Site icon CPI(M)

History of CPI in Bengal: A Lost Link

সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়

নভেম্বর। শুধু একটি মাস নয়। বিপ্লবের মাস। দুনিয়া জুড়ে মেহনতী মানুষের লড়াইয়ের প্রতিনিধি এই মাস। এই মাসেই ঘটেছিল পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। গোটা পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের লড়াইয়ের ধারাই বদলে গিয়েছিল। অনেক সমস্যা ও মতবিরোধ থাকলেও এই বিপ্লব কোটি কোটি মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিল, হাজার হাজার শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুবরা বাঁচতো – মরত এই বিপ্লবের প্রেরণায়। আজও সেই প্রেরণা শেষ হয়নি।

ঔপনিবেশিক ভারতেও একই রকম ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল সমাজতন্ত্রের আদর্শ। তৈরী হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি। সে সব ঘটনা – ইতিহাস আমরা জানি। এবার কিছু অন্য কথা বলি।

আজ থেকে প্রায় বছর দশেক আগে বর্তমান নিবন্ধের লেখককে এক অনুজ কমরেড (ছাত্র যুব আন্দোলনের কর্মী; কিন্তু বিশেষ কারণে নাম টা জানাতে পারছি না) বলেন যে তিনি তাঁর দিদিমার মুখে শুনেছেন যে তাঁর মামার বাড়িতে একসময় কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ আশ্রয় নিয়েছিলেন কিছু দিনের জন্য। তখন বিষয় টা শুনে কিছুটা আনন্দ পেয়েছিলাম। কিন্তু তলিয়ে অতটা ভেবে দেখিনি।

সম্প্রতি একটি প্রসঙ্গক্রমে বিষয়টি পুনরায় মনে পড়ায় হঠাৎ মনে হলো এটা কোন সময়ে? কোন বাড়ি? কারণ ওই কমরেডের মামার বাড়ি যে এলাকায় কথিত আছে সেখানে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলন হয়েছিল, যদিও কোনও দলিল পাওয়া যায় না।

অতঃপর খোঁজ চললো। খুঁজে পেলাম। দেখলাম ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড থেকে প্রকাশিত একটি দলিল সংকলন গ্রন্থে লেখা আছে  ‘এসম্পর্কে একটি ভিন্নমতও আছে। কারো কারো মতে ১৯৩৬ সালের সেপ্টেম্বর মাে অবিভক্ত বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সম্মেলন গোপনে অনুষ্ঠিত হয় কলকাতার বেহালার বুড়োশিবতলায়। এই সম্মেলনে মণি চ্যাটার্জীর জায়গায় প্রাদেশিক কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন গোপেন চক্রবর্তী। দুঃখের কথা হল এই যে, ১৯৩৪ অথবা ১৯৩৬ যে বছরেই প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকুক না কেন কোন সম্মেলনেরই দলিল, প্রস্তাব ইত্যাদি আজ মানুষের পর্যন্ত কেউ প্রকাশ করেননি বা কোথাও আছে বলেও আমরা জানি না। এগুলি খুঁজে বের করবার সব প্রচেষ্টা এখন পর্যন্ত সফল হয়নি। এর একটি কারণ অবশ্য আছে। এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে গুরুর সময় থেকেই বাধা, ঝড়, মৃত্যু, দুর্বিপাক মাথায় নিয়ে গোপনে কাজ করতে হয়েছে, অবলম্বন করতে হয়েছে নানারকমের সতর্কতা। সেই আমলে পাড়ার পরেই সব সার্কুলার, দলিল, প্রস্তাব ইত্যাদি পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া ছিল। ফলে সে সময়ের অনেক কিছুই এখন আর পাওয়া যায় না’।

এরপরেই প্রাথমিক ভাবে যেটা মনে হয় তা হলো কমরেড মুজফফর আহমেদ কত সালে বা কোন সময়ে আশ্রয় নেন? অতঃপর সেই কমরেড কে (বর্তমানে কর্মজীবনে ব্যস্ত) প্রশ্ন করতেই তিনি উত্তর দেন সময় কাল ১৯৪৮ এর আশে পাশে। ১৯৪৮-৫১ পার্টি নিষিদ্ধ থাকাকালীন এই আশ্রয়। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে অন্তত দশ বারো বছরের পরিচয় না থাকলে সেই যুগে এমন আশ্রয় নেওয়া প্রায় অসম্ভব।

এবার একটু দেখা যাক এই বুড়োশিবতলা কোথায়? অঞ্চলটি দক্ষিণ কলকাতার বেহালা অঞ্চলের মধ্যে পড়ে। বেহালার কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীণ। এই অঞ্চলে বঙ্গভঙ্গের সময় অনুশীলন সমিতির শাখা তৈরী হয়। যুগান্তর পার্টির গুপ্ত ঘাঁটিও ছিল এখানে। ১৯৪২ সালে বেহালা থানার সামনে ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে সমর্থন করে ট্রামে আগুন লাগিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া কিছু যুবক জেলে বসে কমিউনিস্ট আদর্শের সংস্পর্শে আসেন। তবে অবিভক্ত সিপিআই এই অঞ্চলে সংগঠিত অবস্থায় আসে ১৯৫৫ সাল নাগাদ।

বিশ ও ত্রিশের দশকে এই অঞ্চলে যুগান্তর ও অনুশীলন সমিতির অস্তিত্ব তথা পরবর্তী কালে সিপিআই (এম) নেতা, বিধায়ক ও পরিবহন মন্ত্রী কমরেড রবীন মুখার্জীর ত্রিশের দশকে ভবানীপুরের গোবিন্দ ঘোষাল লেনের যুগান্তর পার্টির শাখার সঙ্গে সক্রিয় যোগ প্রমাণ করে যে অনেক আগে থেকেই বেহালা অঞ্চলে কমিউনিস্ট নেতাদের যাতায়াত ছিল।

সেই কমরেড’কে জিজ্ঞাসা করলে, তিনি সঠিক ঠিকানা’ও জানিয়েছেন। রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই ঠিকানা আমরা এখানে জানাতে পারছি না। শুধু এটুকু থাক যে বর্তমানে সাহাপুর বা পুরোনো বেহালার নিয়ম অনুযায়ী পুঞ্জসাহাপুর অর্থাৎ সাহাপুরবেহালার অন্তর্গত ঐ বাড়ি।

ফলত: সম্ভবত এই বাড়িটিতেই প্রথম প্রাদেশিক সম্মেলন হয়েছিল। প্রাদেশিক সম্মেলনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংগঠিত হওয়ার কারণেই কমরেড মুজফফর আহমেদ এই বাড়িতে আশ্রয় নেন।

আজ নভেম্বর বিপ্লবের ১০৬ বছর পূর্তিতে এই ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো। যদিও বিষয়টি সম্পূর্ণ প্রামাণ্য নয়, কারণ দলিলের অপ্রতুলতা, তবুও বিষয়টি নিয়ে গভীর অনুসন্ধান হওয়া উচিত বলেই এই নিবন্ধের অবতারণা।

তথ্যসুত্র-

১. বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলন দলিল ও প্রাসঙ্গিক তথ্য, প্রথম খণ্ড, প্রধান সম্পাদক অনিল বিশ্বাস; সম্পাদকমণ্ডলী রবীন দেব, শ্যামল সেনগুপ্ত দিলীপ ব্যানার্জী, সরল বিশ্বাস, অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী, ন্যাশনাল বুক এজেন্সী, কলকাতা।

২.বৃহত্তর বেহালা জনপদের ইতিবৃত্ত- পবিত্র অধিকারী, প্রকাশক: প্রগতি লেখক সংঘ, বেহালা শাখা ও পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ, দক্ষিণ-পশ্চিম কলকাতা আঞ্চলিক কমিটি, ২০১৪। পৃষ্ঠা – ৩৯৩-৩৯৫।

৩.পূর্বোক্ত – পৃষ্ঠা – ৩৯২

শেয়ার করুন