোগানকে আগে ব্রিটিশ সরকার ভয় পেত, এখন বিজেপি, আরএসএস ভয় পায়।
যেই মূল উদ্যেশ্য নিয়ে দেশের বীর সন্তানরা দেশ স্বাধীন করেছিল, দেশের স্বাধীনতাকেই জীবনের এক এবং একমাত্র লক্ষ্য বানিয়েছিল সেই শহীদদের মর্যাদা দিতে পারিনি আমরা। দেশের সরকার তাদের বিরোধিতাকে দেশের বিরোধিতা হিসেবে অ্যাখা দিয়ে দেশবিরোধী কার্যকলাপের আইন প্রণয়ন করছে। যুব সমাজকে চাকরি দিতে ব্যর্থ। বছরে দুই কোটি বেকারের চাকরির কথা বলা বিজেপির সরকার যেই যেই সরকারি ক্ষেত্রে সময় সময় নিয়োগ হত সেই নিয়োগ করতে ব্যার্থ। ২০০৪ সালের পর থেকে যারা কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে এসেছে তাদের পেনশন বন্ধ। সামাজিক সুরক্ষাকে তোয়াক্কা করছেনা সরকার কারণ তারা কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের থেকে দূরে গিয়ে কিছু কর্পোরেটের মুনাফা হবে এমন রাষ্ট্রের ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করছে নাগপুরে বসে। দেশের সেনাবাহিনীতে যাওয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহ কমানো হয়েছে। পার্ট টাইম অগ্নিবীর নিযুক্ত করার প্রয়াস নিয়েছে সরকার। যুব সমাজকে টিভিতে দেশভক্তির যে লেকচার দিচ্ছে সেখানে দেশভক্তির কিছু নেই বিজেপি এবং তার ঘৃণ্য সম্প্রদায়িক রাজনীতির পাঠ দেওয়া হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এক্ষেত্রে অন্য সম্প্রদায়ের কিছু মৌলবাদী গোষ্ঠী উস্কানি পাচ্ছে, এতে হানাহানির পরিবেশ তৈরি হওয়া ছাড়া আখেরে কোন ভাল কিছুই হচ্ছেনা। ছাত্রদের জাতীয় শিক্ষা নীতির মধ্যে দিয়ে পাঠ্য পুস্তকের মধ্যে সাম্প্রদায়িক আবহাওয়া তৈরি হচ্ছে। মধ্যযুগের ইতিহাস মুছে ফেলার প্রয়াস নিয়েছে এরা। রাজ্যের ক্ষেত্রে তৃণমূল একদম বিজেপির ছোট ভার্সন বেকারের কাজ নেই, শিল্প নেই, সরকারি স্কুলে তালা পড়ছে। ৮২০০ সরকারি স্কুলের গেটে তালা মেরেছে রাজ্যের তৃণমূলের সরকার। দুই সরকারই শিক্ষায় বরাদ্দ কমিয়েছে এবং সর্বোপরি রাজ্যের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত এক দশকের বেশি সময় নির্বাচিত ছাত্র সংসদ নেই। রাজ্যে সর্বত্র শেষবার ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় ২০১৭ সালে। আস্তে আস্তে ছাত্র রাজনীতির মধ্যে নীতি, আদর্শের পাঠ তুলে ছাত্র রাজনীতি তুলে দেওয়া এদের উদ্দেশ্য। কারণ ক্যাম্পাসগুলো থেকেই বিকল্পের আওয়াজ ওঠে, ক্যাম্পাস রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী মনোভাবকে প্রশ্ন করে এবং সরকারের পতন ঘটায়। গোটা বিশ্বে ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। আজকে ছাত্র সংসদ নির্বাচন তুলে দিচ্ছে কালকে সাধারণ নির্বাচন, পঞ্চায়েত, পৌরসভা, স্থানীয় প্রশাসনের নির্বাচন তুলে দেবে। মূল উদ্যেশ্য গণতন্ত্রকে শেষ করা, আর প্রশ্ন করলেই তাকে দেশদ্রোহী অ্যাখ্যা দিয়ে দেওয়া।
যেটা না বললে পুরোটা অসম্পূর্ণ হয়ে যায় তা হল, স্বাধীনতার লড়াই যারা করেছিল তাদের মতাদর্শকে পাথেয় করে আগামীদিনের মানবমুক্তির লড়াইটা মজবুত করার প্রয়োজন আছে। ইতিহাসের বই থেকে ধীরে ধীরে বিপ্লবী আন্দোলনের অধ্যায় মুছে মন্দির, মসজিদের গল্প পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াস নিয়েছে বর্তমান শাসক শ্রেণি। নতুন নতুন দেশপ্রেমিকের সঙ্গা তৈরি করার কাজ করেছে এরা। আর এদের বিরুদ্ধে বললেই আপনি শহুরে নকশাল, মাওবাদী, পাকিস্তানি। ঘটনাচক্রে এরা মসজিদের তলায় মন্দির খোঁজার কাজে নিযুক্ত করে এদের কিছু দালাল মিডিয়াকে এবং ইদানিং সময়ে এই বাহিনী নেমেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের তলায় মন্দির খুঁজতে। কেউ ভাববেননা খালি হিন্দুত্ববাদী শক্তির কথা বলছি। ওপারে বাংলাদেশে একই কাজে নিযুক্ত হয়েছে জামাত বাহিনী। ইতিহাসের পাতায় জামাত বা আরএসএসকে দেখবেননা যে তারা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়েছে বরং যারা লড়েছে তারা আজ এদের তৈরি করা পাঠ্য সিলেবাস থেকে বাদ যাওয়ার পর্যায়ে আছে। সংবিধানের রচয়িতা ডক্টর. বি.আর. আম্বেদকরকে সংসদের অভ্যন্তরে অপমানিত করেছে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এদের থেকে আপনি কিই বা আশা করেন।

সেদিন ভগৎ সিংহরা যখন স্বাধীনতার যুদ্ধে নেমেছিলেন তখন তার সাথীদের জাতপাত,ধর্ম দেখে লড়াইয়ে নামেনি। এই দেশের স্বাধীনতার জন্য হিন্দুর যতটা রক্ত আছে, মুসলিম, শিখ, ক্রিশ্চান,আদিবাসী, দলিতের এবং অন্যান্যদের অতটাই রক্ত আছে। কিন্তু বর্তমান সময়ের শাসক শ্রেণি আজ ধর্মের ভিত্তিতে আমাদের আলাদা করছে কালকে জাতপাতের ভিত্তিতে আলাদা হবে। এখানে ওদের দেওয়া স্লোগানকেই সামনে এনে বলছি অমরা ভারতীয়রা যদি আলাদা হই তাহলে ওরা আমাদের শোষণ করতে সক্ষম হবে, ওরা বলতে শাসক শ্রেণি। আর এক থাকলে ওরা আমাদের পায়ে এসে পড়বে, অমরা জনতা এই দেশটা আমাদের, এই সংসদীয় গণতন্ত্র আমাদের।
সময়ের দাবি আরও ঐক্যবদ্ধ হওয়া সমস্ত বৈষম্যকে কাটিয়ে একত্রিত হওয়া। স্বাধীনতার বীর শহীদদের আদর্শকে সম্বল করে ছাত্র যুবদের লড়াইটা মজবুত করার। ছাত্র সংসদ নির্বাচন আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার, কর্মসংস্থান আমাদের হক। এই সবের জন্য মুষ্টিবদ্ধ হাতের সংখ্যা বাড়াতে হবে। মিছিল লম্বা করতে হবে। সংসদের অভ্যন্তরে ওরা আটকালে রাস্তায় ওদের আটকাতেই হবে। স্বাধীনতার জন্য এত এত শহীদের রক্ত বিফলে যেতে দেওয়া যাবেনা।
কমরেড ভগৎ সিংহ, কমরেড সুখদেব, কমরেড রাজগুরু লাল সেলাম।Rajguru, Sukhdev, Bhagat Singh,
We Shall Fight, We Shall Win...
লেখক গবেষক এবং ছাত্র আন্দোলনের কর্মী