Tereskova Cover 2024

Ye stars! Which are the poetry of heaven: A Tribute

প্রাককথন

সমাজতন্ত্র নিজে যতটা নির্মাণের বিষয়, সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ তার চাইতে কম কিছু নয়, বরং লেনিন তাকেই খানিক বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলে গেছিলেন। আজকের প্রজন্মের অনেকেরই সম্ভবত জানা নেই, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের চিন্তাভাবনায় সমাজতন্ত্র নির্মাণের বুনিয়াদি পরিকল্পনাটি মূলত দেশজুড়ে বিদ্যুতায়নকে কেন্দ্রে করেই ছিল। লেনিন উপলব্ধি করেছিলেন বিপ্লব সংগঠিত করার পরেই সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জ কমিউনিস্টদের সামনে আসতে চলেছে তার নাম ‘নতুন সমাজ নির্মাণ’ আর সে ব্যাপারটি ‘নতুন মানুষ’, ‘নতুন মানসিকতা’ কার্যত ‘নতুন সংস্কৃতি’ বিনা ঘটবে না। এও বুঝেছিলেন যে ইউরোপের পিছনের উঠোন বলে চিহ্নিত রাশিয়া উন্নত পুঁজিবাদী দেশসমূহের সাথে চুড়ান্ত অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে চলেছে, কার্যত সার্বিক অবরোধের সামনে বিরাট বিপদের সম্মুখীন হতে চলেছে। একদিকে যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদী দেশসমুহের সামনে রাশিয়াকে নিরাপদ রাখা আরেকদিকে সমাজতন্ত্র বলতে কি বোঝায় তাকে হাতেকলমে দেখিয়ে দেওয়া। সেদিন সকলেই তার মতো দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ছিল না, নিউ ইকোনমিক পলিসি’র ন্যায় অবস্থানের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে নিজের দেশ এমনকি নিজের পার্টির মধ্যেও লেনিন অনেকটাই একা হয়ে পড়েছিলেন। সেদিন লেনিনের পরিকল্পনাকে যারা সবার আগে ব্যঙ্গ, বিদ্রুপের বিষয়ে পর্যবসিত করেছিলেন তারাও কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যেই ছিলেন। লেভ দাভিদোভিচ ব্রনস্টাইন অর্থাৎ লিও ত্রতস্কি ছিলেন সেই বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর মাথা। কার্ল রাদেক তো সরাসরি ‘ইলেক্ট্রিফিকেশন’-কে ‘ইলেক্ট্রো ফিকশন’ বলেই দাগিয়ে দেন।

সেদিনের রাশিয়া, পরবর্তীকালের সোভিয়েত ইউনিয়ন দেখিয়েছে সমাজতন্ত্র কাকে বলে। আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে গোটা দুনিয়ার নিপীড়িত, মুক্তিকামী মানুষের লড়াইতে ঐ সোভিয়েত কিই না করেছে। বিপ্লব সফল হওয়ার পরে লেনিন বেশীদিন বাঁচার সুযোগ পাননি, তাকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা হয়। সেই ক্ষত তাকে আর আগেকার মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে দেয়নি। তেমন কিছু হলে অন্তত গুটিকতেক ভ্যালেন্তিনা’দের নিজের চোখেই দেখে যেতেন। ভ্যালেন্তিনা তেরেশকোভা। প্রথম মহিলা মহাকাশচারী। এই অবধি স্কুল পাঠ্যেই থাকে, কিছুতেই এর চাইতে বেশি থাকে না- ইচ্ছাকৃত। যাতে আধুনিক প্রজন্ম না জানতে পারে প্রথম মহিলা মহাকাশচারী কোনও ‘অ্যাফ্ল্যুয়েন্ট ফ্যামিলি’র সদস্য ছিলেন না। ছোট থাকতেই বহু সুযোগ, বহু সুবিধা পেয়ে বড় না হয়েও একজন কিভাবে দুনিয়ার ‘প্রথম’ হন সেটাই সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ, সমাজতান্ত্রিক বিকল্প।

স্কুলের বইতে বেশি কিছু নেই বলেই সেই ইতিহাস সামনে নিয়ে আসতে হবে এটুকুই পরিকল্পনা ছিল না। প্রকৃত অর্থে সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পনা বলতে কি বোঝায় তাকে তুলে ধরাই ছিল ওয়েবডেস্কের ভাবনা। ইতিহাস লেখার নাম করে আজকের ভারতে যা চলছে তার উদ্দেশ্যে একটাই, কি করে নয়া উদার অর্থনীতির উপযোগী সস্তার শ্রমশক্তি যোগান দেওয়া যায়। তারই বিরুদ্ধে এই লেখা। মানুষ, আরও নির্দিষ্ট করে বললে প্রান্তিক, কোনোদিন মানুষচিত জীবনযাপনের সুযোগ না পাওয়া মানুষও প্রকৃত অর্থে সঠিক পরিবেশের প্রভাবে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলেন- সাবেক বলুন আর হাল ফ্যাশনের ক্রোনি কোনও পুঁজিবাদেরই হিম্মৎ নেই এ সত্য উচ্চারনের, কমিউনিস্টদেরই সেই কাজ করতে হয়।  

আর তাই এমন প্রতিবেদন।

ঋজুরেখ দাসগুপ্ত

পৃথিবীর বুকে মাটির স্তরের নীচে কয়লা বা খনিজ তেল সঞ্চিত হয়ে আছে কয়েক লক্ষ বছর। আমরা তা ব্যবহার করতে পারি মাত্র কদিন? এই খনিজের শক্তি ব্যবহার করে রেলগাড়ির দৌড়, ঘরের আলো, এই প্রকান্ড সভ্যতা- এই সমস্ত কিছুর বয়স আরও কম। কীভাবে এই রূপান্তর সম্ভব হল? একদিনে? এক চুটকিতে? নাঃ, দীর্ঘদিনের মানব সভ্যতার প্রচেষ্টায়, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ব্যাপক অগ্রগমনের ফলশ্রুতি এবং সর্বোপরি আমাদের চারিপাশে যে ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে, তার ভিতে মাটির তলায় চাপা পড়ে থাকা এই নিহিত শক্তি প্রাণসঞ্চার করেছে সভ্যতায়। এই একই কথা আমরা শুনেছিলাম ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ সিনেমায়। সেই বিখ্যাত সাক্ষাৎকারের দৃশ্যে ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় বলছেন চাঁদে মানুষের পা রাখার তুলনায় ভিয়েতনামের মুক্তি সংগ্রাম বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ- সেই সংগ্রামে জনগণের নিহিত শক্তির স্ফূরণ ঘটেছে ব্যবস্থা বদলানোর লড়াইয়ে। এই নিহিত শক্তির জাগরণে কী প্রয়োজন? কোন চালিকাশক্তি মানুষের মধ্যে নিহিত এই শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে পারে?

আজ ১৬ই জুন, ২০২৪’এ এই নিহিত শক্তি জাগিয়ে তোলার ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনার কারণ কী?

১৯৩৭’এর ৬ই মার্চ। সোভিয়েত ইউনিয়নের বলশয় মাস্লেননিকোভো গ্রামে এক কৃষিজীবী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেন ভ্যালেন্তিনা তেরেশকোভা। বাবা ট্র্যাক্টর চালক। মা কাজ করতেন খামারে। সোভিয়েত ইউনিয়নে কোনো কৃষক ঋণ শোধ করতে না পেরে আত্মঘাতী হতেন না। ভ্যালেন্তিনা পড়াশুনা শেষ করে কাজ করা শুরু করলেন বস্ত্র কারখানায়। বস্ত্র কারখানার শ্রমিক ভ্যালেন্তিনা অবসর সময়ে নিজেকে ব্যস্ত করে রাখতেন স্কাই ডাইভিংসহ বিভিন্ন অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসে। এই ভ্যালেন্তিনাই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম মহিলা যিনি মহাকাশে পৌঁছলেন ভস্টক ৬ মহাকাশযানে। প্রথম মহিলা হিসেবে আমাদের সমগ্র গ্রহের সৌন্দর্যের চাক্ষুস সাক্ষী থাকলেন মহাকাশযান থেকে। ফিরে এসে ভ্যালেন্তিনা জানিয়েছিলেন- যে বর্ণেরই মানুষ হোক না কেন, যে মহাদেশের মানুষ হোক না কেন! মহাকাশ থেকে সকলের চোখেই আমাদের গ্রহ সমান সুন্দর! এই গ্রহ যুদ্ধে-দাঙ্গায় বিধ্বস্ত হয়, আমাদের উচিত এই গ্রহের সৌন্দর্যকে রক্ষা করা। এই গোটা ক্রিয়াকলাপের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন৷ সোভিয়েতের ব্যবস্থায় একজন বস্ত্র কারখানার মহিলা শ্রমিক হয়ে উঠলেন প্রথম মহিলা মহাকাশচারী। স্ফূরণ ঘটল মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সেই নিহিত শক্তির।

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা, বামপন্থার সবচাইতে অভুতপূর্ব বৈশিষ্ট্যের ফসল এই ঘটনা। একটা ব্যবস্থা যা দ্বাদশ বছর বয়সী ইভানকে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুদ্ধে জনগণের মুক্তিসংগ্রামে গুপ্তচরের ভূমিকায় অবতীর্ণ করতে পারে। হাড়কাঁপানো শীতে নিপা নদী সাঁতরে পার করাতে পারে। একটা ব্যবস্থা সাইবেরিয়ার বরফ ঢাকা প্রাঙ্গণে শ্রমিক মালিকানায় গড়ে তুলতে পারে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ব্লাস্ট ফার্নেস। একটা ব্যবস্থা যা গোটা পৃথিবীকে শেখাতে পারে যে রাজনৈতিক পোস্টারে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছবি ছাপানো যায়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় একটা ব্যবস্থা যা আগাগোড়া জাগিয়ে তুলতে পারে সক্কলকে। এই ব্যবস্থারই ফসল ভ্যালেন্তিনা তেরেশকোভারা। এই ব্যবস্থারই ফসল ল্যুডমিলা পাভলিচেঙ্কো, যিনি ফ্যাসিবাদবিরোধী জনযুদ্ধে ৩০৯ জনকে স্নাইপারের শিকার করে জানিয়েছিলেন- কোনো মানুষ নয়, ৩০৯ জন ফ্যাসিস্তকে পরাজিত করেছেন।

আমাদের দেশেও বামপন্থীরা যখন যেখানে সামান্যতম সুযোগও পেয়েছেন, একইভাবে স্ফূরণ ঘটিয়েছেন মানুষের মধ্যে এই নিহিত শক্তির। কমরেড জ্যোতি বসু বাংলার মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ঘোষণা করেছিলেন- “চাষার ব্যাটা শুধু চাষাই কেন হবে, ডাক্তার কেন হবে না?”। একইভাবে বাংলায় বামপন্থীদের আহ্বানে গোটা রাজ্যের মানুষকে রক্তদান করেছিলেন বক্রেশ্বরে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে। বুকের রক্ত উজাড় করে মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন অন্ধকারে আলো জ্বালবার উদ্দেশ্যে। এক্ষেত্রে দক্ষিণপন্থীদের ভূমিকা ঠিক বিপরীত। দিনেরাতে সর্বক্ষণ আপনি অনুধাবন করবেন কীভাবে জনগণের আত্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করতে নানান সংলাপের পসার সাজিয়ে রাখেন দক্ষিণপন্থীরা। কখনও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন ঈশ্বরের অবতার হিসেবে। কখনও নিজেই ঘোষণা করেন ‘আমাকে দেখে অনেকে জেলাসি করে, যব রাজা চালে বাজার তো কুত্তা ভওকে হাজার’। তারা মানুষকে নকল যুদ্ধে বাজি ধরা দর্শক বানিয়ে রাখতে চায়৷ ডুবিয়ে রাখতে চায় বিভ্রান্তির কালো জলে। আর এই দ্বন্দ্বেই একুশ শতকে বামপন্থীদের কাছে তীব্রতম চ্যালেঞ্জ উপস্থিত। একদিকে জনগণকে দাবিয়ে রাখার দক্ষিণপন্থী আস্ফালন। সে আস্ফালনের স্পনসর কর্পোরেটদের ইলেকটোরাল বন্ডের বিপুল অর্থ। আর বিপরীতে, বস্ত্র কারখানার মহিলা শ্রমিকের মহাকাশচারী হয়ে ওঠার লড়াই।

সবচাইতে পিছিয়ে যারা তাদের হাত ধরে সামনের দিকে সম্মিলিত অগ্রগমনের অদম্য প্রচেষ্টা।

বামপন্থার লড়াইয়ের পুনর্নির্মাণ।

জনগণের শক্তির পুনরুত্থান।

কঠিনতম সময়েও মতাদর্শের দৃঢ় ভিতে অবিচল থেকে সামনের লড়াইয়ের প্রস্তুতি- এটাই ভ্যালেন্তিনাদের শিক্ষা, এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।

ওয়েবডেস্কের পক্ষে প্রাককথন – সৌভিক ঘোষ

Spread the word

Leave a Reply