Fundamentalism

সাম্রাজ্যবাদের গর্ভেই জন্ম মৌলবাদের

শমীক লাহিড়ী

আজকের যুগে লগ্নী পুঁজি উৎপাদনমুখী নয়, মূলত লুট মুখী। যে রাজনৈতিক দল এই লুটে সহায়তা দেয়, তাদেরই নির্বাচনে জেতাবার জন্য নেমে পড়ে লুটেরা লগ্নি পুঁজি। এই কারণেই ট্রাম্প আবার আমেরিকার নির্বাচনে জয়ী হয়। সমগ্র ইউরোপ জুড়ে এই কারণেই অতি দক্ষিণপন্থীদের শক্তি বাড়তে পারছে।

বিভিন্ন দেশে অতি দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি আলাদা হলেও তাদের বক্তব্য একই ধরণের। আমেরিকার নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রচার কী ছিল? আমাদের চাকরী হচ্ছে না কারণ বিদেশীরা কাজ দখল করে নিচ্ছে। ক্ষমতায় এলে সমস্ত বাইরের লোকজনকে বের করে দেওয়া হবে। বাইরে থেকে কাজ করিয়ে আনা বন্ধ করা হবে। ভারতে মোদী নিজের ভাষণে ‘ঘুষপেটিয়া মুসলমান’দের সম্পর্কেও একই অভিযোগ করছেন ও একই দাওয়াই দিচ্ছেন। বাংলাদেশেও দুর্দশার জন্য সেখানকার সংখ্যালঘুদের নিশানা করা হচ্ছে। এটা কোনও নতুন কায়দা নয়। জার্মানিতে নাৎসিরা ক্ষমতায় আসার আগে ‘কর্মসংস্থান কোন পথে’ শীর্ষক এক বিতর্কসভায় সোস্যালিস্টরা বললেন, পুঁজিবাদ সবাইকে কাজ দিতে পারে না, তাই সমাজতন্ত্র আনতে হবে। কমিউনিস্টরাও বেকার সমস্যার সমাধানে পুঁজিবাদের অসাড়তা ব্যাখ্যা করলেন। শেষে নাৎসি প্রতিনিধি বললেন, আমার আগে যারা বললেন তাদের বক্তব্য আগামী দশ বছরেও বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা কোথায়? আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, আমরা ক্ষমতায় এলে সেদিন বিকাল থেকেই আপনারা অনেক সম্পদের মালিক হবেন, সকলে খেতে পাবেন, কাজ পাবেন। সবাই জানতে চাইল, এমনটা কিভাবে হবে? নাৎসি প্রতিনিধির উত্তর - এটা খুবই সহজ কাজ। নিজেদের পাড়ায় থাকা ইহুদীদের বাড়ি ঘর, দোকানপাট, ব্যবসা সবকিছু দখল করে ওদের তাড়িয়ে দিন, তাহলেই সমস্যা মিটে যাবে!

একই কথা একেক দেশে একেক কায়দায় বলা হচ্ছে। নিজেদের দেশের পরিস্থিতি অনুযায়ী ওরা জনগণের অপর অংশকে দুর্দশার জন্য দায়ী করছে এবং ঐ একই সমাধানের পথ দেখাচ্ছে।

আমাদের দেশে মৌলবাদীরা বলছে মুসলমানদের হটাও, তাহলেই সব সমস্যা মিটে যাবে। এরাই বাংলাদেশে বলছে হিন্দুদের তাড়িয়ে দাও, তাহলেই ওদের জমি বাড়ি চাকরি তোমার। সবটা একসাথে বিচার করলেই বোঝা যায়, মোটের উপরে এরা চায় বিদ্বেষ বিভাজনের রাজনীতি ছড়িয়ে নিজেদের শাসনকে কায়েম রাখতে চাইতে।

গত বছরের একটি ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। গভীর রাতে চলন্ত ট্রেনের মধ্যে রেলেরই এক নিরাপত্তা রক্ষীর রাইফেলের গুলি ঝাঁঝরা করে দেয় তিন যাত্রীকে। গ্রেপ্তার করার সময় সে স্লোগান দিলো - এদেশে হিন্দুরা ছাড়া আর কেউ থাকবে না। এদেশে ভোট দিতে চাইলে শুধু মোদী ও যোগীকেই ভোট দিতে হবে। এরা মুসলমান বলেই ঐ তিনজনকে আমি খুন করেছি। এই লোকটি কে? সাধারণ নিম্নবিত্ত কৃষক  পরিবারেরই। বিদ্বেষের বীজ কত গভীরে গেলে একজন মানুষ এমন আচরণ করতে পারে? যারা আখলাখ'কে পিটিয়ে খুন করল, তারা সবাই দাগী অপরাধী ছিলেন না তো! এখানেই বিদ্বেষের রাজনীতির কৌশল। যারা দাঙ্গা করে তারা প্রত্যেকেই দাগী খুনি নাকি? জনগণকে পরিকল্পিত ভাবে উন্মত্ত করে তোলা হয়। ফ্যাসিবাদ এটা পারে। সমাজ থেকে, জীবনযাপন থেকে যুক্তিবোধকে নিকেশ করে দিলে তবেই এমনটা করা যায়।

ভারতের প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে কেন নিশানা করা হচ্ছে? দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, আক্রমণ নামিয়ে আনার উদ্দেশ্য কী? আসলে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রগুলিকে আক্রমণ না করলে সার্বিক যুক্তিবোধ নিকেশের কাজটি সম্পন্ন হয় না। এই প্রসঙ্গে ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদের প্রথম শিক্ষা বাজেটের বক্তৃতাটি মনে রাখতে হয়। তিনি বলেছিলেন, Universities arethe centre for descent অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় হল যাবতীয় মতামতের বিরোধিতা করার কেন্দ্র। আগের মতামতকে চ্যালেঞ্জ না করলে, নতুন মতামত গড়ে ওঠে না। এটাই বিজ্ঞান। মানুষের জানা বোঝা একজায়গায় থেমে থাকে না, সময়ের সাথে এগিয়ে চলতে হয়। ডালটনের মতামতে আটকে থাকলে আজকের পদার্থবিদ্যা কোয়ার্ক কণার বিজ্ঞানে পৌঁছতে পারত না। ফ্যাসিবাদের ভাবনায় এসবের সুযোগ নেই, কোনকিছু বদলের অধিকার নেই।

পাকিস্তানে বছর কয়েক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে নব্বইজন ছাত্রছাত্রীকে খুন করা হল। এই আক্রমণের আসল লক্ষ্য শিক্ষার্থীরা ছিলেন না। যারা খুনী এবং যারা খুন হলেন, সবাই তো একই ধর্মের। আসলে সন্ত্রাসবাদের ধর্ম নেই। শুধু আতঙ্ক তৈরি করাই এর উদ্দেশ্য, যাতে কোনও বাবা-মা নিজেদের সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাবার সাহস না করেন। জ্ঞানচর্চার সাথে মৌলবাদের বিরোধ চিরায়ত। নতুন কথা, নতুন বোধ, নতুন জীবনচর্চা সবটাই মৌলবাদের ধারণার পরিপন্থী।

ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার এসবের বিরোধিতায় এই কারণেই মৌলবাদের এত আপত্তি। সব সময় মৌলবাদ যে কেবল মাত্র ধর্মকেই আশ্রয় করে, তা নয়। কখনো ধর্ম, কখনো ভাষা, কখনও জাতি পরিচয়, অর্থাৎ মানুষের মধ্যে বিভাজন করতে যেখানে যা কার্যকরী হয় তাকেই কাজে লাগানো হয়। আজও মেগাদিসু'তে গৃহযুদ্ধ চলছে, এর শিকার কারা হচ্ছেন? যারা খুন করছে আর যাদের খুন করা হচ্ছে, তাদের চেহারায় কোনও ফারাক নেই। কিন্তু একাংশের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, আরেকজনের জন্যই তার যাবতীয় দুর্দশা। খুন না করলে ওরা সংখ্যায় তোমাদের ছাড়িয়ে যাবে। আর তাই খুন করার সময় পুরুষ অপেক্ষা নারীদের প্রতি বাড়তি মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে, যাতে আগামী প্রজন্ম সৃষ্টির সম্ভাবনাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এই কারণেই প্যালেস্তাইনে সবচেয়ে বেশি খুন হচ্ছেন নারীরা ও শিশুরা। একে বলা হয় ক্লিন্সিং, নির্মূলকরণ প্রক্রিয়া। এই হল বিদ্বেষ। একাংশের মানুষের অস্তিত্বের সাথে আরেক অংশের মানুষের পরিচিতির ভয়ানক বিদ্বেষ তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে, যাতে আক্রমণকারী মনে করে, সামনের জন বেঁচে থাকলে সে নিজে বাঁচতে পারবে না।

আর তাই আম্বানি-আদানি সহ লুটেরাদের লুটের খবর তাকে বিচলিত করে না। কারণ সে বিশ্বাস করে যত লুট সব করছে ভিন্ন ধর্ম, ভাষা, জাতি বা উপজাতির মানুষ। ভারতে সেই শত্রু মুসলমান, বাংলাদেশে হিন্দু। পাকিস্তানে আবার বিভিন্ন উপজাতিদের মধ্যে বিদ্বেষ তৈরি করে গুলি গোলা সন্ত্রাসবাদ কায়েম করা হচ্ছে।

ভারতীয় উপমহাদেশে এহেন রাজনৈতিক কৌশলের গুরুত্ব কোথায়? বাংলাদেশের মৌলবাদীরা স্লোগান তুলছে, চলো কলকাতা দখল করি, আর এদেশের মৌলবাদীরা বলছে চলো চট্টগ্রাম দখল করি। হঠাৎ চট্টগ্রাম কেন? ঢাকা নয় কেন? ভারতের পূর্বপ্রান্তের বন্দরগুলির দিকে নজর দিলেই উত্তরটা বেরিয়ে আসে। এদেশের সমস্ত বন্দর আদানিদের মালিকানায় চলে এসেছে। চট্টগ্রাম বন্দর হাতে চলে এলে সম্পূর্ণ বঙ্গোপসাগরের ওপর একচেটিয়া দখলদারী কায়েম করতে পারবে আদানি। গুরুত্ব এখানেই, তাই চট্টগ্রাম দখল করা চাই! চট্টগ্রাম দখল করার স্লোগান শুভেন্দু অধিকারীদের মাথা থেকে বেরোয়নি, তাদের যারা চালায় সেই আদানীরাই নিজেদের লুটের ব্যবসার জন্য এমনটা চাইছে।

গোটা প্যালেস্তাইন দখল করার জন্য ইজরায়েল  আক্রমণের অজুহাত হিসাবে ইহুদী ধর্মকে ব্যবহার করছে, ইহুদী ধর্মের বয়ান হিসাবে জায়নবাদকে তুলে ধরছে। আমাদের দেশে হিন্দু ধর্ম আর হিন্দুত্বের রাজনীতির মধ্যে যতটা পার্থক্য, জায়নবাদ আর ইহুদী ধর্মের ফারাকও ঠিক ততটাই। ইহুদী একটি প্রাচীন ধর্ম, কয়েক হাজার বছর জুড়ে তার ইতিহাস। জায়নবাদ আসলে ধর্মের নামে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের কৌশল। উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে  থিওডোর হেরজল নামক একজন অস্ট্রিয়ান নিজের ইচ্ছামত জায়নবাদের ব্যাখ্যা দিয়েছেন, এদেশেও তেমনই হিন্দুত্বের স্রষ্টা ছিলেন  বিনায়ক দামোদর সাভারকার। বৈদিক হিন্দু ধর্মের ইতিহাস মানেই ভারতবর্ষে সভ্যতার সূচনা নয়। মেহেরগড় ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হওয়ার পর একথা স্পষ্ট হয়ে গেছে, আর্যরা এদেশে আসার অনেক অনেক আগেই ভারতবর্ষের মানুষ নগর সভ্যতায় অভ্যস্ত ছিল। হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো আরও পরের নগর সভ্যতা। তখনও আর্যরা এদেশে আসেনি। আবার প্রাচীন বৈদিক ধর্মের আচার আচরণের সাথে আজকের হিন্দু বিশ্বাস আস্থার কোনও মিল রয়েছে নাকি? আজ যে সমস্ত ধর্মীয় উৎসবগুলির  আয়োজনে লক্ষ লক্ষ মানুষ অংশগ্রহন করেন, সেসব দেব দেবীদের নাম চারটি বেদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়?

একটা সময় অবধি বেদের কোনও লিখিত রূপই ছিল না। একে শ্রুতি হিসাবে চর্চা করা হত, অনেক ক্ষেত্রে বেদের বিরোধী ভাষ্যের সাহায্যে বেদে উল্লিখিত বয়ানকে জানতে হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর আড়াই দশক পেরোনোর পরেও আরএসএস বলছে, দলিত বা মহিলারা মন্দিরে প্রবেশের অধিকার পাবে না, মহিলারা অবগুণ্ঠিত অবস্থায় চলাফেরা করবেন। অথচ বেদ উপনিষদ রচনায় লোপামুদ্রা, বশিষ্ঠা, অহল্যা, গার্গী সহ অনেক মহিলার বিশেষ ভূমিকার কথা আমরা জানি। পরবর্তীকালে বৌদ্ধ, জৈন ধর্মও এক জায়গায় আটকে থাকেনি। মহাযান, থেরবাদ, দ্বিগম্বর, শ্বেতাম্বর ইত্যাদি ভাগ তৈরি হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। ইতিহাসের গতিপথ, সমাজের ঐতিহ্য একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না, নানা বাঁক মোড় পেরিয়ে সময়োপযোগী হতে হতে এগিয়ে চলে। এমনটা না হতে পারলেই তো নিষ্প্রাণ হয়ে যেতে হয়। একই ঘটনা হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থানের যুগেও দেখা গেছে। রবীন্দ্রনাথের লেখা পূজারিণী কবিতায় আমরা পাই -

“নৃপতি বিম্বিসার

নমিয়া বুদ্ধে মাগিয়া লইলা

পাদ-নখ-কণা তাঁর।”

অর্থাৎ তিনি বৌদ্ধ। এরপরে তাঁরই পুত্র রাজ সিংহাসনে আসীন হয়ে কি করলেন?

“অজাত শত্রু রাজা হলো যবে

পিতার আসনে আসি

পিতার ধর্ম শোণিতের স্রোতে

মুছিয়া ফেলিল রাজপুরী হতে

সঁপিল যজ্ঞ-অনল-আলোতে

বৌদ্ধ-শাস্ত্ররাশি।

কহিলা ডাকিয়া অজাতশত্রু

রাজপুরনারী সবে,-

বেদ ব্রাহ্মণ রাজা ছাড়া আর

কিছু নাই ভবে পুজা করিবার

এই ক'টি কথা জেনো মনে সার-

ভুলিলে বিপদ হবে।”

এর অর্থ কী? কোনকিছুই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না।

হিন্দুত্বের ধারণা যার মস্তিষ্কপ্রসূত তিনি স্পষ্টই লিখেছিলেন, হিন্দুত্ব কোনও ধর্ম নয়, এটি হল একটি রাজনৈতিক প্রকল্প। তার লেখার কোথাও মন্দির, মঠের কোনও উল্লেখ ছিল না। যা ছিল তাকে আগাগোড়া এক সাংস্কৃতিক সাধারণীকরণে এবং রাষ্ট্র দখলের প্রস্তাবনা বলাই সঠিক। যে কোনও মানুষের ধর্ম, বিশ্বাস আস্থা যাই হোক না কেন, যদি তিনি ঐ সাধারণ প্রস্তাবনা মেনে নেন, তাহলেই  হিন্দুত্ব তাকে স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু অন্য ধর্মের সংস্কৃতি অনুযায়ী জীবনযাপন করলে, তাঁদের দেশ ছাড়তে হবে।

ইসলাম, বৌদ্ধ ধর্মমতের মধ্যেও মৌলবাদের বিপদ রয়েছে। আসলে মৌলবাদ কার্যত লুটের প্রক্রিয়ায় সহায়তা যোগায়। সেই কারণেই ধর্মের নামেই হোক আর বর্ণ, ভাষা ইত্যাদি যেকোনো কিছুর ভিত্তিতে গড়ে ওঠা মৌলবাদ সবসময় আতঙ্ক বা ভয় তৈরির মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। কেউ হাতে ত্রিশূল নেয়, কারোর হাতে থাকে ইনসাস। জনমানসে সীমাহীন আতঙ্ক তৈরির জন্যই এটা করা হয়। এমন আতঙ্ক যাতে মানুষ কোনোভাবেই এদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে না পায়। সেই আতঙ্কই জনগণের যুক্তিবোধকে ধ্বংস করে দেয়। এটা কোনও ধর্ম নয়।

আজ গোটা মধ্যপ্রাচ্য সাম্রাজ্যবাদের দখলে চলে এসেছে। এখন  মার্কিন-ন্যাটো জোটের লক্ষ্য ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, বাংলাদেশ সহ গোটা উপমহাদেশ দখল। আজ ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা যে স্লোগান তুলছে, আজ থেকে ৫ দশক আগে মধ্যপ্রাচ্যে মৌলবাদীরাও একই স্লোগান তুলেছিল। আজ ইরাক, সিরিয়ার কী অবস্থা? তারা আর কিছুতেই ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।

গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে নিজেদের দখলে রাখা প্রয়োজন ছিল সাম্রাজ্যবাদের। কারণ মধ্যপ্রাচ্য হল তেলের ভান্ডার।  এটাই দখলদারির আসল উদ্দেশ্য। এমন দখল কায়েম করতে গেলে কী দরকার? শিক্ষা, যুক্তি, বিজ্ঞানকে নিরর্থক করে দিতে হবে। নাহলে দখলদারকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে - তুমি কে, মাটির নিচের সম্পদের মালিকানা তো এদেশের মানুষের। অতএব এদের যুক্তিহীনতায় ভাসিয়ে দিতে হবে, ধর্মান্ধতায় ডুবিয়ে দিতে হবে। ধর্ম, ভাষা, জাত্যাভিমান এসবকে কাজে লাগাতে হয় তার জন্য। কিভাবে সেখানকার অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে তার বর্ণনা ধরা আছে জন পার্কিনসের লেখা ‘The Confessiom of Economic Hitman’ বইতে। আফগানিস্তান, লিবিয়া, ইরাক, সিরিয়া, প্যালেস্তাইন এই সমস্ত দেশ সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের বড় উদাহরণ। অর্থনীতির নিরিখে লিবিয়া একসময় রীতিমত সমৃদ্ধ দেশ ছিল।  মুয়াম্মার গদ্দাফি নিজেদের দেশের সংবিধানে যুক্ত করেছিলেন ‘ইসলামিক সোস্যালিজম’ শব্দটি। বেশিরভাগ প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যক্তি মালিকানার বদলে সরকারের অধীনে নিয়ে আসা হয়েছিল। ইরাকেও একই ধরণের কাজ সাদ্দাম হুসেন করেছিলেন। তাই এদের হত্যা করা হয়েছে। আলজিরিয়া, প্যালেস্তাইনেও একই অবস্থা ছিল। আজ এইসব দেশ সহ প্যালেস্তাইন, সিরিয়া, আলজিরিয়ার অবস্থা কী?

কারা এমন পরিস্থিতি তৈরি করল? কারা মৌলবাদী শাসন ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার জন্য সহায়তা যোগালো? এসব কিছুই হয়েছে সিআইএ’র  নির্ধারিত পরিকল্পনা, অনুযায়ী। ‘Legacy of Ashes: The History of the CIA’ - টিম উইনটার-এর লেখা এই বইয়ে আছে সিআইএ-র ইতিহাস, বিশেষত  মধ্যপ্রাচ্যে তাদের ভূমিকা নিয়ে। ‘The CIA and the Cult of Intelligence’ - ভিক্টর মার্ক-র লেখা এই বইটিতেও সিআইএ-এর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অপারেশন নিয়ে উল্লেখ করা আছে। ‘The Ghost Wars: The Secret History of the CIA, Afghanistan, and Bin Laden, from the Soviet Invasion to September 10, 2001" - স্টিভ কল-এর লেখা এই বইটিতে আফগানিস্তানে সিআইএ-এর কার্যকলাপ এবং আফগান যুদ্ধে তাদের ভূমিকা বিশদভাবে বর্ণনা করা আছে।

সাম্রাজ্যবাদ আর লুটেরা পুঁজি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিই চায়। অন্য দেশের সম্পদকে নিজেদের দখলে আনার জন্যই এত আয়োজন।

আর তাই মৌলবাদকে সাম্রাজ্যবাদের থেকে আলাদা করে বিবেচনা করা যায় না, সেটা করলে আগুয়ান বিপদকে ছোট করে দেখা হবে। যে দেশে মৌলবাদকে মাথায় উঠতে দেওয়া হয়েছে, তারা প্রত্যেকেই পরবর্তীতে সাম্রাজ্যবাদের পায়ে পড়তে বাধ্য হয়েছে। তাই আজকের পৃথিবীতে মৌলবাদ বিরোধী লড়াইকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের সাথে সম্পৃক্ত করেই এগতে হবে। এই লড়াই সংগ্রাম আসলে একই শত্রুর বিরুদ্ধে। সেই লড়াইয়ে মানুষকে জিততেই হবে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন