পর্ব ৯
বন্ধ বিএসকেপি,
বন্যা মদের,
প্রবচনে স্বয়ংসেবক
‘‘আমি জিততে চাই। রাজনীতিতে জেতার জন্য সবকিছু করব। আর জেতার পর ভালো ভালো কথা বলব। জিততে না পারলে নীতি আদর্শ ধুয়ে কেউ জল খাবে না।’’
নীতিকথার এই ‘শিক্ষক’-র নাম কী? স্বাভাবিক প্রশ্ন। ক্রমশ প্রকাশ্য। আগে বলুন কেমন লাগলো? মগজ কিঞ্চিৎ ঘিনঘিন করে উঠলো? নবজাগরণের ঐতিহ্যে উৎসারিত বাঙালী মননের সযত্নলালিত নৈতিকতার শ্লাঘায় কেউ পদাঘাত করলো? প্রশ্ন উঠলো — কার এই অসহ্য দুঃসাহস? তাহলে বলি। বক্তা যে সে নন। তিনি বিধায়ক ছিলেন। এখন সাংসদ। একটি জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক দলের রাজ্য কমিটির তিনি সভাপতি। তিনি ‘সাংস্কৃতিক সংগঠন’ হিসাবে প্রচারিত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের পূর্বাঞ্চলের অন্যতম সংগঠক। তিনি দিলীপ ঘোষ। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘এই সময়’ পত্রিকায় গত লোকসভা নির্বাচনের আগে, এপ্রিলে তাঁর এক ফলাও সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সেখানেই রাজনীতি, নীতি-আদর্শ সম্পর্কে তাঁর এই ধারনার কথা তিনি বলেছিলেন।
সাক্ষাৎকারে তিনি সেদিন আরও বলেছিলেন,‘‘রাজনীতিতে জেতার জন্য সবকিছু করব। আর জেতার পর ভালো ভালো কথা বলব।’’ সাক্ষাৎকারে সেদিন আরও দাবি করেছিলেন, ‘‘এটাই বাংলার রাজনীতি। ভদ্রভাবে কথা বলে কে কবে জিতেছেন?’’
এই জ্ঞান তিনি কোথা থেকে পেলেন? বিজ্ঞান বলে — আগে বস্তু পরে জ্ঞান। অভিজ্ঞতার নিরিখেই জ্ঞানের উৎপত্তি। যে কোনও মূল্যে জেতো, যা খুশি, যেমন খুশি মিথ্যা বলো, নীতি-আদর্শের বালাইহীন এই ‘স্যাটানিক’ কৌশল প্রকাশ্যে বললেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সহ্য তা করতে পারেন — এই উপলব্ধিতে দিলীপ ঘোষকে পৌঁছে দিলেন কে? একজনই — তিনি মমতা ব্যানার্জি।
২০০৭-০৮-এ সিঙ্গুরে কারখানা আটকানোর কাজে যখন মমতা ব্যানার্জির পাশে রাজ্যবিরোধী সব শক্তি একজোট, তখন কবীর সুমন লিখলেন —‘মমতা একটি ফেনোমেনা।’ অর্থাৎ মমতা ব্যানার্জি একটি বাতাবরণ। রাজ্যের ভবিষ্যৎ গড়ে উঠার সম্ভবনা ছিল শিল্পকে কেন্দ্র করে। সেই স্বপ্ন যখন জাতীয় সড়কে ভাঙছে, সেই ধ্বস্ত সময়ে এই ‘ফেনোমেনা’র জন্ম অবশ্যম্ভাবি।
কিসের বাতাবরণ? অনৈতিকতার। ঘৃণার ভাষা, ডাহা মিথ্যাকে সমাজে সোচ্চারে প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রবল হতাশার এক বাতাবরণ দরকার হয়। তৃণমূল কংগ্রেস তা সৃষ্টি করেছে। সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত তাঁরা, যাঁরা সবচেয়ে বেশি আশা করেছিল। যুব সমাজ। সিঙ্গুরে কারখানাও একটি ‘ফেনোমেনা’ ছিল। রাজ্যে ঘনীভূত কাজের সঙ্কটের কিছুটা সমাধানের পথ দেখিয়েছিল শিল্পের সম্ভাবনা।
তৃণমূল কংগ্রেস তাকে ভেঙেচুরে যুব সমাজকে এক প্রবল অস্থিরতায় টেনে নিয়ে গেছে। যা বিপথগামী, ভুল পথে যাওয়ার আশঙ্কাকে প্রবল করে।
তাই হয়েছে। যার ডিগ্রি জাল, তাঁকে ‘সততার প্রতিক’ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। যাঁকে আরএসএস বলেছে ‘সাক্ষাৎ দূর্গা’, তাঁকে তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার মডেল হিসাবে। তিনি বিনা দ্বিধায় বলেছেন, ‘‘শিশুদের পা চিড়ে চিড়ে তালপাটি খালে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে।’’ ‘‘মেয়েদের স্তন কেটে ফেলা হয়েছে।’’ মিডিয়া তার সবিশেষ প্রচারও করেছিল। সত্যিই কোনও শিশু নিখোঁজ কিনা, কে দেখেছে পা চিড়ে চিড়ে শিশুদের জলে ছুঁড়ে ফেলতে — কোনও প্রমাণের দরকার নেই। যুক্তির মারো গুলি। বিষ ছড়াও — এই ‘ফেনোমেনা’ রাজ্যে এনেছেন মমতা ব্যানার্জি। এই ‘ফেনোমেনা’ সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে রাজ্যের নব প্রজন্মের মধ্যে। একদিকে কাজের হাহাকার, একদিকে মন্দা। এমন পরিবেশে ‘যুব আন্দোলনের মশাল’র শিরোপা জুটতে পারে কার? অধ্যাপিকাকে জলের জগ ছুঁড়ে মারা আরাবুল ইসলামের। কলেজের অধ্যক্ষকে টেনে হিঁচড়ে মারধর করে যারা, তারা হতে পারে ‘দুষ্টু ছেলে।’ ধর্ষণ হয়ে উঠতে পারে ‘ছোট ঘটনা।’ ঘৃণার ভাষা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। আমরা তৃণমূল কংগ্রেসের নেতানেত্রীদের মুখে শুনতে থাকি ‘সিপিএম সাপের বাচ্চা’, ‘সিপিএম ডালকুত্তার দল’, ‘সিপিএম টালা পার্কের জলে বিষ মেশাতে পারে’, ‘চমকাইতলায় চমকে দেবো’ — এমন বাক্যবন্ধ। এই গড়ে ওঠা ‘ফেনোমেনা’র উপর দাঁড়িয়ে কথা বলার সুযোগ করে নিয়েছেন দিলীপ ঘোষরা।
রাজ্যের যুব সমাজকে অভ্যস্ত করে তোলার চেষ্টা হয়েছে এই ‘নৈতিকতায়’। ফিরে এসেছে পরীক্ষায় ঢালাও টোকাটুকি। চাকরির জন্য মোটা টাকা দেওয়া হয়ে উঠেছে ‘নর্মাল’। ‘তোলা’ হয়ে উঠেছে অর্থনীতির অংশ। যুব সমাজ যখন কাজের আশায় অস্থির, তখন মুখ্যমন্ত্রী অবলীলায় চপের দোকান দিতে পরামর্শ দিতে পারেন। ক্লাবের পিছনে টাকা ঢেলে স্বনির্ভরতা প্রকল্প বন্ধ করতে পারেন। নিয়োগ থমকে রাখতে পারেন। এমন পরিস্থিতি তে শুঁড়িখানা হয়ে উঠতে পারে একমাত্র শিল্প।
‘‘শিল্পের থেকে আজ শুঁড়িখানা অনেক বেশি। শিল্প মানে কেন শুধু মদের বন্যা! আর বিষমদে মৃত্যুর কান্না! কেন এসব ভাবব না আমরা!’’ উপরের তিনটি বাক্য পড়ে মনে হতে পারে আজকের পশ্চিমবঙ্গের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু তা নয়। ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের ইশ্তেহারের পাতায় এই কথাগুলি লিখেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। আজকের পশ্চিমবঙ্গের কী আশ্চর্য মিল! তাই না?
রাজ্যের মদ বিক্রী প্রচুর বেড়েছে গত সাড়ে ন’ বছরে। রাজ্য সরকার মদের দোকান বাড়িয়েছে ঢালাও। গত অক্টোবরে রাজ্য সরকার নির্দেশিকা জারি করে মদ বিক্রী আরও বাড়াতে বলেছে। ‘টার্গেট’ দেওয়া হয়েছে আবগারি অফিসারদের। শুধু অফিসারদের নয়, লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হবে খুচরো বিক্রেতাদেরও। মদ বিক্রীর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারলে মিলবে ‘উৎসাহ ভাতা। না পারলে হবে জরিমানা। এখন মদ বিক্রী করে সরকারের বছরে ১২ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি আয় হয়। আগামী আর্থিক বছরে এই লক্ষ্যমাত্রা অন্তত ২০ হাজার কোটিতে নিয়ে যেতে চাইছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। সে জন্য ২০ টাকার পাউচে মদ বিক্রীর নতুন পরিকল্পনাও ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার।
‘মদের বন্যা’ তো একেই বলে! সেই মদের স্রোত বাড়াতে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার পঞ্চায়েত এলাকাতেও মদের দোকান খোলার ফী বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালের তুলনায় প্রায় ৪০% কমিয়ে এনেছে। লক্ষ্য সোজা — যথেচ্ছ মদের দোকান খোলা হোক। মদ সহজলভ্য হোক। এই পথের ঘোরতর বিরোধী ছিল বামফ্রন্ট।
এই একই মমতা ব্যানার্জি যুবদের স্বনির্ভরতা প্রকল্প বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছেন। বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে প্রকল্পটির নাম বাংলা কর্মসংস্থান প্রকল্প(বিএসকেপি)। মমতা ব্যানার্জি নামকরণ করতে ভালোবাসেন। তিনি প্রকল্পটির নাম বদলে করলেন স্বামী বিবেকানন্দ স্বনির্ভর কর্মসংস্থান প্রকল্প(এসভিএসকেপি)। ২০০০-’০১ থেকে রাজ্যে এই প্রকল্প শুরু করে রাজ্য সরকার। নিজস্ব ব্যবসায় যুবদের উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাই ছিল প্রকল্পের উদ্দেশ্য। প্রথমে শুধু মাত্র শহর এলাকার জন্য নির্ধারিত থাকলেও, ২০০৭-’০৮ থেকে প্রকল্পটি গ্রামের যুবকদের জন্যও চালু হয়। শুধু ২০০৯-’১০-এ ওই প্রকল্পে রাজ্যে ব্যবসা শুরু করেছিলেন প্রায় ২০ হাজার যুব। তার মধ্যে সংখ্যালঘু প্রধান মালদহ এবং মুর্শিদাবাদের ছিল প্রায় ৩১০০। দশ বছরে ওই প্রকল্পে প্রায় ২লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছিল। সেই প্রকল্পের ৪০০ কোটি টাকা প্রত্যাহার করে নেয় অর্থ দপ্তর। ফলে বেকার যুবদের স্বনির্ভরতার প্রকল্পটি বন্ধ হতে চলেছে। এই প্রকল্পে সরকার ভর্তুকি দেয়। গত আর্থিক বছরের জন্য প্রকল্পের ভরতুকি খাতে বরাদ্দ প্রায় ১০০ কোটি টাকাও আটকে দিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। অথচ ক্লাবে ঢালাও টাকা ঢেলেছে তৃণমূল কংগ্রেস। ক্লাবগুলিকে টাকা দেওয়া শুরু করেছে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার। গত পাঁচ বছরে এখনও পর্যন্ত রাজ্যের ২৬ হাজার ক্লাবকে প্রায় ১০০০ কোটি টাকা দিয়েছে সরকার। কেন? মমতা ব্যানার্জির ভাষায়,‘‘মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য।’’ কিন্তু মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য যুবকদের ভরতুকির টাকা বন্ধ। প্রকল্প বন্ধ হওয়ার মুখে। যে যুবশ্রী প্রকল্পকে নিজের কৃতিত্ব জাহির করেন মমতা ব্যানার্জি, সেই প্রকল্পে বছরে গড়ে মাত্র ১১৮ কোটির ৪০লক্ষ টাকা খরচ করে তার সরকার। তাঁর সরকারই জানিয়েছে ২০১৮-১৯-র আর্থিক হিসাবে। অন্যদিকে রাজ্যে যখন আলুর কেজি ৪৫ টাকা, পেয়াঁজ ১০০ টাকা কেজি, তখন ঢালাও মদের ব্যবস্থা করতে ২০ টাকার পাউচ চালু করছে সরকার। লক্ষ্য স্পষ্ট।
রাজ্যের যুব সমাজ যখন কাজের আকাঙ্খায় অস্থির তখন মমতা ব্যানার্জি তাদের বিপথে পরিচালিত করার নানা ফন্দি বের করেছে। তাঁর সরকার পরিচালনার সিদ্ধান্তগুলি সহজেই বলে দেয় যে, রাজ্যের মূল সমস্যাগুলি সমাধানের পথের ধারেকাছে যাওয়ার উদ্যোগ তাঁর নেই। তিনি রাজ্যের দীর্ঘদিনের সংস্কৃতিকেই ধ্বংস করতে চাইছেন।
নিয়োগের ক্ষেত্রে এই সরকার চূড়ান্ত ব্যর্থ। অথচ এই প্রসঙ্গে দেদার মিথ্যা কথা বলে তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১৭-তে মাত্র ৬ হাজার গ্রুপ ডি কর্মী নেওয়ার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল। ২৭ লক্ষ আবেদন জমা দেন। ২০১৭-র ২০ মে ২৪ লক্ষ পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় বসেন। এরপর ১৯ হাজার ৪০০ জনের প্যানেল তৈরি করে বোর্ড। তার মধ্য থেকে ৫৪২২জনের নিয়োগ সম্পূর্ণ করে একটা বড় অংশকে ‘ওয়েটিং’ করে রেখে দেওয়া হয়েছে। গত তিন বছর ধরে সেই এই প্রার্থীরা ঘুরছেন। ১৪ হাজার ৩৩৯টি পদের জন্য ২০১৫ সালে নিয়োগের পরীক্ষায় বসেছিলেন আপার প্রাইমারি শিক্ষক পদের প্রার্থীরা। সেই নিয়োগ আজও হয়নি। শুধু স্কুলশিক্ষা ক্ষেত্রেই রাজ্যে প্রায় ১ লক্ষ শিক্ষক পদ বছর ফাঁকা পড়ে আছে। নিয়োগ নেই। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের শূন্যপদ প্রায় ২৫ হাজার। পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে শূন্যপদ ৭০ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। রাজ্যের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষক নিয়োগের জন্য ২০১৭ সালের ১০ অক্টোবর বিজ্ঞাপন দেয় স্কুলশিক্ষা দপ্তর। সাড়ে চার লক্ষ পরীক্ষার্থী আবেদন করে বসে আছেন। এখনও পরীক্ষাটা নিতে পারেনি সরকার।
★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★ ধারাবাহিক চলবে....
আগামী ১০ পর্বের বিষয়-
নারীদের অবস্থা মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর শাসনে
শেয়ার করুন