প্রথম পর্ব
আফগানিস্থান দখল নিয়েছে তালিবানরা ২০বছর পরে। সেই দেশের ভয়াবহ দৃশ্য বিশ্বজুড়ে বহু মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। মৌলবাদী তালিবানদের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালাবার জন্য মরিয়া আফগানিস্থানের কর্মরত বিদেশীরাই শুধু নয়, সে দেশের বহু মানুষও।
কুড়ি বছর বাদে কিভাবে ক্ষমতা দখল করল এরা? ১৯৯৬ সালে কিভাবে প্রথমবার ক্ষমতা দখল করেছিল এরা? বিপুল অত্যাধুনিক অস্ত্র এবং অর্থ এরা এখনই বা পেল কোথা থেকে আর ১৯৯৬ সালের আগেই বা পেয়েছিল কোথা থেকে? কেন, কিভাবে সন্ত্রাসবাদের আঁতুড় ঘর হয়েছে এই দেশ? এই প্রশ্নগুলো উত্তর পেতে গেলে ইতিহাসের সময়সারণী বেয়ে একটু পিছনে ফিরে তাকাতে হবে।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
আফগানিস্থানের ভৌগলিক অবস্থানের কারণেই বারবার আফগানিস্তান বহিরাগতদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। আরব এবং এশিয়ার মধ্যে দ্বারপ্রান্ত এই দেশ। ব্যাবিলনিয়ার রাজা প্রথম দারিয়ুস ৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে এবং ম্যাসিডোনিয়ার সম্রাট আলেকজান্ডার ৩২৯ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে এই ভৌগলিক অঞ্চল দখল করেন।
১১০০শতাব্দীতে গজনীর মামুদ ইরান থেকে ভারতবর্ষ পর্যন্ত তার সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। চেঙ্গিস খান ১৩০০ শতাব্দীতে এই দেশ জয় করেন। তবে এই সময় জুড়ে অন্তত ১৭০০ শতাব্দী পর্যন্ত আফগানিস্তান কোনও ঐক্যবদ্ধ একটি দেশ ছিল না। বিভিন্ন স্থানীয় উপজাতি শাসকদের অধীনে বিভক্ত ছিল এই ভৌগলিক অঞ্চল। ১৮৭০ সাল পর্যন্ত আরব দেশগুলির বিভিন্ন রাজা নানা সময় এই ভৌগলিক অঞ্চলের নানা স্থান দখল করে রাখে এবং এই সময়েই এই অঞ্চলের মানুষ ইসলাম ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত হন বলে মনে করেন ঐতিহাসিকরা।
সংহত আফগানিস্তান
উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় ব্রিটিশরা তৎকালীন ভারতের শাসক হিসাবে আফগানিস্তান দখলের চেষ্টা চালায়। ১৮৩৮-৪২, ১৮৭৮-৮০ এবং ১৯১৯-২১ সাল পর্যন্ত দফায় দফায় ইন্দো-ব্রিটিশ বনাম আফগান যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধই সম্ভবত ব্রিটিশদের সবচাইতে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ ছিল এবং ১৯২১ সালে এই যুদ্ধে পরাস্ত হয় ব্রিটিশরা। আমির আমানুল্লা খান আফগানিস্তানকে সংহত করে তার রাজত্ব শুরু করেন। আমানুল্লা খানের এই বিজয় নি:সন্দেহে অবিভক্ত ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতার লড়াইকে অনুপ্রাণিত করে। পরবর্তীতে আমানুল্লা খানের বিরুদ্ধে জাহির শাহ যুদ্ধ করে ক্ষমতা দখল করে এবং আফগানিস্তানের রাজা হিসাবে প্রায় ৪০ বছর শাসন করেন।
১৯৪৭সালে ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যায় এবং ভারতবর্ষ ও পাকিস্তান দুটি পৃথক স্বাধীন দেশ আত্মপ্রকাশ করে।
১৯৫৩ সালে রাজা জাহির খানের তুতো ভাই মহম্মদ দাউদ খান সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী হন এবং সেই দেশকে আধুনিক ভাবনায় গড়ে তোলার প্রয়াস গ্রহণ করেন। তিনি প্রতিবেশী সমাজতান্ত্রিক দেশ তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তাঁর সংস্কার প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সেই দেশের মহিলারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনার সুযোগ পান এবং চাকরি করার অধিকারও পান।
সমাজতান্ত্রিক ভাবনা
১৯৬৫ সালের ১লা জানুযারি আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি গোপনে গঠিত হয়। মাত্র ২৭জন সদস্য, কাবুলে নূর মহম্মদ তারাকি’র বাসস্থানে মিলিত হয়ে গঠন করে The People’s Democritic Party of Afginistan (PDPA) । তারাকি এই পার্টির সাধারণ সম্পাদক এবং বাবরাক কামাল উপ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে একমাত্র হাফিজুল্লাহ আমিন এই দলের হ’য়ে সংসদে নির্বাচিত হন।
১৯৭৩ সালে মহম্মদ দাউদ খান এক সামরিক অভ্যূত্থানের মাধ্যমে মহম্মদ জাহির শাহ’কে অপসারিত করেন এবং রাজতন্ত্রের অবসান ঘোষণা করেন। দেশের নতুন নাম হয় সাধারণতান্ত্রিক আফগানিস্তান এবং তিনি নিজে দেশের রাষ্ট্রপতি হন।
১৯৭৫-৭৭ সালের মধ্যে তিনি নতুন সংবিধান তৈরী করে মহিলাদের নানান অধিকার দান করেন এবং আধুনিক সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের লক্ষ্য ঘোষণা করেন। বিরোধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনি একাংশের দ্বারা অবশ্য নিন্দিত ও সমালোচিত ছিলেন।
১৯৭৮ সালে নূর মহম্মদ তারাকি’র নেতৃত্বে সে দেশের কমিউনিস্টদের মধ্যে খালক্ গোষ্ঠী ক্ষমতা দখল করে। তারাকি দেশের রাষ্ট্রপতি এবং পরচম গোষ্ঠীর (PDPA পার্টির আর একটি গোষ্ঠী) নেতা বাবরাক কামাল উপ-প্রধানমন্ত্রী হন। এই নতুন সরকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত হবার কথা ঘোষণা করে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বন্ধুত্বের চুক্তি স্বাক্ষর করে।
এই সময় রক্ষণশীল এবং মৌলবাদী কিছু ইসলামিক নেতা নতুন সরকারের সমাজ সংস্কারের বিরুদ্ধে গেরিলা সংগঠন তৈরী করে ‘মুজাহিদীন’ নাম দিয়ে এবং সশস্ত্র লড়াই শুরু করে সরকারের বিরুদ্ধে।
মুজাহিদীনদের আত্মপ্রকাশ
১৯৭৯ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি তারাকি এই মুজাহিদীনদের হাতে খুন হন। দেশে এক টালমাটাল পরিবেশ তৈরী হয়। উপ-প্রধানমন্ত্রী বাবরাক কামাল এর পর দেশের প্রধানমন্ত্রী হন। ২৪শে ডিসেম্বর সোভিয়েত সেনাবাহিনী আফগানিস্তানে প্রবেশ করে এবং ২৭শে ডিসেম্বর মুজাহিদীনদের নেতা আমিন সহ তার অনুগামীদের অনেকেরই মৃত্যু হয় সোভিয়েত সেনাবাহিনীর সাথে লড়াইয়ে। উপ-প্রধানমন্ত্রী বাবরাক কামাল দেশের প্রধানমন্ত্রী হন।
৮০-র দশকের গোড়ায় এই মুজাহিদীনরা ক্রমশ সংগঠিত হতে থাকে এবং সৌদি আরব, পাকিস্তান, ব্রিটেন এবং আমেরিকার কাছ থেকে ব্যাপক পরিমাণে অর্থ ও অস্ত্রের যোগান পেতে থাকে। ১৯৮২ সালের মধ্যে আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলগুলি ক্রমশ এদের দখলে চলে আসে। এই সময় সৌদি আরবের সাহায্যপ্রাপ্ত মৌলবাদী জঙ্গী ওসাবা বিন লাদেন এদের সমর্থনে সেখানে যান।
১৯৮৬ সালের ৪ঠা মে PDPA-এর সাধারণ সম্পাদক ড: মহম্মদ নাজিবুল্লা আহমদজাই, বাবরাক কামাল’কে সরিয়ে সেই দেশের রাষ্ট্রপতি হন।
আরব মৌলবাদ – বিন লাদেন
১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওসামা বিন লাদেন এবং ১৫টি বিভিন্ন ইসলামিক মৌলবাদী সংগঠনগুলি মিলে নতুন একটি সংগঠন তৈরী করে, যার নাম ‘আল-কায়দা’। এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাবরাক কামালের সরকারকে উৎখাত করা এবং সোভিয়েত সৈন্যবাহিনীকে অপসারণ করে ইসলামিক আফগানিস্তান রাষ্ট্র গঠন করা।
১৯৮৯ সালে জেনেভাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের মধ্যে এক শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে আফগানিস্তানের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয় এবং ১০ হাজার সোভিয়েত সেনা সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তবে মুজাহিদীন গেরিলা বাহিনী ও আল কায়দা এই চুক্তি না মেনে বিদেশে তাঁদের নিজস্ব সরকার গঠন করে এবং আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে।
লেখাটি সম্পূর্ণ ৩ টি পর্বে প্রকাশিত
চলবে…………………
দ্বিতীয় পর্বটি পড়তে এই লিংকে ক্লিক করুন