সৌরভ গোস্বামী
‘দার্শনিকরা বিভিন্নভাবে দুনিয়াকে কেবল ব্যাখ্যাই করেছেন; কিন্তু আসল কাজ হল একে পরিবর্তন করা।’
কার্ল মার্কস, থিসিস অন ফয়েরবাখ

ফরাসি বিপ্লব: ধর্মান্ধতার উপর যুক্তির জয়
১৭৮৯ সালে বাস্তিল দুর্গের পতন শুধু ফ্রান্সে সামন্ততান্ত্রিক রাজশক্তির পতন নয়, বরং আলোকায়নের যুক্তিবাদের ধর্মীয় কর্তৃত্বের উপর বিজয়ের প্রতীকী মুহূর্ত। এটা ছিল ইতিহাসে এক মৌলিক ছেদ—যখন সাধারণ মানুষের সংগ্রাম রাজাদের ঐশ্বরিক অধিকারের ধারণাকে উচ্ছেদ করে ঘোষণা করল, সার্বভৌম ক্ষমতা জনগণের।
রবসপিয়ের, দিদরো ও রুশোর মতো চিন্তাবিদরা কেবল রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করেননি, তাঁরা সেই চিন্তাভাবনারও বিরোধিতা করেছিলেন যা সমাজের ধর্মীয়, শাস্ত্রভিত্তিক এবং জন্মসূত্র নির্ধারিত অনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসকে স্বাভাবিক বলে মান্যতা দেয়। বিপ্লবের স্লোগান—Liberté, égalité, fraternité—শুধু কথার কথাই নয়, বরং যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে রাজনীতি নির্মাণের প্রচেষ্টা।
যদিও এই বিপ্লবের রাশ শেষপর্যন্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতে চলে যায়, তবুও জ্যাকোবিনদের নেতৃত্বে বিপ্লবের র্যাডিক্যাল পর্যায়ে এমন এক চেতনার জন্ম হয়, যা ভবিষ্যতের প্রলেতারীয় বিপ্লবের বীজ রোপণ করে—ধর্মনিরপেক্ষতা, সমতা এবং সর্বজনীন মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে, ফরাসি বিপ্লব ছিল দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী ইতিহাসবোধের প্রাথমিক প্রতিফলন— যেখানে সমাজ ও রাষ্ট্রের কাঠামোকে পরিবর্তনযোগ্য, মানব ইতিহাসের অংশ ও শ্রেণিসংগ্রামের মাধ্যমে রূপান্তরযোগ্য হিসেবে দেখা হয়।
আলোকায়নের উত্তরাধিকার: সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে প্রগতিশীল সংবিধানবাদ
যদিও ফরাসি বিপ্লব সমাজতন্ত্র আনতে পারেনি, কিন্তু তা আধুনিক শ্রেণিচেতনার বীজ বপন করেছিল। মানব যুক্তি ও সমতার প্রতি আলোকায়নের দায়বদ্ধতা পরবর্তী কালে মার্ক্সবাদী ধারা দ্বারা আরও গভীর ও বিস্তৃত হয়। মার্ক্স নিজে যদিও বুর্জোয়া আলোকায়নের “অবাস্তব অধিকার”-সমূহের সমালোচক ছিলেন, তবুও তিনি বুঝেছিলেন—ফিউডাল মিস্টিসিজমের সাথে তার বিরোধিতা ছিল প্রলেতারীয় বিপ্লবের পূর্বশর্ত।
আলোকায়ন ছিল দ্বি-মুখী অস্ত্র: একদিকে এটা বুর্জোয়া শ্রেণির উত্থানকে যুক্তির মোড়কে বৈধতা প্রদান, অপরদিকে তা সেই যুক্তির ভিতরেই সমাজতান্ত্রিক চেতনার বীজ বপন। প্যারি কমিউন, বলশেভিক বিপ্লব, কিংবা এশিয়া-আফ্রিকার ঔপনিবেশিক মুক্তি আন্দোলন—সবখানেই আলোকায়নের প্রগতিশীল ধারা বিজ্ঞানমনস্কতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং শোষণহীন সমাজব্যবস্থার সংগ্রামের মধ্যে বিদ্যমান ছিল।
ভারতের প্রেক্ষিতে, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও বিজ্ঞানমনস্কতার প্রতিশ্রুতি সেই আলোকায়নের উত্তরাধিকারকেই আংশিকভাবে ধারণ করে। আম্বেদকর-এর জাত-বিরোধী যুক্তিবাদী সংগ্রাম এবং নেহরুর আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক উন্নয়নের প্রতি বিশ্বাস, দুটোই সেই প্রগতিশীলতাই প্রতিফলিত করে।
কিন্তু এই সাফল্যগুলি ছিল পলকা। বিপ্লবী ফ্রান্সের মতো ভারতে সামন্ততন্ত্র ও ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার সাথে পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটেনি। জাতভিত্তিক হিন্দু ধর্মতন্ত্রকে জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি বরং আঁকড়ে ধরে রাখে। আজকের পাল্টা দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়ার/ধাঁচের 'পপুলিজম'এর বাড়বাড়ন্ত এই আপসেরই ফল।
বিশ্বজুড়ে দক্ষিণপন্থী পাল্টা বিপ্লব: যুক্তি থেকে পশ্চাৎপসরণ
আজকের বিশ্বে আমরা এমন এক পাল্টা বিপ্লবের মুখোমুখি, যেখানে আলোকায়নের মূল্যবোধকে এক সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে। ট্রাম্পের শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ, বলসোনারোর ধর্মীয়-মিলিটারিজম, ভিক্টর অরবান-এর খ্রিস্টান জাতিবাদ, এবং মোদীর হিন্দুত্ব—সবকিছু এক বৃহত্তর প্রবণতার অংশ: যুক্তি থেকে পশ্চাৎপসরণ, সাধারণতন্ত্র থেকে বর্ণবাদের দিকে যাত্রা।
এই প্রবণতা কাকতালীয় নয়—এর শিকড় নিহিত পুঁজিবাদের গভীর সংকটে। বাজারমুখী মুক্তবাণিজ্যের নামে পরিচালিত বিশ্বায়ন “স্বাধীনতার” প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল; বাস্তবে এনেছে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, বৈষম্য ও পরিবেশ ধ্বংস। বিকল্প বিপ্লবী পথ অনুপস্থিত থাকায়, শাসক শ্রেণি গণবিক্ষোভের মোড় ঘোরাতে ধর্মীয়, জাতীয় ও জাতিগত চেতনার উপর ভরসা রাখছে।
আজকের তথাকথিত “পোস্ট-ট্রুথ” যুগে যুক্তি, ইতিহাস ও বিজ্ঞানকে প্রতিস্থাপন করেছে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব, মিথ্যাচার ও অজ্ঞতা। রাষ্ট্র আর যুক্তির প্রতিনিধি নয়—বরং বিশ্বাসের। বিশ্বাস রাষ্ট্রনেতার প্রতি, বিশ্বাস জাতির শ্রেষ্ঠত্বে, বিশ্বাস অতীতের অলৌকিক ইতিহাসে।
বাস্তিলের পতনে মানুষ মুক্তি পেয়েছিল অন্ধকার চিন্তার বন্ধন থেকে। আজকের বুলডোজারসমূহ সেই স্বাধীনতাকে ছিন্ন করে দমন ও নিপীড়ন- ডার্ক এজ-এর প্রতীক হয়ে উঠেছে।
ভারতের অন্ধকার পর্ব: মোদীর শাসনে আলোকায়নের অবসান
এই পাল্টা-আলোকায়ন প্রকল্পের সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ বর্তমান ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা। হিন্দুত্ব আদতে ব্রাহ্মণ্যবাদী জাত্যন্ধতা এবং ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদের ঔপনিবেশিক নকল—যা ভারতীয় সংবিধানকে ধ্বংস করে এক জাতি-এক ধর্ম-এক ভাষা রাষ্ট্র নির্মাণে লিপ্ত।
মোদী শাসনকালে আলোকায়নের উপর আঘাত এসেছে বহু দিক থেকে:
* ইতিহাস বিকৃতি: পাঠ্যবই থেকে মুঘলদের অবদান মুছে ফেলা, আম্বেদকরের বিদ্রোহী ভাবধারাকে লঘু করা, এবং পৌরাণিক কল্পকাহিনিকে ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে প্রচার করা—এসবই শিক্ষার নামে রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্র।
* অপবিজ্ঞানের প্রচার: প্রাচীন ভারতে বিমান ও স্টেম-সেল প্রযুক্তির মতো দাবি করে বাস্তব বৈজ্ঞানিক অনুশীলনকে উপহাসে পরিণত করা হচ্ছে।
* আইনের বাইরে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস: গোরক্ষার নামে গণপিটুনি, মুসলিমদের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া, "অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড"—এসব মিলে তৈরি হয়েছে একটি সমান্তরাল ফ্যাসিস্ট আইনব্যবস্থা।
* অসন্তোষ দমন: সাংবাদিক, ছাত্র, শিক্ষক সবাইকে “দেশদ্রোহী” আখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রীয় দমননীতির শিকার করা হচ্ছে।
আজকের ভারত যেন বিপ্লবপূর্ব ফ্রান্স—যেখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, ধর্মীয় কর্তৃত্ব ও শ্রেণিবিশেষের স্বার্থ পরস্পরে একীভূত। ব্রাহ্মণ্যবাদ রাষ্ট্রধর্ম হয়ে উঠেছে; কর্পোরেট পুঁজিপতি হয়ে উঠেছে নতুন সামন্ত।
এখানে রাষ্ট্র বুলডোজার চালায় শুধু নির্মাণের জন্য নয়, বরং দমন-পীড়নের দৃশ্যমান প্রতীক হিসেবে—ভিন্নমত, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও দরিদ্র মানুষের উপর খাঁড়া হয়ে।
বিপ্লবী আলোকায়নের পুনরুদ্ধার: এক নতুন অভিযাত্রার ডাক
এই চরম প্রতিক্রিয়াশীল যুগে, মার্ক্সবাদ কী বলছে? আমরা কেবল “গণতন্ত্রের” প্রতি নস্টালজিক হয়ে ফিরতে পারি না। ফ্যাসিবাদ কোনও বিচ্যুতি নয়—এটি পুঁজিবাদের সঙ্কটকালীন আত্মরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়া।
আমাদের দরকার এক নতুন প্রলেতারীয় আলোকায়ন—যা যুক্তিকে অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড় করাবে, বিজ্ঞানের পক্ষে দৃঢ় থাকবে, এবং ভ্রাতৃত্ববোধকে জাতি-ধর্ম-জাতপাতের বিভেদে প্রতিস্থাপনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে।
ভারতের প্রেক্ষিতে এই আলোকায়ন হতে হবে জাত-বিরোধী সংগ্রামের ভিতরে, আম্বেদকরের বিদ্রোহী মানবতাবাদে, এবং শ্রেণি-জাতির যৌথ দ্বান্দ্বিক বিশ্লেষণের ভিতর দিয়ে।
প্রতিবাদের অঙ্কুর ইতিমধ্যেই গজিয়ে উঠেছে:
* কৃষক আন্দোলন কর্পোরেট দখলের বিরুদ্ধে কৃষক শক্তির সংগঠিত অভ্যুত্থান;
* জেএনইউ, জামিয়া ও আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন প্রতিরোধের প্রগতিশীল কণ্ঠ;
* শাহীনবাগ ও CAA বিরোধী গণআন্দোলন সংবিধাননির্ভর বহুত্ববাদী চেতনার শক্তি।
তবে এই বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধকে দিতে হবে বিপ্লবী দিশা, শ্রেণিসংগ্রামের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা।
মার্ক্স আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন: ইতিহাস মানুষ নিজেই নির্মাণ করে, যদিও নিজের পছন্দের পরিবেশে নয়।
বাস্তিল ভাঙা হয়েছিল জনতার হাতে, আজ বুলডোজার চালায় রাষ্ট্র
বাস্তিল ধ্বংস হয়েছিল মানুষকে মুক্ত করার জন্য; আজ বুলডোজার চালানো হচ্ছে মানুষকে দমন করতে। ইতিহাসের এই বিপরীতগামী মোড় সত্ত্বেও, দ্বান্দ্বিকতা রয়ে গেছে।
প্রতিটি প্রতিবাদী আওয়াজে, প্রতিটি মুক্ত চিন্তায়, প্রতিটি বিজ্ঞানমনস্ক উদ্যোগে রবসপিয়েরের সেই কথারই পুনরুক্তি হয়- ‘স্বাধীনতার গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে শিক্ষায়; আর স্বৈরতন্ত্রের রহস্য অজ্ঞতা রক্ষা করায়।’
আমাদের কাজ স্পষ্ট: আলোকায়নের বিলাপে ভেসে না গিয়ে, তাকে নতুন করে চিনতে হবে, শ্রেণিসংগ্রামের মাধ্যমে বাস্তবায়িত করতে হবে, ও যুক্তি ও মানবতার পতাকা তুলে ধরে নতুন পথ নির্মাণ করতে হবে।