Taste-Of-Cherry

ইরানি সিনেমা: দেখার পরের দেখার জন্মদাতা

শৌনক সরকার

একটি শিশুর চোখের দিকে তাকান। কী দেখছেন? শুধুই সদ্য পৃথিবীকে দেখার কৌতূহল? নাকি সমাজের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক নির্মম বাস্তবতা? ইরানি সিনেমা ঠিক এই প্রশ্নগুলোকেই তুলে ধরে—অন্তর্মুখী, নীর পন্থায়। অথচ তীব্র প্রতিবাদের ভাষায়। যেখানে শব্দ অনুপস্থিত। ফ্রেমই সর্বস্ব জাঁকজমক বিলীন হয়ে আছে অনুভব। এই অনুভব এতটাই মানবিক, এতটাই অন্তরঙ্গ যে, একবার যার সংস্পর্শে এলে তা দগদগে ছাপ রাখে।

ইরানি সিনেমা নিছক কোনো ন্যাশনাল সিনেমা নয়। এটি এক ধরনের চলচ্চিত্র-দর্শন, যা সংযম, প্রতীক, বাস্তবতা এবং নৈতিক সংকটকে একসঙ্গে মিশিয়ে তৈরি করে এক অনন্য ভাষা—যেখানে দর্শককে ভাবতে হয়, যেখানে দেখার শেষের ক্ষণ থেকে আসল দেখার জন্ম।

শুরুর কথা 

ইরানে সিনেমার আবির্ভাব বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে যখন রাজা মুজাফফরউদ্দিন শাহ ইউরোপ সফর থেকে ফিল্ম ক্যামেরা আনেন। এরপর কয়েক দশক ধরে গড়ে ওঠে একটি বাণিজ্যিক ধারা। এর বেশিরভাগই ছিল পশ্চিমা ধাঁচের গান-বাজনা নির্ভর এবং মধ্যবিত্ত শহুরে দর্শকের জন্য তৈরি।

তবে ১৯৬০-এর দশকে একদল চলচ্চিত্র নির্মাতা সেই একঘেয়ে ধারার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে গড়ে তোলেন Iranian New Wave। এই নতুন নির্মাতারা বাস্তব, সাহিত্য, কবিতা ও দার্শনিক প্রশ্নকে মিশিয়ে এমন এক চলচ্চিত্র ভাষার জন্ম দেন, যা শৈল্পিকভাবে মানবিকতাকে তুলে ধরেন।

তাঁদের মধ্যে ছিলেন দারিউশ মেহরজুই, ফরখান্দে গাফারী, নাসের তাগভাই এবং পরে আব্বাস কিয়ারোস্তামি—যাঁদের কাজ শুধু ইরান নয়, বিশ্ব চলচ্চিত্রের ভাষাকেই পাল্টে দেয়।

ঘেরাটোপে শিল্প

১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লব ইরানকে একেবারে নতুন সামাজিক কাঠামোয় নিয়ে আসে। নতুন সরকার চলচ্চিত্র শিল্পে আরোপ করে কড়া বিধিনিষেধ—নারীর পর্দা বাধ্যতামূলক, প্রেম-ভালোবাসার প্রকাশ সীমিত, পুরুষ-নারীর সংলাপ নিয়ন্ত্রিত। এই কঠোর সেন্সরশিপ অনেক নির্মাতার পা আটক দিয়েছিল। কিন্তু যে পৃথিবীতে বুরবো রাজাদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রুশো লিখেছেন ‘সোশ্যাল কনট্র্যাক্ট’, কাজী নজরুল ইসলাম বলতে পারেন,’যত সব বন্দিশালায় আগুন জ্বালা’ , সে পৃথিবীতে সেন্সর আটকাতে পারে না শিল্পকে, যে শিল্প মানুষের কথা বলে।

তাই চিত্র পরিচালকেরা সরাসরি কিছু না বলে গল্প বলতে চাইলেন—শুধু ছবি, প্রতীক ও ফ্রেম ব্যবহার করে। এই সময়ে নির্মিত সিনেমাগুলো হয়ে ওঠে বোবা উচ্চারণ—যেখানে শব্দ হয়তো নেই, কিন্তু বোধ আছে।

প্রতীকী সিনেপৃথিবী 

ইরানি সিনেমার অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রতীকময় ফ্রেম। এক কাপ চা, বন্ধ দরজা, রাস্তার বাঁক, কিংবা একজোড়া ছেঁড়া জুতো—এসব সাধারণ জিনিস হয়ে ওঠে সিনেমার প্রাণ। এই প্রতীক ব্যবহারে সবচেয়ে দক্ষতা দেখিয়েছেন আব্বাস কিয়ারোস্তামি, মজিদ মাজিদি, জাফর পানাহি ও সামিরা মখমালবাফের মতো নির্মাতারা।

শিশুদের চোখ দিয়ে সমাজকে দেখানোর এই কৌশল বারবার ব্যবহৃত হয়েছে, কারণ শিশু চরিত্র সেন্সরের বাইরে। কিন্তু তার সরলতা দিয়ে নির্মাতা সমাজের জটিলতা প্রকাশ করতে পারেন।

একটি ক্লাসিক উদাহরণ— ‘Children of Heaven’ (মজিদ মাজিদি)। এক ভাই-বোনের জুতো হারানোর গল্প এখানে হয়ে ওঠে দারিদ্র্য, ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধের গল্প। আবার ‘Where Is the Friend’s Home?’ ছবিতে আব্বাস কিয়ারোস্তামি দেখিয়েছেন, কেবল বন্ধুকে খাতা ফেরত দিতে চাওয়ার মধ্যে কীভাবে সমাজ, নৈতিকতা এবং কর্তব্যবোধের প্রশ্ন উঠে আসে।

চুপভাষার জাতকেরা 

আব্বাস কিয়ারোস্তামি ইরানি সিনেমাকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, তা আজ বিশ্ব চলচ্চিত্রে এক অনুপ্রেরণা। তিনি ছিলেন কবি, চিত্রগ্রাহক, দার্শনিক—একই সঙ্গে। তাঁর সিনেমাগুলোতে কোনো নাটকীয় মোচড় নেই। নেই তীব্র সংলাপ। বদলে আছে নীরবতা, দীর্ঘ ফ্রেম, মানুষের হাঁটাচলা, প্রকৃতির অনুরণন।

‘Taste of Cherry’ ছবিতে এক ব্যক্তি আত্মহত্যা করতে চায় এবং খুঁজতে থাকে এমন কাউকে, যে তাকে মৃত্যুর পর কবর দেবে। এই একটি গল্পকে কিয়ারোস্তামি এমনভাবে তৈরি করেন, যেখানে আত্মহত্যার ভাবনা, জীবনের অর্থ এবং মৃত্যু-পরবর্তী মর্যাদা এক সুতোয় বাঁধা।

তাঁর আরেকটি ছবি ‘Close-Up’—বাস্তব ঘটনার পুনর্নির্মাণ, যেখানে একজন সাধারণ মানুষ নিজেকে বিখ্যাত নির্মাতা বলে পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করে। সিনেমাটি আমাদের প্রশ্ন করে—সিনেমা ও বাস্তবের মধ্যে কে কাকে অনুকরণ করছে?

কিয়ারোস্তামির ক্যামেরা চলন্ত গাড়ির ভেতর বসে থাকে, চরিত্রদের অনুসরণ করে, যেন দর্শকও তাদের সঙ্গে পথচলা শুরু করে। এই ‘রোড সিনেমা’ ঘরানায় তাঁর ভূমিকা বিশ্ব চলচ্চিত্রে অনন্য।

মজিদ মাজিদির সিনেমা দেখতে বসলে মনে হয়,‌একটি কোমল কবিতার ভেতর ঢুকে পড়েছি। তাঁর চলচ্চিত্রে নেই উচ্চ চিৎকার, নেই রাজনৈতিক স্লোগান। তবুও একটি ক্ষুধার্ত শিশুর দৃষ্টি, একটি বোনের না বলা অভিযোগ, কিংবা এক পিতার অব্যক্ত লজ্জা যেন হয়ে ওঠে গভীর প্রতিবাদের ভাষা।

‘Children of Heaven’ (১৯৯৭) ছবিতে এক ভাই-বোন একটি জুতো ভাগ করে পরার মাধ্যমে শুধু দারিদ্র্য নয়, বরং ভাইবোনের পারস্পরিক নির্ভরতা, দায়িত্ববোধ এবং ভালবাসার দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়েছে। দর্শক প্রথমে হাসে, পরে চুপ করে যায়, তারপর কাঁদে—কিন্তু সেই কান্না করুণা থেকে জন্ম নেয়নি। তা আসে সহানুভূতি থেকে, সমানুভূতি থেকে।

মজিদির আরেকটি শক্তিশালী চলচ্চিত্র ‘The Color of Paradise’—এক অন্ধ শিশুর জীবনের গল্প। শিশুটি বোঝে প্রকৃতির রঙ, কিন্তু সমাজ ও তার বাবার চোখে সে এক বোঝা। এই দ্বৈত মানসিকতা, ভালবাসা ও প্রত্যাখ্যানের দ্বন্দ্ব মজিদি তুলে ধরেছেন সুনিপুণভাবে, যেখানে ঈশ্বরের উপস্থিতিও প্রতীকীভাবে বিদ্যমান।

মজিদির সিনেমায় ধর্ম ও মানবতা হাত ধরাধরি করে চলে। তিনি বলেন, ঈশ্বর আছেন প্রতিটি শিশুর কান্নায়, প্রতিটি দৃষ্টিহীনতার আলোয়।

যেখানে কিয়ারোস্তামি ও মাজিদি ছিলেন প্রতীকধর্মী নির্মাতা, আসগর ফরহাদি সেখানে আত্মাকে ভেঙেছেন। তাঁর সিনেমাগুলো শহরের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত সমাজকে কেন্দ্র করে গঠিত, যেখানে প্রতিটি চরিত্রই একেকটি নৈতিক দ্বন্দ্বে জর্জরিত।

‘A Separation’ ছবিতে একজন নারী স্বামীকে ছেড়ে যেতে চায়, কারণ সে চায় বিদেশে মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য বসবাস করতে। কিন্তু বৃদ্ধ শ্বশুরকে ছেড়ে যেতে চায় না স্বামী। এরপর পারিবারিক সমস্যার মধ্যে প্রবেশ করে ধর্ম, শ্রেণি, লিঙ্গভিত্তিক বিভাজন এবং নৈতিক দ্বিধা।

এই ছবিতে কোনো ‘ভিলেন’ নেই, জীবনের মতোই কোনো চালুনিতে ফেলে বাছা যায় না  ন্যায়-অন্যায়। সবাই নিজের জায়গা থেকে ঠিক—এবং তাতেই তৈরি হয় এক অনিশ্চিত, অস্থির বাস্তবতা। ফরহাদি আমাদের কোনও উত্তর দেন না। বরং প্রশ্ন করেন—আপনি হলে কী করতেন?

‘The Salesman’ ছবিতে একটি দম্পতির মধ্যে তৈরি হয় অবিশ্বাস ও সামাজিক অপমানের সংঘাত, যা ধীরে ধীরে সম্পর্ককেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। এইসব গল্পের মাধ্যমে ফরহাদি তুলে ধরেন পুরুষতন্ত্র, নৈতিকতা এবং আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্ব।

ইরানের সিনেমায় নারী

ইরানে নারীর সিনেমা করা এক চ্যালেঞ্জ। কারণ সেখানে নারীর শরীর, সংলাপ এমনকি উপস্থিতি পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত। তবু এর মধ্যেও অনেক মহিলানির্মাতা সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন।

সামিরা মখমালবাফ মাত্র ১৭ বছর বয়সে ‘The Apple’ নামের চলচ্চিত্র বানান। বাস্তব কাহিনির ভিত্তিতে তৈরি  এই ছবি দুই বোনের গৃহবন্দি জীবনের গল্প, যারা বারো বছর ধরে কখনও ঘর ছেড়ে বেরোয়নি। কিন্তু একদিন, একটি আপেলের লোভে তারা জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখে বাইরের জগৎ।

‘Offside’ (জাফর পানাহি) ছবিতে নারী ফুটবলপ্রেমীরা ছেলেদের ছদ্মবেশে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করে ম্যাচ দেখতে চায়। এই হাস্যরসাত্মক, অথচ তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক সিনেমা আমাদের বলে—নিয়ম যতই কড়া হোক, নারীর কণ্ঠ কখনও চাপা পড়ে না।

এইসব চলচ্চিত্রে নারী চরিত্র শক্তিশালী, নীরব কিন্তু দৃঢ়। তারা নিজেদের জন্য নিজেদের পাশে দাঁড়ায়, প্রশ্ন তোলে সমাজের কারাগারকে উপেক্ষা করে।

স্বীকৃতি: পুরস্কারে ও মানবমননে

ইরানি সিনেমা কেবল শিল্পমানেই নয়, মানবিক স্পর্শে বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে স্থায়ী আসন তৈরি করেছে। ১৯৯৭ সালে ‘Taste of Cherry’ কানে ‘Palme d’Or’ জিতে নেয়। ২০১১ ও ২০১৭ সালে আসগর ফরহাদির ‘A Separation’ এবং ‘The Salesman’ দুটি অস্কার পায় সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে।

তবে পুরস্কারই সব নয়। শিল্পের আসল ঝলমলানি মানুষের মনে রয়ে যাওয়ায়। ইরানি সিনেমা যেটা করেছে তা হলো—দর্শককে নতুন করে ভাবতে শেখানো। তারা দেখিয়েছে—অল্প বাজেটে, সীমিত সংলাপে, এবং সেন্সরের ভিতরে থেকেও একটি সিনেমা কীভাবে দর্শকের মনের ভেতরে আলোড়ন তুলতে পারে।

ইরানি সিনেমা আমাদের শেখায়, সিনেমা মানেই নয় দৃশ্য আর সংলাপের বাহুল্য। বরং একটি সিনেমা তার নীরবতা, প্রতীক, চোখের ভাষা ও মানবিক সংকটের মাধ্যমে হয়ে উঠতে পারে এক নিঃশব্দ বিপ্লব।

ইরানি চলচ্চিত্র আদতে তাদের রুখা দেশে বেজে ওঠা রাওয়াবের মতোই স্পষ্ট, নির্বাক, কিন্তু ২০০% খাঁটি।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন