দেবাঞ্জন চক্রবর্তী
এই আলোচনার শুরুতে প্রথমেই ‘অসংগঠিত ক্ষেত্র’ এবং ‘অসংগঠিত শ্রমিক’ বলতে কী বোঝায় তা আমাদের জেনে নেওয়া প্রয়োজন।
দ্য আনঅর্গানাইজড ওয়ার্কার্স সোশ্যাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০০৮ ধারা 2(L) অনুযায়ী ‘অসংগঠিত ক্ষেত্র’ বলতে বোঝাবে একটি সংস্থা যা কোন ব্যক্তি/ব্যক্তিবর্গ বা স্বনিযুক্ত শ্রমিক/শ্রমিকরা তার মালিক এবং এই সংস্থাটির কোন দ্রব্য উৎপাদন বা কোন সামগ্রী বিক্রি বা যেকোনো ধরনের পরিষেবা প্রদান করে এবং এই কাজের জন্য শ্রমিক নিয়োগ করে কিন্তু তার সংখ্যা ১০ জনের কম।
এই আইনের ধারা 2(M) অনুযায়ী ‘অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক’ বলতে বোঝাবে – একজন গৃহভিত্তিক শ্রমিক, স্বনিযুক্ত শ্রমিক বা বেতনভুক শ্রমিক – যে বা যারা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করে এবং সংগঠিত ক্ষেত্রের সেই শ্রমিককে বোঝাবে যে বা যারা নিম্নলিখিত আইনের সুবিধাদি পায়না-
১. শ্রমিক ক্ষতিপূরণ আইন,১৯২৩
২. শিল্প বিরোধ আইন,১৯৪৭
৩. এ এস আই আইন,১৯৪৮
৪. পি এফ আইন,১৯৫২
৫.মাতৃত্বকালীন সুবিধাদি আইন,১৯৬১
৬. গ্রাচুইটি প্রদান আইন, ১৯৭২
এই প্রসঙ্গে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা সকলের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। কানপুরে অনুষ্ঠিত ১৩ থেকে ১৭ এপ্রিল,১৯৮৩, সিআইটিইউ পঞ্চম সারা ভারত সম্মেলনে সর্বপ্রথম অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তারপর থেকে পথচলা শুরু। আজ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের অর্ধেকের বেশি সদস্য হল অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবীরা।
কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কমিশন গঠন করে অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা সংক্রান্ত অনেক ভালো ভালো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।কিন্তু আজও তার বাস্তবায়ন হয়নি। যেমন
১. ১৯৬৯ সালে গঠিত প্রথম জাতীয় কমিশন
২.১৯৮৮ সালে গঠিত স্বনির্ভর মহিলা এবং মহিলা শ্রমিকদের জন্য জাতীয় কমিশন
৩.১৯৯১ সালে গঠিত গ্রামীণ শ্রমজীবীদের জন্য জাতীয় কমিশন
৪.২০০২ সালে গঠিত দ্বিতীয় জাতীয় শ্রম কমিশন
৫.২০০৭ সালে গঠিত অসংগঠিত ক্ষেত্রের সংস্থাসমূহের বিষয়ে জাতীয় কমিশন
বর্তমানে সর্বশেষ ২০১১ সেন্সাস রিপোর্ট অনুযায়ী দেশে মোট ৩৮.৬০ কোটি শ্রমিক অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত এবং ৩.৭১ কোটি সংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিক-কর্মচারী যুক্ত আছে। সংগঠিত ক্ষেত্রে অসংগঠিত শ্রমিক সংখ্যা ২০১১ সালে ছিল ১৬ লক্ষ। এখন তা অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ৩৮.৬০ কোটি শ্রমিকদের মধ্যে নির্মাণ এবং বিড়ি শ্রমিকদের আলাদা সামাজিক সুরক্ষা স্কিম ছিল। তাও হয়েছে বহু আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে।
কিন্তু কেন্দ্রে আরএসএস পরিচালিত বিজেপি সরকার ২৯টি শ্রম আইনকে চারটি শ্রম কোডে সংযুক্তকরণের মাধ্যমে নির্মাণ,বিড়ি,সিনে ওয়েলফেয়ার ফান্ড আইন-১৯৮১, ইন্টারস্টেট মাইগ্রান্ট ওয়ার্কার্স আইন-১৯৭৯,দ্য ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট এ্যান্ড নিউজপেপার এম্প্লয়িজ আইন ১৯৫৫,এইসব ক্ষেত্রে শ্রমিক-কর্মচারীদের যেসব সামাজিক সুরক্ষা ছিল তাও বাতিল করে দিয়েছে। এরই সাথে উল্লেখ করতেই হয় দ্য স্ট্রীট ভেন্ডার্স আইন ২০১৪ এবং প্রাইভেট সিকিউরিটি এজেন্সিস আইন ২০০৫ কেন্দ্রীয় সরকার বাস্তবায়িত করছে না। ফলে লক্ষ লক্ষ পথ হকার এবং নিরাপত্তা কর্মীরা বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে চলেছে।
পরিশেষে বলি, দি আনঅর্গানাইজড ওয়ার্কার্স সোশ্যাল সিকিউরিটি আইন,২০০৮ এর আওতায় কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক কেন্দ্রীয় বাজেটে অর্থ বরাদ্দ এপর্যন্ত না করায় এই আইনে প্রদেয় সুবিধাগুলি একটাও বাস্তবায়িত হলো না। এই পরিস্থিতিতে কোটি কোটি অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের কাছে ধর্মঘট করে সামাজিক সুরক্ষার দাবি আদায় করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
এই ধর্মঘটের দাবি সমূহ হলো:
১.শ্রম কোড এবং এসেনশিয়াল ডিফেন্স সার্ভিসেস আইন বাতিল করতে হবে
২.সরকারি সংস্থা, ব্যাংক-বীমাসহ সব রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ বন্ধ করতে হবে
৩.আইসিডিএস সহ বিভিন্ন প্রকল্প কর্মীদের ন্যূনতম মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প চালু করতে হবে
৪.ঠিকা ও সমস্ত প্রকল্প কর্মীদের স্থায়ীকরণ সাপেক্ষে স্থায়ী শ্রমিকদের মতনবেতন দিতে হবে
৫.আয়করের বাইরে থাকা সকল নাগরিকদের মাসে নগদ ৭,৫০০ টাকা দিতে হবে এবং বিনামূল্যে রেশন দিতে হবে
৬.সকলের জন্য সামাজিক সুরক্ষা দিতে হবে
৭. পেট্রল বিদেশের দাম কমাতে কেন্দ্রীয় অন্তঃশুল্ক কমাতে হবে
৮.নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমাতে হবে
৯.জাতীয় পেনশন প্রকল্প বাতিল করতে হবে। পুরাতন পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। ন্যূনতম পেনশন যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি করতে হবে।
১০.কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় বাজেটে আরও ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।
১১.অতিমারি সময়ে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে যারা কাজ করেছেন তাদের জন্য সুরক্ষা এবং পেনশন চালু করতে হবে।
১২.মনরেগা প্রকল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে এবং তার শহরেও লাগু কর।
আসুন, আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের সামাজিক সুরক্ষার দাবিতে ধর্মঘট সফল করি।