আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা ডঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের সার্বিক জীবনচর্চার চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্যবাদী চিন্তা-চেতনার দ্বারা পরিচালিত মারাঠা নিয়ম-নীতি সংস্কৃতির উপরে হিন্দুত্ববাদীদের সবসময় অত্যন্ত বেশি রকমের গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। হেডগেওয়ারের জীবন, চিন্তাধারা, কর্মপদ্ধতি, মানসিকতা ইত্যাদি বিষয়গুলিকেই আরএসএস তাদের চিন্তা-চেতনার প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে জন্মলগ্ন থেকে প্রতিষ্ঠা করে।
আজ পর্যন্ত সেই একই ধারায় ওই বিষয়গুলিকে তুলে ধরছে আর এস এস।তাই মারাঠি সংস্কৃতি ,মারাঠি অস্মিতা, সার্বিকভাবে মারাঠি রীতিনীতি-- হিন্দুত্ববাদী চিন্তা-চেতনার বিকাশের ক্ষেত্রে একটা বড় রকমের ভূমিকা পালন করে আসছে ।এই গোটা চিত্রনাট্যটি নির্মাণের ক্ষেত্রে হেডগেওয়ারের পূর্ব পুরুষের অন্ধপ্রদেশের তেলেঙ্গানা অঞ্চল থেকে চলে আসা এবং সেই চলে আসার পেছনে মুসলিম বিদ্বেষের বিষয়টিকে প্রধান অনুঘটক হিসেবে উপস্থাপিত করে, হিন্দু ভোঁসলে সাম্রাজ্যের অন্তর্গত নাগপুরে বসতি স্থাপন এবং সঙ্ঘীয় ভাবধারা অনুযায়ী বৈদিক চিন্তা চেতনার সঙ্গে একাত্ম করন-- এই গোটা পরিমণ্ডল টিকে আরএসএসের আদর্শগত পরিকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই সংঘের লোকজন বিশেষ রকম গুরুত্ব আরোপ করেছিল।
সেই গুরুত্ব কিন্তু আরএসএসের চিন্তাভাবনায় সময়ের নিরিখে ,রাজনীতির দাবিতে ,নানা ধরনের অদলবদল ঘটলেও মুসলিম বিদ্বেষ এবং মারাঠি অস্মিতা --এই দুটি বিষয় খানিকটা মৌলিক বিষয় বস্তু হিসেবে থেকেই গেছে। তাই অতি সাম্প্রতিককালে (২০১৯ এর অক্টোবর) মহারাষ্ট্র বিধানসভার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শিবসেনা সঙ্গে বিজেপির সাময়িক বিচ্ছেদকে ঘিরে আমাদের এটা মনে রাখা দরকার যে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে কাল থেকে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠন জনিত যে বিরোধ, তাকে কেন্দ্র করে ভারতের বাণিজ্য রাজধানী বোম্বাইতে দখল করার পর্যায়ক্রমের ভেতর দিয়ে, মহারাষ্ট্র আর গুজরাটের মধ্যে জহরলাল নেহেরুর প্রধানমন্ত্রীত্ব কালে যে সংঘাত তৈরি হয়েছিল এবং সেই সংঘাতের ফলশ্রুতিতে বাণিজ্য রাজধানী বোম্বাইয়ের মহারাষ্ট্রের অন্তর্গত হয় --এই প্রেক্ষাপটে মারাঠি অস্মিতা সঙ্গে রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা কে মিলিয়ে মিশিয়ে ,রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদ কে ভারতের দক্ষিণ প্রান্তে প্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষেত্রে একটা ভূমিকা নিয়েছিল।
দক্ষিণ ভারতে নেহরু জমানাতে ভাষা ভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাকে সম্বল করে আরএসএস প্রত্যক্ষভাবে খুব একটা সাফল্য অর্জন করতে না পারলেও, তাদের সঙ্গে অভিন্ন রাজনৈতিক এবং মতাদর্শ গত অবস্থানে থাকা শিবসেনা কিন্তু অনেক বেশী রকমের সাফল্য অর্জন করতে পেরেছিল ।সেই সাফল্যের জেরেই ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের অব্যবহিত পরে মুম্বাই শহরে প্রলয়ংকর দাঙ্গার মধ্যে দিয়ে হিন্দু-মুসলমানের বিভাজন রেখা কে তীব্র করে তুলে, শিবসেনা যেমন সংসদীয় গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে নিজেদের একটা সুবিধাবাদী অবস্থান তৈরি করতে পেরেছিল ,তেমনি ই সুবিধাবাদী অবস্থান তৈরি করে দিতে পেরেছিল তাদের আদর্শগত সঙ্গী আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির।
স্থানীয় ইতিহাসের উপাদান গুলিকে নিজেদের ভাবনা চিন্তার জারকে জারিত করে, তাকে ভারতীয় সভ্যতা -ভারতীয় সংস্কৃতির এক এবং একমাত্র রূপ হিসেবে উপস্থাপিত করা জন্ম লগ্ন থেকেই আরএসএসের সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য ।সেই বৈশিষ্ট্যের লক্ষণটি কে বজায় রাখবার জন্য, হিন্দু কুল শিরোমণি হিসেবে শিবাজী কে উপস্থাপিত করে, শিবাজী কর্তৃক মুঘলদের সঙ্গে নিছক সাম্রাজ্য রক্ষার খাতিরে যুদ্ধ-বিগ্রহ -অশান্তি- মনোমালিন্য, তাকে একটি ধর্মীয় চিন্তাভাবনায় উপস্থাপিত করে, গোটা বিষয়টিকেই হিন্দু- মুসলমানের লড়াই হিসেবে দেখানোর উদ্দেশ্যে ভোঁসলে সাম্রাজ্যের আভ্যন্তরীণ পরিকাঠামোর ভিতর রাজনৈতিক হিন্দুত্বের উপাদান খুঁজে বের করাই ছিল জন্মলগ্ন থেকে আরএসএসের এক এবং একমাত্র উদ্দেশ্য।
সেই উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে তারা ভোঁসলে সাম্রাজ্যের স্থানীয় ইতিহাসের হিন্দুত্ববাদী ভাবধারার নায়কদের প্রতি হেডগেওয়ারের পূর্বপুরুষদের আকর্ষণের কথার ভেতর দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক কর্মসূচি 'সাম্প্রদায়িকতা'র প্রচার-প্রসার ও প্রয়োগের ক্ষেত্রটিকে প্রথম থেকেই পরিব্যাপ্ত করতে শুরু করে দিয়েছিল। হেডগেওয়ারের পরিবারের যেমন প্রথম থেকে একটি জাতপাত ও বর্ণভিত্তিক ব্রাহ্মণ্যবাদী ভাবধারার প্রতি সবথেকে বেশি আকর্ষণ, সেই আকর্ষণ টিকেই আরএসএস প্রতিষ্ঠা অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে, সংঘের প্রথম সারির নেতারা চিরদিন দেখাবার চেষ্টা করেছে।
পড়তে থাকুন... www.cpimwb.org.in