মহান নভেম্বর বিপ্লব - ১৯১৭ সালের ৭ই থেকে ১৭ই নভেম্বর কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের “দুনিয়া কাপানো দশ দিন (জন রীড বর্ণিত) এ যা সুসংহত হয়েছিলো। দার্শনিক হেগেল ‘ফিলজফি অব রাইট’ এ ব্যাখ্যা করেছেন যে, মতাদর্শ তখনই শক্তিশালী হয় যখন তা জনগণ গ্রহণ করে ও কার্যকরি করতে সচেষ্ট হয়। রাশিয়াতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে গণভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে কমরেড লেনিন নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষন করেই নভেম্বর বিপ্লবের সাফল্য অর্জন করতে সফল হয়েছিলেন। তত্ত্ব ও প্রয়োগে মার্কসবাদ প্রসারিত হয়েছে মার্কসবাদ - লেনিনবাদে।
নভেম্বর বিপ্লব ও তার গৌরবজনক ফসল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার সর্বক্ষেত্রে চমকপ্রদ সাফল্য সারা বিশ্বে, বিশেষ করে দেশে দেশে মুক্তিকামী জনগণের আন্দোলন, স্বাধীনতার সংগ্রাম ও শ্রেণী আন্দোলনকে মদত জুগিয়েছে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ( মার্কসবাদী )'র কর্মসূচীতে উল্লেখ করা হয়েছে, - “এই শতাব্দী (বিংশ শতাব্দী) দেখেছে বিরাট বিরাট বৈপ্লবিক ঘটনা, যার সূচনা ১৯১৭ সালের অক্টোবর (নভেম্বর) সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জয় হয়েছিল বিরাট এক ঘটনা, সোভিয়েত ইউনিয়ন সেখানে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছিল (পার্টি কর্মসূচী ২.১নং অনুচ্ছেদ)। এই কর্মসূচীতে আরো বলা হয়েছে - “সোভিয়েত ইউনিয়নের সাফল্য ধণতান্ত্রিক দেশগুলিতে প্রভাব ফেলেছিলো। শাসক শ্রেণীগুলি বাধ্য হয়েছিল জনকল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণায় নিজেদের নাগরিকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করতে, তার প্রসার ঘটাতে।

কমরেড মাও-জে-দং চীনের বিপ্লবী প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন যে নভেম্বর বিপ্লবের রণধ্বনি শুধু রাশিয়াতেই নয়, সারা পৃথিবীর দেশে দেশে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বার্তাকে পৌঁছে দিয়েছে ও সেই দেশগুলির জনগণের মুক্তি আন্দোলনকে শক্তি ও সংহতি জুগিয়েছে। এই ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ ভারতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। নভেম্বর বিপ্লবের বহুমাত্রিক প্রভাব পরেছিলো ভারতে ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে। ইংরেজ শাসক এই “বলশেভিক” বিপদের আঁচ টের পেয়েছিলো। এই বিপদের উল্লেখ করেই ১৯১৮ সালে ভারতে ‘মন্টেগু-চেমসফোর্ড’ কমিশনের রিপোর্ট উল্লেখ করা হয়েছিলো যে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের জয় হিসাবে বিচার করেই ভারতের জনগণ ভারতীয় রাজনীতিতে উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে শ্রমজীবী জনগণের অংশগ্রহন নিশ্চিত করতে কমিউনিস্ট পার্টি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে যার প্রধান প্রেরণা নভেম্বর বিপ্লবের সাফল্য এবং তার বিশ্বব্যাপী প্রভাব। ৭ জন প্রবাসী বিপ্লবীকে নিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অঙ্কুর সৃষ্টি করা হয় সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার তাসখন্দে। মহম্মদ সফিক হন তার সম্পাদক। ক্রমে ক্রমে তা দেশের অভ্যন্তরে সংযোগ ঘটাতে সক্ষম হয়। বাংলায় মুজফ্ফর আহমেদ, মুম্বাইতে শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে, মাদ্রাজে সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার নেতৃত্বে সংগঠন গড়ার উদ্যোগ শুরু হয়। ১৯২০ সালে অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস ও ১৯৩৬ সালে সারা ভারত কৃষক সভা গঠিত হয়।
স্বাধীনতা আন্দোলনের নানা ধারার অন্যতম ছিলো বিপ্লববাদী ধারা। এই বিপ্লববাদী ধারায় সংগঠকরা অনেকেই সমাজতান্ত্রিক ভাবনা ও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। শহীদ ভগৎ সিং, গদর পার্টির বিপ্লবীগন, আন্দামান জেলে নির্বাশিত বিপ্লবীরা, চট্টগ্রাম বিদ্রোহের নেতা মাস্টারদা সূর্যসেনের অনুগামীগন সহ অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীরা মতাদর্শ হিসাবে সমাজতন্ত্রকেই অনুসরন করেন নভেম্বর বিপ্লবের প্রেরণায়।

ইংরেজ শাসক ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাবে কমিউনিস্টদের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির কার্যক্রমকে উদ্বেগের সঙ্গে মোকাবিলা করতে উদ্যোগী হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের এই বামপন্থী উদ্যোগগুলিকে বিনষ্ট করার জন্য একের পর এক “বলশেভিক” ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে গ্রেপ্তার ও অত্যাচার শুরু করে ইংরেজ সরকার। শত অত্যাচারেও এই বিপ্লবীদের মনোবল দূর্বল করতে পারেনি শাসক সরকার। লাহোর মামলার শুনানী চলাকালীন বিচারকের শাসনেই ভগৎ সিং সহ সহবন্দীরা স্লোগান তোলেন, - “সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব জিন্দাবাদ” - “কমরেড লেনিনের চিন্তাধারা দীর্ঘজীবী হোক”, “ সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক্”। একইভাবে মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্তদের পক্ষ থেকে কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদ সহ অন্যান্যরা যে বিবৃতি দেন তা ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের একটি ঐতিহাসিক দলিল। (Communists Challenge Imperialism from the Dock)|
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাব অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো কংগ্রেস অধিবেশনে কমিউনিস্টদের পক্ষ থেকে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী উত্থাপন ও ইস্তাহার প্রচার। ১৯২১ সালে জাতীয় কংগ্রেসের আহমেদাবাদ অধিবেশনে মৌলানা হসরত মোহানী ও স্বামী কুমারানন্দ যৌথভাবে সমস্ত রকম বৈদেশিক নিয়ন্ত্রন মুক্ত এক পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী উত্থাপন করেন। কিন্তু গান্ধীজী এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন।
উল্লেখ করা দরকার যে কমিউনিস্টরাই প্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী তুলেছিল শুধু তাই নয়, এই দাবী উত্থাপকদের একজন মুসলমান ও অপরজন হিন্দু। আজকের বিজেপি-আরএসএস এর সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতের বিপদগ্রস্ত দেশ ও কর্পোরেট সাম্প্রদায়িক নরেন্দ্র মোদী সরকারের জনবিরোধী নীতির মোকাবিলায় উপরোক্ত নজীর উল্লেখ করা খুবই প্রাসঙ্গিক । ১৯২২ সালে পুনরায় কংগ্রেসের গয়া অধিবেশনে এম.এন.রায় পূর্ণ স্বাধীনতার দাবীতে ইস্তাহার প্রচার করেন। অবশেষে ১৯২৯ সালে জাতীয় কংগ্রেসের লাহোড় অধিবেশনে পূর্ণ স্বরাজের প্রস্তাব গৃহীত হয়।
বিংশ শতাব্দীতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যেও নভেম্বর বিপ্লব ও সোভিয়েত রাশিয়ার সর্বক্ষেত্রে সাফল্য প্রভাব ফেলেছে। জওহরলাল নেহরু অকপটে বলেছেন যে - “ভাবনার দিক থেকে আমি সমাজতন্ত্রের পক্ষে”। শুধু রাজনৈতিক জগৎ নয়, নভেম্বর বিপ্লবের ফসল সোভিয়েত ইউনিয়ন সুসম সমাজব্যবস্থা, শোষণহীন সমানাধিকারের সমাজ চমৎকৃত করেছিলো বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথকেও। তিনি ত্রিশের দশকে রাশিয়া ভ্রমন করে বলেছিলেন - “রাশিয়ায় না এলে আমার জীবনের তীর্থ দর্শন অপূর্ণ থেকে যেত।” এই অনুভব ও উপলব্ধির প্রভাব পড়েছিল ত্রিশ -চল্লিশের' এর দশকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী তরুণ সমাজের মধ্যে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান হয়েছিলো স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত বাহিনী লাল ফৌজের হতে হিটলারের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। ফ্যাসীবাদের বিভীষিকাকে পরাজিত করতে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার দুই কোটি মানুষ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। বিশ্ব রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন ঘটলো - এর পরই অর্জিত হলো ভারতের স্বাধীনতা।
আজ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেছে। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় আপাত বিপর্যয় ঘটেছে। কিন্তু নভেম্বর বিপ্লবের ফসল সোভিয়েত ইউনিয়নের সাফল্য, বিশ্বব্যাপী শোষণ মুক্তির সংগ্রামে নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাব এবং অবশ্যই আমাদের দেশ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার অবদান চির অমলিন থাকবে।
