কুৎসার আড়ালে প্রকৃত সত্য (শিল্পে পশ্চিমবঙ্গ)

১৮ জানুয়ারি ২০২১ সোমবার
শিল্পে পশ্চিমবঙ্গ : কুৎসা বনাম বাস্তব
পর্ব -২


১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর শিল্পায়নের ক্ষেত্রে গতি আনার যে সমস্ত প্রয়াস গ্রহণ করেছিল সেগুলির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের নেতিবাচক মনোভাব।
    ১৯৯১সাল পর্যন্ত দেশে কোথায় শিল্প প্রতিষ্ঠা হবে তা কেন্দ্রীয় সরকারের মর্জির উপর নির্ভর করায় পশ্চিমবঙ্গের বড় ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ বারেবারে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে।
কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই চালাতে বদ্ধপরিকর ছিল পশ্চিমবাংলা।
প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের শিল্পনীতিতে অগ্রাধিকার পায় বেকার সমস্যার বৃদ্ধি প্রতিহত করা, শিল্প ও কৃষিতে অধিকতর কর্মসংস্থান করা,রাজ্যের অর্থনীতির উপর একচেটিয়া প্রতিষ্ঠান ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান গুলির নিয়ন্ত্রণক্ষমতার হ্রাস ঘটানো,শিল্পে স্বনির্ভরতা ও দেশীয় যন্ত্রকৌশলের প্রসার, রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগের ক্রমপর্যায়ে প্রসার,শিল্পক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার বিকাশ ইত্যাদি। কিন্তু নানাভাবে এই শিল্পায়নের প্রক্রিয়ায় বাধা দিতে থাকে কেন্দ্রীয় সরকার।লাগাতার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয় এ রাজ্যের মানুষ। বঞ্চনা ও ষড়যন্ত্রকে প্রতি পদে প্রতিহত করেই এগোচ্ছিল পশ্চিমবঙ্গ।



১৯৭৭-৮১সালের মধ্যে ৫১৭টি প্রকল্পে ৯৫২কোটি ১৯লক্ষ টাকা বিনিয়োগ হয়েছিল।

১৯৮১ সালে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার খসড়া সম্পর্কে আলোচনা সভায় উপস্থিত হয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেন:
১। পূর্বাঞ্চল বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিদ্যুৎ সংকট তীব্র হওয়া সত্ত্বেও কেন যোজনার খসড়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর প্রস্তাবে এই অঞ্চলগুলির জন্য বিদ্যুৎ শক্তি সবচেয়ে কম বাড়ানোর ব্যবস্থা করা হলো?

২। কেনই বা মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে পেট্রোকেমিক্যাল কমপ্লেক্স তৈরী করে দেবার ব্যবস্থা রাখা হলো অথচ তা পশ্চিমবঙ্গের জন্যে হল না?

৩। অন্য সমস্ত রাজ্যের জন্য যোজনায়১৯৮১-৮২ সালে কেন্দ্রের নিঃশর্ত বাৎসরিক অনুদানের পরিমাণ ১৯৮০-৮১ সালের তুলনায় বাড়ানো সম্ভব হল অথচ কেন পশ্চিমবঙ্গের জন্য ওই অনুদানের পরিমাণ ১৯৮০-৮১ সালের তুলনায় কমিয়ে দেওয়া হল?
এই প্রশ্নগুলির উত্তর পরিকল্পনা কমিশনের চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে ছিল না।

বকেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র


১৯৮৩ সালে রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে চিরাচরিত শিল্পাঞ্চলের বাইরে শিল্প বিকাশ কেন্দ্র বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেন্টার গঠন করা হবে। পরবর্তী কালে কল্যাণী,হলদিয়া, খড়গপুর, শিলিগুড়ি, বজবজ, উলুবেড়িয়া,কুচবিহার, মালদহ, জলপাইগুড়ি, মুর্শিদাবাদ ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় যে শিল্পবিকাশ কেন্দ্র গুলি গড়ে ওঠে তা সবই বামফ্রন্টের ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালের শিল্পনীতির ফসল।

১৯৭৭ সালে রাজ্য সরকার গঠনের পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গে সম্ভাবনাময় শিল্প যাকে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু 'সূর্যোদয়ের শিল্প' বলতেন সেই পেট্রোকেমিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স শিল্প গড়ার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়। হলদিয়াতে  পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প এবং সল্টলেকে ইলেকট্রনিক্স প্রকল্প বাস্তবায়িত করার জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা গ্রহণ করে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন সরকার। অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এই শিল্প প্রকল্প নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে একের পর এক প্রস্তাব পাঠানো সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার  টালবাহানা করতে থাকে। অবশেষে ১৯৮৪ সালের ৬ জুলাই ভারত সরকার জানিয়ে দেয় যে হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসে ভারত সরকার বা কোন কেন্দ্রীয় সংস্থা অংশগ্রহণ করবে না। এতেও হতোদ্যম না হয়ে শিল্প স্থাপনের স্বার্থে একদিকে প্রশাসনিক উদ্যোগ অন্যদিকে গণ আন্দোলন গড়ে তোলেন এরাজ্যের বামপন্থীরা। সল্টলেকে ইলেকট্রনিক্স প্রকল্প নিয়েও কেন্দ্রীয় সরকার চরম অসহযোগিতা করে এবং  পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তবর্তী রাজ্য হওয়ায় প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সমস্যা হতে পারে এই অজুহাতে প্রকল্প টি থেকে হাত গুটিয়ে নেয়।

এত অসহযোগিতা ও ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের কাজ বামফ্রন্ট সরকারের আমলে থেমে থাকেনি। কেন্দ্রীয় সরকার অনুমতি দিতে প্রায় বারো বছর সময় নিলেও রাজ্য সরকারের দৃঢ় মনোভাবের জন্য হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, সল্টলেকে গড়ে উঠেছে একের পর এক ইলেকট্রনিক্স শিল্প।

হলদিয়া শিল্পাঞ্চল


বামফ্রন্ট সরকার যখন এই রাজ্যে ক্ষমতাসীন হয় তখন রাজ্যে বিদ্যুতের সংকট ছিল ভয়াবহ। রাজ্য সরকার এই বিদ্যুৎ সংকট থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য রাজ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলার দ্রুত উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও অসহযোগিতা করে কেন্দ্রীয় সরকার। একথা সকলের জানা যে বক্রেশ্বরে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত করার যে উদ্যোগ নিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার তাতে কেন্দ্রীয় সরকার নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু
    বামফ্রন্ট সরকারের দৃঢ়তা ও জনগণের অকুণ্ঠ সহযোগিতায় এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়িত হয়। গার্ডেনরীচে সি ই এস সির বিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদন দিতে বারো বছর সময় নেয় কেন্দ্রীয় সরকার।
বঞ্চনা ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এভাবে ধৈর্য ধরে,দৃঢ়তার সাথে একটার পর একটা মাইলস্টোন  পেরিয়ে যায় পশ্চিমবঙ্গের মানুষ।



বামফ্রন্ট সরকার যখন এ রাজ্যে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় তখন রাজ্যে দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬০%। ভূমি সংস্কার কর্মসূচির সফল রূপায়ণের মাধ্যমে রাজ্যে ভূমি সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটিয়ে এবং ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা কায়েম করার মধ্যে দিয়ে রাজ্যের  গ্রামীণ অর্থনীতি ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। গ্রামীণ জনতার ক্রয়ক্ষমতা বাড়তে থাকে।এর ফলে রাজ্যে বিকশিত হয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প যাতে পশ্চিমবঙ্গ অতি দ্রুত সারা ভারতবর্ষে প্রথম স্থান অধিকার করে। মজবুত এই গ্রামীণ অর্থনীতি পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গে  শিল্প বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তিতে পরিণত হয়।



(ক্রমশ....) কুৎসার আড়ালে প্রকৃত সত্য (শিল্পে পশ্চিমবঙ্গ)
শেয়ার করুন

উত্তর দিন