।ফ্যাক্টরি ওহি বানায়েঙ্গে - ময়ূখ বিশ্বাস

১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বুধবার

দিনকয়েক আগেও অরুণাভ ব্যাঙ্গালুরুর এক বেসরকারি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কাজ করত।বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তে গিয়ে ওর মধ্যবিত্ত বাবা মা যে মোটা টাকা ধার করছিলেন ব্যাংক থেকে, তার অনেকটাই ও শোধ করে দিয়েছিলো। ঠিক যখন এক সুখী ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনছিলো অরুণাভ, তখনই লকডাউন। হাতে পিঙ্ক স্লিপ ধরিয়ে দিয়েছিলো কোম্পানি। সংসার চালানোর ব্যয় চালানোর জন্যে সেলসম্যানের চাকরি নিতে হয়েছে।

মুর্শিদাবাদের ওসমান মিস্ত্রির কাজ করত নয়ডায়।কেন্দ্রের অবিবেচনাপ্রসূত লকডাউনে সে হারিয়েছে সর্বস্ব। গ্রামে ফিরেও ১০০ দিনের কাজ মেলেনি। আবার কাজের খোঁজে মুর্শিদাবাদ থেকে বাসে চাপে পাড়ি দিয়েছে কেরালা।

বাগানডির বছর পঁচিশের শুভঙ্কর। এলাকায় কাজ না পেয়ে উত্তরাখন্ডে কাজ করতেন। লকডাউনে নিজের উদ্যোগেই গ্রামে ফিরেছিল। কিন্তু শুভঙ্করও এলাকায় কাজ না পেয়ে আবার উত্তরাখন্ডের ঋষিগঙ্গায় নির্মীয়মান জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কাজ করতে চলে গিয়েছিলো দুর্গাপূজার আগেই। কয়েকদিন আগে উত্তরাখন্ডে দুর্ঘটনার পর আর তাঁর খোঁজ নেই।

এরকম লক্ষ লক্ষ যুবক-যুবতীর হাহাকার শোনা যাচ্ছে এ বাংলার সর্বত্র।করোনা পরিস্থিতি ও তারপর লকডাউনে বাংলার পরিযায়ী প্রজন্মের বিষময় পরিণতি এবং তাদের প্রতি সরকারের চূড়ান্ত অবহেলা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বর্বর,অমানবিক দিক যেমন উন্মোচন করে দিয়েছে, তেমনি এক দশকে তৃণমূল রাজে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ব্যর্থতার ছবিটি আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। একদিকে সংসদে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ এবং মৃত্যু সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে শ্রমমন্ত্রীর তাচ্ছিল্য, অন্যদিকে স্যানিটাইজার দিয়ে করোনা ভাইরাস মুছে ফেলার মত পরিযায়ীদের নিয়ে রাজ্য সরকারের নিষ্ক্রিয়তা বুঝিয়ে দিয়েছে 'ভিকাস' এবং 'উন্নয়ন' আসলে কত বড় প্রতারণা। যখন পরিযায়ী শ্রমিকরা ঘরে ফেরার জন্য আকুল, সে সময় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শ্রমিক সহায়তার জন্যে দেয় লিংক কাজ করেনি। সরকারের থেকে ত্রাণ পাওয়া তো দূর অস্ত। কিন্তু এই পরিস্থিতির মধ্যে কেন পরতে হলো বাংলা থেকে ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া অসংখ্য মানুষকে? কারণ বাংলায় শিল্প নেই, লগ্নি নেই, বিনিয়োগের উপযুক্ত জমিনীতি নেই, তাই কাজ নেই।

আজ বাংলার বিভিন্ন রেলস্টেশনে, বাইপাসের ধারে চোখে পড়ছে বৃদ্ধাশ্রম এবং আয়া সেন্টারের বিজ্ঞাপন। কারণ ঘরে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের দেখার জন্য সন্তানরা নেই, গ্রাম হয়েছে পুরুষশূন্য। উৎসবের সময়ে কলকাতা, আসানসোল, শিলিগুড়ির মত শহর আজ বাঙালীর কাছে বেড়ানোর জায়গা । বাংলা আজ পরিণত হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। NSSO এর ২০১১-১২ রোজগার ও বেকারত্ব এবং ২০১৮-১৯ এর পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স এর উপর করা সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ১৫-৫৯ বছরের মধ্যে কর্মক্ষম মানুষদের মধ্যে বেকারত্ব ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।গ্রামীণ এলাকায় ৮.৩ লাখ এবং নগরাঞ্চলে ৬.৫ লাখ মানুষ কাজ খুঁজছে। বেকারভাতা পাওয়ার আশায় এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নাম লেখাচ্ছেন দলে দলে।পরিসংখ্যান বলছে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নাম লেখানো বেকার যুবক-যুবতীদের সংখ্যা হিসাব করলে পশ্চিমবঙ্গ সারা দেশের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। শিক্ষিত বেকারদের সংখ্যা বিপজ্জনক হারে বেড়েছে। ১০ বছরে সরকারি শূন্যপদ এখনো ২ লক্ষ।স্কুলশিক্ষক শূন্যপদ ১ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। গ্রুপ ডি নিয়োগে প্রতিশ্রুতি ছিলো ৬০ লক্ষ।আদতে নিয়োগ হয়েছে ৫ হাজার। ফলত ২০১১-১২ থেকে ২০১৮-১৯ ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে ১০-১৩ শতাংশ।গ্রামে তৃণমূল শাসনের এক দশকে কাজ হারিয়েছে ৯.৩ লাখ মহিলা।

এক্ষেত্রে অবশ্যই লক্ষ্যনীয় 'পরিবর্তনের' এক দশকে সরকারি চাকরির সুযোগ হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। স্কুলসার্ভিশ কমিশন, কলেজসার্ভিশ কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ সোনার পাথরবাটিতে পরিণত হয়েছে।

কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা ছিলো না। ২০০১ এ বামফ্রন্ট সরকার 'কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ' স্লোগান দেওয়ার পরই ২০০৩ সালে কগনিজেন্টের নতুন কমপ্লেক্স হলো। রাজারহাটে আইটি পার্ক হলো ওই বছরের অক্টোবরে। সেই সেক্টর ফাইভ বা নিউ টাউন হতে পারতো সিলিকন ভ্যালি। কিন্তু দিদি শুধু সিঙ্গুর থেকে টাটা নয়, ২০১০ সালে রাজারহাট থেকে ইনফোসিসকেও তাড়িয়েছিল শিল্পঘাতী জমি আন্দোলন করে। তার আগে বুদ্ধদেব ইনফোসিসকে রাজী করিয়ে ফেলেছিলেন। ৫০ একর জমি নেবে তারা। এমনই কথা ছিল। প্ল্যান ছিলো ধাপে ধাপে তারা দেড় হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করবে । যাতে প্রায় বিভিন্ন পর্যায়ে দশ হাজার কর্মসংস্থান হবে। সব চূড়ান্ত হওয়ার পর মমতার জমি আন্দোলনের ফলে ফিরে গিয়েছিল তারা।

সিঙ্গুরে প্রায় আস্ত কারখানা ডিনামাইট ফাটিয়ে ভাঙা হয়েছিল। আজ সেখানে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে তীব্র হতাশা। মনে থাকা উচিত পশ্চিমাঞ্চলের শালবনীতে জিন্দাল গ্রুপের প্রস্তাবিত এশিয়ার বৃহত্তম ইস্পাত প্রকল্পের উদ্বোধন সেরে ফেরার পথে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয়ে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল তৃণমূল-মাওবাদী বাহিনী। জিন্দলের কারখানাও হলো না। এই সিঙ্গুর, শালবনির সমসাময়িক সময়েই পুরুলিয়ায় শিল্পের মুখ রঘুনাথপুরে শুরু হয়েছিল শিল্প গড়ার প্রক্রিয়া। রঘুনাথপুর ১ ও নিতুড়িয়া ব্লক জুড়ে ভারী শিল্প গড়ার কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল। আজ সেখানে শ্মশানের নিঃস্তব্ধতা। রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চল হল হলদিয়া। বাম ছাত্র যুবদের দৃপ্ত মিছিলে যার সূচনা। কিন্তু বর্তমান রাজ্য সরকারের আমলে সেখানে নতুন শিল্পায়ন তো হয়নি বরং এখানে বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়েছে। অধিকারী পরিবারের তোলাবাজির কল্যাণে। এখন তাঁরাই ফুল বদলে মহাসাধুর ভান করছে। নন্দীগ্রাম যেখানে কেমিক্যাল হাব গড়ে তোলার জন্য ২০০৬ সালে শিল্প প্রকল্প নিয়েছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বধীন তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। কিন্তু ওই কেমিক্যাল হাব প্রকল্পের বিরোধিতা করে তৎকালীন বিরোধী তথা আজকের শাসক দল তৃণমূলের নেতৃত্বাধীন ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির জমিরক্ষা আন্দোলন ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল রাজ্য রাজনীতি। শেষ পর্যন্ত ওই কেমিক্যাল হাব তৈরির প্রকল্প থেকে পিছিয়ে আসে রাজ্য সরকার। আজ সেখানেও হাহাকার শিল্প হারানোর। মাত্র একয়েক বছরে। ওর উল্টোদিকে রায়চক থেকে বারাসাত চার লেনের আন্তর্জাতিক মানের রাস্তা হওয়ার কথা ছিলো। সেসব এখন দূরের কথা। এনএইচ ৩৪ চওড়া করা যায়নি। শিলিগুড়িতে ভিডিওকনের কারখানাও হয়নি। এই না পাওয়া, না হওয়ার লিস্ট অনেক দীর্ঘ।

আর শিল্প বলতে শুধু বাংলায় এখন শুধু তোলাবাজি, চিটফান্ড আর সিন্ডিকেট। ক্লাবে- পুজোয় টাকা আছে। ছেলেদের মধ্যে ড্রপ আউট বাড়ছে স্কুলে। স্কুল কলেজে নিয়োগে দুর্নীতি। স্থায়ী সরকারি চাকরি নেই।শিল্পের অভাবে বন্ধ হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গুলো। বাংলায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম শেষ হচ্ছে ভাইপো ও অধিকারীদের মুনাফার জন্যে।

এরমধ্যে বাংলার ছাত্র যুবরা প্রতীকী শিল্যানাস করেছে সিঙ্গুর, শালবনি, গোয়ালতোড়ের ১২ হাজার একর পরিত্যক্ত বীজ খামারের জমি থেকে খড়গপুরে বিদ্যাসাগর শিল্প তালুক, দাসপুরের প্রস্তাবিত শিল্প তালুকের জমিতে। এই সব কটি জায়গাই রাজ্য সরকারের বিশ্বাসভঙ্গতা, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি আর বেকার যুবকের স্বপ্নভঙ্গের প্রমাণ হয়েই দাঁড়িয়ে আছে। ওরা যখন ধর্ম নিয়ে ব্যস্ত, আমরা তাই বলছি, 'ফ্যাক্টরি ওহি বানায়েঙ্গে।' বাংলাকে আবার আমরা শিল্প মানচিত্রে তুলে আনবো। শুধু পূর্ব ভারত না, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দুয়ার বানাবো। তার আগে যারা বাংলার ছাত্র যুবদের সাথে প্রতারণা করে, বিভাজনের বিষ ঢোকাতে চাইছে তাদের বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করতে হবে। ১১ই নবান্ন, ২৮ শে ব্রিগেড। প্রতিবাদ প্রতিরোধের লহরীর পর লহরী গড়ে নতুন দিনের পথ প্রস্তুত করতেই হবে।




শেয়ার করুন

উত্তর দিন