তৃতীয় পর্ব
আগুন নিয়ে খেলা
আগুন নিয়ে এই খেলার বিরুদ্ধে ১৯৮০ সালের শেষের দিকে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী আমেরিকার রাষ্ট্রপতি এইচ ডব্লু বুশকে ক্রমবর্দ্ধমান ইসলামী মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে সতর্ক করে বলেন – আপনারা ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরী করছেন।
সূত্রঃ “The Road to September 11 “. Evan Thomas. Newsweek. 1 October 2001.
নোবেল জয়ী প্রখ্যাত ব্রিটিশ জীব বিজ্ঞানী স্যার মার্টিন এওয়ান্স তার বইতে উল্লেখ করেছেন – আফগান আরব গেরিলা, যাদের মধ্যে প্রধান ছিল আল কায়দা, তারা পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা ISI এর মাধ্যমে CIA এর থেকে সব রকমের সাহায্য পেয়েছিল। প্রায় ৩৫হাজার আরবের সন্ত্রাসবাদীকে পাকিস্তানে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল ৮০০মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে, CIA এর দেওয়া অর্থ ও সমরাস্ত্রের সাহায্যে। ওসামা বিন লাদেনের দীর্ঘদিনের সহকর্মী মৌলবী জালালউদ্দিন হক্কানি এবং গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার সরাসরি CIA এর সাহায্য পেয়েছিল।
সূত্রঃ ১) Ewans, Martin (1 December 2004). Conflict in Afghanistan: Studies in Asymetric Warfare. Routledge. ২) Ewans, Sir Martin; Ewans, Martin (5 September 2013). Afghanistan – A New History. Routledge.
ব্রিটিশ বিদেশ সচিব রবিন কুক ( ১৯৯৭-২০০১) ২০০৫ সালের ৮ই জুলাই গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বলেন – ওসামা বিন লাদেন পশ্চিমী দুনিয়ার সুরক্ষা এজেন্সিগুলোর এক ভয়ঙ্কর এক ভুল সৃষ্টি। সমগ্র ৮০ দশক জুড়ে তাকে সশস্ত্র করার জন্য অর্থ সরবরাহ করেছে CIA এবং সৌদি আরব, রাশিয়ান সেনাদের আফগানিস্তান থেকে তাড়াবার জন্য।
সূত্রঃ “The struggle against terrorism cannot be won by military means”. The Guardian. 5th July, 2005. London: Guardian Unlimited. Retrieved 8 Jul 2005
সৌদি আরবের যুবরাজ প্রিন্স বান্দার বিন সুলতান বিবিসি’র এক সাক্ষাৎকারে বলেন – আমরা যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হাত মিলিয়ে মুজাহিদীনদের সাহায্য করছিলাম আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনা বাহিনীকে তাড়াবার জন্য। সেই সময়ে ওসামা বিন লাদেন আমার সাথে সাক্ষাত করতে এসে আমাকে ধন্যবাদ জানান নাস্তিক এবং কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করার জন্য এবং তাদের বন্ধু আমেরিকাকে আফগানিস্তানে নিয়ে আসার জন্য।
সূত্রঃ “Bin Laden comes home to roost”. BBC News.
এই রকম অসংখ্য উদাহরন দিয়ে দেখানো যায় কিভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কমিউনিস্টদের বিরোধীতা করতে গিয়ে নানা দেশে নাশকতামূলক কাজ শুধু নিজেরা চালিয়েছে তাই নয়, বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবাদীদের মদত দিয়েছে।
২০০১ সালে ৯ই সেপ্টেম্বর নিজেরা আক্রান্ত হওয়ার পর তারা বোঝে কেমনভাবে নিজেরা ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরী করেছে।
পুতুল সরকার
২০০১ সালের ২২শে ডিসেম্বর হামিদ কারজাইকে আফগানিস্তানের অর্ন্তবর্তীকালিন সরকারের প্রধান বানায় আমেরিকা এবং ব্রিটেন। এরপর ২০০৪ সালে লোক দেখানো একতরফা নির্বাচনে মাত্র ৮০ লক্ষ ভোট পড়ে। সেই সময়ে আফগানিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ২কোটি ১৬ লক্ষ ৬৯হাজার ৮৮জন। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ, এমনকি রাষ্ট্রসঙ্ঘের পক্ষ থেকেও স্বীকৃতি পায়। ২০০৯ সালে আবার তিনি নির্বাচিত হন এবং একইভাবে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে।
সূত্রঃ ১) Rod Norland (23 June 2011). Afghan Court Ruling Seeks to Alter Election Results Archived 23 July 2016 at the Wayback Machine, The New York Times. ২) “Fraud endangers Afghan democracy”. Financial Times. 2 September 2009। ৩) “BBC News – Fraud and corruption fears in Afghanistan elections”. BBC. 17 September 2010. Archived from the original on 7 February 2012.
২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হ’ন বিশ্বব্যাঙ্কের প্রাক্তন আমলা মহম্মদ আশরাফ ঘানি আহমদজাই। তাঁর নির্বাচন ঘিরেও একইরকম অস্বচ্ছতার অভিযোগ ওঠে। শেষ পর্যন্ত মার্কিন স্বরাষ্ট্র সচিব জন কেরীর মধ্যস্থতায় নির্বাচনের ফল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। এই নির্বাচনেও ৮০ লক্ষ ভোট পড়ে, যা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ ওঠে। ২০২১ সালের ১৫ই আগষ্ট তালিবানদের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান তিনি।
মার্কিনীদের তৈরী এই দুই সরকারকেই সে দেশের মানুষ নিজেদের সরকার বলে মনে করেনি।
আশ্চর্যজনক পরাজয়
তালিবানদের মাত্র মাত্র ৭৫-৮০হাজার সশস্ত্র যোদ্ধার সাথে লড়াইয়ে ৮৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ ক’রে গড়ে তোলা ৩লক্ষ অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত আফগান সরকারি বাহিনী ৩মাসের মধ্যে প্রায় বিনা প্রতিরোধে তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়লো কি ভাবে – এই প্রশ্ন এখন বিশ্বজুড়ে ঘুরছে।
পশ্চিমী সংবাদমাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে ব্যাপক দুর্নীতি, ২০ বছর ধরে মার্কিন এবং ন্যাটো সেনা নির্ভরতাই নাকি এই পরাজয়ের মূল কারণ। অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত ৩ লক্ষের বাহিনী মাত্র ৭৫-৮০ হাজার সশস্ত্র জঙ্গীর সামনে নি:শর্ত আত্মসমর্পন করার ঘটনা এত সরল হতে পারে না। প্রশ্ন উঠেই যাচ্ছে তাহলে কি মার্কিন ও ব্রিটেনের সরকার তালিবানদের হাতেই আফগানিস্তানকে তুলে দিতে চেয়েছে ঘুরপথে?
২৯শে ফেব্রুয়ারী, ২০২০ দোহায় তালিবানদের সাথে মার্কিন সরকারের যে চুক্তি হয় সেই অনুযায়ী ৩১শে আগষ্টের মধ্যে মার্কিন ও ন্যাটো সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০২০ সালের ১০ই মার্চ নরওয়ের অসলো শহরে আফগানিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও কোন সিদ্ধান্তে পৌছতে পারেনি কোন পক্ষই। এর মধ্যে তালিবান এবং আফগান সরকারী সেনাদের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ হতে থাকে। ২০২১-এর ৬ই মার্চ আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি আশরাফ ঘানি তালিবানদের সাথে নতুন করে আলোচনা চালাতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। ১৩ই এপ্রিল বাইডেন প্রশাসন ঘোষণা করে তারা অবশিষ্ট্ ২.৫ হাজার সেনা ১১ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রত্যাহার করবে। একই সাথে তারা আফগান সরকারকে প্রতিশ্রুতি দেয়, প্রয়োজন মতো মার্কিন প্রশাসন তাদের সাহায্য করবে। কিন্তু এর আগেই ১৫ই আগষ্ট প্রায় বিনা বাধায় কাবুলের রাষ্ট্রপতি ভবন, সংসদ ভবন সহ দেশের শাসন ক্ষমতা দখল করে তালিবান গোষ্ঠী। ফলে ঘটনা পরম্পরা দেখে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, এত সহজে কিভাবে তালিবানরা ঐ দেশ দখল করলো।
এখন কি হবে
এখনও পর্যন্ত একটি প্রদেশ (পঞ্জশির) বাদ দিয়ে প্রায় সমগ্র আফগানিস্তান তালিবানদের দখলে এসে গেছে। আফগানিস্তান একটি বহুজাতিক দেশ। ভাষা এবং জাতিগতভাবে এখানে নানা জনগোষ্ঠী মানুষের বাস। পাশতুন (পাঠান বা পাখতুন), তাজিক, হাজারা, উজবেক, আইমেক, তুর্কমেন, বালুচ, পাশাই, নূরিস্তানী, গুজ্জর, আরব, ব্রাহুই, ক্যুইজিবাশ, পামীরি, কির্গিজ, সাদাত ইত্যাদি নানা জনজাতির বাস আফগানিস্তানে। এর মধ্যে পাশতুন জনজাতি সর্ববৃহৎ এবং এরা মোট জনসংখ্যার ৪২%। তাজিক জনজাতি গোষ্ঠী ভুক্ত মানুষ মোট জনসংখ্যার ২৭%। এছাড়া উজবেকরা ৯% এবং হাজারা জনজাতি গোষ্ঠী ভুক্ত মানুষ ১০% আছে। বাকিরা সবাই মোট জনসংখ্যার ১0-১২%। তালিবানদের অধিকাংশই পাশতুন সম্প্রদায়ভুক্ত। জনসংখ্যার বাকি ৫৮% সাধারণভাবে তালিবানদের প্রতি সহানুভূতিশীল নয়। আবার পাশতুনদের সবাই যে তালিবানদের সমর্থক তাও নয়। বরং আফগান জনগোষ্ঠীর বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই এদের বিরোধী।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ মার্কিন ও ন্যাটোর মদতে চলা তালিবান সরকারের নৃশংসতা প্রত্যক্ষ করেছে সে দেশের মানুষ। এবার কাবুল দখলের পর তালিবানদের মুখপত্র এবং তাদের ঘোষিত বিদেশ মন্ত্রী জাবিউল্লাহ্ মুজাহিদ দাবী করেছেন এবারে তালিবান নাকি ৯৬-এর তালিবানের চাইতে আলাদা। ইতিমধ্যেই ভারত সরকারকে পাশে পাওয়ার জন্য তারা ঘোষণা করেছে – কাশ্মীর ভারতবর্ষের আভ্যন্তরীন বিষয় এবং তারা এবিষয় হস্তক্ষেপ করতে চায় না। একইভাবে ঘোষণা করেছে – শরিয়ত আইন মেনে নাকি মেয়েদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার এবং চাকরি করার অধিকার থাকবে। কারুর বাড়ী দখল করা হবে না, কারোর ওপর অত্যাচার করা হবে না। আফগানিস্তানের সব জানজাতিকে নিয়ে তারা নাকি সরকার গড়তে চায়। সেখানে কি হচ্ছে এসব ঘোষণা সত্ত্বেও সবাই দেখতে পাচ্ছে। এসবের কি হবে সে কথা সময়ই বলবে। তবে মৌলবাদী জঙ্গীদের আদৌ কোনও পরিবর্তন হয় এমন কোনও প্রমাণ ইতিহাসে দেখা যায়নি।
প্রশ্ন হলো আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী কারা? বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবাদ তৈরীর মূলে কারা? সেদিন সমাজতান্ত্রিক নাজিবুল্লাহ্ সরকারকে সরাবার জন্য মরীয়া মার্কিন-ন্যাটো জোট যদি মুজাহিদীন এবং আরব সন্ত্রাসীদের মদত দিয়ে অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ না করতো, তাহলে আজ আফগানিস্তানের চেহারা এইরকম হতো না, আলকায়দার আক্রমণে আমেরিকার ট্যুইন টাওয়ার্স ধ্বংস হতো না অথবা বিশ্বজোড়া সন্ত্রাসবাদের বিপদ এই চেহারা নিয়ে পৃথিবীতে আত্মপ্রকাশ করতে পারতো না।
তাই সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা না করে, মৌলবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায় না।
পাঠকবর্গের কাছে আবেদন – বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য বিবরণে কোনো ভুল চিহ্নিত করে দিলে, সেগুলি সংশোধন করে নেওয়া হবে।
One comment