Writing the Truth, Five Difficulties (Part II)

প্রাককথন

রাজনীতির চিরায়ত প্রশ্নটি যা চলছে তার বদল ঘটানোকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। এই বদল কেমন, এর প্রকৃত অর্থ আসলে কী এ নিয়েই যাবতীয় বিতর্ক। এখানেই ইতিহাস নির্দিষ্ট কর্তব্য সম্পাদনে সমাজের কেউ কেউ অন্যদের চাইতে কিছুটা বাড়তি দায় স্বীকার করেন। প্রচলিত অর্থে তাদেরই আমরা বুদ্ধিজীবী বলি।

এরা কথা বলেন, লেখেন এবং সবটাই করেন সেই বদলের উদ্দেশ্যে। কিন্তু বাস্তব হল এই যে পুঁজিবাদ সমাজব্যবস্থা হিসাবে এমনই এক বিকৃত পরিবেশ নির্মাণ করে যখন একদল মানুষ সমাজে বসবাস করতে চান এই বলে যে তারা চাইলেই লিখতে পারেন, বলতে পারেন, শাসককে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন। অর্থাৎ বুদ্ধিজীবী হওয়ার সমস্ত গুণ লক্ষণ তাদের মধ্যে রয়েছে কিন্তু আপাতত সে কাজটি তারা করছেন না! এহেন অবস্থান আজকের দিনে আর নতুন কিছু না, আন্তোনিও গ্রামশির সুবাদে দুনিয়া জেনে গেছে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও আসলে দুটি গোষ্ঠী রয়েছে। সাবেক অংশটি যা চলছে তার সুবাদেই করেকম্মে রয়েছেন বলে আর নতুন করে হুজ্জুতি পাকাতে চান না।

এই অনীহা কেন?

বুদ্ধিজীবীর অভিধায় ভূষিত হতে যাদের সাধ তারা আচমকা এমন জড়ভরত হয়ে ওঠেন কিভাবে?

Writing the Truth, Five Difficulties শিরোনামে ১৯৩৫ সালে তারই অনুসন্ধানে কলম ধরেন বের্টল্ট ব্রেখট্‌, পাঁচটি অধ্যায়ে সেই পর্যালোচনা শেষ করেন। এ লেখায় তার সেই বিখ্যাত ধরণটিই ফুটে উঠেছে যে কায়দায় তিনি থিয়েটারের আঙ্গিক বদল দিয়েছিলেন। চোখের সামনে যা দেখানো হচ্ছে সেটা যে আসল না আগাগোড়া সে বিষয়ে দর্শক কিংবা পাঠককে সচেতন রাখাই সে আঙ্গিকের মূল কথা।

মুখবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন-  ‘আজকের সময়ে যে মিথ্যা এবং অজ্ঞতার বিরুদ্ধে লড়তে চায় এবং লিখতে চায় সত্যি কথা, তাকে অতি অবশ্যই পাঁচটি ঝামেলার মোকাবিলা করতে হবে। সত্যির বিরোধিতা যখন সর্বস্থানে, তখন তাকে অবশ্যই যা সত্যি তা লেখার সাহস দেখাতে হবে; সত্যিকে গুপ্ত রাখার প্রচেষ্টা যখন সর্বত্র, তখন তাকে চিনে নেওয়ার আগ্রহ থাকতে হবে; থাকতে হবে সত্যিকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার দক্ষতা; সঙ্গে কারা এই অস্ত্র যথাযথ ব্যবহার করতে পারবেন তা বেছে নেওয়ার বিচারবোধ; এবং পরিশেষে থাকতে হবে সেই নির্বাচিত লোকজনের মধ্যে সত্যিকে ছড়িয়ে দেওয়ার কৌশলী বুদ্ধি। ফ্যাসিবাদের অধীনে বাস এমন লেখকদের জন্য, যারা পলাতক বা নির্বাসিত তাদের এমনকী নাগরিক স্বাধীনতা রয়েছে এমন দেশে কর্মরত লেখকদেরও এই সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।’

ব্রেখটের সেই প্রবন্ধটির সম্পূর্ণ বাংলা অনুবাদ আমরা রাজ্য ওয়েবসাইটে ধারাবাহিক হিসাবে প্রকাশ করছি।

প্রতি সপ্তাহের বুধবার।

আজ তার দ্বিতীয় পর্ব।

বের্টল্ট ব্রেখট্

২য় পর্ব

সত্যি চেনার আগ্রহ

সব জায়গায় যেহেতু সত্যিকে চেপে রাখাই রেওয়াজ, তাই অধিকাংশ মানুষ মনে করেন সত্যি লেখার কঠিন কাজটি শুধুই লেখকের চরিত্রের দৃঢ়তার উপর নির্ভরশীল। তাঁদের বিশ্বাস, এই বিষয়ে সাহস-ই যথেষ্ট। ভুলে যান, সত্যি লেখার আরও একটি ঝঞ্ঝাট রয়েছে, এই দ্বিতীয় ঝঞ্ঝাট হল : সত্যিকে খুঁজে পাওয়ার অসুবিধা। যা সত্যি, তাকে সহজেই প্রমাণ করা যায়, আদতে এ এক অসম্ভব দাবি।

কোন সত্যি কথা বলার মত, প্রথমেই আমরা সমস্যায় পড়ি তা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে। যেমন, সমগ্র বিশ্বের চোখের সামনে একের পর এক দেশে সভ্য জাতিগুলি বর্বরতন্ত্রের খপ্পরে গিয়ে পড়ছে। এর পাশাপাশি, সকলেই জানে এই দেশগুলিতে বর্বরতা বিরোধী মানুষের বিরুদ্ধে ভয়াবহ পদ্ধতিতে চালানো হচ্ছে এক অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ, যা যে কোনও মুহূর্তে একটি বিদেশী যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়ে আমাদের মহাদেশকেই একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দিতে পারে। এই বক্তব্য একটি সত্যি কথা, কিন্তু এ’ছাড়াও তো আরও অনেক সত্যি কথা রয়েছে। যেমন আরামকেদারায় গদি আঁটা থাকে বা বৃষ্টি উপর থেকে নিচে ঝরে। অনেক কবি এই দ্বিতীয় ধরণের সত্যি কথা লিখতেই পছন্দ করেন। ডুবন্ত জাহাজের এক চিত্রশিল্পীর মত তাঁরা চোখ কান বুজে জাহাজের দেওয়ালে নিস্তরঙ্গ জীবনের ‘সত্য’ চিত্র আঁকতেই বেশি আগ্রহী। প্রথম সত্যি কথাটা নিয়ে আমাদের যে ঝঞ্ঝাট, তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে তাঁরা নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটান না এবং দ্বিতীয় প্রকার সত্যি কথাগুলির মধ্যে থেকে তাঁরা বিবেক পরিষ্কার রাখেন।

এই সত্য-সাধক শিল্পীদের ক্ষমতাসীনরা নীতিভ্রষ্ট করতে পারেন না ঠিকই, কিন্তু নিপীড়িতের আর্তনাদেও তাঁরা বিচলিত হননা, এদিক ওদিক না তাকিয়ে ছবি এঁকে চলেন। তাঁদের এই অনুভূতিশূন্য আচরণের অবধারিত পরিণাম হিসেবে জন্ম নেয় এক ‘গভীর’ হতাশা, যা তাঁরা বেশ ভালো দামে বিক্রি করে থাকেন; অবশ্য এই শৈল্পিক ওস্তাদ ও তাঁদের বিক্রিবাটা যাঁরা পর্যবেক্ষণ করেন তাঁদের মনেই আদতে হতাশাটা গভীর হওয়া উচিৎ ছিল। আসলে এটা উপলব্ধি করা সহজ নয় যে এঁদের শিল্পে থাকা সত্যিগুলি আসলে ঐ আরামকেদারার গদি অথবা বৃষ্টির নিচের দিকে ঝরার মত সত্যি; শুধু আপাত ভাবেই মনে হয় এই সত্যি খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু। একটু খুঁটিয়ে দেখলেই ফাঁস হয়ে যায় : কেদারা হল কেদারাই, ওর মধ্যে গভীর কিছু নেই আর বৃষ্টি পড়া খুব স্বাভাবিক বিষয়, কেউ না চাইলেও তা হবে।

আদতে যে সত্যি লেখা জরুরি, তা তাঁরা খোঁজারই চেষ্টা করেন না। অন্যদিকে আবার এমন কিছু মানুষ রয়েছেন যাঁরা জরুরি কাজ নিয়েই ব্যস্ত, যাঁরা দারিদ্র্যকে আলিঙ্গন করেছেন এবং শাসকদেরও ভয় পাননা, কিন্তু তবুও তাঁরা সত্যিকে খুঁজে পাচ্ছেন না। এঁদের যেটা অভাব, সেটা জ্ঞানের। এঁরা প্রাচীন কুসংস্কারগুলির ডিপো, বিগত সময়ে সুন্দর ভাষায় মুড়ে যে কু-আচারগুলিকে প্রশ্রয় দেওয়া হত তা তাঁদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। পৃথিবীটা তাঁদের জন্য খুব জটিল; বাস্তব যে কী এই বোধ তাঁদের নেই; বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে সম্পর্ক তাঁরা বুঝতে পারেন না। তাই প্রয়োজনীয় মানসিক ধাত ছাড়াও আমাদের দরকার জ্ঞান, যা অর্জন করা যেতে পারে এবং পদ্ধতি, যা শেখা যেতে পারে। বিভ্রান্তিতে পরিপূর্ণ ও বিদ্যুৎগতিতে পরিবর্তনের এই যুগে সকল লেখকের যা আয়ত্ত করা প্রয়োজন তা হল অর্থনীতি ও ইতিহাসের বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিকতা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান। প্রয়োজনীয় অধ্যাবসায় থাকলে এই জ্ঞান বই এবং হাতে-কলমে শিক্ষা, দুই-এর মাধ্যমেই শেখা যেতে পারে। অনেক সত্যিকেই এই পদ্ধতিতে সহজে খুঁজে পাওয়া সম্ভব, সমগ্র সত্যিকে সব সময় পাওয়া না গেলেও পাওয়া সম্ভব সত্যির কিছু টুকরোকে বা সত্যির আবিষ্কারের দিকে এগোনো যায় এমন তথ্যকে। যে কোনও অনুসন্ধান একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে করা ভাল, তবে কোনও পদ্ধতি – এমনকী কোনও অনুসন্ধান ছাড়াও সত্যিকে খুঁজে নেওয়া সম্ভব। তবে পদ্ধতি, অনুসন্ধান বিহীন ও অপরিকল্পিত ভাবে যে সত্যি আবিষ্কৃত হয় সাধারণতঃ তাকে এমন ভাবে সাজানো খুব কঠিন হয়ে পড়ে যা দেখে মানুষ সেই সত্যিকে বিশ্বাস করে তার ভিত্তিতে মাঠে নামবে। এদিক সেদিক থেকে ছোটো খাটো তথ্য নোটবইয়ে টুকে যারা ক্ষান্ত দেয়, তারা বিশ্বে ঘটে চলা ঘটনাপ্রবাহগুলিকে কখনও সহজে নিয়ন্ত্রণ করে সাজাতে পারে না। অথচ সত্যির এই একটি বৈ আর কোনও উপযোগিতা নেই। তাই এই ধরণের লোকজন সত্যি লেখার যে আদত প্রয়োজনীয়তা সেটাই মেটাতে পারেন না।

সত্যি লেখার এই দুই ঝঞ্ঝাট যদি কেউ অতিক্রম করেন, তারপরেও আরও তিনটি ঝঞ্ঝাট রয়ে যায়, যা তাঁকে অতিক্রম করতে হবে।

ভাষান্তরঃ রবিকর গুপ্ত

ব্যবহৃত ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া সুত্রে প্রাপ্ত

Spread the word

Leave a Reply