গঙ্গা-যমুনা তাহজিব ও গান্ধী হত্যা

ডঃ নুরুল ইসলাম

গঙ্গা-যমুনা তাহজিব বা মহা মিলনের সংস্কৃতি ভারতবর্ষের বহু প্রাচীন ঐতিহ্য। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য ভাবনাই ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। বিভিন্ন ধর্ম বর্ণের ভাষার সংস্কৃতির মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষে বাস করে আসছে শান্তিপূর্ণভাবে।কবির ভাষায়, " নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান। " ভারতের সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ব্রিটিশ আমলে, বিশেষত ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর। সাম্রাজ্যবাদী শোষক ইংরেজ বুঝতে পারে যে সোনার ভারতকে লুণ্ঠন করতে হলে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে রাখতে হবে। তাই ব্রিটিশ সরকার শাসন কৌশল পরিবর্তন করে নানা ভাবে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিরোধ বাধিয়ে দিতে শুরু করে।

শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের নেতৃত্বে নানা ফড়নাবিশ, ঝাঁসি রানী লক্ষ্মীবাঈ, তাঁতিয়া টোপি, বাজী রাও প্রমুখ সামন্ত প্রভুরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জীবনপণ লড়াই করেন। সেই সময় হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বা শত্রু ভাব থাকলে মহাবিদ্রোহ এতখানি বিস্তার লাভ করত না। মহা বিদ্রোহ দমনের পর হিন্দু মুসলমানের এই সম্প্রীতি ভাব দেখে ব্রিটিশরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। ভারত বাসীরা যাতে কখনো এইভাবে হিন্দু-মুসলমান মিলিত হয়ে কোন প্রতিরোধ করতে না পারে তার জন্য নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা লীলা চালান l জানা যায় অযোধ্যার রামগড়ি মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ও পার্শ্ববর্তী বড় মসজিদের ইমামকে একই সঙ্গে গাছের এক ডালে ঝুলিয়ে হত্যা করেন এবং বেশ কয়েকদিন এই মৃতদেহ সৎকার করতে দেওয়া হয়নি। শেষে তারাই ইমাম সাহেবকে শ্মশানে দাহ করেন এবং পুরোহিত মশাইকে কবরে সমাধিস্থ করে।

২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে ৫০০ বছরের মুসলিম শাসনের মৌলিক চরিত্রগত পার্থক্য ছিল।

মুসলিম শাসকরা বহিরাগত হলেও পরবর্তীকালে তারা বংশ পরম্পরায় এই দেশের মাটি সমাজ সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। এদেশ থেকে তারা সামান্য সম্পদ লুণ্ঠন করে অন্য কোন দেশে নিয়ে যাননি বাহাদুর শাহ জাফর ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কাছে পরাস্ত হলে রাশিয়ার কাজাকিস্তানে আশ্রয় নেন। মৃত্যুকালে তিনি তার ইচ্ছের কথা জানান, তার দেহ যেন হিন্দুস্থানের মাটিতে সমাধিস্থ করা হয় । একান্ত সম্ভব না হলে সেখান থেকে এক মুঠো মাটি এনে যেন তার কবরের উপর ছড়িয়ে দেওয়া হয় না হলে তার আত্মা শান্তি পাবে না। ভারত ছাড়া অন্য কোন দেশ তাদের কাছে প্রিয়ভূমি ছিল না। মন্দির মসজিদ ভাঙার যে সমস্ত ঘটনাগুলি ঘটেছে তা অধিকাংশ শাসকই সেখানকার লুকিয়ে রাখা গচ্ছিত সম্পদ দখল করার উদ্দেশ্যে এই কাজ করে। ঔরঙজেব সোমনাথ মন্দির আক্রমণের পাশাপাশি গোলকুন্ডা মসজিদও ভাঙেন এই উদ্দেশ্যে।কিন্তু ব্রিটিশরা তাদের ২০০ বছরের শাসনে লক্ষ লক্ষ কোটি ডলার পাউন্ড তাদের দেশে নিয়ে চলে যান। রেল মেল জেল ইত্যাদি সবকিছু হয়েছিল দ্রুতগতিতে ভারতের সম্পদ তাদের নিজেদের দেশে নিয়ে যাওয়ার তাগিদে এবং বিদ্রোহ দমন করতে। হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদক হরিশ মুখার্জির বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, একজন নীলকর সাহেব মাত্র কয়েক বছর নীল উৎপাদনের মাধ্যমে কয়েকটি জাহাজ ভর্তি নানান ভারতীয় মূল্যবান সামগ্রী স্বদেশে নিয়ে যেতেন।

জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী আমাদের মহান ভারত বর্ষকে চারটি মূল্যবান উপহার দিয়ে গেছেন তাহলো ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান, সামাজিক ন্যায়,যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং আর্থিক আত্মনির্ভরতা ।তিনি সাম্প্রদায়িক বিবাদ , বর্ণ ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, নারী নির্যাতন নিগ্রহের বিরুদ্ধে তিনি আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন।

১৯৪০ সালে ২৭ শে জানুয়ারি হরিজন পত্রিকায় তিনি লেখেন, "আমার বিশ্বাস অটুট যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছাড়া অহিংসার মাধ্যমে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করা যায় না। সম্প্রদায়ের মধ্যে ন্যায় বিচার ছাড়া ঐক্যে পৌঁছানো যায় না। "

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সংহতি মহাত্মা গান্ধীর শৈশবকাল থেকে তার জীবন ও কাজের মধ্যে সংজ্ঞায়িত ছিল। তিনি সাম্প্রদায়িক ঐক্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেন এবং ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতির বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য ধারণাকে লালন করে বলেন, "আমি চাইনা ভারত সম্পূর্ণরূপে হিন্দু,পবিত্র ঐসলামিক এবং সম্পূর্ণ খৃষ্টান হোক,তবে তার সমস্ত ধর্ম সহাবস্থান ও সমৃদ্ধিসহ সম্পূর্ণ সহনশীল হোক।"

গান্ধীজীর সত্যাগ্রহের ধারণা তৈরি বিকাশ ও প্রয়োগ হয় দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে, লিও টলস্টয়ের প্রভাবও ছিল বলে অনেক গবেষক মনে করেন।তার অহিংস সংগ্রামের পদ্ধতিটি বিভিন্ন ধর্মের ঐতিহ্যের মধ্যে নিহিত ছিল।তিনি তার বিভিন্ন বক্তৃতায় তার দৃষ্টান্ত দেন হিন্দু পুরাণের ভক্ত প্রহ্লাদের কাহিনী থেকে,গ্রীক ইতিহাস থেকে, সক্রেটিস, খৃষ্ট ধর্মের প্রচারক যীশুখ্রীষ্ট,ইসলামের ইমাম হোসেন ও ইতিহাসের মীরাবাঈয়ের জীবন থেকে।তাঁরা প্রত্যেকেই তাদের নিপীড়কদের বিরুদ্ধে শাস্তি বিধান কামনা করেননি।ক্ষমাশীল যীশু বলেন প্রভু ওদের ক্ষমা করো ওরা জানে না ওরা কি ভুল করছে। তাঁকেও যখন নাথুরাম গডসে গুলি চালিয়ে হত্যা করে তখনও তিনি বলেন, "হে রাম"। হরিনাম জপ করা বন্ধ করার জন্য ভক্ত প্রহ্লাদ হরির কাছে তার বাবার শাস্তি বিধানস্বরূপ কোন অসুস্থ ইচ্ছা প্রকাশ করেন নি। সক্রেটিস রাজার আদেশে বিষ পান করে বুঝিয়ে দেন যে তিনি সত্যে অবিচল থাকতে মৃত্যুকেও ভয় পান না, ইমাম হোসেন পরম সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য শাহাদাত বা শহীদের মৃত্যুবরণ করেন। মীরাবাঈ ভগবান কৃষ্ণের প্রতি ভক্তির জন্য স্বামী শ্বশুরবাড়ির দ্বারা নির্যাতিত হন, এমনকি বাড়ি থেকে বিতাড়িত হন, তবুও তিনি কারো বিরুদ্ধে কোনো রূপ আক্রোশ বা বিদ্বেষ পোষণ করেননি। বিভিন্ন ধর্মীয় ঐতিহ্য থেকে সত্যাগ্রহের আবশ্যক পাঠ শেখার ক্ষেত্রে তার দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার এক ইতিবাচক প্রয়াস।তিনি হিন্দু মুসলিমের মধ্যে শুধু রাজনৈতিক ঐক্য নয়,হৃদয়ের ঐক্য চেয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের হৃদয়ের ঐক্য। হিন্দু পানি,মুসলিম পানি এবং হিন্দু মুসলিম চায়ের বিভেদ দূর করে আজাদ হিন্দ বাহিনীর মতো সবার মধ্যে হৃদয়ের ঐক্য সম্প্রীতি সৌহার্দ্য গড়ে তুলতে চান।

মহাত্মা গান্ধীজীর সবরমতী আশ্রমে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে তার বন্ধু আব্দুল্লাহর পুত্র এসেছিলেন। বাপুজী বলে সম্বোধন করে তাকে পায়ে প্রণাম করেন,তখন গান্ধীজি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঈদ মোবারক জানান।কারণ সেই দিন ছিল ঈদুল ফিতরের দিন। গান্ধীজি তার মুসলিম বাবুর্চিকে বাইরে থেকে মাংস শিমুই পরোটার আয়োজন করতে বললে সেই বন্ধুর পুত্র মাংস খেতে চাননি, কোনোরকম আমিষ খাবার খাবেন না বলে জানান। এরই নাম হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা পারস্পরিক সম্মান শ্রদ্ধাবোধ।

১৯৪৭ সালের ২ নভেম্বর নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবন্ধে তিনি আশঙ্কা করেন, অন্ধ মৌলবাদী বিশ্বাসের ফলে মুঘল যুগের অনেক কিছু ইতিহাস বই থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। বর্তমানে সেই বিপদ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ভারত ভাবনা, সংবিধান,গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, সবকিছুই কলুষিত হচ্ছে।

বাপুজী সম্পর্কে বলা হয়, "Gandhiji was born in India, but Gandhiji was made in South Africa. " ২ দশকের বেশি সময় ধরে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণ ভেদাভেদ অস্পৃশ্যতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন এবং তার জন্য তাকে অনেক নির্যাতনেরও শিকার হতে হয়। "মানব কল্যাণে যা করা উচিত তা করো, পরে কী ঘটবে তা ভেবো না"।

প্রখ্যাত রুশ লেখক লিও ট্লস্টয় তাঁর মৃত্যুর চারদিন আগে ডাইরিতে রুশ ভাষায় লিখে যান এই কথা । টলস্টয় ও গান্ধীজী উভয়ই একই পথের পথিক, মানবিক সহৃদয়তা সামাজিক ন্যায়বিচারের সর্বোচ্চ লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। উভয়েই যুদ্ধের বিরুদ্ধে, শান্তির স্বপক্ষে, মানবতাবাদের পক্ষে সংগ্রাম করে গেছেন। উভয়েই চাইতেন সমস্ত রকম বাধা-বিঘ্ন, জাত-পাত,ধর্ম-বর্ণগত ভেদাভেদ সবকিছু ভেঙে ফেলে বিশ্ব জুড়ে সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তুলতে। উনবিংশ বিংশ শতাব্দীতে উন্মত্ত সমরবাদী জনবিরোধী শক্তিকে প্রতিহত করতে শান্তি সম্প্রীতি সৌহার্দের বাণী দিয়ে নতুন সমাজ নতুন পৃথিবী গড়ে তোলা ছিল তাঁদের প্রধান লক্ষ্য ।

লিও টলস্টয় এর জন্ম রাশিয়ার তুলা প্রদেশে, গ্রামের নাম ইয়ামায়া পালিয়ানা।' যুদ্ধ ও শান্তি ','আম্মা কারেনিনা ' বিশ্ব বিখ্যাত যুদ্ধ বিরোধী উপন্যাস তাঁর।টলস্টয়ের জন্ম ৯ সেপ্টেম্বর, ১৮২৮, গান্ধীজীর থেকে তিনি ৪১ বছরের বড় ছিলেন। দুই দেশ, দুই জাতি, অথচ দুজনের মধ্যে যুদ্ধ বিরোধী ভাবনার, সম্প্রীতি - সৌহার্দ্য ভাবনার আশ্চর্য মিল। অশিক্ষা,কুশিক্ষা, কুসংস্কার ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন আজীবন। দুজনের কাছেই জীবনের প্রধান লক্ষ্য ছিল জনগণ তথা সমগ্র মানবজাতির নিঃস্বার্থ সেবা। প্রাচ্য পাশ্চাত্যের সক্রিয় প্রেম এবং সব জীবের প্রতি শ্রদ্ধার আদর্শ উভয়কে অনুপ্রাণীত করে। তলস্তয় লিখেছেন, "সেকেলে ও জীর্ণ যা কিছু, সেগুলিকে সরিয়ে দিয়ে সেই জায়গায় নতুন কিছুকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একটি উচ্চতর অভিন্ন আদর্শ তুলে ধরা চাই। সেই আদর্শই হল মানবিক ঐক্যের,বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্বের আদর্শ।আমাদের চেষ্টা করা দরকার ভেদাভেদ সৃষ্টিকারী সমস্ত চক্রান্ত-বাধা ভেঙে ফেলার।"

মহাত্মা গান্ধী বর্ণ বৈষম্যবাদ, অস্পৃশ্যতাসহ নানা মানবতাবিরোধী আন্দোলন করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হন লিও টলস্টয় ও রাসকিনের দ্বারা।

তিনি জন্মগ্রহণ করেন গুজরাটের কাথিয়াবাড় রাজ্যের পোরবন্দর এলাকায়। তাঁর বাবা করমচাঁদ উত্তম চাঁদ গান্ধী বা কাবা গান্ধী ছিলেন সেই রাজ্যের দেওয়ান বা মন্ত্রী, তার মা পুতলি বাই। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তাঁর বিবাহ হয় কস্তুরবা গান্ধীর সঙ্গে, কস্তুরবা ছিলেন তাঁর থেকে এক বছরের বড়। তাঁর চার পুত্র সন্তান, হরিলাল, মনি লাল, রামলাল ও দেবদাস। বিখ্যাত শিল্পপতি যমুনা লাল বাজাজকে তার পঞ্চম পুত্র হিসেবে বিবেচনা করা হতো, তিনি তাকে খুব ভালবাসতেন। তার বিখ্যাত আত্মজীবনীমূলক 'My Experiment With Truth' গ্রন্থে তাঁর সম্পর্কে আমরা অনেক কিছু জানতে পারি। এটি নবজীবন পত্রিকায় সাপ্তাহিক কিস্তিতে ১৯২৫ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। তার ব্যক্তিগত সচিব মহাদেব দেশাই এবং তা ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। রাজনৈতিক গুরু ছিলেন গোপালকৃষ্ণ গোখলে। যার বিখ্যাত উক্তি আমরা বাঙালি মাত্র প্রায় প্রত্যেকেই জানি, "what Bengal thinks today, India thinks tomorrow. "

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে মহাত্মা উপাধি দেন, সুভাষচন্দ্র বসু তাঁকে ফাদার অফ নেশন বা জাতির জনক হিসেবে অভিহিত করেন, জহরলাল নেহেরু তাকে বাপু বলে সম্বোধন করতেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল তাকে বলতেন হাফ নেকেড ফকির। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলে তিনি বেলেঘাটায় অনশন শুরু করেন এবং হিংসাত্মক খুনোখুনি বন্ধ হয়, তখন লর্ড মাউন্টব্যাটেন তার নাম দেন, " one man boundary force . "

১৮৮৮ সালে তিনি আইন শিক্ষা লাভ করতে লন্ডনে যান এবং ১৮৯১ সালে ফিরে এসে গুজরাটের রাজকোটে ও বোম্বাইতে ওকালতি শুরু করেন। কিন্তু খুব একটা সাফল্য পাননি। ১৮৯৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসকারী দাদা আব্দুল্লাহ নামে এক ব্যবসায়ীর হয়ে মামলা লড়তে চলে যান দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেখানে গিয়ে তিনি বর্ণবৈষম্যের কুৎসিত রূপ প্রত্যক্ষ করেন। দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল ভারতের মতো ব্রিটিশ উপনিবেশ। সেখানে ভারতসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা বসবাস করতেন। চিনি কারখানা ও রেললাইন নির্মাণে কাজ করতো বহু ভারতীয়। ব্যবসায়ীদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন মুসলিম। ভারতের অনেকেই ছিলেন নিরক্ষর বা তাদের অনেকের ইংরেজি জ্ঞান ছিল অল্প। তারা প্রতি পদে পদে জাতি বৈষম্যের শিকার হন।তাঁদের বলা হতো অর্ধবর্বর এশীয়, দীর্ঘ কাল ধরে স্থায়ী ভাবে বসবাস করলেও তাঁদের ছিল না কোনো ভোটাধিকার। তাঁদের নাটাল এলাকার বাইরে কোথাও বসবাস করতে দেওয়া হতো না বা বাইরে কোথাও জমি জায়গা কেনার কোন অধিকার ছিল না।সেখানকার পরিবেশ ছিল ঘিঞ্জি আর অস্বাস্থ্যকর।শুধু তাই নয়, রাত নটার পর বাড়ি থেকে বের হবার বা বাড়ির দরজা খোলার অধিকার ছিলনা। সরকারি ফুটপাত চলাচলের জন্য তারা ব্যবহার করতে পারত না। মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ভারতীয় শ্রমিকদের সেখানে তিন পাউন্ড করে জরিমানা দিতে হতো বসবাসের জন্য,এটা নিম্নবিত্ত মানুষের পক্ষে ছিল বিরাট বোঝা । প্রত্যেক ভারতীয়কে স্থানীয় থানায় হাতের আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে নাম নথিভুক্ত করতে হতো অপরাধীদের মতো।সেখানে খ্রিস্টান মতে বিবাহ ছাড়া মুসলিম বা হিন্দু মতে বিবাহ-গ্রাহ্য করা হতো না।এমনকি ভারতীয়রা দক্ষিণ আফ্রিকার এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে যাতায়াত করতে পারতোনা।গান্ধীজীও সেখানে গিয়ে এই ধরনের জঘন্য সমস্যার মুখোমুখি হন এবং ধীরে ধীরে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। এই ব্যাপারে গান্ধীজি বেশ কয়েকটি চিঠি লিখেন ব্রিটিশ সরকারকে কিন্তু তার কোন ফল তিনি পান না। ১৮৯৪ থেকে ১৯০৬ পর্যন্ত এই ১২ বছর তিনি এই আন্দোলন চালিয়ে যান। তিনি ভারতীয়দের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার সভাপতি নির্বাচিত হন হাজী আব্দুল আদম জার্ভেরি। শুধু তাই নয়, তিনি 'ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে বৈষম্যমূলক ঘটনাগুলির সংবাদ প্রকাশ শুরু করেন। তাঁকে দৈহিকভাবে আক্রমণ করে অর্ধমৃত অবস্থায় রাস্তার ধারে ফেলে দেওয়া হয়,তবুও তাঁকে দমানো যায়নি।

তিনি বিভিন্ন রকম বই পড়তে খুব পছন্দ করতেন। সেই সময় দুজন লেখকের দ্বারা তিনি খুব প্রভাবিত হন। একজন লিও টলস্টয় আর অন্যজন জন রাস্কিন। রাস্কিনের 'Unto the last' এবং তলস্তয়ের 'The kingdom of God' গ্রন্থ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নাটাল ফিনিক্স সেটেলমেন্ট বা ফিনিক্স আশ্রম নির্মাণ করেন ১৯০৪ সালে। পরে ১৯১০ সালে হার্মান কার্লবাখের সহায়তায় টলস্টয় ফার্ম স্থাপন করেন। সেখানে ভারতীয় শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হতো এবং নারী পুরুষকে নানাভাবে হাতের কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো যাতে তারা স্বনির্ভর ও সক্ষম হয় । গান্ধীজীর নেতৃত্বে ভারতীয়রা নাটাল থেকে ট্রান্সভাল যাত্রা করেন সেই দেশের অভিভাসন আইনের প্রতিবাদে। জেলবন্দী হন অনেকে। গান্ধীজির এই আন্দোলন হল সত্যাগ্রহ আন্দোলন। সত্যাগ্রহ শব্দটি সত্য এবং আগ্রহ দুই শব্দযোগে তৈরি। সাধারণ অর্থ হল সত্যের প্রতি আগ্রহ অর্থাৎ যেটা নিজে সত্য বলে বিশ্বাস করব তাকে রূপায়ণ করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাব। সত্যের প্রতি অবিচল আস্থা রেখেই গান্ধীজী সেই দেশে বেশ কিছু সংস্কার আনতে সক্ষম হন। বিভিন্ন ধর্ম মতের বিবাহের স্বীকৃতিসহ এশিয়দের জন্য নানা বিধি নিষেধ লাঘব করা হয়।

গান্ধীজীর নেতৃত্বে সবচাইতে বড় আন্দোলন গড়ে ওঠে new cashel কয়লা খনি এলাকায়, হাজার হাজার শ্রমিক গান্ধীজীর নেতৃত্বে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে, এর জন্য গান্ধীজীকে ৯ মাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। এই আন্দোলন নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে এবং পুলিশের গুলিতে কয়েকজন ভারতীয় মারা যান। তাতেও আন্দোলন স্তব্ধ হয়নি। অবশেষে ১৯১৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা শাসক প্রধান জেনারেল স্মার্ট গান্ধীজীর সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হন। নতুন ত্রাণ আইন এনে ভারতীয়দের অনেক দাবি মেনে নেওয়া হয়,ফলে সেই দেশে ভারতীয়দের আর্থসামাজিক অবস্থার কিছুটা মানোন্নয়ন ঘটে। দক্ষিণ আফ্রিকার গান্ধীজীর নেতৃত্বে আন্দোলনের বিরাট তাৎপর্য হলো তিনি ধর্ম বর্ণ জাতি নির্বিশেষে সমস্ত নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষকে একই সঙ্গে আন্দোলনে শামিল করতে সফল হয়েছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় আন্দোলনের সাফল্যের পর তার আন্তর্জাতিক খ্যাতি বৃদ্ধি পায় এবং ধর্ম বর্ণ ভাষার দ্বন্দ্বে জর্জরিত ভারতবাসীরা একজন ধর্মনিরপেক্ষ নেতা হিসেবে পেল গান্ধীজিকে।

ভারতে ফিরে গান্ধীজি গোখলের পরামর্শে সারা ভারত ভ্রমণ করেন সাধারণ অতি দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করতে।

মহাত্মা গান্ধী বিহারে চম্পারন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন তে কাঠিয়া প্রথা নিবারণের জন্য এবং নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধেও সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।

সুরাট আমেদাবাদের বস্ত্র শ্রমিকদের ধর্মঘটকে সমর্থন করে অনশন শুরু করেনতিনি । তার এই আন্দোলনের ফলে বস্ত্র শ্রমিকরা ৩৫%বোনাস আদায় করতে সক্ষম হন।

গুজরাটের খেরায় এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয় এবং বহু ফসল নষ্ট হয়ে যায় নিয়ম ছিল এক চতুর্থাংশ ফসল না হলে খাজনা বা লাগান মুকুব করা হবে। কিন্তু জমিদাররা বল পূর্বক খাজনা আদায় করলে গান্ধীজি তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন এবং জেলবন্দী চাষীদের মুক্ত করে আনেন।

১৯১৯ খেলাফত আন্দোলন গান্ধীজিকে বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে বড় জনপ্রিয় করে তোলে। ব্রিটিশ সরকার তুরস্কের খলিফাকে ক্ষমতাচ্যুত করলে এদেশে আলী মোহাম্মদ ব্রাদার্স শওকত আলী ও মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে ফেলাফত আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। দিল্লিতে এক সভায় সভাপতিত্ব করেন গান্ধীজি। এক বছরের জন্য সমস্ত সরকারি দপ্তরে কর্মীদের না যাবার অনুরোধ জানান তিনি।

১৯২০ সালে গান্ধীজী ব্রিটিশ সরকার বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন। এই সময় ভগত সিং,রাজগুরু,রামপ্রসাদ বিসমিল সিং,আস্ফাকুল্লাহ খান চন্দ্রশেখর আজাদ,রাসবিহারী বসুর নেতৃত্বও সশস্ত্র আন্দোলন চলছিল উত্তর ভারত জুড়ে। উত্তরপ্রদেশের চৌরিচৌরা থানার সামনে অবস্থানরত জনতার উপর পুলিশ গুলি চালালে গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেন। ১৯৩০ সালে ১১ দফা দাবি নিয়ে গান্ধীজি সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন। দাবি করা হয় ব্রিটিশ সরকারের লবণের উপর একাধিকত্ব বন্ধ করতে হবে এবং কৃষকদের উপর ৫০% করের বোঝা কমাতে হবে। সবরমতী আশ্রম থেকে গান্ধীজী ডান্ডি অভিযান শুরু করেন বলে এই আন্দোলনের নাম লবণ সত্যাগ্রহ নামেও পরিচিত। ১২ মার্চ থেকে ছয় এপ্রিল পর্যন্ত ২৮ দিন ধরে প্রায় ২৪০ মাইল যাত্রা করেন গান্ধীজি।প্রথমে ৭৮ জন ছিলেন পরে সেটা যেন বিশাল জনযাত্রায় পরিণত হয় এবং সেখানে গিয়ে তিনি নিজে লবণ তৈরি করেন।

১৯৪২ সালে, ৮ ই আগস্ট থেকে গান্ধীজীর নেতৃত্বে ভারতছাড়ো আন্দোলন শুরু হয় এবং এই আন্দোলন করতে গিয়ে গান্ধীজীসহ অনেকেই বন্দন গান্ধীজি এই সময় ডাক দেন ডু অর ডাই করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহাত্মা, নেহেরুর বাপুজি, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জাতির জনক গান্ধীজিকে ১৯৪৮, ৩০ জানুয়ারি স্বাধীনতা লাভের মাত্র ৫ মাস ১৫ দিন পরে নাথুরাম গডসে দিল্লির বিড়লা হাউসে গুলি বিদ্ধ করে হত্যা করেন।তিনি তখন উপাসনা করতে যাচ্ছিলেন।তাঁর প্রতি এই আঘাত বা হত্যা ভারতীয় সংবিধানের উপর আঘাত, ধর্মনিরপেক্ষতার উপর আঘাত, সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি আঘাত, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর আঘাত। বর্তমানে ভারত বর্ষ চরম সমস্যার মুখোমুখি। পুরো উপমহাদেশ জুড়ে চলছে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ খুনোখুনি হানাহানি। জনগণের দৈনন্দিন সমস্যাকে দূরে সরিয়ে রেখে প্রত্যেকটি দেশের মৌলবাদী সংগঠন গুলি অন্য ধর্মের বর্ণের ভাষার মানুষকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে মানুষের মধ্যে বিদ্বেষভাব তৈরি করছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি উপাসনা স্থল যেমন ধ্বংস করছে পাকিস্তানেও আজকে যেহেতু সেখানে সংখ্যালঘু মানুষের অস্তিত্ব প্রায় ক নেই বললেই চলে সেখানে নিজেরা নিজেরা অন্য অংশের মানুষের উপর হামলা চালাচ্ছে নিজেদের মূল সমস্যাকে আড়াল করার জন্য। আফগানিস্তানেও একটা মৌলবাদী সরকার চলছে সেখানেও মানুষের দৈনন্দিন জীবনে উন্নয়ন অগ্রগতি এবং প্রগতিশীল চিন্তাভাবনাকে ধ্বংস করা হচ্ছে। ভারতবর্ষের বেকারত্বের সীমা অতীতের সমস্ত রেকর্ডকে হার মানিয়েছে। শিক্ষা স্বাস্থ্য কৃষির অবস্থা চরম খারাপ। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আকাশ ছোঁয়া। দৈনন্দিন অসংগঠিত শ্রমিকদের কোনরকম বেতন বাড়ছে না অন্যদিকে তাদের কাজের সীমা বাড়িয়ে দেওয়ার চক্রান্ত  করা হচ্ছে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন