১৭ অক্টোবর ২০২২, সোমবার
প্রথম পর্ব
আমরা জানি, সোভিয়েত রাশিয়ায় বিপ্লব হবার পরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়েছিল।
এখানে প্রাসঙ্গিক কিছু পুর্ব কথা বলি। কার্ল মার্কস ও ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস দিগদিশারী ‘কমিউনিস্ট ইস্তেহার’ লেখার আগেই ১৮৪৭ সালে ‘কমিউনিস্ট লিগ’ গঠন করেন। আর ১৮৬৪ সালে গঠন করেন ‘কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম আন্তর্জাতিক’।
তখন ভারতেও নবগঠিত পুঁজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হয়েছে। হাওড়ায় রেল শ্রমিকদের ধর্মঘটও হয়ে গিয়েছে ১৮৬২ সালে। সেসবের সংবাদ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিতও হয়েছে।
১৮৭১ সালে এক অজ্ঞাতনামা কলকাতাবাসী, এখানে প্রথম কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের শাখা খোলার জন্য চিঠি লিখেছিলেন। ১৮৭১ সালের ১৫ই আগস্ট কার্ল মার্কসের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সভায় সেই চিঠি পাঠ করা হয়। “The Secretary was instructed to write and advise the establishment of a branch, but he is to inform the writer that it must be self-supporting. He was also to urge the necessity of enrolling natives in the Association.” – From the minutes of the meeting of the General Council of the First International held on August 15, 1871. ভারতের প্রথম সচিত্র শ্রমিক পত্রিকা ‘ভারত শ্রমজীবী’র প্রকাশনা কলকাতায় ১৮৭৪ সালের মে মাস থেকে শুরু হয়। তার সম্পদক শশীপদ বন্দোপাধ্যায় ঐ প্রস্তাবটির প্রেরক বলে অনেকের ধারণা।
আমরা জানি, ১৯০৫ সালে রুশদেশে একটি বিপ্লব হয়েছিল। যা ছিল ১৭১৭ সালের বিপ্লবের ভিত্তি। তখন বাংলার অনেকগুলি পত্রিকায় তা নিয়ে লেখা হয়। যেমন, দ্য বেঙ্গলী, দ্য ইংলিশম্যান, বিজলী, মাসিক ঊষা, প্রবাসী ইত্যাদি।
১৯০৮ সালে তিলকের কারাদণ্ড, তার বিরুদ্ধে বোম্বাই শ্রমিকদের সাধারণ ধর্মঘটের সংবাদ পেয়ে, লেনিন সুইজারল্যাণ্ডে নির্বাসিত অবস্থায় থেকে যা লিখেছিলেন, তা নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় উল্লেখ করছি – “ভারতবর্ষে শ্রমিক শ্রেণীও এরই মধ্যে সচেতন, রাজনৈতিক গণসংগ্রামের স্তরে উঠেছে। আর তাই যদি হয়, তবে ভারতে রুশী ঢং-এর বৃটিশ রাজত্বের দিন খতম হয়ে এল।” ( ‘বিশ্ব রাজনীতিতে দাহ্য উপাদান’, আগস্ট, ১৯০৮)
আর ১৯১৭ সালের পর তো অনেক পত্রিকাতেই লেখা প্রকাশিত হয়। অনেক পুস্তকও লেখা হয় বাংলা প্রদেশে। বেশিরভাগই প্রসস্তি। দেবব্রত ভট্টাচার্যের সমাকালীন ‘বাঙালির দৃষ্টিতে সোভিয়েত দেশ’ পুস্তকটি পাঠ করলে এসব বিস্তৃত জানা যাবে। ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও চর্চা হয়েছিল, বলা বাহুল্য।
অন্যদিকে ব্রিটিশরাজ কী বসে থাকতে পারে!। বলা বাহুল্য, কখনোই না। সোভিয়েত বিপ্লব হবার সময় ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার ভারতের বিষয়ে মন্ত্রী মন্টেগু। তাঁর সঙ্গে ভারতের বড়লাট চেমস ফোর্ডের পরামর্শ হলো। ঠিক হলো, রাশিয়ার খবর যাতে এ দেশে আসতে না পারে- তার জন্য কড়াকড়ি করতে হবে। তাই ই হলো। সেই সঙ্গে লেনিন সহ বিপ্লবের অন্যান্য নেতাদের বিরুদ্ধে চালানো হতে থাকলো বেপরোয়া কুৎসা। কুৎসার মূল প্রচারক দ্য স্টেটসম্যান।
২
সোভিয়েত রাশিয়ার বিপ্লবের আগে-পরে ভারতের কোন কোন স্বাধীনতাকামী ইউরোপ–আমেরিকা-এশিয়ায় ছড়িয়ে পরেছিলেন।
এরকমই একজন নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ভারত থেকে আমেরিকা, আমেরিকা থেকে মেস্কিকোতে গিয়ে, বোরিয়া নামে এক রাশিয়ান বিপ্লবীর সহযোগে কমিউনিস্ট পার্টিতে এলেন। তাঁর নাম এখন হলো মানবেন্দ্রনা রায়। সেরকমকই আরেকজন অবনীন্দ্রনাথ মুখার্জী হলাণ্ড এলেন। রুটগ্রেস নামে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের ওয়েস্ট ইউরোপিয়ান ব্যুরোর একজন সদস্যের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হলো, তিনিও কমিউনিস্ট পার্টিতে এলেন। প্রথম জনের আমেরিকান এভিলিনা ট্রেণ্ড আর দ্বিতীয় জনের রাশিয়ান রোজা ফিটিংগফের সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল। এঁরা সবাই মস্কোতে অনুষ্ঠিত ১৯২০ সালের ১৯শে জুলাই হতে ৭ই আগস্ট পর্যন্ত চলা কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে প্রতিনিধি হয়ে এলেন।
অন্যদিকে মুহম্মদ আলী লাহোরের মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছিলেন। তিনি অনেক আগেই নিজেকে কমিউনিস্ট বলে দাবি করেছিলেন। আর একজন ছিলেন মুহম্মদ শফীক, পেশোয়ার জেলার নৌশহরা তহসীলের অন্তর্গত আকোয়ারের বাসিন্দা। ১৯১৯ সালের রাওলাট বিলের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে কাবুলে চলে যান। সেখানে আত্মগোপনে থাকা বলশেভিকদের সঙ্গে তাঁর সংযোগ হয় এবং সেখান থেকে তাসখন্দে যান।
ব্রিটীশ বিরোধী রাজনৈতিক কার্য-কারণে দেশ ছাড়েন ১৯১৯ সালে এম প্রতিবাদী বায়াংকর আচার্য্য, আসলে মহিসুরের বাসিন্দা, কিন্তু অনেকদিন ধরে মাদ্রাজে বাস করছিলেন। কোন বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। লণ্ডনে পড়াশুনার জন্য এসে বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলেন। তারপর ফরাসি দেশ হয়ে রুশ দেশ - লেনিনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাত করে, তিনি আসেন কাবুলে।
কাবুলের পাশেই তুর্কিস্তান। সোভিয়েত ভূমি। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার অন্তভূক্ত হলেও, তখনও আলাদা আলাদা প্রদেশ হয় নি। পরে উজবেকিস্তান গঠিত হয়। তারই রাজধানী তাসখন্দ।
তখনকার ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম দিকের এলাকাগুলো কাবুলের পাশে। আর কাবুলের পাশে সোভিয়েত। অনেক মুহাজীর (আত্মনির্বাসিত) যুবক, ব্রিটিশ ভারত থেকে বেরিয়ে অনেক কষ্ট করেই শেষ পর্যন্ত তাসখন্দে আসতেন। এখানকার বুখারার একটা বাড়িতে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা হতো। তাঁরা সামরিক ও রাজনৈতিক ট্রেনিং নিতে শুরু করে দিলেন।
অনেক সংখ্যক ভারতীয়ের ভিড় এখানে। তাই এখানেই কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের অনুজ্ঞা নিয়ে, তুর্কিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির তত্বাবধানে, আগে পরে পৌঁছে, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুললেন, ১৭ই অক্টোবর, ১৯২০ সালে - ১। এম এন রায় ২। এভেলিনা ট্রেণ্ট রায় ৩) অবনী মুখার্জী ৪) রোজা ফিটিংগফ, ৫) মুহম্মদ আলী (আহমদ হাসান) ৬) মুহম্মদ শফীক সিদ্দিকী ও ৭) এম প্রতিবাদী আচার্য। মুহম্মদ শফীক নির্বাচিত হলেন সম্পাদক। সভার সভাপতি হয়েছিলেন – এম আচার্য।
কতগুলো রেজেলিউশন হল – প্রার্থীসভ্য করা হবে, প্রার্থী সভ্য হিসাবে থাকার মেয়াদ হবে তিন মাস।
এই ঘোষণাটি লিপিবদ্ধ হলো – “ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তৃতীয় আন্তর্জাতিকের বিঘোষিত নীতির অনুসরণ করবে এবং ভারতের অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে একটা প্রোগ্রামও রচনা করবে“। সাক্ষর করলেন দুজন – এম আচার্য ও এম এন রায়।
”সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো যে, আব্দুল কাদির সেহরাই, মসউদ আলি শাহ কাজী ও আকবর শাহ পার্টির প্রার্থী সভ্য হলেন।
রায়, শফীক ও আচার্যকে নিয়ে পার্টির একটি কার্যকরী কমিটি গঠিত হলো।“
পরে তাসখন্দের ঘাঁটি কুটনৈতিক কারণে তুলে মস্কোতে নিয়ে যাওয়া হয়। পার্টির কর্মকর্তা ও মুহাজীর হিসাবে যাঁরা এসে পার্টি কর্মীতে রূপান্তরিত হচ্ছিলেন, সকলে সেখানে গিয়ে ইণ্ডিয়া হাউসে থাকতে লাগলেন, এসিয়ার অন্তর্গত সোভিয়েত রাশিয়ার অন্যান্য প্রদেশের কমরেড সহ।
ওপাশে জার্মানীর বার্লিনে ভারতের কিছু কমরেড আছেন। মস্কো থেকে এঁদেরও কেউ কেউ সেখানে যাতায়াত করেন। ওখানে একটা ঘাঁটি গড়ে উঠল ভারতের কমিউনিস্টদের। ভারতবাসী কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করাও সুবিধাজনক হলো তাতে।
কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের পরামর্শে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কাজ কিছু কিছু চলতে লাগলো সেখান থেকে। ১৯২২ থেকে প্রয়োজনীয় সতর্কতার কারণেই, মাঝে মাঝে নাম বদলে বদলে, প্রবাশের ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা প্রকাশিত হয়ে চলল, দি ভ্যানগার্ড অব দি ইণ্ডিয়ান ইণ্ডিপেণ্ডেন্টেস, এডভান্স গার্ড, দি ভ্যানগার্ড।
৩
ঐ পার্টির পক্ষ থেকেই কমরেড লেনিন ও কমরেড স্তালিনকে দেখিয়ে নিয়ে, এম এন রায় ও অবনী মুখার্জীর নামে ১৯২১ সালের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের গুজরাটের ৩৬ তম আহমেদাবাদ অধিবেশনে ইস্তেহার বিলি করা হয়, কমিউনিস্ট মওলানা হসরত মোহানী অধিবেশনেই পরিপূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। পরের বছর গয়ায় অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনের জন্য কর্মসূচি লিখে পাঠান এম এন রায়। ঐ অধিবেশনের প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে কমিউনিস্ট ইন্টার ন্যাশনালের চতুর্থ কংগ্রেস একটি বানী পাঠিয়েছিলেন। সেগুলি গোপনে বিলি করা হতো। এসব প্রচারে ব্যাপক আলোড়ণ সৃষ্টি হয়েছিল। মেহনতির স্বাধীনতা কথাটাই তার আগে পর্যন্ত ছিল বাতুলতা। সেই অসাধ্য সাধনই করলেন কমিউনিস্টরা। একটা দিশার মতো দিশা দেখালেন।
কর্মসূচী ও বানী একত্রে পাঠ করলে বোঝা যায়, এই দলিলগুলি রচিত হয়েছিল মার্কসীয় দর্শন, অর্থনীতি তথা মতাদর্শকে ভিত্তি করেই। ভারতে তখন যে দ্বন্দ্বগুলি বিরাজ করছিল, কোন দ্বন্দ্বটিকে আশু সমাধান করতে হবে, তারও চ্ছটা দেখাতে পাওয়া যায় দলিলগুলিতে। সেগুলি পড়লে এখনো রোমাঞ্চ সৃষ্টি হয়।
উল্লিখিত পত্রিকাগুলি ও জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনের জন্য বড় লেখা গুলি কোন মামুলি ব্যাপার ছিল না। এই কথাটা আমাদের মনে রাখতে হবে। সহজ লভ্য এসবের পাঠ এখন পাওয়া যায়। সেগুলো যাঁরা পড়েন নি, তাঁদের পড়ে নিতে অনুরোধ করি।