Ganesh Ghosh Profile

ভবিষ্যতের ১৯৪৫ সাল আর কত দূরে?

মুখবন্ধ

ভারতে স্বাধীনতার সংগ্রামের ইতিহাস অনেকগুলি বহতা নদীর এক সম্মিলিত প্রবাহ।

সশস্ত্র সংগ্রাম তারই অন্যতম একটি ধারা।

মাস্টারদা, সূর্য সেন’রা বুঝেছিলেন সাম্রাজ্যবাদী লুঠেরাশক্তির পরাক্রমের জোর মুলত দুটো কারণে। প্রথমত তারা বুঝে নিয়েছে এদেশের বেশিরভাগটাই পুরাকাল-পরকালের গল্প বুকে চেপে বাঁচে, ফলে এদের এককাট্টা হওয়াটাই হয়ে ওঠে না। দ্বিতীয়ত কামান কিংবা বন্দুকের সামনে খালি বুক পেতে বীরের মৃত্যুলাভ করার মতো যারা সাহসী, তাদের সম্পর্কে লোকে গল্প করে, শিহরণ অনুভব করে কিন্তু ঐ জীবন অনুসরণ করা যায় না। সিংহসদৃশ হৃদয়ের কাহিনীতে দেশের লোকের মনে পাল্টে দেবার আশা সঞ্চারিত হয় না - কারণ ওভাবে সবাই বুক পাতে না, পাতবে না। এখানেই ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবের ইতিহাসে সূর্য সেনের গুরুত্ব, তিনি শুধু পিস্তল ধরতেই শেখাননি, কার্যত মনের কোনে শাসক সম্পর্কে যে ভয় থাকে তাকেই দুরমুশ করে দিয়েছেন। আঘাত হানতে হবে এমনভাবে যেটাকে কৌশল হিসাবে অন্যত্র কিংবা প্রায় সর্বত্র অনুসরণ করা যায়, স্থানভেদে বারে বারে প্রয়োগ করা যায়। যেটা নিজেরা রপ্ত করে অন্যদের শেখানো যায়।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের গালে সপাটে চড় মেরে সেদিন গেরিলারা শুধু অস্ত্রাগারই আক্রমন করেননি- চট্টগ্রামকে মুক্তাঞ্চলেও পরিণত করেছিলেন। জালালাবাদের পাহাড়ে মেশিনগানের সামনে ঐ লুঠ করা বন্দুক হাতে নিয়েই ওদেরই অস্ত্রে ওদের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন- হারিয়ে দিয়েছিলেন!

এদেশে্র মাটিতে তখন সবে সাম্যবাদের লাল পতাকা উড়তে শুরু করেছে, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পাতা উল্টে দেখতে শুরু করেছেন কয়েকজন। সেই জমিতে মাস্টারদা গেরিলা যুদ্ধ প্রয়োগে শত্রুর অস্ত্র ব্যবহার করে ঘাঁটি এলাকা তৈরী করিয়ে একটা গোটা সেনাবাহিনীকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছিলেন। এই গোটা ব্যাপারটাকে আধুনিক রাজনীতিতে বা আধুনিক সমরবিদ্যায় গেরিলা ওয়ারফেয়ার বলা হয়। এই হল সেই কৌশল যাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে মাও সে তুং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার রূপ দিয়ে গেছেন, লাতিন আমেরিকার এক বিস্তীর্ণ এলাকায় চে গ্যেভারা প্রয়োগ করেছেন। এদেশে যারা আজকাল নিজেদের মাও সে তুঙের উত্তরাধিকারী বলে পটকা ফাটান তাদের মনে রাখা উচিত সশস্ত্র বিপ্লবপন্থায় সূর্য্য সেন শুধু মাস্টারই নন খোদ হেডমাস্টার।

বিশ্বাসঘাতক নেত্র সেনের টাকা-পয়সার লোভ মাষ্টারদাকে ধরিয়ে দিয়েছিল। ইংরেজ তাকে জেলবন্দি অবস্থায় হাত পায়ের নখ উপড়ে নিয়ে, হাতুড়ি পিটে হাত পা- দাঁত ভেঙে দিয়ে এবং সবশেষে ফাঁসি দিয়েও শান্তি পায়নি। মৃতদেহ সৎকার হতে না দিয়ে সাগরের জলে নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু ততদিনে তার ছাত্রছাত্রীরা লড়তে শিখে গিয়েছিল- তাই আন্দামান জেলে থাকতেই মার্কসবাদে দীক্ষিত হয়ে উঠলেন তারা।

জেল থেকে বাইরে এসে এরাই কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হলেন।

গনেশ ঘোষ সেই ঐতিহ্যেরই অন্যতম এক ব্যক্তিত্ব।

আজ তার জন্মদিবসে, তারই লেখা বই ‘মুক্তিতীর্থ আন্দামান’ থেকে কিছু অংশ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হল। এ কাজে ন্যাশনাল বুক এজেন্সি থেকে প্রকাশিত বইটিকে আমরা ব্যবহার করেছি।

এর উদ্দেশ্যে শুধু বিপ্লবী গনেশ ঘোষকে শ্রদ্ধা জানানো নয়।

এই প্রতিবেদন আসলে আরেকবার বুঝে নেওয়া, ঝালিয়ে নেওয়া- কোন উত্তরাধিকার আমাদের জন্য পূর্বসুরীরা রেখে গেছেন?

Andaman Jail

গনেশ ঘোষ

১৮ আগস্ট সকালবেলা এই বারের প্রথম দলের রাজবন্দিরা ‘মহারাজ’ জাহাজ থেকে নেমে সেলুলার জেলে পৌঁছোনোর পর জেলর ঠিক আগের কালের মতোই ওই বন্দিদের সামনে এসে দাঁড়ায় এবং একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে বন্দিদের বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করে যে, বন্দিরা যেন কখনই ভুলে না যায় যে তারা আর বাংলাদেশে নেই; তারা যেন সবসময়েই মনে রাখে যে তারা এখন আন্দামানে এবং অদূরের খুব বড় বড় তিন তলার বাড়িগুলিকে অঙ্গুলি সঙ্কেতে দেখিয়ে, এবং চোখ দুটিকে একটু বিস্ফারিত ও গোল গোল করে বলে যে ওইখানে ওই সব বাড়িতে সিংহদের পোষ মানানো হয়।

যথার্থই সেই সময়টায় ওইখানকার পরিস্থিতি একটু অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। জেল গেটের বাইরে ট্রাক থেকে নামিয়ে জেল গেটের ভিতরে যেখানে রাজবন্দিদের এনে দাঁড় করানো হয়েছিল অর্থাৎ যেখানে এসে জেলর রাজবন্দিদের কাছে ওই বক্তৃতা দিয়ে বন্দিদের মনে সেলুলার জেল সম্পর্কে একটি স্থায়ী আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল সেই জায়গাটি ছিল জেলখানার ভিতরে, জেলের প্রধান ফটকের খুব কাছে বড় ফাঁকা জায়গাটিতে। জেলরের পূর্ব আদেশ ও ব্যবস্থায় সমগ্র জেলখানাটি ওই সময়ে ছিল সম্পূর্ণ নীরব ও নিস্তব্ধ। সেলুলার জেলের ভিতরে তখন খুব বেশি সংখ্যক কয়েদি ছিল না এবং কোনো কয়েদিকেই তখন ওই ফাঁকা জায়গাটির আশেপাশে কোথাও আসতে দেওয়া হয়নি; এমনকি অদূরের রান্নাঘর থেকেও সেই সময়ে কাউকে বাইরে আসতে নিষেধ করে দেওয়া হয়েছিল। কয়েদিদের সকলকেই নিজ নিজ খাটুনির জায়গায় আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল।

সকাল বেলার ৯টা-১০টার সময়ে ওই অস্বাভাবিক প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা এবং সেলুলার জেলের ওই বড় বড় বাড়িগুলির অদ্ভুত চেহারা-এই দুইটি মিলিয়ে বন্দিদের মনে কেমন একটা অসহায়তার ভাব সৃষ্টি করবার চেষ্টা করেছিল। ওই প্রথম দলের রাজবন্দিরা সকলেই ছিলেন বাংলাদেশের মানুষ এবং বাংলাদেশের বহু জেলখানা সম্পর্কে তাঁদের অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু কোথাও বাংলাদেশের কোনো জেলখানাতেই সকাল বেলা ৯টা-১০টার সময় নীরবতা অথবা শব্দহীনতা তাঁদের অভিজ্ঞতায় ছিল না। দিনের বেলা কোনো জেলখানা সম্পর্কে এ কল্পনা করাও অবাস্তব; অবশ্য কেবলমাত্র যখন কোনো জেলখানা পরিদর্শন করতে কোনো লাটসাহেব বা ওই পর্যায়ের কেউ যায় সে সময়ের কথা বাদ দিয়ে। জেলখানায় প্রত্যেক কাজেই শব্দ একটু বেশি করেই হয়। এবং বাংলাদেশের কোনো জেলখানাতেই সেলুলার জেলের মতো অত বড় বড় বাড়ি নেই কিংবা কোথাও তিনতলা বাড়িও ছিল না। তাই সেই দিন সকালবেলায় সেলুলার জেলের ওই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখে কোনো কোনো বন্দির খুব স্বাভাবিকভাবেই মনে হয়েছিল যে সত্যিই হয়তো ওই সেলুলার জেলের ভিতর থেকে জীবন নিয়ে আর কোনো দিনই বের হয়ে দেশে ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু এই চিন্তা রাজবন্দিদের মনে হতাশা কিংবা ভীতি সৃষ্টি না করে তাঁদের মনে খানিকটা বে-পরোয়া হবার, মরিয়া হবার মনোভাবই সৃষ্টি করে তুলেছিল।

যাই হোক, জেলরের ওই হ্রস্ব বক্তৃতা সমাপ্তির পরই বড় জমাদারের ইঙ্গিতে ভিতরের দিক থেকে একজন সিপাই একজন কয়েদিকে নিয়ে এল যে জেলখানায় কামার মিস্ত্রির কাজ করে। ওই কয়েদি এসে হাতুড়ি ছেনি ইত্যাদি যন্ত্রপাতি দিয়ে বন্দিদের পায়ের লোহার (ডান্ডা) বেড়ি কেটে দিতে আরম্ভ করে। তখন ওই লোহা কাটার আওয়াজ অদূরের রান্নাঘরের ভিতরের বাসন-পত্র ফেলবার বিকট বিকট আওয়াজ এবং দূরে দূরে কয়েদিদের আবির্ভাব যেন মুহূর্তেই সমস্ত পরিস্থিতিটিকে স্বাভাবিক ও সহনীয় করে তুলল।

তারপর বন্দিদের ভিতরের দিকের একটি ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হলো এবং বাড়িটির এক তলার বারান্দায় নিয়ে গিয়ে প্রত্যেককে একটি ঘর দেখিয়ে দেওয়া হলো যে ঘরটিতে তাঁকে থাকতে হবে। ভিতরের অন্যসব ব্যবস্থাও প্রায় ঠিক পূর্বের মতোই ছিল- সমুদ্রের লোনা জলে স্নান করতে হবে; বিকাল আন্দাজ ৪.৩০ যখন বাইরে প্রচণ্ড রোদ থাকে সেই সময়েই বন্দিদের সন্ধ্যার ভাত খাইয়ে প্রত্যেককে পৃথক পৃথকভাবে এক একটি ঘরে তালাবন্ধ করে দেবে; ভোরবেলা ৫টার আগেই উঠে বাইরে আসতে হবে; ইত্যাদি, ইত্যাদি।

পরদিনই খুব প্রত্যুষে বন্দিদের কুঠরির তালা খুলে দেবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একজন কয়েদি এসে প্রত্যেক বন্দির দরজার সামনে দুই পাউন্ড ওজনের নারকেলের ছোবড়ার এক একটি বড় প্যাকেট রেখে গেল এবং ওই কয়েদির সঙ্গে সিপাই প্রত্যেক বন্দিকে জানিয়ে দিল যে ওই দুই পাউন্ড নারকেলের আঁশ হাতে পাকিয়ে দড়ি বানাতে হবে এবং অল্প কিছুক্ষণ পরেই আর এক জন কয়েদি এসে প্রত্যেককে শিখিয়ে দেবে কীভাবে ওই আঁশ হাতে পাকিয়ে দড়ি তৈরি করতে হয়।

প্রথম প্রথম এই দড়ি পাকানো একটি অতি কঠিন কাজ। নারকেলের ছোবড়ার ওই আঁশ নিয়ে মোটা মোটা পাঁজ তৈরি করে দুই হাতের তালুতে ঘসে ঘসে পাকাবার চেষ্টা করলে অল্প কিছুক্ষণ পরেই দুই হাতের তালুতে ফোস্কা পড়ে চামড়া উঠে যায় এবং বড় বড় ঘা হয়ে যায়। ওই বন্দিদের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছিল। নারকেলের ছোবড়ার আঁশ হাতে পাকিয়ে কীভাবে দড়ি তৈরি করতে হয় এবং প্রথম প্রথম সে চেষ্টা করলে শিক্ষার্থীর কী অবস্থা হয় সে সম্পর্কে বন্দিদের কোনো ধারণাই ছিল না; তাই সকাল ৭টা-৭.৩০ সময় একজন সিপাই-র সঙ্গে একজন কয়েদি এসে বন্দিদের যখন দেখিয়ে দিল কীভাবে ওই আঁশ হাতে পাকিয়ে দড়ি তৈরি করতে হয় তখন বন্দিরা কাজটি খুব সহজ এবং সরল মনে করেই অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে দড়ি তৈরি করতে আরম্ভ করে দিলেন। কিন্তু মিনিট ১৫-২০ পরেই দেখা গেল প্রায় প্রত্যেকেরই দুই হাতে বড় বড় ফোস্কা পড়েছে এবং কারও কারও হাতের ফোস্কা গলে গিয়ে একটি বিশ্রী কষ্টদায়ক অবস্থা সৃষ্টি করেছে। প্রায় প্রত্যেকের হাতেই ওই একই অবস্থা। প্রশ্ন উঠল ওই হাতে ভাত খাওয়া যাবে কেমন করে? চামচ পাওয়ার তো কোনো উপায় নেই।

ওই প্রথম দলের রাজবন্দির ভিতর ভারতবর্ষের কারা-আইন অনুযায়ী দুই শ্রেণির বন্দিই ছিলেন: দ্বিতীয় শ্রেণি (Division II) এবং তৃতীয় শ্রেণি (Division III)। ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লাহোর জেলে রাজনৈতিক অভিযোগে ধৃত বন্দিদের জন্য কারাগারে রাজবন্দির মর্যাদা ও তদনুযায়ী ব্যবহার দাবি করে এবং লাহোর জেলের সেই বিচারাধীন বন্দিদের প্রতি সরকারের অন্যায়, অমানুষিক ও বর্বর ব্যবহারের প্রতিবাদ করে দীর্ঘদিন অনশনের পর যতীন দাসের প্রাণত্যাগের পর সারা দেশব্যাপী যে প্রচণ্ড আন্দোলন ও প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছিল তার ফলে ভারতের অনিচ্ছুক ব্রিটিশ সরকার ভারতের কারাগারে বন্দিদের অবস্থা ও বন্দিদের প্রতি সরকারের ব্যবহার সম্পর্কে খুব গুরুতর দৃষ্টি দিতে এবং ওই ব্যবস্থার কিছুটা পরিবর্তনের বন্দোবস্ত করতে বাধ্য হয়েছিল।

১৯৩১ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ভারতের কারাগারসমূহে সরকারের স্বীকৃতিতে মাত্র দুই শ্রেণির বন্দি ছিল ভারতীয় শ্রেণি ও ইউরোপিয়ান শ্রেণি। ইউরোপীয় শ্রেণিতে পরিগণিত হত কেবল মাত্র তারাই যারা ইউরোপের অধিবাসী কিংবা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান অথবা এদেশীয় ফিরিঙ্গি যাঁদের একটা সাহেবি নাম থাকত, কোট পেন্টল পরতে পারত; এবং নিজেদের ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত কিংবা তাদেরই নিকটতম আত্মীয় মনে করত। সেই যুগে অর্থাৎ ১৯৩১ সালের পূর্ব পর্যন্ত এই ইউরোপীয় শ্রেণির বন্দিদের ভারতের কারাগারে প্রায় রাজার হালে থাকবার ব্যবস্থা ছিল; তা তাদের অপরাধ যতই গর্হিত, যতই ঘৃণ্য কিংবা যতই ন্যক্কারজনক হয়ে থাকুক না কেন। সরকারি অর্থে এই ধরনের বন্দিদের জেলখানায় যে পোশাক পরিচ্ছদ, যে খাদ্য এবং যে বিছানাপত্র দেওয়া হত বাইরের ইউরোপীয়দের জীবনযাত্রার প্রায় সম-পর্যায়ের ছিল।

আর এই শ্রেণির বন্দি ভিন্ন কারাগারের অন্য সব কয়েদিদেরই ভারতীয় শ্রেণি বলে পরিগণিত করা হত। এদের যে পরিচ্ছদ দেওয়া হত তা অতিশয় সামান্য, কেবলমাত্র কোনোরকমে নগ্নতা রক্ষার উপযোগী বলেই বলা যায়। এদের বিছানা ছিল মাত্র দুটি 'কুলি কম্বল'; শীতের তিন মাস একটি বেশি কম্বল। এদের খাবার বাসন ছিল একটি লোহার থালা ও একটি লোহার বাটি যে দুইটিতে দেখা যেত প্রত্যহই মরচে ধরে (rust) একেবারে লাল হয়ে রয়েছে। প্রত্যহ দুইবেলাই এই দুইটিকেই ভালো করে না মেজে-ঘসে ভাত খাওয়ার কিংবা জল খাওয়ার কোনো উপায় থাকত না। এই শ্রেণির বন্দিদের জন্য খাদ্যের যে ব্যবস্থা ছিল তা যত নিকৃষ্ট ধারণা করা যায় তাই। অবশ্য কারা-আইনে যা বলা ছিল সেই অনুসারে এই বন্দিদের প্রত্যেকের প্রতি ৭-৮ দিন পরে এক টুকরো মাছ ও পরের ৭-৮ দিন পরে এক টুকরা মাংস দেবার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা সব সময় হয়ে উঠত না।

১৯৩১ সাল পর্যন্ত ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের সব বন্দিকেই এবং কংগ্রেসি সত্যাগ্রহ আন্দোলনের বহুসংখ্যক বন্দিকে এই ‘ভারতীয় শ্রেণি’-ভুক্ত হয়ে এই অবস্থার মধ্যে কারা ভোগ করতে হয়েছে।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশক থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন কারাগারে রাজবন্দিরা বিশেষত বিপ্লবী সংগ্রাম-সংক্রান্ত অপরাধে অভিযুক্ত বন্দিরা রাজবন্দির মর্যাদা অর্জনের জন্য এবং কারাগারের মধ্যে কিছুটা মানবিক সুযোগ সুবিধা দাবি করে এবং সেই সুযোগ অর্জনের প্রচেষ্টায় অপরিসীম দুঃখ ও অত্যাচার ভোগ করেছেন; অগণিত রাজবন্দি দীর্ঘদিন অনশন ধর্মঘট করেছেন; কয়েকজন রাজবন্দি এই অধিকার অর্জনের প্রচেষ্টায় কারাগারের অভ্যন্তরে প্রাণ দিয়েছেন। সেই পরিস্থিতির কিছুটা বিস্তারিত উল্লেখ এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে হয় না।

লাহোর জেলে শহীদ যতীন দাসের আত্মাহুতির পর ভারতীয় জেলে এই দুইটি শ্রেণি বিভাগ উঠে যায় এবং তার জায়গায় সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের তিনটি ভাগে ভাগ করার ব্যবস্থা হয়। প্রথম শ্রেণি, দ্বিতীয় শ্রেণি এবং তৃতীয় শ্রেণি (Division 1. Division II এবং Division III)। যাঁরা ধনে, মানে, সম্মানে এবং দেশবাসীর দৃষ্টিতে খুব বড়, যেমন ডা. বিধানচন্দ্র রায়, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু প্রমুখ জননেতৃবর্গ অহিংস সত্যাগ্রহ করে কারাবরণ করলে সাধারণত তাদের প্রথম শ্রেণির বন্দি বলে গণ্য করা হত। এঁদের জেলের মধ্যেও প্রায় ঠিক বাড়ির মতোই থাকবার ব্যবস্থা আছে। এঁরা বাড়ির পোশাক পরিচ্ছদ পরতে পারেন; ইচ্ছা করলে সকাল দুপুর বিকাল সন্ধ্যা নিজস্ব ইচ্ছা ও রুচি অনুযায়ী খাবার বাড়ি থেকে এনে খেতে পারেন এবং বৈদ্যুতিক পাখা, রেডিয়ো ব্যবহার করতে পারেন। এঁদের শুধু দিনের বেলা একটি ওয়ার্ডের মধ্যে আবদ্ধ থাকতে হয় এবং রাত্রিকালে একটি কুঠরির মধ্যে তালাবন্ধ হয়ে আটক থাকতে হয়।

যাদের কাছ থেকে সরকার আয়কর আদায় করে কিংবা যাদের আর্থিক অবস্থার সাধারণের চাইতে অনেক ভালো তাদেরই সাধারণত দ্বিতীয় শ্রেণির বন্দি বলে গণ্য করা হয়। ধনী ব্যক্তিরা অতি জঘন্যতম অপরাধ করা সত্ত্বেও তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির পর্যায়ে ফেলা হয় এবং জেলখানায় তারা অন্যান্য বন্দিদের অপেক্ষা অনেক অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। অবশ্য কয়েকটি বিশিষ্ট রাজনৈতিক মামলার সকল বন্দিকেই (যেমন প্রথম চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার মামলা, ১৯৩০; সেই বছরেরই ডালহৌসি স্কোয়ারে বোমার মামলা) এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলার অনেক বন্দিকে ব্যক্তিগত বিবেচনায় দ্বিতীয় শ্রেণির বন্দি বলে গণ্য করা হয়েছে। আবার ১৯৩০ সালের লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার, যে মামলায় শহীদ যতীন্দ্রনাথ দাস একজন বিচারাধীন বন্দি ছিলেন, সেই মামলায় দণ্ডিত একজন বন্দিকেও দ্বিতীয় শ্রেণির বন্দি বলে গণ্য করা হয়নি। ইংরেজ সরকারি আমলাদের ব্যক্তিগত আক্রোশ চরিতার্থতা এবং সরকারের পক্ষ থেকে জঘন্যতম প্রতিহিংসাপরায়ণতা ছাড়া এর আর অন্য কী সন্তোষজনক কৈফিয়ত থাকতে পারে!

এই দ্বিতীয় শ্রেণির বন্দিদের জেলখানায় ধুতি পাঞ্জাবি জুতো পরতে দেওয়া হয়; তাদের দৈনিক খাবারও অনেক উন্নত ধরনের। তাদের সকালে রুটি মাখন চা দেওয়া হয়; দুপুর বেলা ভাতের সঙ্গে মাছ কিংবা মাংস অথবা ডিম দেওয়া হয় এবং রাত্রেও তাই। তাদের কুঠুরিতে রাত্রে আলো দেওয়া হয় যাতে তারা পড়াশোনা করতে পারে। সরকারি খরচে তাদের দৈনিক খবরের কাগজ দেওয়া; এবং তারা বাইরে থেকে অথবা 'জাতীয় গ্রন্থাগার' থেকেও বই আনিয়ে নিতে পারে। দ্বিতীয় শ্রেণির কয়েদিদের খাটুনি হিসাবে সাধারণত কেরানির কাজ অথবা ওই ধরনের কোনো কাজ দেওয়া হয়; যে-সব কাজে সাধারণত দৈহিক পরিশ্রম বেশি করতে হয় না। ঘানি টানা প্রভৃতি কাঠোর পরিশ্রমের কাজ কখনই দ্বিতীয় শ্রেণির বন্দিদের দেওয়া হয় না।

এছাড়া অন্য সব সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদেরই তৃতীয় শ্রেণির বন্দি বলে গণ্য করা হয়। এই তৃতীয় শ্রেণির বন্দিদের বাস্তব অবস্থা এখনও অনেকাংশেই অতীতের 'ভারতীয় শ্রেণির' বন্দিদের মতোই রয়ে গিয়েছে-সেই পরিচ্ছদ, সেই খাবার, সেই খাটুনি। শুধু এইটুকু পরিবর্তন হয়েছে যে প্রত্যেককে লোহার থালা বাটির পরিবর্তে অ্যালুমিনিয়ামের থালা বাটি দেওয়া হয়; প্রত্যেককে একখানি করে বিছানার চাদর দেওয়া হয় এবং বন্দিরা ইচ্ছা করলে বাইরে থেকে মশারি এনে ব্যবহার করতে পারে।

পঞ্চাশ বছরেরও অধিক কাল ভারতবর্ষের বিভিন্ন কারাগারে রাজবন্দিরা বিশেষভাবে বিপ্লবী আন্দোলন সংক্রান্ত বন্দিরা, জেলখানায় রাজবন্দির মর্যাদা এবং কিছুটা মানবিক সুযোগ-সুবিধা অর্জনের চেষ্টায় বহু সংগ্রাম করেছেন ও অপরিসীম দুঃখ ভোগ করেছেন। কিন্তু ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী শাসকেরা জিদ করে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই দাবির বিরোধিতা করে গিয়েছে। তারা গণ-আন্দোলনের চাপে পড়ে কয়েদিদের সামাজিক মর্যাদা ও পদ অনুযায়ী জেলখানায় তাদের শ্রেণিবিন্যাস করতে বাধ্য হয়েছে; কিন্তু জেলখানায় রাজন্দিদের স্বীকৃতি দেয়নি।

পরদেশ লুণ্ঠনকারী সাম্রাজ্যবাদী শাসকের তৈরি সেই পুরাতন কারা-কানুন এবং কারাগারের সেই পুরাতন ব্যবস্থা মোটামুটিভাবে কিন্তু আজ আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের ত্রিশ বছর পরেও অক্ষুণ্ণ রয়েছে। আমাদের দেশের শ্রমিক কৃষক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা যারা শ্রেণি-সংগ্রাম করে কিংবা গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করবার জন্য অথবা ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রসারিত করবার প্রচেষ্টায় সংগ্রাম করে কিংবা সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা সর্বসাধারণের কাছে জনপ্রিয় করে তুলবার প্রচেষ্টায় সংগ্রাম করে কারাবরণ করেন তাদের আজও রাজবন্দির মর্যাদা দেওয়া হয় না। একটি অতি জটিল প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আমাদের দেশের বর্তমান শাসকদল নিজেরাই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা নিরন্তর এবং সতত তারস্বরে ঘোষণা করেন অথচ আমাদের দেশের শ্রমিকেরা বেকারির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে অথবা বাঁচার মতো মজুরির জন্য সংগ্রাম করে কিংবা গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সত্যাগ্রহ করে যখন কারাবরণ করেন তখন তাদের কিন্তু কারাগারে রাজবন্দি বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। এর যথার্থ কারণ কী জানার সত্যিই একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

অত্যন্ত দুঃখের এবং ক্ষোভের কথা এই সকল সংগ্রামী রাজনৈতিক কর্মীদের জন্য এমনকি শাসকদলের অন্যতম একজন সর্বোচ্চ নেতা এবং পশ্চিমবাংলার দীর্ঘকালের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় যেটুকু সুযোগ-সুবিধা এবং মর্যাদা কারাগারের অভ্যন্তরে দেবার জন্য আইনগত ব্যবস্থা করেছিলেন, বর্তমানের শাসকেরা কিন্তু সেটুকুও অতি অশোভনভাবে কেড়ে নিয়েছে।

একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় বিদেশি অত্যাচারী ইংরেজ শাসকেরাও রাজনৈতিক কর্মী সন্দেহে যাঁদের বিনাবিচারে আটক করে রাখত তাঁদের প্রত্যেককে জেলখানায় অনেক সুযোগ-সুবিধা দিত, বর্তমানের দ্বিতীয় শ্রেণির বন্দিরা যেটুকু সুযোগ-সুবিধা পায় তার চাইতে অনেক অনেক বেশি। কিন্তু বর্তমানের শাসকদল বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মীদের নিজেদের খামখেয়াল খুশিমতো বিনাবিচারে জেলখানায় আটক করে রাখে কিন্তু তাঁদের প্রায় সবাইকে তৃতীয় শ্রেণির বন্দিদের অপেক্ষা আরও শোচনীয় অবস্থার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকতে বাধ্য করা হয়। জেলখানায় সাধারণ তৃতীয় শ্রেণির বন্দিদের প্রতি যেরূপ ব্যবহার করা হয় এই সকল বিনাবিচারে আবদ্ধ রাজনৈতিক কর্মীদের প্রতি তার চাইতে আরও অনেক খারাপ ব্যবহার করা হয়।

জনসাধারণকে উদ্যোগী হয়ে বিশেষভাবে শ্রমিক কৃষক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির নিজেদেরই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ স্বার্থে এবং আরও বিশেষভাবে দেশের শ্রমিক শ্রেণিকেই যাদের উপর দেশের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক কর্তব্য ও দায়িত্ব ন্যস্ত রয়েছে তাদেরই উদ্যোগী হয়ে এ সবের যথার্থ কারণ অন্বেষণ করে জেনে নিতে হবে।

সদ্য অতীত ইতিহাসের একটি অতি কঠোর শিক্ষা সংগ্রামী জনতাকে নিশ্চয়ই কিছুটা পথের ইঙ্গিত দেখাতে পারে। এডলফ হিটলার সমাজতন্ত্রের ('জাতীয় সমাজতন্ত্রের') নামে বহু লক্ষ দরিদ্র শ্রমিক কৃষক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকে নিষ্ঠুর ও নির্লজ্জভাবে হত্যা করেছিল। অবশ্য সমগ্র পৃথিবীর গণতন্ত্রপ্রিয় প্রায় সব মানুষ ১২ বছর পরে ১৯৪৫ সালে এই নারকীয় বর্বরতার কিছুটা প্রত্যুত্তর দিয়ে হিটলার ও তার অনুচরদের কাছ থেকে কিছু হিসাব নিকাশ মিটাবার চেষ্টা করেছে। আমাদের দেশের শাসকেরাও 'সমাজতন্ত্রের' কথা বলেন এবং ইতিমধ্যেই একমাত্র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যেই এক সহস্রেরও অধিক রাজনৈতিক কর্মী নিহত হয়েছেন যাঁদের একমাত্র ‘অপরাধ’ ছিল তাঁরা সমাজতন্ত্রবাদী সমাজব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ আইনানুগভাবে জনসাধারণের কাছে জনপ্রিয় করে তুলবার চেষ্টা করেছিলেন।

‘ইতিহাসের তো পুনরাবৃত্তি ঘটেই’ (‘History repeats itself'), তাই অতি স্বাভাবিকভাবেই আমাদের দেশের সংগ্রামী মানুষের মনে প্রশ্ন জাগছে: ‘ভবিষ্যতের ১৯৪৫ সাল আর কত দূরে?’

 

ওয়েবডেস্কের পক্ষে মুখবন্ধ- সৌভিক ঘোষ


শেয়ার করুন

উত্তর দিন