তাপমান ৪৫১ ডিগ্রী ফারেনহাইট
যে তাপমাত্রায় কাগজ পোড়ে
তমাল বসু
জার্মান কবি হিনরিখ হাইনে কমবেশী ২০০ বছর আগে বলেছিলেন “ যেখানে বই পোড়ে সেখানে মনুষ্যত্বকেও দাহ করা হয়”।
১০মে ১৯৩৩, নাজি ছাত্র সংগঠন the National Socialist German Students' League , বার্লিন ও জর্মনীর আরও সব বিশ্ববিদ্যালয় শহরে মশাল মিছিল করে আসে এবং প্রায় ২৫ হাজার বই পোড়ায় (বার্লিন, ওপার্নপ্ল্যাটজ চত্বর), এবং এর সাথেই শুরু হয়ে যায় কুখ্যাত নাজি স্টেট সেন্সরশিপ যুগের।
সে রাতে নাজি প্রচারমুখ গোয়েবলস এর উস্কানিতে তথাকথিত "unGerman" আদর্শে লেখা বই পোড়াতে হাজির হন ৪০,০০০ মানুষ যার মধ্যে নাজি অফিসারেরা ছাড়াও ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ, অধ্যাপক, ছাত্র, নেতৃবৃন্দ এবং সাধারন দর্শক (যাদের একটা বড় অংশকে ওই ধংসলীলা দেখতে বাধ্য করা হয়)।
কাদের কাদের এবং কোন ধরনের বই আগুনে ছুঁড়ে ফেলা হয়? সমস্ত মার্ক্সীয়, সাম্যবাদী ও বলশেভিক সাহিত্য, গনতান্ত্রিক লেখালেখি যা কিনা ফুয়েরারের বিরুদ্ধে (হাইনরেখ মান), সমস্ত ঐতিহাসিক দলিল যা কিনা নাজি বর্নিত স্বচ্ছ ও খাঁটি জর্মন ঐতিহ্যকে মাটিতে টেনে নামায়(এমিলে ল্যুদউইগ),অজর্মন লেখকের লেখা যৌন ও আদিরসাত্মক সাহিত্য, এছাড়াও আর যা কিছু বিষয় যা কিনা নাজি বর্নিত খাঁটি জর্মন ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে যায়, অবাক করে দেওয়া লেখক তালিকা, মার্ক্স-এঙ্গেলস, ফ্রয়েড, আইনস্টাইন, টমাস মান, কাফকা, ব্রেখট, হিনরিখ হাইনে, রোজা লুক্সেমবার্গ, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, মাক্স ব্রড, সিগফ্রিড ক্রকাওয়র, জর্জ লুকাস, ক্লাউস মান, এরুইন পিস্কাটার, এরিখ মারিয়া রেমার্ক, জোসেফ রথ ও আরো বহু, এ তো গেল শুধু জর্মন লেখক তালিকা, এছাড়া ফরাসী ভিক্তর উগো, আন্দ্রে জিদ, র্যঁমা রঁলা, অরি বারবুসা। আমেরিকান আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, আপটন সিনক্লেয়ার, থিয়ডর দ্রেইসার, জ্যাক লন্ডন,হেলেন কেলার, জন দাস পাসোস। ইংরেজ জোসেফ কনরাড, ডি এইচ লরেন্স, জ্যাক লন্ডন, এইচ জি ওয়েলস, অলডাস হাক্সলি। আইরিশ জেমস জয়েস। রাশিয়ান দস্তয়েভস্কি, গোর্কী, ইসাক বেবেল, লেনিন, ভ নবোকভ, তলস্তয়, ত্রতস্কি, মায়াকভস্কি, ইলভা এরেনবার্গ এবং আমাদের রবীন্দ্রনাথ সেই রাতে পোড়েন। শুধুমাত্র পুড়িয়েই ক্ষান্ত হননা তারা সাথে সাথে যারা নাজিবাদের বিরুদ্ধে কোনোকিছু লিখছিলেন বিভিন্ন কাগজে বা পত্রিকায় সেই সব লেখক সাংবাদিকদেরও আটক করা হয়।
“জর্মন ছাত্রদের প্রতি খোলা চিঠি”তে হেলেন কেলার লেখেন “আমার এবং আমার মত আরো অনেকের বই তোমরা হয়তো পুড়িয়ে শেষ করতে পারবে, কিন্তু ঐসব বইয়ের দ্বারা যে আইডিয়া এবং দর্শন মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে তার বেলা?”
মে ১৩, ২০১১ সাল। ‘’ARTURO UI ‘’ উত্থিত হলেন বাঙালীর ঘর জুড়ে। এই উত্থান রেসিস্টেবল ছিল কিনা, তা নিয়ে নির্বুদ্ধিজীবীরা কতখানি ভেবেছিলেন, সেটা আজ আর জানবার উপায় নেই কিন্তু, অন্ততঃ সমগ্র রাজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তনের যে মিথিক্যাল বেলুনটা কিছু দিনের জন্য উড়ছিল, সেটা আজ চুপসে যাচ্ছে। আর তাই দাঁত-নখ বের করে ফেলছে সরকার ও সরকার পোষিত দলের কর্মীরা।
“উনি নির্ভুল। যখন সব কিছুই ঘটে চলেছে “কুৎসিৎ ও নিকৃষ্ট” স্তরে। আমরা যেহেতু রাজনীতি করি, আপনি,আমি ও আমাদের বন্ধুরা, তাই এটা শেষপর্যন্ত একটা যুক্তি সমর্থিত বেছে নেওয়া। গেস্টাপো প্রতিম সরকারি ব্যবস্থাগুলোর আক্রমনে একজন সাধারন মানুষ হিসেবে- অন্যরা যেমন মৃত কৃষকের পরিবার বা মৃত শিশুর মা - আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ছি… দুই সরকারি কাজকর্মের নমুনা দেখে ও মিথ্যে প্রতিশ্রুতি শুনতে শুনতে।
অনেকেই সব প্রতিশ্রুতি রাখেন না। বামফ্রণ্ট সরকারের তিন দশকে সমস্ত প্রতিশ্রুতির ১০০ শতাংশই সম্পন্ন হয়েছিল - একথা অতিবড় অন্ধ সমর্থকও হয়তো বলবেন না। কিন্তু হায়, আজকের সরকার দুটির মতন নির্লজ্জ, বেহায়া, প্রেত-প্রতিম, নির্বীজ প্রতিশ্রুতি আর কেউ অন্তত আমার বেড়ে ওঠার বয়সে এ রাজ্যে কখনও করেছেন বলে মনে করতে পারছিনা।
এরা বড্ডই চক্ষুহীন, আর আমরাও তেমনি বোকা। তবে সুখের কথা এই যে, সাধারন মানুষের চোখ এনারাই খুলে দিচ্ছেন। মা, মাটি, মানুষ আর বিকাশের মোহ এবারে কাটছে। কারন,যাদের সাধারন মানুষ ভোট দিয়েছিল একটি অলীক পরিবর্তনের আশায়, সে আশায় নিজেরাই ভাঙ্গন ধরিয়েছেন। মানুষ ওদের দেখে ভেবেছিলেন দু-টি অবিচ্ছেদ্য ধারনার প্রতিমূর্তি ঔদার্য ও প্রতিরোধ। এখন সেই মানুষগুলোই দেখছে কাপুরুষতা। আসলে সবকিছুই ঘটে চলেছে 'কুৎসিৎ ও নিকৃষ্ট স্তরে'।
যদি এগুলো তত গভীর দূর্ভোগ নাও হয়! তবু, যে আকাশচুম্বী প্রত্যাশার ফানুষ মানুষের কাছে ছিল, যা কিনা ওদের ওই সব মিথ্যা প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে আর মিডিয়ার মিথ্যা ঢক্কাণিনাদের মাধ্যমে অর্জিত! সেই ফানুষ আজ চুপসে গেছে। সেই প্রেরণা সম্বন্ধে মানুষ আতঙ্কিত।
এখন আমরা নিশ্চিত আমরাবা আমাদের মতন আর কেউ ভবিষ্যতে,এমনকি স্তব্ধতার মধ্যে হলেও, এদের সাথে করমর্দনেও ভীত হব। এ জন্যে নয় যে ওদের সাথে মিল আছে সেইসব হাতের, যেগুলো থেকে আউসউইৎজ, স্পেন বা জালিয়ানয়ালাবাগের রক্ত মুছে ফেলা যাবেনা। এটা কারন নয়। মোটেও নয়।
ওদের হাত বিশুদ্ধ কান্টবাদ বা জাতীয়তাবাদীদের মতই, কারন তার তো হাতই নেই। সুতরাং অন্ধ ও হস্তহীন, বাস্তব থেকে পলায়ন প্রয়াসে শুধু পদযুক্ত এককথায় কাপুরুষ অথবা বিস্মৃত অথচ ধূর্ত একনায়ক যে কথা বললেই সেটা নির্জলা মিথ্যাচার বলেই মনে হয়, মানে বিষয়টা প্রায় একই দাঁড়ায়।
বিস্ময়ের আর বাকী প্রায় কিছুই নেই, যখন আমরা ওদের দলীয় কর্মীদের পরিচালিত গুন্ডামো আর হত্যালীলার বিষয়ে অবলীলায় অবিরাম মিথ্যাভাষ্য শুনি, আসল কন্ঠ চিনতে পারি। না, আদৌ কিছুই বিস্ময়কর নয় এই চুড়ান্ত কাপুরুষতায়। নিজেকে ওরা অন্তর্গত স্মৃতিসমূহের ভেতরে উটপাখীর মত সমাধিস্ত করেছেন।
এসব কী, ভয়?
পুনশ্চ- বাঙালী বুদ্ধিজীবিদের সামাজিক/রাজনৈতিক ভুমিকা সম্পর্কে আলোচনার ইচ্ছা আমাদের নেই, কেননা, আজ পর্যন্ত বুদ্ধিজীবিরা ছাড়া আর কেউই তাতে তেমন ভাবে যোগ দেননি। আমরা সচারচর এইসব হামটি-ডামটি'দের দেওয়ালের দু-দিকে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতেই দেখি। সময় বুঝে তারা নিজেদের সুবিধে মত দিকটিতে পড়ে যায়। কখনো তারা কেউ কেউ ঈষৎ কাঁদেন এবং পরে নিজেদের প্রাপ্য বুঝে নিয়ে আবার দেওয়ালের ওপর উঠে বসে প্রতিরোধ আর আত্মসম্মানের লজেন্স চুষতে চুষতে চাটুকারবৃত্তির কাজটি করতেই থাকেন।
*মতামত লেখকের ব্যাক্তিগত