Greece Unrest Cover

অগ্নিগর্ভ গ্রিস: বর্তমান পরিস্থিতি

রবিকর গুপ্ত

এথেন্স আর থেসালোনিকির রাস্তায় জনপ্লাবন, দেশের সর্বত্র পুলিশ আর জনতার মধ্যে সংঘাত, গণ-ধর্মঘটে স্তব্ধ দেশ। শেষ কবে এমন চিত্র দেখেছিল গ্রিস ? উত্তর হল, এক দশক আগে, ২০১০-১২ সালে। তখন অর্থনৈতিক মন্দা, আইএমএফ-এর ঋণের জাল, দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি নিয়ে মানুষের প্রবল ক্ষোভে ভেসে গেছিল গ্রিসের চিরাচরিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা। সেই প্রবল বিক্ষোভ, যার তীব্রতা অভ্যুত্থানের নিছক এক ধাপ নিচে ছিল, আপাত ভাবে ভেঙে চুরমার করে দেয় গ্রিসের জাতীয় রাজনৈতিক সমীকরণ। দক্ষিণপন্থী নিউ ডেমোক্রেসি আর মধ্য-বাম প্যানহেলেনিক সোশ্যালিস্ট মুভমেন্ট – প্রধান দুই দলকেই নির্বাসনে পাঠিয়ে নির্বাচনে মানুষ সুযোগ দিয়েছিলেন পশ্চিমা বামপন্থী সিরিজা দলকে। অনেক আশা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তরুণ বাম নেতা অ্যালেক্সেই সিপ্রাস। সেই আন্দোলনের পুরোভাগে থাকা গ্রিসের কমিউনিস্ট পার্টিও সংসদে তার শক্তি বৃদ্ধি করেছিল, কিন্তু সরকারে যাওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যোগদান করেনি। তাঁদের বক্তব্য ছিল গ্রিসের মূল কাঠামোগত সমস্যাগুলির সমাধান সিরিজা যেভাবে চাইছে, সেইভাবে সমাধান সম্ভব নয়। গ্রিসের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে এই ‘সংকীর্ণ’ অবস্থানের সেই সময়ে তাঁদের সমালোচনাও শুনতে হয়েছিল অনেক।

কিন্তু ইতিহাস তাঁদের সঠিক প্রমাণ করেছে। ছয় বছর শাসনের পর সিরিজা গ্রিসের কাঠামোগত সমস্যাগুলোর অধিকাংশই সমাধান করতে পারেনি। সিপ্রাস শেষ পর্যন্ত আইএমএফ-এর কাছে ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কর্তাদের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছেন। হতাশ হয়ে সিরিজা ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন য়ানিস ভারুফাকিস-এর মত নেতারা। এই ব্যর্থতায় ভর করে প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখ থেকে আবার মসনদে ফেরত এসেছে গ্রিস ও তার জনতাকে সংকটে ফেলার মূল কারিগর কারিগর নিউ ডেমোক্রেসি। আবার শক্তিসঞ্চয় করার সুযোগ পেয়েছে উগ্র দক্ষিণপন্থীরা। অন্যদিকে সিরিজার ভোটদাতাদেরও একটি বড় অংশ হতাশ হয়ে আবার সমর্থন করতে শুরু করেছেন মধ্য-বাম প্যানহেলেনিক সোশ্যালিস্ট মুভমেন্টকে। এমন পরিস্থিতি অনেকেরই মনে হয়েছিল ২০১০-১২-এর উত্তাল দিনগুলি যেন ব্যর্থ ছিল। কোনও ছাপ-ই যেন তা রেখে যেতে পারেনি। ঐতিহাসিক সুযোগ যেন হাতছাড়া হয়েছে চিরকালের মত। কিন্তু ‘আবার পূর্ববত অবস্থা চলিবেক’ লেখা নোটিসবোর্ডকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল দুই বছর আগের একটি মর্মান্তিক রেল দুর্ঘটনা।

গ্রিস একটি পাহাড়ময় দেশ, খুব অল্প অংশই সমতলভূমি। তাই এখানে সড়কপথই যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। মূল রেলপথ একটি-ই, সংযোগ রক্ষা করে রাজধানী এথেন্স ও দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর থেসালোনিকির মধ্যে। দীর্ঘদিন ধরে সরকারী বিনিয়োগের অভাব আর প্রশিক্ষিত কর্মীর অভাবে ধুঁকছিল গ্রিক রেলব্যবস্থা। ‘বে-সরকারি করলে পরিষেবা ভালো হবে’ – এই নয়া উদারনৈতিক যুক্তির ধ্বজা তুলে ২০১৭ সালে রেলব্যবস্থার অনেকটাই বে-সরকারীকরণ করা হয়। এই লাইনের রেল পরিবহনের দায়িত্বের একটি বড় অংশ প্রদান করা হয় ‘হেলেনিক ট্রেন’ নামক বেসরকারি একটি সংস্থার উপর। এছাড়া যাত্রী পরিবহণকে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে বিভিন্ন সংস্থার মুনাফা বাড়াতে মালগাড়ি পরিবহনকেই অগ্রাধিকার প্রদান করে সরকার। নিয়ম-নীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যথাযথ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না নিয়েই পরিবহন করা শুরু হয় নানা বিপদজনক রাসায়নিক ও কাঁচামালের।

এর পরিণতি যে নেতিবাচক হতে পারে, তা নিয়ে দীর্ঘদিন অল ওয়ার্কার্স মিলিট্যান্ট ফ্রন্ট-এর মত ট্রেড ইউনিয়নগুলি সতর্ক করে আসছিল। মূল ধারার মধ্য-বাম ও দক্ষিণপন্থী দলগুলি তাতে কর্ণপাত করেনি। বামপন্থী সিরিজা-ও সরকারে থাকাকালীন এই প্রক্রিয়া ঠেকানোর খুব একটা প্রচেষ্টা করেনি। এরই প্রত্যক্ষ ফল ছিল এই দুর্ঘটনা। ২০২৩ সালের ২৮-শে ফেব্রুয়ারি এথেন্স থেকে থেসালোনিকি যাওয়ার পথে লারিসার কাছে ‘হেলেনিক ট্রেন’ দ্বারা পরিচালিত একটি বেসরকারি যাত্রীবাহী ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় একটি মালগাড়ির। এই ঘটনায় মৃত্যু হয় ৫৭ জনের, আহত হন ৮৫ জন। দক্ষিণপন্থী নিউ ডেমোক্রেসি সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস্‌ মিতসোতাকিস্‌ সচেষ্ট হয় এই দুর্ঘটনার তদন্তকে যথাসম্ভব ধামাচাপা দিতে। প্রবল গণ-আন্দোলন এই প্রচেষ্টাকে সম্পূর্ণ সফল হতে দেয়নি। ত্রুটিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ হলেও প্রাথমিক তদন্তের প্রতিবেদনে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে মুনাফার লোভে রেলব্যবস্থাকে একেবারে পঙ্গু করে দেওয়ার পরিণতি এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা। যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকা রেলকর্মী বারংবার ভুল করেছিলেন, ‘হেলেনিক ট্রেন’ টাকা সাশ্রয় করতে যাত্রী সুরক্ষার জন্য যে সব পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তা নেয়নি, সরকারি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ত্রুটি ছিল রেল পরিকাঠামোতেও। চাপা দেওয়ার চেষ্টা সত্ত্বেও এই তথ্য উঠে আসে যে মালগাড়িটি সম্ভবতঃ বেআইনি দাহ্য কোনো পদার্থ বহন করছিল, যে কারণে দুর্ঘটনা এত প্রাণঘাতী হয়।

এই তথ্যগুলি ক্রমে ক্রমে যত প্রকাশ্যে আসে, রেল দুর্ঘটনার প্রতিকার সংক্রান্ত আন্দোলন রূপ নেয় সামগ্রিক নব্য-উদারনৈতিক আর্থ-রাজনৈতিক কাঠামো বিরোধী আন্দোলনে। উত্তপ্ত ক্ষোভ আছড়ে পড়ে শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। ক্রমশঃ চড়তে থাকে বিক্ষোভ, আন্দোলনের পারদ। এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে, দুর্ঘটনার দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে আন্দোলন এক নতুন মাত্রা নেয়। ২৭-শে ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, নাগরিক সমিতি এবং কমিউনিস্ট পার্টি জাতীয় সংসদ ঘেরাও করে স্লোগান দেয় ‘হয় ওদের মুনাফা নয়তো আমাদের জীবন’ ! ২৮-শে ফেব্রুয়ারি আহ্বান করা হয় সাধারণ ধর্মঘটের যা প্রায় দু’শোটি শহরে সফল ভাবে পালিত হয়। বৃহৎ পুঁজির সমর্থনে সরকার এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কর্তৃক গৃহীত যে নীতিগুলি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গণ-পরিবহনের ক্ষেত্রে মুনাফার যূপকাষ্ঠে নাগরিক স্বার্থ ও সুরক্ষাকে বলি দিচ্ছে তা সব প্রত্যাহার করতে হবে – এই ছিল জনতার মূল দাবি। ‘পুঁজিবাদীদের মুনাফা উসুল জনগণের চাহিদার শ্বাসরোধ করছে। নিঃশ্বাস নিতে হলে আমাদের এই ব্যবস্থাকে ছুঁড়ে ফেলতে হবে।’ আর ‘হয় ওদের মুনাফা, নয় আমাদের জীবন’-এর মত স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ডে মোড়া গলিত লাভার মত জনস্রোত ঢেকে দেয় এথেন্স আর থেসালোনিকির রাজপথ। যাঁরা ভেবেছিলেন ২০১০-১২-এর গণ আন্দোলনের দিন অতীত হয়েছে, তাঁরা কাঁপতে থাকেন আতঙ্কে।

আগের বার গ্রিসের কমিউনিস্ট পার্টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিলেও আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি তাঁরা ছিলেন না। এইবার তাঁরাই মূলতঃ এই গণ-আন্দোলনের প্রধান সংগঠিত শক্তি। কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক দিমিত্রিস কুতুম্পাসকে দেখা গেছে আন্দোলনের অগ্রভাগে - কৃষকদের ব্যারিকেড থেকে নাগরিক মিছিলে। সুতরাং আবারও যদি ২০১০-১২-এর পুনরাবৃত্তি হয়, তবে সিরিজার মত পশ্চিমা বামপন্থীরা নয়, সামগ্রিক ভাবে শক্তি বৃদ্ধি হবে আপোষহীন ভাবে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী গ্রিসের কমিউনিস্ট পার্টির-ই। এ গ্রিস তথা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের শাসকগোষ্ঠীর জন্য অবশ্যই শুভ সংবাদ নয়। সংসদে সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলিতে যখন গ্রিসের পশ্চিমা বামপন্থীদের শক্তি হ্রাস হয়েছে, গ্রিসের কমিউনিস্ট পার্টি তার শক্তি বৃদ্ধি করেছে। ২০২৪ সালের ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের নির্বাচনে তাঁদের প্রাপ্ত ভোট দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু সংসদীয় রাজনীতির এই সাফল্যে সংসদ বহির্ভূত রাজনীতিকেও তাঁরা ভোলেননি, একটি যে অপরটির পরিপূরক তা স্মরণে রেখেছেন। তাই চলমান নাগরিক আন্দোলনের সুতীক্ষ্ণ বর্শা ফলক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার কমিউনিস্ট পার্টির ঐতিহাসিক দায়িত্ব তাঁরা গ্রহণ করেছেন স্বচ্ছন্দে। এখনও অবধি সেই দায়িত্ব পালনে উত্তীর্ণও হয়েছেন সসম্মানে। সেই কারণেই আবারও জনরোষে চূর্ণ হওয়ার মুখোমুখি গ্রিসের রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা, মন্থনে জন্ম নিচ্ছে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন