World Day to Combat Desertification and Drought 2024

সৌরভ চক্রবর্তী

গরমে জ্বলছে দেশ, আছড়ে পড়ছে ‘ রেমাল ‘ ঝড়, সামনে অতি বর্ষণের শঙ্কা। জল জমি জঙ্গল সংকুচিত, জমি চরিত্র হারিয়ে অবক্ষয়িত – অনুর্বর, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস-প্রজাতি বিলোপ। এই হলো ঘটমান বর্তমানের সালতামামি। পৃথিবী অ-বাসযোগ্য হয়ে ওঠার হাতছানির মধ্যে নীল সবুজ গ্রহের মানুষ টিকে থাকার সংগ্রাম করছে কৃষিক্ষেতে, কলে-কারখানায়, সড়কে – গলিতে। যারা টিকতে পারছে না মরছে গরমে, দূষণে, ভাইরাসের আক্রমণে, খরা বন্যা সাইক্লোনে, ঘরবাড়ি ছেড়ে অনেকেই হচ্ছে উদ্বাস্তু – আধুনিক নাম পরিবেশ বা জলবায়ু উদ্বাস্তু

কি করছে রাষ্ট্রনেতারা?

মানব প্রজাতি যখন থাকবে কি থাকবে না এটাই প্রশ্ন! যখন সময়ের গাড়ি দুদ্দাড় বেগে চরম ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে তখন প্রয়োজন ছিল বৈজ্ঞানিক বোধের হাতিয়ারে সজ্জিত হয়ে দেশের মানুষকে সঙ্গে করে ধ্বংসমুখী গাড়ির গতিরোধ করা কিন্তু তারা কি করলেন?

তারা দেশের মানুষকে ভাগযোগ করে নিয়ে সময়ের উল্টোদিকের গাড়িতে উঠে পড়ে আদিম প্রস্তর যুগের জাদু বিশ্বাসের চেতনায় ধ্যানমগ্ন হলেন!

বিশ্ব মরুকরণ ও খরা প্রতিরোধ দিবস

আজ ১৭ই জুন – ” বিশ্ব মরুকরণ ও খরা প্রতিরোধ দিবস ” এবারের থিম হলো”United for Land. Our Legacy. Our Future.” এই মূল ভাবনায় পৃথিবীর কয়েকশো কোটি মানুষের জীবনের স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে জমির যত্ন নেবার ভবিষ্যৎকে তুলে ধরা হয়েছে।

বর্তমানে মরুকরণ, জমির অবক্ষয় এবং খরা গুরুতর এক চ্যালেঞ্জ – সারা পৃথিবীর ৪০ শতাংশ জমি আজ অবক্ষয়ের শিকার। মরুকরণ এবং খরার সমস্যা আরও জটিল হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে ক্রমবর্ধমান অস্থির এবং চরম আবহাওয়ার জন্য যা প্রতিবছর কোটি কোটি মানুষকে বাড়িঘর ছেড়ে পরিবেশ উদ্বাস্তু হতে বাধ্য করছে।এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের মূল ভাবনাও ছিল এমনই।আমাদের বাস্তুতন্ত্রের চরমভাবে অবক্ষয়ের শিকার,বাস্তুতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করতে না পারলে মরুকরণ এবং খরাকে প্রতিহত করা যাবে না।

Source: Google

এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের থিম

এবার ৫ ই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসের থিম ছিল – “Land restoration, desertification and drought resilience “যা গেছে তা যাক নয়, জমির অবক্ষয় রোধ করে তার পুনরুদ্ধার, মরুকরণকে প্রতিহত করা এবং খরা মোকাবিলা করার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে এবার।

পুনরুদ্ধার করো বাস্তুতন্ত্র

মানুষের বেঁচে থাকার মূল উপাদান গুলি হ’ল জল,জমি,জঙ্গল, বিশুদ্ধ বায়ু। মানুষ আর তার আবাসস্থল বাধ্যতামূলকভাবে নিজের মধ্যে এবং এইসব উপাদান গুলির সাথে বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে, আদান-প্রদানের মিথস্ক্রিয়া ঘটায়, নিবিড় আন্তঃসম্পর্কের জালিকা তৈরি ক’রে এক সুস্থিত তন্ত্র গঠন করে, একেই বলে বাস্তুতন্ত্র যার সুস্থিতি রক্ষাই হলো বেঁচে থাকার মূল শর্ত।

এই শর্তই আজ লঙ্ঘিত -অবক্ষয়িত।বাস্তুতন্ত্রের অবক্ষয় প্রতিহত করে পুনরুদ্ধার করতে হবে – এটাই চ্যালেঞ্জ।নাহলে এই নীল সবুজ গ্রহে মানব প্রজাতির কোনও ভবিষ্যত নেই।

ভূমিকা নেবে না রাষ্ট্র? উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে হঠযোগ নিদ্রায় মগ্ন হবে!

ইউনাইটেড নেশনস এমন আটটি বাস্তুতন্ত্রকে নির্দিষ্ট করেছে যা অবক্ষয়িত, যাদের পুনরুদ্ধার করতে হবে। এই দশকে” ইউএন ডিকেড অন ইকোসিস্টেম রেস্টোরেশন ” কর্মসূচির লক্ষ্য হিসেবে কৃষিজমি, জঙ্গল, মিঠে জল ভান্ডার, তৃণভূমি, পাহাড়,সমুদ্র এবং উপকূল, এবং নগরের বাস্তুতন্ত্র।এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে গেলে এদের পুনরুদ্ধার করতেই হবে।

পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থাই বাস্তুতন্ত্রের শত্রু

পুঁজিবাদী মুনাফা কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যবস্থা যেমন মনুষ্য শ্রম শোষণ ক’রে আত্মসাৎ করে তেমনি প্রাকৃতিক সম্পদও শোষণ ক’রে আত্মসাৎ করে, এই উৎপাদন ব্যবস্থা কখনোই টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থা হতে পারে না।

এই ব্যবস্থা লোভ এবং ভোগ চালিত প্রাকৃতিক সম্পদের বল্গাহীন লুটের ব্যবস্থা যা প্রকৃতি মানুষ সমাজের মিথস্ক্রিয়া জনিত আত্ম সম্পর্ককে ভেঙে দেয়; বিপন্ন করে তোলে বেঁচে থাকার প্রধান শর্ত বাস্তুতন্ত্রকে। মার্ক্স যেমন অসীম দরদে বলেছেন প্রকৃতি এবং মানুষের সাথে যে বিপাক ক্রিয়া ঘটে, পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা তাতে ফাটল ধরায়। এটাই স্বনামধন্য সমাজবিজ্ঞানী জন বেলামি ফস্টার কথিত ‘ মেটাবলিক রিফ্ট। ‘

ইউনাইটেড নেশনস বলছে অ-টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থা এবং সীমাহীন ভোগসর্বস্যতা আমাদের বাস্তুতন্ত্রকে ভয়াবহ তিনগুণ সংকটের মধ্যে এনে ফেলেছে – জলবায়ু পরিবর্তন,প্রকৃতির জৈব বৈচিত্রের ধ্বংস এবং দূষণও বর্জ্য। খনি শিল্প নগরায়ন বাস্তুতন্ত্রকে সরাসরি আঘাত করছে। তথাকথিত উন্নয়নের গ্রাসে কৃষিজমি, জলাভূমি, জঙ্গল। তীব্র দূষণ এবং বর্জ্যে অবক্ষয়িত বাস্তুতন্ত্র।

জমি জঙ্গলের পুনরুদ্ধার

সমগ্র পৃথিবীর এক-পঞ্চমাংশ জমির আজ অবক্ষয় ঘটেছে। বিশ্বে ৩২০ কোটি মানুষ ভূমির অবক্ষয়ের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত।ছোট জোতের কৃষক, দরিদ্র মানুষ, দেহাতি মানুষেরা, মহিলারা এই ক্ষতির শিকার। বিশ্বের ৪ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ খরার শিকার হন। ভূমির অবক্ষয়ের কারণে খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি হয় খাদ্য সামগ্রীর দাম বাড়ে,তৈরী হয় খাদ্য সংকট।একেই বিশ্ব উষ্ণায়নে

কৃষিজ ফলন কমছে তার উপর ভূমির অবক্ষয় সমস্যাকে তীব্রতর করছে।

ভূমির উর্বরাশক্তির প্রধান উপাদান হলো ভূমির উপরিভাগের মৃত্তিকা বা ‘টপ সয়েল ‘ যা তৈরি হতে এক হাজার বছর লাগে, ভূমির উপর সবুজের আচ্ছাদন ঘাস- গুল্ম, বৃক্ষচ্ছেদন করলে এই উর্বর মৃত্তিকা অনাবৃত হয়ে পড়ে, জলে ঝরে এই অমূল্য সম্পদ বিনষ্ট হয়। অতিকর্ষণ,অতি পশুচারণে জমির অবক্ষয় ঘটে উর্বরা শক্তি কমে – জমি অনাবাদী হয়ে পড়ে, মরুময় হয়।পৃথিবীর ভূমির ৩১ শতাংশ হলো জঙ্গলাকীর্ণ যার মধ্যে ৮০ শতাংশ স্থলভাগের প্রাণী উদ্ভিদ এবং পতঙ্গ প্রজাতির বাস। জঙ্গল ধ্বংস মানে প্রজাতি ধ্বংস। ইউ এন বলছে ১০ লক্ষ প্রজাতি ধ্বংসের মুখে। জঙ্গল ধ্বংস হলে কোভিড১৯ এর মতো জুনোটিক রোগের অতিমারি ঘটে।মানব শরীরে নতুন নতুন এবং উদীয়মান সংক্রমণ জনিত রোগের পঁচাত্তর ভাগই হলো জুনোটিক রোগ।

জঙ্গল আমাদের খাদ্য,তন্তু এবং আবশ্যকীয় দ্রব্য, জৈব বৈচিত্র, আর্থিক-সামাজিক- সাংস্কৃতিক জীবনকে ধারণ করে। প্রস্বেদনের মাধ্যমে বায়ু শীতল করে, ভূগর্ভস্থ জল ভান্ডারকে পুরণ করে।ভূমি স্থলভাগের সর্ববৃহৎ কার্বনের মজুদ ভান্ডার – জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রতিহত করে। সারা বিশ্বের জঙ্গল ৭.৬ বিলিয়ন মেট্টিক টন কার্বন শোষণ করে যা আমেরিকার বার্ষিক কার্বন নির্গমনের দেড় শতাংশ। আবার যখন জঙ্গল সাফ করা হয় এর থেকে বেশি কার্বন নির্গত হয় – তাই জঙ্গল সাফ করা বিপজ্জনক।

চাই টেকসই কৃষি ব্যবস্থা – ফেরাও মৌমাছির গুঞ্জন

মাটির উর্বরা শক্তি ফেরাতে হলে মুনাফা চালিত বাণিজ্যিক কৃষি ব্যবস্থার অবসান চাই। বাজারের কৃত্রিম অপ্রয়োজনীয় চাহিদা নয়, স্থানীয় মানুষের চাহিদা – স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র উপযোগী বিজ্ঞানের মিশেলে চিরায়ত ও জৈব কৃষি ব্যবস্থার প্রণয়ন চাই। এজন্য সরকারের পাশে থাকা নিশ্চিৎ করতে হবে। সার কীটনাশক বিদ্যুতে ভর্তুকি, ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের গ্যারান্টি সরকারকে দিতে হবে। নয়া কৃষি আইন কার্যকর থাকবে আর কৃষি টেকসই হবে তা সোনার পাথর বাটি।

জলের মিতব্যয়িতার জন্য যেমন’ ড্রিপ- স্প্রিঙ্কলার ‘সেচ এবং ‘মালচিং ‘ এর প্রয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে তেমনই পরাগমিলনকারী হিসেবে মৌমাছি বাদুড় প্রজাপতি সহ পাখি ও পতঙ্গদের ফিরিয়ে আনতে হবে। নতুন চ্যালেঞ্জে নতুন অর্থনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।

“কুনমিং-মন্ট্রিল গ্লোবাল বায়ো ডাইভারসিটি ফ্রেমওয়ার্ক ২০২২” ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি যাতে বিভিন্ন দেশ আশ্বস্ত করেছিল যে ২০৩০ সালের মধ্যে অন্ততপক্ষে ৩০ শতাংশ অবক্ষয়িত স্থলভাগ, অন্তর্দেশীয় জল, সামাজিক এবং উপকূলবর্তী বাস্তুতন্ত্রকে কার্যকরভাবে পুনরুদ্ধার করা হবে।

Source:Google

মিঠে জলের বাস্তুতন্ত্র

এই বাস্তুতন্ত্র এক-তৃতীয়াংশ মেরুদন্ডী প্রজাতি এবং পৃথিবীর ১০ শতাংশ প্রজাতির আবাসস্থল। এই বাস্তুতন্ত্র আমাদের খাদ্য, পানীয় জল, কৃষি-শিল্প -পরিবহনের ব্যবস্থা করে, জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করে। জল এবং জঙ্গল আন্তর্সম্পর্ক যুক্ত। ১৪০ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা এই বাস্তু তন্ত্রের সাথে যুক্ত। নগরায়নের নামে এই বাস্তুতন্ত্র আজ ভয়াবহভাবে আক্রান্ত। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বৃষ্টিপাত কোথাও কমছে, সেখানে জলের সংকট তীব্র হচ্ছে,মাটির তলার জল ৯২ শতাংশ কৃষি কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। শহরের বহুতল মাত্রাতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ জল তুলছে ফলে জলের সংকট তীব্র হচ্ছে। সেইসাথে লবণাক্ততা এবং আর্সেনিকের সমস্যা বাড়ছে। জলাভূমি ভূগর্ভস্থ জলকে পুষ্ট করে, জলাভূমি হলো বন্যা এবং এবং খরার মধ্যবর্তী এক সহায়ক অবস্থা (ইন্টারফেস) এই বাস্তুতন্ত্র কে পুনরুদ্ধার করতেই হবে।

পর্বতের বাস্তুতন্ত্র

সারা পৃথিবীর অর্দ্ধেক জৈব বৈচিত্রের ‘হটস্পট’। মিঠে জল,কাঠের সরবরাহকারী। পর্বতকে ‘ওয়াটার টাওয়ার’ বলা হয়, সারা পৃথিবীর মানুষের প্রয়োজনীয় জলের অর্ধেকের যোগানদার হলো পর্বত। উন্নয়নশীল দেশের পাহাড়বাসী অর্ধেক মানুষ অবক্ষয়িত পাহাড়ি জমিতে বসবাস করছেন। তীর্থ – পর্যটনে এবং তথাকথিত উন্নয়নের নামে আজ হিমালয়ের ভূপ্রকৃতি চরম ক্ষতিগ্রস্ত। এর সাথে জলবায়ু পরিবর্তনে বাড়ছে, মেঘ ভাঙা বৃষ্টি, হরপা বান হ্রদ বিস্ফোরণের আশঙ্কা। সিকিমের লোহনাক হ্রদ বিস্ফোরণ এবং তার প্রভাবে ধ্বংসলীলা, যোশীমঠের ভূমিধ্বস, সিলকিয়ারা সুরঙ্গ বিপর্যয় এই তথাকথিত উন্নয়ন মডেলকে প্রত্যাখ্যান করার পক্ষে জোরদার আওয়াজ তুলেছে।

সমুদ্র ও উপকূলের বাস্তুতন্ত্র

পৃথিবীর সব প্রাণকে ধারণ করে। ৯০ শতাংশ জীবন সহায়ক স্থানের ব্যবস্থা করে দেয়। বায়ুমন্ডলের ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ অক্সিজেনের যোগান দেয়। আবহাওয়া এবং জলবায়ুর নিয়ন্ত্রণ করে। খাদ্য ও ওষুধের ব্যবস্থা করে। ৭০ শতাংশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সমুদ্র পথে পরিচালিত হয়। সামুদ্রিক জলাভূমি, প্রবাল প্রাচীর, সমুদ্র এবং ম্যানগ্রোভ সমুদ্র উপকূল ভূমি রক্ষা করে, জলপ্লাবনের প্রবাহকে মন্থর করে,সাগরের ঢেউয়ের উচ্চতাকে কমায়। মাত্রাতিরিক্ত মাছ শিকার চলছে সমুদ্রে – অনুৎপাদক হয়ে পড়ার আশঙ্কা সমুদ্রের। ফলে বিশ্বের ৬ কোটি মৎস্যজীবীর জীবন-জীবিকা সংকটে। সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণ এক ভয়াবহ সমস্যা। মাইক্রোপ্লাস্টিক সামুদ্রিক মাছ হয়ে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। সাগরে অম্লতা বাড়ছে, তেল দূষণ ঘটছে, সমুদ্রে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমছে – ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সমতুল মাপের সমুদ্র ‘ডেড জোন’ এ পরিণত হয়েছে।

কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেড়ে যাওয়ার দরুন সাগরের তাপ এবং অম্লতা বাড়ছে। ফলতঃ উৎপাদনশীলতা কমছে যদি বাতাসে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ না কমানো যায় তাহলে অম্লতার কারণে এই শতাব্দীর মধ্যে সমস্ত প্রবাল প্রাচীর ‘ব্লিচ’ করে ধ্বংস হয়ে যাবে – যে প্রবাল প্রাচীর জলজ প্রজাতির২৫ শতাংশের আবাসস্থল।

নগরের বাস্তুতন্ত্রঃ

নগর গোটা পৃথিবীর ৮০ শতাংশ জিডিপি উৎপাদন করে। নগর হল ব্যবসা-বাণিজ্য এবং উদ্ভাবনের আধার। আবার অপরিকল্পিত নগর পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনা আর্থসামাজিক অসাম্যের জন্ম দেয় এবং পরিবেশের গুণমানের অবনতি ঘটায়। নগর তীব্র দূষণ এবং গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ ঘটায়। নগর ৭০ শতাংশ গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন করে এবং বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ শক্তি ব্যবহার করে (ইউএন)। বায়ুদূষণ মারাত্মক – নগরের ৮০শতাংশ মানুষ বায়ু দূষণের শিকার।

এর সাথে নগর হলো সিমেন্ট, স্টিল, কাঁচ, অ্যাসফল্ট নির্ভর কংক্রিটের নির্মাণ যা সূর্যের তাপ শোষণ এবং ধারণ করে রাখে। অপরিকল্পিত নগরায়ন প্রকৃতির আবরণকে ঘন সন্নিবিষ্ট ধূসর কংক্রিটের কাঠামো, ফুটপাত, অ্যাসফল্টের সড়ক দিয়ে যখন প্রতিস্থাপিত হয় – সূর্যের তাপ শোষিত হয় এবং সেই তাপ ধরে থাকে,ঘিঞ্জি বহুতলের জন্য বায়ুচলাচল রুদ্ধ হয় ফলে গ্রামের তাপমাত্রার সাথে শহরের তাপমাত্রার প্রায় ৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত পার্থক্য হয়ে যায় – একেই বলে ‘আরবান হিট আইল্যান্ড এফেক্ট ‘, একে খানিকটা প্রতিহত করতে পারে নীল- সবুজ পরিকাঠামো বা জলাভূমি এবং গাছগাছালির মিশ্রন, পার্ক, খোলা মাঠ, পুকুর ইত্যাদি।

এই গ্রীষ্মে কলকাতা যখন ৫০ বছরের রেকর্ড ভেঙে ৪৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় পৌঁছে গেল সেতো এই ‘আরবান হিট আইল্যান্ড এফেক্টে ‘ এর কারণেই।

হাড় হিম করা প্রতিবেদন শুনিয়েছে ‘ইন্টারগভর্ণমেন্টাল পানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ ( আইপিসিসি)’ র ওয়ার্কিং গ্রুপ – ১ এর প্রতিবেদন – কলকাতার তাপমাত্রা ২০৮১-২১০০ সালের মধ্যে ৪৯.৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে পৌছবে।

Source: Google

কেন এই পরিণতি?

‘ সেন্টার ফর সায়েন্স এ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ২০২২-২৩ এর সমীক্ষায় জানায় – কলকাতায় ৩৯শতাংশ জলাভূমি ভরাট হয়েছে, ১৯শতাংশ বনভূমি ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছে, সেখানে নির্মাণ ক্ষেত্রের আয়তন বেড়েছে ৯শতাংশ। এর ফলেই তাপমাত্রার বৃদ্ধি।

পরিবেশ ন্যায় – সাম্য

এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি তো সবাই সমান ভাগ করে নেয় না।

অর্থনৈতিক সুবিধার কারণে কেউ ঠান্ডা ভোগ করে আবার কেউ চরম তাপপ্রবাহে জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য হয় কিন্তু প্রকৃতি সবার ক্ষেত্রেই সমান। এখান থেকেই দাবি উঠছে পরিবেশ ন্যায়, তাপীয় আরাম (থার্মাল কম্ফর্ট), তাপীয় সাম্য (থার্মাল ইক্যুইটি) র। একই ভাবে খরা, বন্যা, সাইক্লোন, বাস্তুতন্ত্রের অবক্ষয়ের ভাগও সবাই সমানভাবে ভাগ ক’রে নেয়না।

চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে মোদ্দা কথাটা এই যে, পরিবেশ সমস্যা আদতে শ্রেণীর সমস্যা যা শ্রেণীবিভক্ত সমাজকেই অনাবৃত করে। পরিবেশ আন্দোলনের ময়দান থেকেই তাই আওয়াজ ওঠে – ন্যায় এবং সাম্যের।

সুপ্রীম কোর্টের মাইলফলক রায়

এই প্রেক্ষাপটেই বিগত ৬ ই এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট এক ‘ ‘মাইলফলক’ রায়দান করে – জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বিরুদ্ধে মানুষের আইন সঙ্গত অধিকার রয়েছে কারণ এই অধিকার এবং নির্মল পরিবেশ পাবার অধিকার একই মুদ্রার দুই পিঠ। যেভাবে জলবায়ু পরিবর্তন বছরে বছরে বৃদ্ধি পাচ্ছে এটা একটা সুনির্দিষ্ট অধিকার ব’লে স্পষ্ট করা দরকার। এই অধিকার ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪ (সাম্যের অধিকার) এবং অনুচ্ছেদ ২১ (জীবনের অধিকার) দ্বারা স্বীকৃত।

রাষ্ট্র কি করছে?

এই সংকটের সাথে মানিয়ে নেওয়া এবং তাকে প্রশমিত করার ক্ষেত্রে সরকারী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন তো আমরা দেখছি না! বিশ্ব উষ্ণায়নকারী গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমানো, জীবাশ্ম জ্বালানি কমিয়ে অচিরাচরিত শক্তির উৎস – সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, ছোট জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যবহার বাড়ানোর যে লক্ষ্যমাত্রার ঘোষণা আন্তর্জাতিক সম্মেলন মঞ্চগুলিতে দেশের সরকার করে এসেছে তার ধারে কাছেও তো পৌঁছনো গেল না! রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলো না যাতে সমাজ জীবনে, ব্যক্তিমানুষের স্তরে এক নতুন জীবন শৈলী গঠন করা যায়! উল্টোদিকে আমরা উদ্বেগের সাথে দেখলাম সরকার বিপজ্জনকভাবে পরিবেশ এবং বন আইন শিথিল করলো – এনভায়রনমেন্ট ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট ২০২০, অরণ্যের অধিকার আইন, ফরেস্ট (কনজারভেশন) এ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ২০২৩, বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি (এ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট ২০২০, এনভারমেন্ট (প্রোটেকশন) এ্যামেন্ডমেন্ট রুলস ২০২৪ – এই প্রবণতা ভয়ানক। উন্নয়নের নামে প্রাকৃতিক সম্পদের লুণ্ঠনকে কার্যত আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হলো।

কি করে রক্ষা পাবে সুন্দরবন? মুর্শিদাবাদের চালতিয়া বিল? বাঁকুড়ার দ্বারকেশ্বর, বর্ধমানের বাঁকা নদী, কৃষ্ণনগরের জলঙ্গি, সর্বোপরি গঙ্গা? পুরুলিয়ার তিলাবনি,পাহাড়িগোড়া? বিরাটির ৯৭ কাটা জোড়া পুকুর? কিভাবে ফিরে পাওয়া যাবে লেকটাউনের নয়ানজুলি?

এ লড়াই বাঁচার লড়াই – এ লড়াই জিততে হবে

জলবায়ু পরিবর্তন হোক আর বাস্তুতন্ত্রের অবক্ষয়ই হোক, আসলে এর চরম কুপ্রভাবের মধ্যে পড়তে হয় গরীব – প্রান্তিক মানুষকে এবং বিশেষত মহিলাদের। জল জমি জঙ্গলের অস্তিত্বের লড়াই, অধিকারের লড়াই, শ্রেণিচেতনা জারিত বৃহত্তর পরিবেশ আঙ্গিনার লড়াই। বিশ্ব মরুকরণ এবং খরা প্রতিরোধ দিবসটি এক বড় মঞ্চে মানুষকে পরিবেশ আন্দোলনের লড়াইয়ের ময়দানে শামিল করার সুযোগ এনে দিয়েছে – এ লড়াই বাঁচার লড়াই – এ লড়াই জিততে হবে।

Spread the word

Leave a Reply