সীতারাম ইয়েচুরি
স্যার।
সরকারের মনযোগ আকর্ষণ করতে আমি এই বিষয়টি উত্থাপন করছি। মাননীয় মন্ত্রী যেমন বললেন, আলোচ্য বিষয়টির প্রভাব শুধু মুক্ত সংবাদমাধ্যমের কার্যক্রমের মধ্যেই সীমিত নয়, তার পাশাপাশি গভীর মানসিক পীড়ন ও শংকার এক জায়গা থেকে আমি বলতে চাই এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের ভবিতব্যও। সংবিধান দ্বারা আমরা যে শাসনব্যবস্থা নিজেদের অর্পণ করেছি, তার সুস্বাস্থ্য নির্ভরশীল জনতার হাতে সার্বভৌমত্ব থাকার অলঙ্ঘনীয় নীতির উপর। জনতার প্রতিনিধিরা, বা আইন বিভাগ সর্বদা সরকার, বা শাসনবিভাগের উপর নজর রেখে তাকে তাদের এবং সেই সূত্রেই জনতার কাছে দায়বদ্ধ রাখে। অতএব জনতার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এই ব্যবস্থার মাধ্যমেই এবং তার অলঙ্ঘনীয়তা প্রবলভাবে নির্ভর করে জনগণের নিরপেক্ষ তথ্য এবং যথাযথ সংবাদ প্রাপ্তির উপর। সুতরাং, জনগণ যাতে প্রচলিত শাসননীতি সম্পর্কে এবং কার্যকর প্রশাসন কারা পরিচালনায় সক্ষম সেই বিষয়ে যথাযথ বিচার করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তার জন্য সঠিক সংবাদ যথার্থ ভাবে তাঁদের পৌঁছে দিতে চতুর্থ স্তম্ভ তথা সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অতএব, এই বিষয়টি শুধুমাত্র সংবাদমাধ্যম বা চতুর্থ স্তম্ভকে-ই প্রভাবিত করে না, প্রভাবিত করে আমাদের দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎকেও…
এই সময় কথা বলতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা চলে.....
সুতরাং, স্যার, আমার বক্তব্য হল যে নিরপেক্ষ, ছাঁকনি বিহীন এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ অথবা তথ্যের পরিবেশক, এই ভূমিকাতেই সংবাদমাধ্যম-কে দেখতে পাওয়া উচিৎ। এই ভূমিকাকে খুবই গুরুতরভাবে বর্তমানে বিপন্ন করে তুলেছে টাকা দিয়ে সংবাদ কিনে নেওয়ার প্রবণতা। মাননীয় মন্ত্রী বলেছেন যে এটি নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু বর্তমানে যা হচ্ছে তা অবশ্যই একটি সম্পূর্ণ নতুন একটি ঘটনা, কারণ বর্তমানে সংবাদমাধ্যমের প্রচার বহুদূর অবধি পৌঁছয় এবং সংবাদ সংস্থাগুলি কর্পোরেটের হাতে চলে যাওয়ার ফলে এখন এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যেখানে এই ধরণের পয়সা দিয়ে কেনা খবর শুধু একটি মুদ্রণ মাধ্যম অথবা একটি বৈদ্যুতিন মাধ্যমের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং একটি-ই সংস্থার অধীনে থাকছে তাদের নিজেদের মুদ্রণ, বৈদ্যুতিন, বেতার মাধ্যম এবং এই সমস্ত প্রকার মাধ্যম মারফৎ কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের প্রচারের জন্য বিশেষ প্যাকেজের প্রস্তাবও দেওয়া চলছে। আমার মতে এই ঘটনা সংসদীয় গণতন্ত্রকে বহু ভাবে বিকৃত করে :
ক) সংবাদ মাধ্যম আর বস্তুনিষ্ঠ থাকে না এবং তার ফলে গণ-চৈতন্যের বিকৃতি ঘটে।
খ) যাদের এই ধরণের খবর কেনার ক্ষমতা রয়েছে তাদের পক্ষে অন্যায় করার সুযোগ-সুবিধা তৈরি হয়, মানুষের নির্বাচনী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের উপর যার বিকৃত প্রভাব পড়ে।
গ) যারা এসব অপকীর্তিতে অংশ নিতে পারে না তাদের জন্য গণতন্ত্রে সবার যে সমান প্রবেশাধিকারের কথা ভারতীয় সংবিধান বলে সেই নীতি সম্পূর্ণ লঙ্ঘিত হয়ে গণতন্ত্র পরিণত হয় পুতুলনাচে।
এবং,
ঘ) এর দ্বারা অপমান হয় সাংবাদিকতারও।
মহাশয়, আমি এমন সাংবাদিকদের চিনি যাঁরা খুবই সৎ উদ্দেশ্য রাখেন এবং দায়বদ্ধতা দেখান, যাঁরা আমাদের দেশের গণ-নীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এবং রাজনৈতিক দলগুলিকে দেশ ও তার জনতার উন্নতিকল্পে পথ দেখাতে অনবদ্য ভূমিকা পালন করে চলেছেন। এই ধরণের সাংবাদিকদের বর্তমানে এই ব্যবস্থা সম্পূর্ণ উপড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে, সাংবাদিকতাকে রক্ষা করতে হলে জরুরি তাকে কর্পোরেট লাগামের হাত থেকে উদ্ধার করা। এই সভায় আমাদের সাংবাদিক বন্ধুদের বসার যেরকম ব্যবস্থা হয়েছে, তার জন্য বেশির ভাগ সময় আমার পেছনেই তাঁরা কথাবার্তা বলেন। তাঁরা যে সমস্ত ভালো কাজ করে চলেছেন তা মুদ্রণে অথবা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে বহু সময়ই প্রকাশিত হয় না, কারণ কোন খবর প্রকাশিত হবে অথবা কী প্রকাশ করা হবে তা পরিচালিত অথবা নির্দেশিত হয় অন্তরালে থাকা আর্থনৈতিক শক্তির দ্বারা। এই সামগ্রিক বিষয়টি যে নজরে আসছে আমার মনে হয় তার কারণ হল বৃহৎ সংখ্যক মানুষ এই নিয়ে চিন্তিত। মাননীয় মন্ত্রী সঠিক। প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া, এডিটর্স গিল্ড এবং মাননীয় উপ-রাষ্ট্রপতি, সাম্প্রতিক অতীতে অন্তত তিনবার বিবিধ প্রসঙ্গে এর উল্লেখ করেছেন। আমি এমনকী এই প্রসঙ্গে মাননীয় উপ-রাষ্ট্রপতির একটি ভাষণ থেকে উদ্ধৃত করতে পারি যেখানে উনি বলেছেন, “বদলে যাওয়া ও বদলাতে থাকা পৃথিবীতে এ’কথা স্মরণে রাখা কাজের যে একটি গণতন্ত্রে প্রাণ রয়েছে এমন সাংবাদিকতা হল নজরদার সাংবাদিকতা। এই নজর থাকতে হবে রাষ্ট্রের ক্ষমতার প্রয়োগের দিকে এবং তাকে সবসময় খাড়া হতে হবে নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষার্থে। নাগরিকদের তথ্য প্রদান ও তাদের ক্ষমতায়ন এই সাংবাদিকতার কাজ, তাদের মনোরঞ্জন করা অথবা উত্তেজিত করা নয়। প্রাণবন্ত সাংবাদিকতা দাঁড়িয়ে রয়েছে পেশাদারী নৈতিকতার উপর। বর্তমানে এগুলি ব্যতিক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে, অথচ এগুলি-ই নিয়ম হওয়া উচিৎ ছিল।” এই প্রাণচঞ্চল সাংবাদিকতাকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। যদি তা ফিরিয়ে আনতে হয়, তাহলে অর্থের শক্তির এই অবৈধ প্রভাবকে আগে মুছে ফেলতে হবে।
ভারতের নির্বাচন কমিশন মুক্ত ও ন্যায্য নির্বাচনের জন্য অনেক বিধিনিষেধ আরোপ করে থাকে। আমাদের দলের মত দরিদ্র দল দেওয়াল লিখতে পারে না। আমরা পোস্টারও মারতে পারি না, কারণ নির্বাচন কমিশনের মতে তাতে সৌন্দর্যহানি হয়। আমরা রাত ১০-টার পরে দিতে পারি না ভাষণও। কিন্তু ওদিকে ২৪ ঘন্টা ধরে চলা চ্যানেলগুলো সারা রাত জুড়ে আমার প্রতিপক্ষের নির্বাচনী প্রচার কিন্তু করে যেতে পারে, কারণ তার জন্য তারা পয়সা দিয়েছে। সুতরাং, পয়সা দিয়ে কেনা খবর, আদতে ভারতীয় সাংসদীয় গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করে এবং যে সাংবাদিকতাকে বর্তমানে কর্পোরেট লাগাম থেকে উদ্ধার করা প্রয়োজন তার মূলে-ই কুঠারাঘাত করে। সংবাদ সংস্থাগুলির কর্পোরেটকরণ এমন পরিস্থিতির দিকে আমাদের ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে যে তা যদি এখনি না ঠেকানো হয়, তাহলে আমাদের দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রই বিপন্ন হয়ে পড়বে। অতএব, স্যার, আমি মাননীয় মন্ত্রী এবং সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আপনার মাধ্যমে তাদের জানাতে চাই যে এই বিষয়ে শুধু নীতিকথামূলক বকধার্মিক ভাষণ দেওয়াই যথেষ্ট নয়। কিছু করতে হবে। যা প্রয়োজন, তা হল তত্ত্ব-তালাশের গুরুতর প্রচেষ্টা এবং যা ঘটছে সেই সম্পর্কে দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করা।
এখন, সাংবাদিক বন্ধুরা যা বলেছেন এবং মাননীয় মন্ত্রী আমাদের কাছে যে রিপোর্ট পেশ করেছেন তার ভিত্তিতে বলা যায় খুব আলগা হিসেবে শুধু অন্ধ্রপ্রদেশের শেষ নির্বাচনেই এই টাকা দিয়ে খবর কিনতে খরচ করা টাকা হাজার কোটি ছাড়িয়েছে এবং এটা কম করে ধরেই বলা হচ্ছে। মহারাষ্ট্র, যা এই কেনা খবরের আঁতুড়ঘর, সেখানে এই ব্যবসা এখন কয়েক হাজার কোটির। এই কারণেই – অন্য এক প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আমি বলেছিলাম – নির্বাচন হল আমাদের ভারতের একক বৃহত্তম অর্থনৈতিক স্টিমুলাস। ঠিক এই কারণেই আমরা দেখছি বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করা হচ্ছে খবর সম্পূর্ণভাবে বিকৃত করার উদ্দেশ্যে এবং মাননীয় মন্ত্রী তার যে সব উদাহরণ দিয়েছেন আমি সেগুলির আর পুনরাবৃত্তি করছি না।
আমার অভিমত হল, এর একটা দায়বদ্ধতার জায়গা থাকা দরকার। আমি জানি না সেটা কীভাবে নিশ্চিত করা যাবে। কিন্তু একটা উপায় হতে পারে একটি সরকারী প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে অভিযোগের ভিত্তিতে অনুসন্ধানের পর যে সংবাদপত্র অথবা চ্যানেল এই ধরণের কাজ কর্মে লিপ্ত বলে চিহ্নিত হবে, সরকার সেই সংবাদপত্রে অথবা সেই চ্যানেলে আর বিজ্ঞাপন দেবে না। মোট কথা হল, যদি এই কাজ আটকানোর মত কোনও কৌশল না ভাবা হয়, তাহলে আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রে গভীর প্রভাব ফেলা এই বিষয়টিকে পরবর্তীকালে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভবপর হবে না। এ কারণেই আমি চাই না 'বর আর কনে নিজেদের মধ্যে আপস করে নিলে আমরা কী করব! দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতিবিদ রয়েছে, দুর্নীতিগ্রস্থ সংবাদ সংস্থাও রয়েছে আর এরা যদি হাত ধরা ধরি করে চলে, আমাদের কী করার আছে!' ইত্যাদি বলে সরকার হাত তুলে বসে থাকুক। আমাদের এদের পিছনে ধাওয়া করতে হবে, করতে-ই হবে। একে আটকানোর মত কোনো একটা প্রতিবন্ধক খাড়া করতেই হবে এবং সমাজে এর সম্পর্কে সচেতনতাও গড়ে তুলতে হবে।
দয়া করে আমাদের দেশে থাকা বহু সত্যিকারের এবং সৎ অভিপ্রায় রাখা সাংবাদিকরা, যাঁরা কর্পোরেটদের পেশীশক্তির সামনে মাথা নত না করে সত্যিই নিজেদের কাজ করছেন তাদের সাহায্য করুন।
আমি চাই, এ বিষয়ে সরকার কিছু প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ অবশ্যই গ্রহণ করুক।
ধন্যবাদ।
৫ই মার্চ, ২০১০, রাজ্যসভায় বক্তৃতা