প্রাককথন
শারদোৎসবের সময়। কলকাতার রাজপথে জুনিয়র চিকিৎসকেরা অনশন করছেন। সিনিয়র চিকিৎসকেরাও তাদের সমর্থনে এগিয়ে আসছেন, অনশন মঞ্চে সক্রিয় উপস্থিতির পাশাপাশি ন্যায্য দাবীর লড়াইকে মজবুত করতে রীতিমত সোচ্চার হচ্ছেন। যদি শুধু এটুকুই কথা হত তবে সম্ভবত বিষয়টি ডাক্তারদের ব্যাপার-স্যাপারে পরিণত হত। তেমনটি আদৌ ঘটেনি, প্রথম থেকেই এ লড়াই গণআন্দোলনের চেহারা নিয়েছে। গোটা রাজ্য, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত এমনকি বিদেশের মাটিতেও তিলোত্তমার বিচারের দাবিতে মানুষ রাস্তায় নেমেছেন। বিচার মানে কি কেবল একজন মহিলা চিকিৎসকের নৃশংস অত্যাচার ও মৃত্যুর প্রতিবাদ? যে ব্যবস্থা, যে তন্ত্র এমন পরিবেশ তৈরি করে অথচ একের পর এক ঘটনাকে একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে, বুঝতে ও দেখাতে সমর্থ হয়েছে তাকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করানোই আজকের লড়াইতে অন্যতম প্রসঙ্গ।
ঠিক এখানেই শাসকের অস্বস্তি। যত বেশি করে এ লড়াই, এ আন্দোলন মানুষের মূল লড়াইের কাছাকাছি যাবে, মূল লড়াইয়ের সাথে সম্পৃক্ত হবে ততই সামনে চলে আসবে আসলে কারা দায়ী? কাদের দায়?
শাসকের বহু প্রচেষ্টার পরেও যা কিছু ঘটছে তাতে স্পষ্ট মানুষ কিছুতেই ব্যাপারটা ভুলে যেতে চাইছেন না। লড়াইটা কিছুতেই একজনের বিচ্ছিন্ন ঘটনায় পর্যবসিত হচ্ছে না। রাজপথের জনরোষ গণবিক্ষোভে রূপান্তরিত, এতে পর্দার আড়াল নেই। আড়াল যদি কোথাও থাকে তবে তা রয়েছে একে দেখার, দেখানোর কৌশলে। এ হল সেই পন্থা যাতে ধরে নেওয়া হয় জনসাধারণ অনেকটা মাটির তালের মতো, চাইলেই চাপ দিয়ে তার আকৃতি বদলে দেওয়া যায়। এর বিপরীতেই মানুষের লড়াই। এর প্রতিরোধই এ মুহূর্তের কর্তব্য।
একদিকে জনগণ, আরেকদিকে গণশত্রুরা।
এ লড়াই শেষ অবধি সকলের। উৎসবের আবহ মানুষকে ভাগ করেনি, তাদের একে অন্যকে পরস্পরের আরও পাশে এনে দাঁড় করিয়েছে।
সে কথাই তিন পর্বের প্রতিবেদনে প্রকাশিত হল।
আজ তৃতীয় ও শেষ পর্ব।
শ্যামাশীষ ঘোষ
ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন বিল, ২০১৯
২০১৯ সালে পাশ হল জাতীয় মেডিক্যাল কমিশন বিল, ২০১৯। স্বাধীনতার পর থেকেই দেশের মেডিক্যাল শিক্ষার ব্যাপারটা দেখছিলেন এম সি আই, অর্থাৎ মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া। এনএমসির কাজগুলি কী কী?
(১) চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান এবং চিকিৎসা পেশাদারদের নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতি নির্ধারণ, (২) স্বাস্থ্যসেবায় মানবসম্পদ এবং পরিকাঠামোর প্রয়োজনীয়তা মূল্যায়ন করা, (৩) বিলের অধীনে প্রণীত বিধিগুলির সাথে রাজ্য মেডিকেল কাউন্সিলগুলির সম্মতি নিশ্চিত করা, এবং (৪) বেসরকারী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ৫০% আসন পর্যন্ত ফি নির্ধারণের জন্য নির্দেশিকা তৈরি করা।
(১) এবং (৩) নম্বর কার্যাবলী প্রধানত নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত। সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ যেখানে শ্রেয় বলে সর্বত্র মেনে নেওয়া হচ্ছে, সেখানে এই বিল ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের পক্ষে। চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভাব-অভিযোগের চূড়ান্ত নিয়ামক এই কমিশন, এবং রাজ্যের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ কমিশনের সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য। এম সি আই নিয়ে অভিযোগ ছিল অবশ্যই, বিশেষত কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে। কিন্তু, দেশের মেডিক্যাল শিক্ষাব্যবস্থা থেকে উৎপাদিত চিকিৎসকদের জ্ঞানগম্যি বা দক্ষতার মান নিয়ে প্রশ্ন সেরকম ওঠেনি। অন্তত, দেশবিদেশের বড় বড় হাসপাতাল বা চিকিৎসাশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে এদেশ থেকে ডাক্তারবাবুরা কাজ করে এসেছেন – করছেনও। তাঁদেরকে স্বল্পশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বা অদক্ষ মনে করা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। যাই হোক, বিশেষজ্ঞরা মনে করলেন, একটি নির্বাচিত সংস্থা যেখানে এর সদস্যরা চিকিত্সকদের দ্বারা নির্বাচিত হন, অর্থাৎ, নিয়ন্ত্রক নিয়ন্ত্রিত দ্বারা নির্বাচিত হন, সেটি ঠিক নয়। অথচ, আমাদের দেশের সরকার কারা চালাবেন, তা আমরাই ভোট দিয়ে ঠিক করি। বাস্তবিকপক্ষে, এই বিল অনুসারে স্বাস্থ্যশিক্ষা তো বটেই, স্বাস্থ্যব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রেও ক্ষমতাটা মুখ্যত কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে চলে যাচ্ছে – রাজ্য সরকারের ভূমিকা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সহযোগীর। যদিও রাজ্য সরকারগুলিকেও স্বাস্থ্যপরিষেবার খাতে অনেকটাই খরচ করতে হয়। বিশেষজ্ঞরা নির্বাচনের পরিবর্তে মনোনয়ন-ভিত্তিক গঠন এবং চিকিৎসা শিক্ষা ও চিকিৎসা পদ্ধতির নিয়ন্ত্রণকে পৃথক করার সুপারিশ করেছেন মেডিক্যাল কমিশন বিলে।
(২) নম্বর কার্যাবলীতে রয়েছে স্বাস্থ্যসেবায় মানবসম্পদ এবং পরিকাঠামোর প্রয়োজনীয়তা মূল্যায়ন করা। জলের মত পরিষ্কার যে দেশের চিকিৎসাক্ষেত্রে মানবসম্পদ এবং পরিকাঠামোর অভাব রীতিমতো খারাপ। তাহলে এগুলির উন্নতির জন্য সরকারের ভাবনা কী, সেটা বোঝা দরকার। দেশে চিকিৎসকের আকাল। জানুয়ারী ২০১৮র হিসাবে, ভারতে ডাক্তার ও জনসংখ্যার অনুপাত ছিল ১: ১৬৫৫, তুলনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত মান ১: ১০০০। চিকিৎসা পেশাদারদের প্রাপ্যতার শূন্যস্থান পূরণের জন্য, বিলে এনএমসিকে আধুনিক চিকিৎসা পেশার সাথে যুক্ত কমিউনিটি স্বাস্থ্য সরবরাহকারী নামে পরিচিত কিছু মধ্য-স্তরের অনুশীলনকারীদের সীমিত লাইসেন্স দেওয়ার বিধান রয়েছে।
মোদ্দা ব্যাপারটা, অতএব, তথাকথিত আধুনিক চিকিৎসা বাদ দিয়ে চিকিৎসাবিদ্যার বাকি সব ধারা, যেমন আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথি ইত্যাদি, যাদেরকে একসঙ্গে আয়ুশ বলা হয়ে থাকে, তাঁদের অল্প কিছুদিনের জন্য ট্রেনিং দিয়ে আধুনিক চিকিৎসার চিকিৎসকে পরিণত করা হবে। যদিও বিলে সরাসরিভাবে এই ব্রিজ কোর্স চালুর কথা বলা নেই, কিন্তু পথটি খোলার ইঙ্গিত আছে নিশ্চিত। পাশাপাশি, তিন লক্ষের বেশি বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর কথা ভাবা হয়েছে, যাঁরা কিনা মুখ্যত প্রাথমিক ও নিবারণী চিকিৎসাটুকু দেবেন। অন্যান্য চিকিৎসা যদি তাঁদের করতে হয়, সেক্ষেত্রে তাঁদের থাকতে হবে মডার্ন মেডিসিনের পাশ-করা ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে। প্রস্তাবটি আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ শুনতে লাগলেও, কিছু প্রশ্ন রয়ে যায়। সরকারপ্রদত্ত ডাক্তারের সংখ্যার তথ্য মানতে গেলে, আয়ুশ ডাক্তারদের হিসেবের মধ্যেই আনা হবে না? এঁরা পড়ছেন সরকারি কলেজে, এঁরা নিযুক্ত হচ্ছেন সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় – কিন্তু, সরকার যখন ডাক্তারের সংখ্যা গুনবেন, আয়ুশ চিকিৎসকরা সেইখানে হিসেবে আসবেন না? এ কেমন দ্বিচারিতা! প্রশ্ন একটাই, সরকার স্বয়ং যখন আয়ুশ ব্যবস্থার উপর ভরসা রাখছেন না, এবং যেনতেনপ্রকারেণ এঁদের দিয়ে মডার্ন মেডিসিন প্র্যাক্টিস করাতে চাইছেন, তাহলে সরকার সরাসরি এইসব চিকিৎসাপদ্ধতি, বিশেষত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি তুলে দিয়ে সেই অর্থ আধুনিক চিকিৎসার কলেজ তৈরির পিছনে ঢালছেন না কেন? ব্রিজ কোর্সের প্রস্তাব বা সরকারি খতিয়ানে আয়ুশ চিকিৎসকদের অনুল্লেখ বা দায়সারা উল্লেখ যে এই চিকিৎসাপদ্ধতির প্রতি নিদারুণ অপমান!
চিকিৎসা বলতে শুধুই যদি পশ্চিমি চিকিৎসাই বুঝি, তাহলে দেশের সব নাগরিকের কাছে চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছানোর কাজটি দুরূহ হয়ে যাবে। মোটামুটি এই ধরণের ভাবনাক্রম অনুসরণ করেই দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় ঠাঁই পেয়েছিল ঐতিহ্যগত চিকিৎসা পদ্ধতিগুলি। এদের চিকিৎসার পাঠ, এমনকি চিকিৎসার দর্শন সবকিছুই আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র, চালু ভাষায় যাকে অনেকে অ্যালোপ্যাথি বলে থাকেন, তার থেকে অনেকখানিই আলাদা। সরকার এঁদেরকে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ঠাঁই দিলেও এইসব চিকিৎসাপদ্ধতি বা গবেষণায় অর্থ বিনিয়োগ করেননি। কাজেই, এইসব চিকিৎসাপদ্ধতির অনেকগুলোই বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। এখন এঁদের কয়েক মাসের ট্রেনিং দিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক চিকিৎসাভাবনায় অভ্যস্ত করে ফেলার ভাবনাটি হাস্যকর ও বিপজ্জনক।
বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ এমনিতেই কম, খুবই কম – সাম্প্রতিক হিসাব দেশের জিডিপির ১.৯%, উন্নত দেশে যার পরিমাণ চার কি পাঁচ শতাংশ – এই কম বরাদ্দে এত বিপুল অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা প্রায় অসম্ভব। সেইখানে, টিমটিম করে চলা প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে শুধুমাত্র স্বাস্থ্যকর্মীর হাতে সঁপে দিলে আগামীদিনে ভালো কিছুর আশা কম। দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যের হাল শোচনীয়। বিভিন্ন স্বাস্থ্যসূচকে আশপাশের বিভিন্ন দেশের তুলনায় আমরা পিছিয়েই চলেছি। বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর কোনো কথা শোনা যাচ্ছে না। যেটুকু বরাদ্দ হচ্ছে, তার সিংহভাগই যাচ্ছে হাই-টেক হেলথকেয়ারের পিছনে। দেশের হেলথকেয়ার পুরোপুরিই ইলনেস-কেয়ার। অর্থাৎ, মুখে স্বাস্থ্য শব্দটি বলা হলেও, প্রায় পুরো ফোকাসটাই চিকিৎসার পেছনে। মানুষ ঠিক কোনপথে সুস্থ ও নিরোগ থাকতে পারেন, সেই নিয়ে চিন্তা না করে খরচ ও মনোযোগের বেশির ভাগটাই বরাদ্দ হয় অসুস্থ মানুষের চিকিৎসার পেছনে। এর ফলে মানুষ অসুস্থ হন বেশি, খরচ হয় আকাশছোঁয়া। এই এন এম সি বিলের কিছুদিন আগেকার নয়া জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে যেভাবে ঢালাও বেসরকারিকরণের কথা বলা হয়েছে, তাতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকে লাটে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে, এমন আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ আছে। স্বাস্থ্যখাতে এই ছিটেফোঁটা বরাদ্দের থেকে নজর ঘোরাতে, বারবার ডাক্তারের আকালের কথাই সরকার তুলে ধরে। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিকাঠামোগত শোচনীয় অবস্থার কথা আড়ালে থেকে যায়। সরকারি হাসপাতালে কোনও মুমূর্ষু রোগির জন্য আইসিইউ বেড না-দিতে পারার কারণে রোগীর মৃত্যু হলে মার খান ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা।
দেশে ডাক্তারের অভাব কতখানি, সেইটা তর্কযোগ্য হলেও, গ্রামাঞ্চলে বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডাক্তারের অভাব নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ নেই। কিন্তু, সেইসব অঞ্চলে স্বাস্থ্য-পরিকাঠামোর হাল? ডাক্তাররাই বা কেন গ্রাম-মফস্বলে যেতে চাইছেন না? সেই রহস্য খুঁড়ে দেখা হয়েছে কি? অন্তত চেষ্টা করা হয়েছে? ডাক্তারের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মীদের অবস্থা কী? দেশে ডাক্তারের অভাবের থেকেও অনেক বেশি করে নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব। অথচ নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মীরা সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে আগ্রহী হলেও, সরকার বিগত এক দশকে ঠিক কেমন সংখ্যায় তাঁদের নিয়োগ করেছেন? সরকার প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ান বা নার্সদের চাকরিতে নিয়োগ করছেন না – কিন্তু, স্বাস্থ্যকর্মীদের নতুন করে ট্রেনিং দিয়ে ডাক্তারি করিয়ে গ্রামীণ স্বাস্থ্যব্যবস্থা মজবুত করবেন?
এখান থেকেই আমরা কমিশনের (৪) নম্বর কার্যাবলীর দিকে তাকালে বুঝতে পারব, চিকিৎসা-শিক্ষার বেসরকারিকরণের ইঙ্গিতটি নিয়ে। ডা. দেবী শেঠী প্রমুখ বহুদিন ধরেই বলে আসছেন যে, আমাদের দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার বেহাল দশার অন্যতম কারণ নাকি আমাদের মেডিক্যাল শিক্ষা। এবং, উন্নতির জন্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে উৎসাহদান সরকারের অবশ্যপালনীয় দায়। তথাকথিত বিশ্বমানের চিকিৎসা-শিক্ষার হাত ধরে আপনা-আপনিই আমাদের স্বাস্থ্য পৌঁছে যাবে বিশ্বমানে, এই তাঁদের আশা। সব চক্ষুলজ্জা কাটিয়ে সরকার এইবার খোলাখুলি পথে নেমেছেন। প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ খোলার ব্যাপারে ঢালাও উৎসাহ দেওয়া হয়েছে – মাত্র একবার খতিয়ে দেখার পরেই বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের ছাড়পত্র মিলবে। পরিকাঠামো ঠিকঠাক আছে কি না, বারবার খুঁটিয়ে যাচাই করা হবে না। কলেজ চালু হওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই কর্তৃপক্ষ সিট বাড়াতে পারবেন, খুলতে পারবেন নতুন পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট কোর্স – নতুন করে পরিদর্শন বা ছাড়পত্র লাগবে না। আসনসংখ্যার পঞ্চাশ শতাংশের ফিজ বেঁধে দেবেন কমিশন, বাকি পঞ্চাশ শতাংশের ক্ষেত্রে মালিক-কর্তৃপক্ষ যথেচ্ছ অর্থমূল্য ধার্য করতে পারেন।
প্রায় একই ধরণের আপাতনিরীহ কিছু প্রস্তাবনার মাধ্যমেই খুলেছিল শিক্ষার বেসরকারিকরণের পথ। তার সম্পূর্ণ সামাজিক অভিঘাত অনেকখানিই টের পাচ্ছি আমরা – আরও অনুভূত হবে আগামী প্রজন্মে। পাশাপাশি, স্পষ্টতই দেখা যায় সরকারি স্কুলের বেহাল দশা। এখানেও সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার গঙ্গাযাত্রা নিশ্চিত করা হচ্ছে বেসরকারি পুঁজির মুনাফার স্বার্থে।
অনুমান করা কঠিন নয়, স্বাস্থ্যশিক্ষার বেসরকারিকরণের অভিঘাত হবে আরও অনেক বেশি গভীর। এনএমসি অ্যামেন্ডমেন্ট বিল ২০২২ এ প্রস্তাবিত হয়েছে এই পরীক্ষা পরিচালনার জন্য একটি স্বশাসিত Board of Examinations in Medical Sciences এর। কমন এনট্রান্স টেস্টকে কেন্দ্র করে কোচিং ব্যবসায়ে মুনাফা এবং পরীক্ষায় সফলতা নিশ্চিত করতে টাকার খেলার স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে খুব সম্প্রতি। প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজের ঢালাও লাইসেন্স – অর্ধেক আসনে কত টাকা নেওয়া হবে, তাতে সরকার মাথা ঘামাবে না। সেইসব মেডিক্যাল কলেজ থেকে লাখ লাখ বা প্রায় কোটি টাকার বিনিময়ে ডিগ্রী পাবেন যারা, তাঁরা আমজনতাকে স্বাস্থ্যপরিষেবা দেবেন ন্যায্যমূল্যে, বিশ্বাস করতে হবে? তাঁদের কোটি টাকার শিক্ষার দাম তাঁরা উশুল করবেন না? স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দুর্নীতি বিষয়ে সরব হওয়ার সময়, তাঁদের দোষারোপ করতে হলে, এই প্রশ্নও করুন, ডাক্তারি শিক্ষায় এমন ‘ফেল কড়ি মাখো তেল’ ব্যবস্থাটি রেখেছেন কারা এবং কাদের স্বার্থে। অথচ, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দুর্নীতি বিষয়ে কথা বলতে গেলে, এসব নিয়ে ভাবার লোকই পাওয়া যায় না।
দেশের নাগরিকের স্বাস্থ্যের দায় কে নেবে? সরকার, নাকি কর্পোরেট মুনাফাভোগীর দল? চিকিৎসা যদি পণ্যই হয়, মনে রাখুন, তা এক অত্যাবশ্যক পণ্য – আপনার ক্রয়ক্ষমতা অনুসারে বেছে নেওয়া রেস্টুরেন্টের খাবার বা হোটেলের স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে তুলনীয় বিলাসিতার সামগ্রী নয়। এই মুনাফার চক্করে স্বাস্থ্যচিকিৎসা সাধারণ মানুষ তো বটেই, চলে যাচ্ছে মধ্যবিত্তের হাতের নাগালের বাইরে। মানুষের মধ্যে বেড়েই চলেছে ক্ষোভ – দিকে দিকে চিকিৎসকরা আক্রান্ত হচ্ছেন, নিগৃহীত হচ্ছেন। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ভেবেছেন, চিকিৎসকরা যে প্রতিবাদ করছেন, তা অবশ্যই তাঁদের নিতান্ত পেশাগত স্বার্থের দিকে তাকিয়ে। এখন আমাদের ভাবার সময় এসেছে, চিকিৎসকদের স্বার্থের থেকে আমাদের স্বার্থটি কি খুব পৃথক?
বিচ্ছিন্নভাবে এই বিল পড়ে দেখলে স্বরূপটি উদ্ঘাটিত হওয়া মুশকিল – সরকারের বাকি প্রকল্প, উদার অর্থনীতির বাকি সব অ্যাজেন্ডা, নতুন জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি, এই সবকিছুর বৃহত্তর প্রেক্ষিতে বিল-টিকে দেখা জরুরি। নব্য উদারবাদী নতুন জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির প্রেক্ষিত যেমন, ঠিক তেমনই কিছুদিন আগেই ঘটা মেডিক্যাল কারিকুলামের বদল, থুড়ি, আধুনিকীকরণের কথাটুকুও মাথায় রাখা জরুরি এই বিলের মূলসুরটি উপলব্ধি করতে হলে। এদেশে চিকিৎসাশিক্ষার কারিকুলাম ঐতিহাসিকভাবেই উচ্চবর্গের মানুষজনের চিকিৎসার প্রয়োজন মেটানোর উপযুক্ত। এরই মাঝে কিছু সমাজমনস্ক ভাবনার ঠেলায় কারিকুলামটি হোলিস্টিক চিন্তাভাবনার অনুসারী হতে পেরেছিল – শুধুই কিছুটা। এই শিক্ষাব্যবস্থায়, এমনকি সমাজের প্রান্তিক অবস্থান থেকে এসে, সরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করেও একজন ছাত্র ডাক্তার হয়ে কর্পোরেট হাসপাতালে উচ্চবিত্তের স্বাস্থ্যসমস্যা শুনে মহার্ঘ্য নিদান যোগাতে যতখানি স্বচ্ছন্দ, ততখানি নন গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্যসমস্যার সমাধানে। যেটুকু পিছুটান ছিল, কাটানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কিছুদিন আগেই, মেডিক্যাল শিক্ষাকে যুগোপযোগী ও আধুনিক করার নামে সিলেবাসে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বদল এনে। কাজেই ভবিষ্যতের আধুনিক এবং ‘অ্যাট-পার-উইথ-ওয়ার্ল্ড’ কারিকুলাম, প্রায় নির্লজ্জভাবেই, কর্পোরেট হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে আসেন যাঁরা, সেইসব মানুষের স্বাস্থ্যসমস্যার সমাধান করার কথা ভেবে এবং হাইটেক পরিকাঠামোয় পরিষেবা যোগানোর লক্ষ্যে সৃষ্ট।
গত ৫০ বছরে স্বাস্থ্যে অসাধারণ অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ব। শিশুমৃত্যুর হার অনেকটাই কমেছে, মানুষ বেশি দিন বাঁচছে, ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে আয়ুর ব্যবধান কমে এসেছে। তবে, চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বাণিজ্যের বিশ্বায়নের হার, ভ্রমণ এবং অভিবাসন, টেকনোলজি, যোগাযোগ ও বিপণন গত দুই দশকে ত্বরান্বিত হয়েছে। ফলস্বরূপ কিছু গোষ্ঠীর জন্য লাভ এবং অন্যদের জন্য প্রান্তিককরণ। স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্য এর পরিণতি হবে গভীর। ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’-র আহ্বান ছিল এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করার, যেখানে সকল মানুষের জন্য স্বাস্থ্য একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসাবে, সুস্বাস্থ্যের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছানোর এবং বজায় রাখার সুযোগ হিসাবে থাকে – সর্বজনীনভাবে এবং তাদের সারা জীবন জুড়ে। ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’-র ডাক বাস্তবে সামাজিক ন্যায়বিচারের আহ্বান। এই ভাবনাটা মাথায় রাখার, এ অধিকার অর্জন এবং সুরক্ষিত রাখায় দায় আমাদেরই।