১৯ জানুয়ারী ,২০২২ বুধবার
১৯৮২ সালের ভারত, ইন্দিরা গান্ধী দেশের প্রধানমন্ত্রী। সারা দেশে নতুন চেহারায় শ্রমিক শ্রেণীর উপরে আক্রমন শুরু হয়, এরই বিরুদ্ধে নতুন উদ্দীপনায় ভর করে সিআইটিইউ’র নেতৃত্বে অন্যান্য শ্রমিক সংগঠন একযোগে শ্রমিক আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা এবং ত্রিপুরা ছাড়াও সারা দেশের অন্যান্য রাজ্যেও শ্রমিক আন্দোলনের প্রভাব বাড়তে থাকে। বোনাস আইন সংশোধন, ছাঁটাই – ক্লোজার বন্ধ, বেকার ভাতা সহ শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার অধিকারের দাবীতে সংগ্রাম শুরু হয়। এই লড়াইতে স্থানীয় এবং আশু দাবীগুলিও যুক্ত ছিল, একইসাথে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি দাবী জানিয়েছিল কৃষিজাত পণ্যের লাভজনক দাম চাই, কৃষি মজুরদের ন্যূনতম মজুরি চাই। সিআইটিইউ’র নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ন্যাশনাল ক্যাম্পেন কমিটি। সেই ন্যাশনাল ক্যাম্পেন কমিটি সর্বভারতীয় প্রতিবাদ দিবস পালনের সাথেই সংসদ অভিযান এবং সারা দেশে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেয়। ধর্মঘটের দিন ধার্য হয় ১৯শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৮২।
ধর্মঘটের সমর্থনে ব্যাপক প্রচার হয় সারা দেশে। শাসক শ্রেণী ধর্মঘট সম্পর্কে ভীত হয়, পরিকল্পনা করে এই আন্দোলনকে ভেস্তে দিতে। তামিলনাড়ু এবং উত্তপ্রদেশে ধর্মঘটের দিন পুলিশের অত্যাচার হয় সবচেয়ে বেশি। দেশের শ্রমিকশ্রেণীর আহবানে সংগঠিত এই ধর্মঘটের প্রতি কৃষক – ক্ষেতমজুর সংগঠনগুলি অভূতপূর্ব সমর্থন জানিয়েছিল। এডিএমকে শাসিত তামিলনাড়ুতে সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীদের উপরে গুলি চলে, উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস সরকারও একইরকম নিপীড়নের সিদ্ধান্ত নেয়। ধর্মঘটের দিন উত্তরপ্রদেশে শ্রমিক-কৃষক –ক্ষেত মজুরদের জমায়েতকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কৃষকনেতা ভোলা পাশওয়ান, তাকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। কিন্তু এতে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হন নি, ভোলা পাশয়ানের ছোট ভাই লালচাঁদ তখন হাতে পতাকা নিয়ে মিছিল এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন, তাকেও পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। গুলি চালিয়ে হত্যা করার পাশাপাশি ঐদিন বহু অংশগ্রহনকারীদের উপরে পুলিশি নির্যাতন নামিয়ে আনা হয়।
এহেন বর্বর আক্রমনের পরেও পুলিশের নির্যাতন থেমে থাকে নি, মৃতদের শবদেহ পরিবারের হাতে না তুলে দিয়ে ঘটনাস্থল থেকে অনেক দূরে নিয়ে গিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এমন ঘটনায় সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। দিনের শেষে তামিলনাড়ুতে পুলিশের অত্যাচারে ১০ জন নিহত হন, উত্তরপ্রদেশে ২৫০ জন ছাত্র গ্রেপ্তার হয়।
নিহতদের পরিবারের সাথে দেখা করেন শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃবর্গ, তাদের পাশে থাকার অঙ্গীকার ঘোষণা করা হয়। প্রতি বছর তামিলনাড়ুর ট্রেড ইউনিয়ন নিজেদের সদস্যদের থেকে চাঁদা ব্যাতিত বাড়তি অর্থ সংগ্রহ করে, সেই বাড়তি অর্থ তুলে দেওয়া হয় ক্ষেতমজুর সংগঠনের তহবিলে। শ্রমিক – কৃষকদের যৌথ লড়াইয়ের ইতিহাসে এই কর্মসূচী এক অভাবনীয় কর্মসূচী। ভারতের বুকে গণআন্দোলনের ইতিহাসে এই দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমিক – কৃষক – ক্ষেতমজুরসহ দেশের নিপীড়িত জনগন ১৯শে ফেব্রুয়ারির ধর্মঘট সফল করেছিলেন, শহীদ হয়েছিলেন। এই সংগ্রাম স্বাধীন ভারতে শ্রমিক – কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে আন্দোলন পরিচালনার এক উজ্জ্বল নিদর্শন।
আজকের ভারতে যখন চরম আক্রমন নামিয়ে আনা হচ্ছে, কৃষকদের সর্বস্বান্ত করে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে আরেকদিকে শ্রমিকদের অর্জিত অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য সংসদে আইন পাশ করছে দেশের সরকার, সংবিধানস্বীকৃত জনগণের অধিকারগুলিকেই অস্বীকার করা হচ্ছে, জনগণের মধ্যে জাত-ধর্মের নাম করে বিভাজন করতে চাইছে বিজেপি-আরএসএস, সেই সময় অতীত লড়াইয়ের উজ্জ্বল ইতিহাসকে মনে রেখেই আগামী দিনের লড়াইতে এগিয়ে যেতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই দেশের কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি এই পরিস্থিতিতে আগামী ২৩-২৪ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে দুই দিন ব্যাপি ধর্মঘটের আহ্বান জানিয়েছে, দেশের কৃষকসংগঠন গুলির যৌথ মঞ্চ সংযুক্ত কিষান মোর্চার পক্ষ থেকে এই ধর্মঘটকে সমর্থন জানানো হয়েছে।
এই ধর্মঘটে দেশের শ্রমিক – কৃষক জনতা আবার একবার হাতে হাত রেখে লড়াই চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সারা দেশের মতো আমাদের রাজ্যেও প্রতিটি জেলায় ব্লক স্তরে কৃষক-ক্ষেতমুজররা ঐদিন পথে নামবেন। করোনা অতিমারির সময়ে কিভাবে নিজেদের সুরক্ষিত রেখে আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যেতে হয় সারা দেশে একবছরেরও বেশি সময় ধরে কৃষকদের আন্দোলন তার সাক্ষ্য রেখেছে। সেভাবেই লড়াই চলবে, শ্রমিক-কৃষকদের যৌথ সংগ্রামই পরাস্ত করবে জনবিরোধী রাজনীতিকে।